কবিতাঃ মুক্তির স্বাদ – রাজু কর্মকার

মুক্তির স্বাদ
রাজু কর্মকার

বহুদিন ধরেই পল্লব বাবু ভাবছেন গতানুগতিক একঘেয়েমি কর্ম জীবন থেকে তিনি নিজেকে অন্তত একদিনের জন্য হলেও মুক্তি দেবেন । অন্তত একটা দিন তিনি সম্পূর্ণ নিজের থাকবেন । সাংসারিক কোনো কর্তব্য থাকবে না সেখানে । সাত সকালে উঠে দ্রুত গতিতে রেডি হয়ে গোগ্রাসে গিলে তাড়িয়ে ট্রেন ধরা নয় , নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মস্থল ব্যাঙ্কে পৌঁছিয়ে একঘেয়েমি ‘ ডিউটি ‘ নয় , গিন্নির ফরমাশ পূরণ নয় , ছেলে মেয়েদের ‘এটা চাই ওটা চাই ‘ নয় , স্ত্রীকে ঘিরে বৃদ্ধ বাবা মায়ের ‘নালিশ ‘ নয় । এই একটা দিন তিনি এসবের বাইরে সম্পূর্ণ নিজের থাকবেন , নিজের মতো করে কাটাবেন । কিন্তু সেখানেও তিনি যেন দায়িত্ববান পুরুষ , তাই একটা দিন নিজের মতো কাটানোর জন্য ছুটির দিনকেই বেঁছে নিলেন – “ ঊর্মি , আগামীকাল আমার এক কলিগের ছেলের জন্মদিনের নেমন্তন্ন আছে , দুপুরে , খুব সকালেই বেরিয়ে যেতে হবে , এতে হাজার দুয়েক টাকা আছে , কালকের দিনটা সামলে নিয়ো । “
কড়কড়ে দুই হাজার টাকা পেয়ে সঙ্গত কারণেই গিন্নি বেশ খুশি , তবু হাল্কা করে একটা খোঁচা দিয়ে বলতে ছাড়লেন না – “ ছুটির দিনেই পড়ে যত নেমন্তন্ন ! এদিকে আমাদেরকে নিয়ে কতদিন বাড়ির বাইরে বের হওনি , সে খেয়াল আছে ? পল্লব বাবু যেন কিছু শুনতেই পান নি ।
সকাল হতেই রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন । প্রথমে বাইকে বারাসাত , সেখান থেকে ট্রেনে হাসনাবাদ , সেখান থেকে হিঙ্গল গঞ্জ হয়ে মধুখালি গ্রাম । সেটাই তার একদিনের স্বর্গীয় নন্দন কানন । বেশ কয়েক বছর আগে সত্যিই একদিন সেখানে তিনি কলিগের ছেলের জন্মদিনে এসে ছিলেন । তিনি অবশ্য এখন কোলকাতাতে ফ্লাট নিয়েছেন । সেখানেই থাকেন ।
ছাউনিযুক্ত ইঞ্জিন ভ্যান থেকে নেমে মেঠো পথ ধরে পূব দিক বরাবর হাঁটা শুরু করলেন পল্লব বাবু । পিছন থেকে হুশ করে দুটি ছেলে সাইকেলের টায়ার কাঠের টুকরো দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেলো । সামনে থেকে একটি খালি গোরুর গাড়ি আসছে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি , আনন্দে গদগদ হয়ে পড়লেন তিনি , কেননা লেক টাউনে জন্ম তার , এখন জীবিকা সূত্রে বারাসাতে থাকেন , ফলে গোরুর গাড়ি কখনোই দেখেননি তিনি – এই সময়ে মোবাইলের কথা খুব মনে পড়ে তার , সেটিকেও আজ ছুটি দিয়ে তিনি বাড়ি রেখে এসেছেন ।
কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তার চোখ পিছনে নিমগ্ন হয় । তিনি লক্ষ্য করলেন একটি বড় বাক্স কাঁধে নিয়ে কয়েকজন ব্যক্তি সশব্দে এগিয়ে আসছেন, পিছন পিছন ছুটে আসছেন বাচ্চা গাচ্চা সহ আরও কয়েকজন নারীপুরুষ , কাছাকাছি আসতেই আবিষ্কার করলেন ভারতের বহু প্রাচীন বাহন পাল্কি , তাতে বসে সলাজে বর –বৌ চলেছে , চোখ জুড়িয়ে গেল তার । এই অতি আধুনিক যুগে এখনো পাল্কির অস্তিত্ব আছে ! মনটা খুশির কানায় কানায় ভরে গেল । সত্যিই এ এক বিরল দৃশ্য । মোবাইলটা সাথে না এনে সত্যিই তিনি খুব ভুল করেছেন । আফসোস হয় তার । কেননা এ দৃশ্য তিনি জীবনে আর কখনো চাক্ষুষ না করতেও পারেন । জনৈক ব্যক্তিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন , এখনো গ্রাম বাংলার কিছু বনেদি পরিবারে বৈবাহিক ক্ষেত্রে পাল্কির ব্যবহার হয় । মনে মনে ভাবলেন , আদ্যন্ত কর্তব্যে মোড়া জীবনে একদিনের জন্য একপ্রকার জোরপূর্বক নিজেকে বাইরে নিয়ে আসাটা সার্থক হল তার ।
তারপর লক্ষ্য করলেন , চাষিদের ব্যস্ততা বলদ যোগে জমি চাষ করতে । নেমে পড়লেন তিনি – ও কাকাবাবু , কী চাষ হবে এখানে ?
ফোকলা দাঁতে মিচকি হেসে উত্তর দিলেন গাঁয়ের চাষি নবীন খুড়ো – আলু চাষ হবে বাবা , কাদের বাড়ি এসেছো খোকা ?
এমনি ঘুরতে এলাম কাকা , কারও বাড়িতে আসিনি ।
পাশের থেকে আরেকজন জিজ্ঞাসা করলেন – কোলকেতা থেইক্যা ?
জন্ম থেকে কোলকাতাতেই থাকতাম , এখন অবশ্য বারাসাতে থাকি ।
শুকনো ঝুরঝুরে মাটির বুক চিরে এগিয়ে চলেছে লাঙলের ফোলা , সেই সাথে ঠাই ঠাই শব্দ , মাদকতায় ভরে গেলেন তিনি—কাকা বাবু , আমি একটু চেষ্টা করবো ?
মন চাইছে ? তাহলে একটু চেষ্টা করে দেখো ।
লাঠি নিয়ে একবার ‘ঠাই ‘ বলার সাথে সাথে এলোমেলোভাবে টানাটানি করতে লাগলো বলদ দুটি । কোনোক্রমে তাদের শান্ত করেন নবীন খুড়ো । তারপর তিনি গোরুদুটিকে সামলাতে সামলাতে পাশাপাশি চলেন ।
কিছু সময় পর একটি ছোট্ট মেয়ে হাঁক দেয় – ও দাদু, খেয়ে নাও । বয়স হবে বছর চারেক মতো , জীর্ণ একটি প্যান্ট , কোনো জামার বালাই নেই । তাকে দেখে মনটা নড়ে উঠলো পল্লব বাবুর । নাম – ধাম জিজ্ঞাসা করতেই আধো আধো ভাবে উত্তর দিলো ছোট্ট মেয়েটি ।
কিন্তু কাকা , পুচকে মেয়েটি খাবার নিয়ে এলো যে , তোমার বাড়িতে আর কেউ নেই ?
ছেলে –বৌ দুজনেই সরষে খেতে , ঠাম্মা রান্নায় ব্যস্ত । তাই ও এসেছে । তুমি পান্তা খাবে ?
পান্তা ? বাঃ দারুণ জিনিস তো । কিন্তু কাকা, আমি খেলে তো আপনার কম পড়ে যাবে । আমার কাছে অবশ্য শুকনো খাবার আছে ।
না , না , কম পড়বে না । চলো খেয়ে নিই । ও আব্বাস , তোমার খাবার আসেনি এখনো ?
আইজ বাড়ি গিয়াই খামু চাচা ।
সে তো অনেক দেরী । এসো , আমারটা ভাগাভাগি করেই খাই ।
দুবার অরাজি হয়ে শেষটায় রাজী হন আব্দুস রহমান । তিনজনে মিলে পেঁয়াজ , লঙ্কা আর চাকি গুড় সহযোগে পান্তা উদারসাৎ করলেন তারা । কিছু সময় ধরে চললো মনের গল্প । তারপর নবীন খুড়োর প্রবল আপত্তি ঠেলে ছোট্ট মেয়েটির প্যান্টের পকেটে পাঁচশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন , বাবাকে দিয়ে খাবার কিনে খাবে । তারপর সেখান থেকে মূল মেঠো রাস্তা ধরে আরও সামনের দিকে এগোতে থাকলেন তিনি ।
ওদিকে পাশের ঘরে ফোনের আওয়াজ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন তার স্ত্রী – কী ভুলো মানুষ রে বাবা , ফোনটা নিতেই ভুলে গেল । কোথায় আছে, কীভাবে যোগাযোগ করবো এখন ? ভাল লাগেনা ছাই । ঘরে পৌঁছাতেই ফোন কেটে যায় । তিনি মোবাইলটি নিয়ে রান্না ঘরের দিকে এগোলেন ।
গ্রাম্য প্রকৃতির রুপ লাবন্য চেটেপুটে উপভোগ করতে করতে অনেকটা পথ অতিক্রম করলেন তিনি । মাঝে একটি গাছ তলায় শুকনো খাবার সহযোগে দুপুরের আহার সারলেন তিনি । আরও বেশ কিছুটা পথ এগোতেই সামনে পড়লো বিশাল এক বটগাছ ,গুঁড়ির চারপাশ ঘিরে বাঁধানো । সেখানে বসে কাটাকুটি খেলছে কয়েকটি বাচ্চা , তার পাশেই মাটিতে কেউ কেউ মার্বেল ( কাঁচের গুলি ) খেলছে , মেয়েরা ব্যস্ত ‘ লাল্টুর ভাই পল্টু ‘ । তিনি সেখানে গিয়ে নিমেষেই তাদের সাথে সঙ্গ দিলেন , খেলা করলেন , খাবার ভাগাভাগি করে খেলেন । বিকাল গড়াতেই লক্ষ্য করলেন , দলে দলে রমণীরা কেউ কলসি , কেউ বালতি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন । বাচ্চাদের থেকে জানতে পারলেন , গ্রামে একটি মাত্র গভীর নলকূপ আছে , সেখান থেকে পানীয় জল সংগ্রহের জন্য দলে দলে রমণীরা যান ।
বটগাছের মাথায় ততক্ষণে নানা প্রজাতির পাখি এসে ভিড় করেছে । রাতের বাসিন্দা তারা । পাখিদের কিচির মিচির আওয়াজে বাচ্চারা বুঝে যায় , সন্ধ্যা আসন্ন । এবার বাড়ি ফেরার পালা । পল্লব বাবুও বুঝলেন , সন্ধ্যা নামার আগে মূল রাস্তায় পৌঁছাতেই হবে । নইলে অজানা অচেনা স্থান থেকে বাড়ি ফেরার সমস্যা হবে । ইতিমধ্যে অদূরে কয়েকটি বাড়িতে সোলার ল্যাম্প জ্বলে উঠেছে । তাই আর বিলম্ব না করে সকল বাচ্চাদেরকে উপহার স্বরূপ একশো টাকা করে বকশিশ দিয়ে ফেরার পথ ধরলেন তিনি । চোখে মুখে প্রস্ফুটিত মুক্তির আনন্দ, হৃদয় জুড়ে মুক্তির স্বাদ ।

One thought on “কবিতাঃ মুক্তির স্বাদ – রাজু কর্মকার

Leave a Reply to Alexfonat Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *