দীর্ঘ কবিতাঃ মানুষ মানুষকে কীভাবে পায় – অনিরুদ্ধ সুব্রত

মানুষ মানুষকে কীভাবে পায়— প্রশ্নটি
এখন এই সন্ধেবেলা থেকে সোজা গিয়ে
সিকি শতাব্দী ঘুরতে গেল, যে পরিভ্রমণ
কৃত্রিম উপগ্রহের মতো— শূন্যে ঘুরপাক

মানুষ মানুষকে পেয়েছে বা তার আগে
বলা ভালো, পেতে সে কেন চেয়েছে, বা
পাওয়া যায়— ধীশক্তি এ ধারণা দিয়েছে
কেন, কী থেকে এই-ই বিশ্বাস হলো দৃঢ়

অথবা প্রশ্নটি পিছনে যেতে যেতে শেষ
অবধি যখন ভূমিষ্ঠে পৌঁছল, তখনও কি
তার ‘পাওয়ারই’ চিৎকার ছিল— অর্থাৎ
পাবে বলেই পার্থিব জীবন পেয়েছিল চেয়ে

কেননা, দু’জন দুজনকে তো বলেছিল, এসো
আমরা আমাদের ভীষণ করে পাই এবং
তাদের সে কথা যে শুনতে পেয়েছিল, সে-ই
ওই অর্ধ শতাব্দীর পেছন দেয়ালে দাঁড়িয়ে

জনককে পেল, জননীকে পেল, জীবনকেও
স্তন্য পেল, লালনের ছোঁয়া আর ছায়া পেল
কোল, পিঠ, বুক, ঠোঁট অথবা হাসি, কান্না মুখ
‘পেয়েছি’ ‘পেয়েছি’ চিৎকার করে পেল সুখ

কিন্তু মানুষ মানুষকে কীভাবে পায়— পাওয়া
কি জ্ঞানযোগ নাকি পাওয়া অমৃতযোগ বা
‘পেতে চাওয়া’ এক অনন্ত যোগ, যার ভিতরে
পেলে সুখ হয়— এ আকাঙ্ক্ষা বুঁদ করে দিল

কারও আঁচল পেতে শুয়ে যে পাওয়া, অশ্রু
ফোঁটা টপ টপ পেয়েছিল, মুঠোয় আঙুল দিয়ে
যে পেতে চাওয়া হাঁটতে শুরু করেছিল দীর্ঘ ও
দীর্ঘতর পথ ও আত্ম-ছায়া, সে কোথায় গেল

সিকি শতাব্দী থেকে আরও একটি সমকোণী,
ভিন্ন আর একটি কোণে, বেঁকে যাওয়া ডেকে
নিল, প্রস্তাবণা ছিল— শুধু প্রকৃষ্টতম পাওয়া
যা আদতে ওই জন্মান্তরের সমান্তরাল, চলা

তারপর সেই উপগ্রহ-সূত্র, যে একটি চাঁদের
মতো, অথবা চাঁদের প্রেক্ষিতে একটি পৃথিবীর
মতো, পরস্পরকে পায় তাদের বিস্তৃত জোছনা
অথবা অমাবস্যায় খোঁজে, কাঁদে, অন্ধকারে

মানুষ মানুষকে কীভাবে পায়— যদিও গল্পে,
উপকথা জাতীয় সমস্ত উপকরণে, মহাকাব্যের
ঘন বুননে পেতে চেয়ে লক্ষ্যভেদ, লক্ষভ্রষ্ট, যুদ্ধ
নতুবা বৈষ্ণবের বুকের ভেতর পদ, পদাবলী গান

না-পাওয়ার চরম ব্যর্থ, হিংসা, মৃত্যু বিভীষিকা
পাওয়া ধরে ধরে বেছে বেছে ক্ষত, বিক্ষত, বিঘ্ন
খুন ও হত্যা, বা ঔদাসীন্য ফের পাওয়াকে পূর্ব
করে, উত্তরে ভুলতে চাওয়ার— শান্তি পাওয়া

মানুষ মানুষকে পেয়েছে কবে, কবে তাকে পেয়ে
সিন্দুকে পুরে, সাম্রাজ্য জয়ের ধ্বজায় দিয়েছে
রং এর রাংতা পরিয়ে, যে পাওয়া থেকে প্রাপ্ত
উঠে এসে বলে গেছে, পেতে পেরেছেন মহারাজ

সারা দেশ পেতে চেয়ে দৌড়ে গেল, সারা পৃথিবী
একে অপরের দিকে এগিয়ে, পুনঃ পিছিয়ে আর
ততবার নতুন করে পাওয়ার জন্য চাওয়া লিখে
হন্যে হয়ে ঘুরে, লাইনে দাঁড়িয়ে, ছন্নছাড়া হয়ে

প্রশ্নটা সিকি থেকে ফিরে অর্ধেক পর্যন্ত, ক্লান্ত
অথচ প্রশ্নের আকার হয়ে উঠতে ব্যর্থ, অবান্তর
কেউ কাউকে পায়নি, পায় না,পাবে না— এভাবে
একটা অপ্রত্যয়ের উত্তর লিখে শেষ হলো

কিন্তু দখলের প্রথা দেখতে দেখতে, যে ভ্রান্তদর্শন
প্রতিনিয়ত গাছের মালিকানা দেয় বা নেয়
অথবা নদী, ধানক্ষেত ও গৃহপালিতরা প্রভু পায়
আর পৃথিবী কতগুলো দেশে ভাগ হয়ে যায়, তাই

তোমার মৃত্যুর দিন অবধি, তুমি তাকে পেলে না,
তোমার যাপনে জাপটে ধরে রাখলে, অথবা
তুমি যে অসত্য দিয়ে তার ধারণা সৃজন করে
গেলে, সে মিথ কেউ ভেঙে বলে দিল না, প্রকৃত

মানুষ মানুষকে কীভাবে পায়— পায় না, খানিক
আপাত প্রত্যয় জন্মায়, ভৌত জ্ঞানে, ফুল জানে,
পাখি জানে, জীবাণুরা জেনে গেছে বহু আগে
মানুষের তবু গ্রহ-ঘূর্ণন, কৃপণ তৃষ্ণায় যেন মরে…

2 thoughts on “দীর্ঘ কবিতাঃ মানুষ মানুষকে কীভাবে পায় – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. চমৎকার একটি কবিতা পড়লাম। মর্ত্যভূমিতে অনিত্য সম্পর্ক। এর ঊর্ধ্বে পাওয়া মানে হয়েওঠা।

  2. এ এক মানুষ জন্ম-অনিবার্য চিত্ররূপময়
    অসাধারণ

Leave a Reply to Soma Mukherjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *