ভ্রমণঃ জঙ্গলমহলের সুয়োরাণী ও দুয়োরাণীদের কথা – তপন কুমার কর

জঙ্গলমহলের সুয়োরাণী ও দুয়োরাণীদের কথা
তপন কুমার কর

প্রথম পর্ব

এ.জি. বেঙ্গল অফিসের কর্মকোলাহলের মধ্যে অহরহ ডুবে থেকে দিবসের দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা শেষে ঘর – সংসারের অমোঘ টানে, দক্ষিন প্রান্তের ভি. আই. পি. গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে যখন সুনসান রাস্তায় এসে পড়লাম তখন ঘড়িতে প্রায় আটটা । পরের দিনের কাজের বোঝার দুঃশ্চিন্তা তখনও আমার পিছু ছাড়েনি । শ্রান্তপদে এসেম্বলি হাউস সংলগ্ন ফুটপাত ধরে এগিয়ে গিয়ে লোহার পরিবেষ্টনীর ঠিক ভিতরের মহা – বৃক্ষের তলে অপেক্ষায় রইলাম বাসের সন্ধানে । বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বুঝতে পারলাম যে বাসগুলি দিক পরিবর্তন করে বিপরীত দিকের আকাশবাণী ভবনের ফটকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে । হন্তদন্ত হয়ে রাস্তা পার হয়ে কাঁধের ব্যাগ সামলে সঠিক জায়গায় উপস্থিত হলাম । কিন্তু চোখ আটকে গেল অনতিদূরে ময়দানে গোষ্ঠ পালের মূর্তির পাদদেশে বিপুলাকায় অর্জুন গাছের আলো আধাঁরে । তখনও ফুটবল খেলায় মত্ত কিছু বালখিল্যর দল । ভারতবর্ষের প্রবাদপ্রতিম ফুটবলারকে হয়ত ওরা চেনে না । কিন্তু তাঁর লৌহসম পদতলে রাখা ফুটবল টিকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে । ঘুমের ঘোরে এক সৌন্দর্যভরা ফুটবল জগতের স্বপ্ন হয়ত ওরাও দেখে । বাড়ির টান নিমেষে অন্তর্হিত হলো । গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম অর্জুন গাছটির কাছে । দেখলাম খেলার চেয়ে ঠেলাঠেলিই তাদের বেশি পছন্দের ।
খেলার প্রথাগত নিয়মকানুন ও ছন্দের বাইরে —- কৈশোরের এলোমেলো, স্বাধীন জীবনে হারিয়ে যাওয়ার আনন্দ যে আর কিছুতেই নেই, জীবনের এই অবেলায় নতুন করে টের পেলাম । কতক্ষণ যে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার হিসাব কখনো রাখিনি । হঠাৎই দৃশ্যপট পরিবর্তিত হলো । আমার চক্ষু যুগল আবর্তিত হয়ে বন্দি হলো মোহনবাগান ক্লাবের গেটের বিপরিতে জঙ্গলাকীর্ণ ঢেউ খেলানো বিস্তীর্ণ নির্জন প্রান্তরে । এ’ জায়গা আমার অপরিচিত নয় । কতবার যে এই প্রান্তরের পাশ দিয়ে যাতায়াত করেছি তার ইয়ত্তা নেই । এতদিন শুধু তার রুক্ষ চেহারা আর ঊষরতা মনের মাঝে বহন করেছি । জঙ্গলের ছোট – বড় গাছের মাথায় চাঁদের উদয় হলো । রুক্ষতার আড়ালে এহেন রূপের হাটে কেনাকাটা ইতিপূর্বে কখনো হয়নি । এ এক নতুন আবিস্কার, নতুন অনুভূতি । এই অরণ্য ভূমির নির্জনতা আমাকে নিমেষে টেনে নিয়ে গেল পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়্গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের অরণ্যভূমিতে ।

জঙ্গলমহলের সাথে আমার আত্মীয়তা অনেক দিনের । আত্মীয়তার নির্দিষ্ট সীমানা ছাড়িয়ে কখন যে নিবিড় বন্ধুত্বে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছি তা আর এখন মনে করতে পারি না । এ বন্ধুত্ব কিন্তু এক দিনে হয়নি । কত রূপে কত সাজে জঙ্গলমহল আমাকে মুগ্ধ করেছে, আবিষ্ট করেছে সে কথা বলার চেয়ে মনের গভীরে লালন করা অনেক সহজ । বিভিন্ন ঋতুতে সে নতুন নতুন রূপে সেজে ওঠে । সময় সুযোগ পেলেই ছুটে গেছি অপরূপার কাছে । ধরেছি তার বাড়ানো হাত ।
গ্রীষ্মের অবকাশে, সংরক্ষিত কামরায় কাকভোরে জানালার ধারে বসে বা আধশোয়া হয়ে প্রকৃতির কোলে মুক্ত আকাশের নিচে পরম স্নেহে ঘুম পাড়ানো নির্জন, নিস্তব্ধ ঝাঁটিপাহাড়ী, সিরজাম, ইন্দ্রবিল, মেটাল শহর স্টেশনের সাথে নিভৃতে প্রেমালাপ করেছি । ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টি পড়তেই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠেছে । আস্তে আস্তে শিথিল হয়েছে মুষ্টিবদ্ধ হাত । বলা হয়নি, শোনা হয়নি সুখ – দুঃখের অব্যক্ত কথা । একই অনুভূতিতে মন প্রান আলোড়িত হয়েছে যখন পুরুলিয়া স্টেশন ছাড়িয়ে মুখোমুখি হয়েছি টামনা, কাঁটাডি কিংবা উরমার সাথে ।


বর্ষায় জঙ্গলের চতুর্দিকে সোঁদা গন্ধ। মৌসুমি হাওয়ায় আলুথালু তার কেশরাশি । পিচ্ছিল উপল খণ্ডের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে বেগবতী ঝোরা কিংবা পাহাড়ি নদী । বহু দূর থেকে শোনা যায় তাদের আস্ফালন গর্জন । জঙ্গলে লতানো গাছপালার সাথে শাল, পিয়াল, নিম, কুসুম, মহুল গাছের বৃষ্টি ভেজা শাখা প্রশাখা ও পত্রের অচেনা রহস্যময় মাতাল করা গন্ধ । শাখায় শাখায় পক্ষীকূলের সমাবেশ ও কলকাকলি । শেওলা ধরা বৃক্ষের বাকল সরিয়ে কাঠঠোকরা পাখীর পোকা ধরার অবিরাম চেষ্টায় নিসৃত ঠক- ঠক শব্দ । ছায়াঘন মায়াবী কল্পরাজ্যের গা ছমছমে পরিবেশের মাঝে আমরা জনা দুই অধিবাসী ।
​​​​ দেখতে দেখতে শরৎকাল এসে গেল ।
মহাষ্টমীর বিকালে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে চলেছি পুরুলিয়া শহরে । রাত প্রায় সাড়ে দশটায় স্টেশন থেকে ত্রি – চক্রযানে রাজা বাঁধের পাশের জনহীন উঁচু – নিচু রাস্তা ধরে যখন গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছি, মনে হলো জ্যোৎস্নাভরা আকাশ বুঝি মাথায় ঠেকেছে । মুক্ত আকাশের চাঁদোয়ার নিচে, নিস্তব্ধতায়, নির্জনে কনকচূড়া, পুটুস ও ভাঁট ফুলের বুনো গন্ধের মাদকতায় জ্যোৎস্না যে এত অপরূপ হয়ে উঠতে পারে, মন এমন উদাস হতে পারে, আগে কখনও বুঝিনি । ​
পুজোর সময় ইতিপূর্বে এখানে বহুবার এসেছি । গাড়িখানা, জেলেপাড়া, আমলাপাড়া, হুচুকপাড়া, কুকস্ কম্পাউন্ড কিংবা নডিহার
মাতৃপ্রতিমার সাবেকিয়ানা, পুজো প্রাঙ্গণের সাজসজ্জা আমার চেনা । বছরে বছরে তার কোন তারতম্য লক্ষিত হয়নি । কোলকাতা বা মফস্বলের পুজোর ধার – ভার কোনটাই এখানে তুলনীয় নয় । মায়ের আরাধনায় সরলতা, অনাড়ম্বর আটপৌরে চেহারা দেখে মনে হয়, মা উমা সত্যিসত্যি অবহেলিত সত্বানদের মাঝেই এসেছেন । কঠিন চিন্তাভাবনা, প্রতিযোগিতার আতিশয্য, প্যান্ডলে প্যান্ডেলে জনবিস্ফোরণ, কৃত্রিমতা……এসবের অনুপস্থিতি আমাকে বারেবারে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। মহানবমীর সকাল হতে না হতেই, দূর – দূরান্তের গ্রামের মানুষের সপরিবারে মিছিল করে শহরে আগমনের চিত্রপট মনের গভীরে চিরন্তন হয়ে থাকবে । তাঁরা এসেছেন শহর, দুগগা ঠাকুর আর আলোর রোশনাই দেখতে । শহুরে বাবুদের পোষাকের চাকচিক্য, গায়ের কৃত্রিম গন্ধ, ভিড়ের মধ্যে দেহাতিদের আড়চোখে দেখে নিয়ে দূরে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা…… তাঁদের কাছে সবই অচেনা, পরম বিষ্ময় । এ’ শহরেই আজ তাঁদের ঘরবাড়ি , আমোদ – আহ্লাদ, ঘরকন্না । যা তাঁদের জীবনের পরম প্রাপ্তি, গর্বের বিষয় । বাকি জীবনের গল্পকথা ।
শহর ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলে কাশ – ঘাসের বনভূমি । জলাভূমিতে বিভিন্ন প্রজাতির পদ্ম আর শালুক ফুলের সমারোহ । বক, কাদাখোঁচা এবং অন্যান্য পক্ষীকূলের আনাগোনা । নিম আর তেঁতুল গাছের শাখায় শাখায়, কোটরে কোটরে টিয়াপাখির দাপাদাপি । দুপুর গড়াতেই, অগুন্তি পাখির ঝাঁক পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে মুক্ত আকাশে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বৈকালিক ভ্রমণে ।
লাল মাটির রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে ছোট ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে । জলাশয়ে কচিকাঁচাদের অফুরন্ত প্রাণ শক্তির প্রদর্শনী । ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত ধান ও সবজি – ক্ষেত । পাথুরে অনুর্বর মাটির জল ধারনের অক্ষমতায়, ক্ষেতের অপুষ্ট চেহারা এখানকার মানুষের সাথে বড়ই মানানসই । খোলায় ছাওয়া পরম যত্নে রং করা মাটির দীন – কুটীর, স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর প্রধান আরাধ্য দেবতার ( “মারাংবুরু ” ) উপাসনা স্থল — সবই চোখে পড়ল । অপরিসীম দারিদ্র্য তাঁদের অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে । কিন্তু শিল্পী মনকে পিষে মারতে পারেনি । মাটির দেওয়ালে নিপুন হাতে চিত্রিত গাছপালা, লতাপাতা, ফুল – পাখী, দৈনন্দিন জীবন কথা কিংবা দেব – দেবীর জীবন্ত হয়ে ওঠা চিত্রকলা সে কথাই বলতে চায় ।
দূরে দলমা পাহাড়ের রেঞ্জ, অযোধ্যা পাহাড়ের হাতছানি । এ যেন এক অপার্থিব রূপকথার জগতে এসে পড়েছি । এ’ রূপ যে বাংলায় অন্যত্র একেবারে দেখেনি এমনটি নয় । কিন্তু এমনভাবে আগে তো কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়নি, ভাবনার রসদ জোগায়নি । কোন্ মন্ত্রবলে সংসারী হয়েও মন হয়ে গেল বিবাগী !

দ্বিতীয় পর্ব

দোল পূর্ণিমার পরপরই অনন্ত যৌবনা কুমারী নদী ও তার উচ্ছলতায় নাজেহাল হয়ে তৈরি ড্যামে কিছুক্ষণ কাটিয়ে , মুরাবুড়ি হিল বা পাখী পাহাড় হয়ে চলেছি বাগমুন্ডিতে । পথ আটকাল তিন দিক দিয়ে ঘেরা গোর্গাবুরু পাহাড়ের কোলে শান্ত, সৌম্য, অচঞ্চল পাপড়াকোচা বা পারডি লেক । পাহাড় আর সবুজে ঘেরা লেকের কাজল কালো জলের বিস্তারে আমার মন ও শরীর এমন ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো, যা ব্যক্ত করার ভাষা আমার অজানা । প্রকৃতির কোলে পরম যত্নে বেড়ে ওঠা এই আদুরে মেয়েকে ফেলে আমি যাই কি করে !! সে যে সর্বাঙ্গ দিয়ে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে । শরীরের অবসতা কিছুটা কাটলো পাশ দিয়ে হুঁস করে বেরিয়ে যাওয়া এক পর্যটক দলের গাড়ির শব্দে । মনে পড়ে গেল অযোধ্যা পাহাড়ের করুণ আকুতি আমাকে কাছে পাওয়ার ।
অযোধ্যা পাহাড়ের মন বড়ই খারাপ । প্রথমে তাকে দেখে চিনতে পারিনি। স্মৃতি হাতড়েও মেলাতে পারিনি । কোথায় গেল তার ভরা যৌবন, অঙ্গসৌষ্ঠব ? মানুষের প্রয়োজনে সে রূপের ডালি বিসর্জন দিয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত আপার ড্যামের জলাধারে । সে এখন রিক্ত, নিঃস্ব । জলাধারের অপরমিত গুরুভারে, বুকের উপর কংক্রিটের চাদরে, তাঁর প্রাণবায়ু প্রায় স্তব্ধ । তার প্রাণখোলা হাসি চোখের জল হয়ে ঝরে পড়ছে জলাধারে । আজন্মের খেলার সাথী—– অরণ্যের গাছপালা, লতাপাতা , ফুল – ফল, পক্ষীকূল, জীবজন্তু, নগ্ন পায়ে পথচলা কাঠকুড়ানিরা —- সবাই, সবাই অশ্রুসিক্ত নয়নে একে একে তাকে পরিত্যাগ করেছে । দিন যায় — আবার সেই বিরস, একদা বিরল দিনগুলি বারেবারে ফিরে আসে । একই কারণে মুখ ভার বামনি কিংবা টুরগা ফলস ও লেকের । শত চেষ্টায় নামাতে পারিনি সে মনোভার ।


​​​ সর্বোচ্চ ৬৯৯ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট অযোধ্যা পাহাড়তলীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট ছোট ডুংরি ( ছোট পাহাড় )। কিছু কিছু ডুংরিতে রুক্ষ্ম পাথুরে পাহাড়ের উপরে শাল, সেগুন, জাম, নিম, কুসুম, শিরীষ আর মহুল গাছ মাথা তুলে আকাশ ছুঁতে চাইছে । পাথরের খাঁজে শেকড় ছড়িয়ে বাঁচার প্রাণপণ লড়াই । পাহাড়ের পাদদেশের সমতল ভূমিতে লুথেরানদের ( ধর্মযাজক মার্টিন লুথারের অনুগামী ) দ্বারা নির্মিত নলকূপ, বাঁধ ( বৃহৎ জলাশয় ), ইঁদারা কিংবা সরকারি ব্যবস্থাপনায় বসানো ট্যাপ থেকে জলভর্তি একাধিক কলসের সারি মাথায় নিয়ে মেয়েরা জঙ্গলের সর্পিল চড়াই পথ ধরে চলেছে কয়েক মাইল দূরের ডুংরিতে । এ তাঁদের নিত্য দিনের কাজ । জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই । উসুল ডুংরি ওয়াচ টাওয়ারে যখন এলাম, ঘোর বসন্তে নাছোড়বান্দা কুয়াশার আগমনে চতুর্দিক আচ্ছাদিত । ওয়াচ টাওয়ারটি স্থানীয় পঞ্চায়েতের অর্থানুকূল্যে তৈরি হয়েছে । অদূরে জঙ্গলাকীর্ণ সবুজে মোড়া উসুল ডুংরির হাতে গোনা ঘরবাড়ি, মানুষজন কুয়াশার চাদরে মুখ ঢেকেছে। সে অবগুণ্ঠন উন্মোচিত হওয়ার অবকাশ আমি দিতে পারিনি।
ততক্ষণে দুয়ারসিনির দিগন্তবিস্তৃত পলাশ বনের হাতছানি আমাকে অশান্ত করে তুলেছে। পথে খয়রাবেড়া লেক, চোরিদা গ্রামের আথিতেয়তাও আমাকে গ্রহণ করতে হবে। অগত্যা ভেবেচিন্তে অযোধ্যা পাহাড়ের সম্প্রসারিত মালভূমিতে অবস্থিত বাঘমুন্ডি শহরের রিসর্টে নিশিযাপনের সিদ্ধান্ত নিতে হল।

দুয়ারসিনি লেক


জঙ্গলমহল, বিশেষ করে পুরুলিয়া হল লোকসংস্কৃতির খনি। সেই খনির সন্ধান নিতে মন – প্রাণ উসখুস করছিল । বেরিয়ে এলাম রিসর্টের সাজান পরিবেশ থেকে । মিশে গেলাম সাধারণ মানুষের মাঝে । তাঁদের লোকাচার , সংস্কৃতি, জীবন সংগ্রামের অজানা কথা মনের গভীরে অধিষ্ঠিত হল। ছৌ, ঝুমুর, টুসু, ভাদু, নাচনী নাচ, দাসাই ( ময়ূর নাচ), নাটুয়া নাচ ( প্রচলিত লোকনৃত্য ) প্রভৃতি নৃত্যকলা ও গান পুরুলিয়ার সংস্কৃতি ও জীবনচর্চার মেলবন্ধন করেছে। নাচনীদের কথা জানা ও প্রত্যক্ষ করার জন্য রয়েছে পুরুলিয়া নাচনী উন্নয়ন সমিতি এবং সংস্থার সাজানো প্রাঙ্গণ । রাতের বাঘমুন্ডি শহর, রিসর্ট ও সন্নিহিত অঞ্চলের সরল সাদাসিধে মানুষজনের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ ।


পরদিন চোরিদা গ্রামে যখন উপস্থিত হলাম, সকল বয়েসের গ্রামবাসীরা স্ত্রী, পুরুষ, নির্বিশেষে ছৌ – নাচের মুখোশ তৈরির কাজে বিভোর । গ্রামের শিল্প কর্মের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ – দেশান্তরে। কুটির শিল্পের এক বিপুল কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে সেখানে । কুটির শিল্প যে কত শত মানুষের কর্মসংস্থান, অন্নসংস্থান করতে পারে , এই গ্রাম তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ । কিছুক্ষণ এখানে অতিবাহিত করে অনুসন্ধিৎসা নিবৃত্ত তো হোলই না, বরং কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেল।
চোরিদা গ্রাম ছেড়ে জাতীয় সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে বুড়দা মোড় থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার দূরে অনুপম নিসর্গের মাঝে খয়রাবেড়া জলাধার । সেখানে গিয়ে যখন উপস্থিত হলাম সূর্যদেব তখন প্রায় মধ্য গগনে মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত । প্রথম চৈত্রেও সুতীব্র হিমেল হাওয়া চতুর্দিক থেকে বেগে ধাবিত হয়ে আমাকে প্রেম নিবেদনে উদগ্রীব হয়ে উঠল। সে প্রেমের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে এক ছুটে বাহনে ফিরে গলাবন্ধ বার করে গলা, মাথা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে প্রেমিকার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করলাম।
তিনদিক ঘন সবুজ পাহাড়ে ঘেরা আর এক দিকে সবুজ উপত্যকা, মাঝে স্বচ্ছ সলিলা নিস্তরঙ্গ প্রায় দেড় কিলোমিটার লম্বা গভীর জলাধার। খয়রাবেড়ার নয়নভোলানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের তৃপ্ত করবেই । মনে এনে দেবে অপার্থিব প্রশান্তি । যারা প্রকৃতির কোলে নিরিবিলিতে সময় কাটাতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য রয়েছে ” ইকো এ্যডভেঞ্চার রিসর্ট “। পাশাপাশি রাত্রিযাপনের জন্য টেন্টের ব্যবস্থাও আছে । আর আছে ট্রেকিং , বোটিং ও ফিশিং এর সুযোগ । পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেচ প্রকল্প গড়ে উঠেছে এখানে ।
খয়রাবেড়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঝা – চকচকে জাতীয় সড়কে ফিরে এসে, বাহনের চালক গতির লাগাম দিলেন আলগা করে । আমরা চলেছি ঝাড়খণ্ড সীমান্ত লাগোয়া দুয়ারসিনি পলাশ বনের দিকে । বেশ কয়েক কিলোমিটার চলার পর হঠাৎই চালক বন্ধু অতি ধীরে চলতে শুরু করলেন । এত দিনের দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান হলো । পলাশ বনের সাথে প্রথম যখন চোখাচোখি হলো, বয়েসের ভার হাল্কা হয়ে আমি যেন বুলি না ফোঁটা শিশু । মাইলের পর মাইল জাতীয় সড়কের দু’ধার দিয়ে পলাশের বনভূমি । কারা যেন সবার অলক্ষ্যে সমস্ত বনভূমি লাল আবীরে সদ্য স্নান করিয়ে দিয়েছে । ফুটন্ত রক্ত পলাশের বনে উপস্থিত শাল, পিয়ালের মঞ্জরীর সুগন্ধে বনের চতুর্দিক মৌ মৌ করছে । মনে হল, এ’ অঞ্চল যেন পৃথিবীর কোন অংশ নয়, মায়াবী স্বপ্নভূমি । প্রকৃতির বিজন রূপসাগরে আমি ডুবে গেলাম ।
জঙ্গলমহল দু’হাত ভরে শুধু দিয়েছে, বিনিময়ে চায়নি কিছুই। তার কাছে আমি চিরঋণী । সে ঋণের বোঝা একসাথে বইতে আমি অপারগ । সময় সুযোগ পেলে সে ঋণের গুরুভার আবার বইবার চেষ্টা করবো ।।

One thought on “ভ্রমণঃ জঙ্গলমহলের সুয়োরাণী ও দুয়োরাণীদের কথা – তপন কুমার কর

  1. পুরুলিয়ার জঙ্গলে ভ্রমণ করে লেখক এক অনবদ্য কাহিনী তুলে ধরেছেন। প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনার সাথে সাথে তুলে ধরেছেন সেখানকার মানুষের লোকাচার, সংস্কৃতি ও জীবন সংগ্রামের কাহিনী। অরণ্যের মায়াময় রূপের সাথে জ্যোৎস্নার রহস্যময় হাতছানি। লেখকের আক্ষেপ করেছেন আধুনিকতা গ্রাস করেছে অরণ্যের স্বাভাবিক ছন্দ। লেখককে ধন্যবাদ।

Leave a Reply to Kanai Halder Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *