বাংলা সাহিত্যে কবি আলাওল আজও স্মরণীয়
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী
সৈয়দ আলাওল (১৬০৭-১৬৭৩)
তখনকার দিনে স্টীম চালিত জাহাজ আবিষ্কার না হলেও মাল্লামাঝির টানা জাহাজ জলযান সমুদ্র পাড়ি দিতো। তেমনই এক জাহাজে চট্টগ্রামের বন্দর থেকে উঠে বাবার সঙ্গে অল্পবয়েসী আলাওল যাচ্ছিল আরাকান রাজ্যের রোসাঙে। তাঁর বাবা ছিলেন বাঙলার স্বাধীন ভূস্বামী মজলিস কুতুবের একজন বিশ্বস্ত দূত । আরাকান রাজের জন্য কিছু গোপন খবর পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে যাত্রা করার সময়ে নিজের কিশোর ছেলেকে সঙ্গে নিয়েছিলেন এই ভেবে যে বিদ্যাবুদ্ধিতে তুখোড় এই ছেলেটার সমুদ্র যাত্রার অভিজ্ঞতা হলে ওর ভালো লাগবে।
কিন্তু, ছেলে আলাওল কিছুক্ষণ সমুদ্রে জলের ঢেউ, ঢেউয়ের সঙ্গে সামুদ্রিক মাছেদের নাচানাচি, আকাশের পাখিদের ওড়াওড়ি এসব দেখতে দেখতে এক সময় চারদিকে শুধু জল আর জল দেখে দেখে তার মনে হলো কখন আরাকানের স্থল দেখা যাবে। জানা গেল , পরের দিন সকালে বন্দরে পৌঁছতে পারা যাবে। চারদিকে শুধু জল আর জল দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগলো।
তবুও সন্ধের পর জাহাজের ভেতর থেকে ডেকের উপর গিয়ে মুক্ত বাতাস পেয়ে কিশোর আলাওলের ভালো লাগলো। তবে আলাদা করে জল আর আকাশ বোঝা যাচ্ছে না, পাড়ের তো কোন কথাই নেই। বাবা অবশ্য বলেছিল রাতে তেমন কিছু দেখা যাবে না। আলাওল ডেক থেকে জাহাজের ভেতর ঢুকতে যাবে এমন সময় দূরে কয়েকটি আলোর বিন্দু দেখে বন্দর আসছে ভেবে উৎসাহিত হতেই মনে হলো, নাঃ সেতো পরের দিন পৌঁছনোর কথা। সে তখন উপর থেকেই বাবাকে ডেকে জানালো।
তার বাবা এবং মাঝিদের কয়েকজন উপরে উঠে দেখল ওগুলো কয়েকটা নৌকা দ্রুত বেগে ওদের জাহাজের দিকেই আসছে। ” সর্বনাশ! এতো পর্তুগিজ বোম্বেটেদের দল! আমাদের ধন প্রাণ সব কেড়ে নিয়ে আমাদের কেটে টুকরো টুকরো করে জলে ফেলে দেবে। ” বলেই বাবা ছেলে আলাওলকে – তুই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে সোজা উত্তর দিকের তারাটার দিকে তাকিয়ে সাঁতার দিতে থাক। যতক্ষণ পারিস। উপর ওয়ালা বাঁচালে বেঁচে যেতেও পারিস। শুধু উত্তরের তারাটাকে লক্ষ্য করে সাঁতার দে”‘
বলেই বাবা নিজের কিশোর ছেলেকে জলে ঠেলে ফেলে দিলেন আর এদিকে ডাকাতরা ওদের জাহাজে উঠে সব লুট করল ও সব্বাইকে নির্মম ভাবে মেরে ফেলল। আলাওলের বাবাও মারা পড়েছিলেন।
আলাওল ভোর হবার আগেই সমুদ্রের শেষে স্থলভাগের মাটিতে পা রাখতে পারল। কিন্তু আলাওল দাস হিসেবে বিক্রিত হয়ে যায়। ক্রমে আরাকান রাজমাতা মাগন ঠাকুরের স্নেহ ভাজন হয়ে যান । রাজা সুধর্মা তাঁকে গ্রহণ করে তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীতে নিয়োজিত করলেন। কিছু দিন পর রাজরোষে তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তাঁর কবি প্রতিভায় রাজা তাঁকে মুক্তি দেন এবং সভাসদ রূপে মনোনীত করেন। ‘তালিম আমিল’ বলে সমাদৃত হন। রাজমাতা মাগনঠাকুরের নির্দেশে দৌলত কাজীর অসমাপ্ত রচনা কাব্য লোর চন্দ্রাণী সমাপ্ত করেন।
বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের এক ক্ষমতাশালী লেখক ছিলেন আলাওল। আলাওলের প্রসঙ্গে যাবার আগে বাংলা সাহিত্যের কিছু কথা বলে নেয়া ভালো বলে মনে হয়।
কৃষি প্রধান গ্রাম বাংলার আঞ্চলিক ভূস্বামীদের অনেকেই সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন, সাহিত্যের অনুপ্রেরণা দিতেন গৌড় দরবার ও আরাকান রাজসভার রাজা আর উচ্চ রাজ কর্মচারী বৃন্দ। অবশ্য, কেন্দ্রীয় মোগল শাসন প্রত্যক্ষভাবে দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য তেমন কোন মাথাব্যথা প্রকাশ করেনি তেমনই আভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপও করত না। কর সময়মতো পেলেই চলতে পছন্দ করতো।
বঙ্গের সুলতান হুসেন শাহের পৌত্র সুলতান ফিরোজ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় কবি শ্রীধর বিদ্যাসুন্দরের প্রণয় কাহিনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছেন। এই প্রণয় আখ্যান কোন ধর্মীয় আখ্যান ছিল না। হ্যা, পরবর্তী কালে কবি ভারতচন্দ্র ও কবি রামপ্রসাদ সূক্ষ্ম ধর্মীয় আবরণ দিয়ে এই আখ্যানের নাম কালিকা মঙ্গল দিয়েছিলেন। জানা যায় , কাশ্মীরী কবি বিহ্লণ তাঁর চৌর পঞ্চাশিকা বিদ্যা ও সুন্দরের গোপন প্রেম কথা লিখেছিলেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সারিবিদ খাঁর এই রচনার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। আরও জানা যায়, কঙ্ক নামের এক কবি এই প্রেম কাহিনীর কাব্যরূপ দিয়েছিলেন। সেসময় কোন ধর্মের আবরণ ছাড়া কোন প্রেম কাহিনীর সমাদর হতো না আর সেজন্য তখনকার কোন প্রতিভাবান কবি লৌকিক প্রেম কাহিনী রচনা করতে উৎসাহবোধ করতেন না।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ধর্মের আবরণ ছাড়া মৌলিক বা অনুবাদ বা ভাবানুবাদ কাব্য ধারার কবিতার বিকাশ ও অনুপ্রেরণার হদিস মেলে আরাকান রাজসভায়। এর নাম ছিল রোসাঙ্। এই অঞ্চলে বাস করত মগ দস্যুরা। প্রথম দিকে রাজা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আর প্রজাদের অধিকাংশ ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ১৬২২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শ্রীসুধর্মা (থিরি থু ধম্মা রাজত্ব কাল ১৬২১ – ১৬৩৮ খ্রী) তখনকার সাহিত্য রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর লস্কর উজীর ছিলেন আশরফ খাঁ। তাঁর ই উৎসাহে ১৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দে পাশের চট্টগ্রামের কবি দৌলত কাজী রচনা করেন একটি প্রেম কাব্য ‘ লোর চন্দ্রাণী ‘। উজীর সাহেব ছিলেন ধর্ম বিশ্বাসে সুফী।
আর এই ‘লোর চন্দ্রাণী’ কাব্যটিকে অনেকে বলতেন ‘ সতী ময়না ‘। গোহারী দেশের রাজা লোর – পত্নীর নাম ছিল ময়না। একসময় রাজা লোর নিজ পত্নীকে ত্যাগ করে মোহরা দেশের রাজার কন্যা সুন্দরী চন্দ্রাণীর প্রতি প্রণয়াসক্ত হন। অথচ চন্দ্রাণী ছিল অপরের বিবাহিতা পত্নী। তার স্বামী ছিল বামন আর নপুংসক। লোর ঐ বামনকে হত্যা করে চন্দ্রাণীকে বিয়ে করে সমগ্র মোহরা রাজ্যের অধীশ্বর হয়। এদিকে পরিত্যক্তা ময়না বিরহে প্রায় পাগল হয়ে যাবার অবস্থায় পড়ে। অনেক ছলচাতুরি প্রলোভনেও ময়না সতীত্ব রক্ষায় সফল হয়। এবার সে রাজা লোরের দ্বিতীয় পক্ষের পত্নী সুন্দরী যুবতীকে করায়ত্ত করার জন্য ছাতন নামের একজন লম্পট রাজকুমার ও রত্তনা নামের এক কুট্টনীকে পাঠায়। সে একটি ‘ বারোমাস্যা ‘ গান গেয়ে যৌবন সুখের বর্ণনা দিতে থাকে।
লেখক দৌলত কাজী এই পর্যন্ত লিখে আর লিখতে পারেন নি, কেননা তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই অসম্পূর্ণ কাব্যটিকে প্রায় ত্রিশ বৎসর পর কবি আলাওল পূর্ণতা দান করেন। – সতী ময়না অনেক দুঃখের পর এক ব্রাহ্মণকে দূতরূপে পাঠিয়ে লোরের সন্ধান পেল। তারপর তার কাছে ফিরে গিয়ে তার সঙ্গে মিলিত হতে পারল। দেরীতে হলেও, অনেক কষ্ট ভোগ করতে হলেও শেষ পর্যন্ত সতী ময়না লোরের সঙ্গে মিলিত হতে সফল হলো।
এই আলাওল অল্প বয়েসে বিভিন্ন ভাষায়, বিশেষ করে বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত, আরবী, ফার্সি, হিন্দী ভাষা গুলি শিখে নেন। রাজমাতা মগনঠাকুর ও রাজার অনুপ্রেরণায় তিনি পদ্মাবতী কাব্য রচনা করেন। অবশ্য, এই কাব্য সুফী মালেক মহম্মদ জায়সীর লেখা হিন্দী ‘পদুমাবৎ’ কাব্যের বাংলা অনুবাদ। রাজস্থানের চিতোরের রাণী পদ্মাবতীর জীবন কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছিল।
আলাওল আরাকান রাজসভার কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি রাজা সুধর্মার প্রধান আমাত্য সুলেমানের কাছ থেকেও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। কবি আলাওল এক পারস্য উপন্যাস ‘সয়ফুল-মুল্ ক-বদিউজ্জমাল’ অবলম্বনে প্রেম কাহিনী রচনা করেন ও সেনাপতি সৈয়দ মহম্মদের অনুরোধ মতো নাম দেন ‘ হপ্তপয়কর ‘ । এতে সাতটি প্রেমের গল্প ছিল। আবার স্বয়ং রাজার আদেশে লেখেন ‘সেকেন্দরনামা’। আলাওলের ‘তোহ্ফা’ ও ‘নবীবংশ’ ছাড়া অধিকাংশ রচনাই জীবন ও প্রেম নির্ভর কাব্য। ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের প্রেম সম্পর্কে কবি আলাওল লিখেছিলেন –
“প্রেম বিনে ভাব নাহি ভাব বিনে রস।
ত্রিভুবনে যত দেখ প্রেম হন্তে বশ।।…”
লৌকিক জীবন এবং মানবিক প্রেম অবলম্বনে ধর্ম নিরপেক্ষ সাহিত্য বঙ্গে বেশ সমাদৃত হয়। আরাকানী সাহিত্যের প্রভাবে অনেক মুসলমান কবি রচনা করেন ‘গোলেবকাওলি’, ‘লায়লা-মজনু’, ‘শিরি-ফরহাদ’, ‘ইউসুফ-জুলেখা’ প্রভৃতি প্রেম কাহিনী।
আরব দেশের খলিফা দের নিয়েও অনেক রচনা, বিশেষ করে ‘কারবালা’ কাহিনীর করুণ বিষয় নিয়ে অনেক করুণ রসাত্মক কাব্য রচিত হয়।
গঙ্গারাম বর্গী আক্রমণ নিয়ে রচনা করেন ‘ মহারাষ্ট্র পুরাণ ‘ ।
মৈমনসিংহ অঞ্চলের লোকগীতিকা গুলোও লৌকিক জীবন ও মানবিক প্রেমে ভরপুর।
এছাড়া যেসব গাথাসাহিত্য মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, লীলা, মদিনা এসবের মধ্যে ধর্ম বা কোন সম্প্রদায়ের প্রভাব নেই। লোকজীবন স্বাভাবিক ভাবেই শুধু জীবন কথার সাহিত্য। সমগ্র বাংলা সাহিত্যই ধর্মনিরপেক্ষ । এটাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস।
এই ইতিহাসে কবি আলাওল আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
ভাল লাগল লেখাটি পড়ে।