দ্বিতীয় পৃথিবী(দ্বিতীয় পর্ব)
অনিরুদ্ধ সুব্রত
অফবিট বুক স্টলে সুমিতের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ দ্বিতীয় পৃথিবী’ সবকটা বিক্রি হয়ে গেছে— ফোনে এই খবর শুনতে শুনতে অমৃতা যার পর নাই আনন্দিত।
“হোক মাত্র দশ কপি, মাত্র চারদিন তো হলো বইমেলার, তাতেই একজনের দশ কপি কবিতার বই বিক্রি, তাও একটা স্টল থেকে। এটা প্রায় অখ্যাত এক কবির ক্ষেত্রে একেবারে অভাবনীয়। তবে অফবিটের স্টল আসলেই অন্যরকম। সেখানে ছকভাঙা একটা আলাদা উপস্থাপনা যেমন আছে, তেমনি বাছাই পাঠক, কবিদের আনাগোনাও চলে। তাহলে নিশ্চয়ই সুমিতের ‘দ্বিতীয় পৃথিবী’ ভালো পাঠকের মনে কিছুটা হলেও জায়গা পেয়েছে। কাল আরও কিছু বই অফবিটের স্টলে রাখার তৎপরতা অমৃতা মনে মনে ভেবে নিল। আর ঠিক তক্ষুনি তার ইচ্ছে করল, ” ইস্ এক্ষুনি যদি এই সুখবরটা সুমিতকে ফোন করে বলতে পারতাম !”
পড়ার ঘরের আলো নিভিয়ে অমৃতা শোবার ঘরে আসে।ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে, বেডের একপাশে অভীক গায়ে কম্বল জড়িয়ে ল্যাপটপে চোখ দিয়ে আছে। অমৃতা ঘরে ঢুকতে অভীক খানিকটা ঘুরে বসলো ল্যাপটপ আড়াল করে। যেহেতু অভীকের কানে অয়ারলেস ইয়ার ফোন লাগানো, ফলে ল্যাপটপে কী চলছে তার কোনো রকম শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
ডাকসাইটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার,অভীক সেন।এককালের মাধ্যমিকে প্রথম কুড়িতে স্ট্যান্ড করা মেধাবী ছাত্র। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। চাকরি পেল একটা আন্তর্জাতিক কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ভারতীয় শাখায়। চাকরি করল বছর কুড়ি, ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে। প্রচুর ফান্ডা তার, বিরাট বিরাট কোম্পানির বিশাল কনস্ট্রাকশন প্রোজেক্ট ড্রইং থেকে বিল্ড সব যেন অভীক সেনের হাতের খেলা। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সুনাম তার নতুন কোম্পানি গুলোর মুখে মুখে।
সম্প্রতি সেই অভীক সেন, দিল কোম্পানির বাঁধা চাকরি ছেড়ে। স্যালারি আর রিওয়ার্ড মিলিয়ে লাখ কয়েক মাস মাস অ্যাকাউন্টে ঢুকত তার। কিন্তু নিজের প্রজেক্ট ফার্ম তৈরির নেশা এখন তার মাথায়। সঙ্গে এসেছে কয়েকজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ারও। মাত্র কয়েক মাস হলো সেক্টর ফাইভে অভীকের নতুন অফিসের উদ্বোধন হলো। উদ্বোধনে জনৈক মন্ত্রী এসে ফিতে কাটলেন। দেখতে দেখতে হুড়হুড় করে কাজ আসতে শুরু করেছে।
চিরকালই অভীক যোগ্যতমের উদবর্তনে বিশ্বাসী। প্রিয় সাবজেক্ট ছিল ফিজিক্স। তারপর একদিন বড় কারখানার কংক্রিট ফাউন্ডেশন থেকে গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণে তার জুড়ি মেলা ভার। নিজের মেধা আর যোগ্যতা দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যকে টেনে আয়ত্তে নিয়ে আসার আনন্দ অভীক পেতে জানে। তবে তার একটা হবি আছে, লেটেস্ট ল্যাপটপ। বাজারে নতুন লেটেস্ট ভার্সনের তো বটেই, এমনকি নতুন চোখে ধরা মডেল পেলেই অভীক সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ল্যাপটপ এক্সেঞ্জ করে নেয়। আসলে কাজের ক্ষেত্রে সেটা তার ব্যাগ-পকেটের সঙ্গী।
দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকার সময় এক মুহূর্তে অমৃতা ল্যাপটপের স্ক্রিনে যা দেখেছে, তা আজই নতুন নয়। তাই চোখ পড়তেই একটা তীব্র বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নেয় অমৃতা। এগিয়ে যায় সোজা মেকআপ টেবিলের দিকে। বড় আয়নায় নিজেকে দেখে। বিরক্ত মুখের ছবিকে ইচ্ছে করে শান্ত করতে চায় সে।
খেয়াল করে, সে মুটিয়ে যাচ্ছে কি না। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে হঠাৎ আয়নার ভিতরেই দেখতে পায় অভীকের মুখে চোখে কী এক লোল-তৃষ্ণার বিকৃত শিরশিরানি। সঙ্গে সঙ্গে মেকআপ টেবিলের সামনের আলোটা অফ করে দেয় অমৃতা। ভাল্লাগে না আর নিজের রূপ, শরীর, বয়স ইত্যাদিতে মনোযোগ দিতে। এগিয়ে যায় শোবার খাটের কাছে, অ্যটাচ ছোট্ট টেবিল থেকে জলের বোতল তুলে নিয়ে দু’ঢোক খায়। তারপর মুখে বলে, ” যথেষ্ট রাত হয়েছে, আমি শোবো, সকালে আমার কলেজ আছে।”
বলে ফের একবার ওয়াশরুম হয়ে এসে একটা বালিশ টেনে খাটের একপাশে কম্বল টেনে শুতে যায়। আর ঠিক তক্ষুনি অভীক ল্যাপটপটা হঠাৎ করে পাশে সরিয়ে অমৃতাকে সবলে আকর্ষণ করতে যায়। অমৃতা ঝটকা দেয়, ” ধুর, ভাল্লাগছে না। আমি আজ খুব ক্লান্ত। আমাকে ঘুমোতে হবে, ছাড়ো।”
অভীক শক্তিশালী বলিষ্ঠ পুরুষ। মধ্য পঞ্চাশের ভোগী মানুষ। তার কাছে জীবন মানে কর্মজগতের সাফল্যের পাশাপাশি উপভোগ্য চড়া আলো। সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কঠিনতর সংগ্রামে দৃঢ় নির্ভিক যুদ্ধবাজ। ‘বীর ভোগ্যা মেদিনী’ তার নিজস্ব সংবিধানের প্রথম পাতায় জ্বল জ্বল করে ।
অর্থই প্রকৃত সার্থকতা, যা যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করতে হয়— অভীক কথায় কথায় একথা বলে, অমৃতা অনেক বার শুনেছে। অথচ মুখে তার ভয়ঙ্কর মেজাজ, শব্দ, চিৎকার, শোক, দুঃখ, কান্না কোনোটিই কোনো কালে বিশেষ উচ্চগ্রামের নয়। অমৃতা বহুবার যেখানে এসে হার স্বীকার করেছে, সে হলো অভীকের কঠিন, স্থির, খর-চোখের শান্ত আগ্নেয়গিরি-দৃষ্টি। এখনও অমৃতা কেন যেন সেই নিঃশব্দ রোষ-পূর্ণ চোখের সামনে আত্মসমর্পণ ব্যতীত শক্ত কিছু ধরতে পায় না। অমৃতা সেই দৃষ্টিকে বিবাহ অবধি কেবল ভয় পেয়ে এসেছে। পদে পদে যেখানে সে যেন বাধ্য পোষ্য।
তবু শরীরের ক্লান্তি অমৃতাকে যতখানি অনীহ না করে, তার চেয়ে অভীকের প্রায়ই রাতে ঐ নীল-সিনেমায় উষ্ণ হওয়ার অভ্যাস বেশি ঘৃণা দেয়। একটা বিশ্রী শীতলতায় অমৃতা কুঁকড়ে যায় ভিতরে ভিতরে। মনে তার দৃঢ় প্রশ্ন, “অভীক কী চায়— মাথায় ফ্যান্টাসি ফিল্ম -এর যৌন-আবহে উত্তপ্ত হয়ে অমৃতা নামক একটি নারী শরীরে শুধু মাত্র পুরুষের যান্ত্রিক স্খলন ?
ভালবাসা, সোহাগ, আদর, আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ অর্থহীন ? মধ্য চল্লিশের স্ত্রী শুধুমাত্র একটি পাত্র বিশেষ ?যেখানে উত্তেজনা নিঃসরণটুকুই এই মাঝবেলার নিশি-যাপন ?”
ভাবতে ভাবতে রাগে দুঃখে অমৃতা নিজের অপমানে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে বারে বারে । তবু আজ রাতেও সেই একই পেষণে তাকে পেষিত হতে হলো। তার পর মনখারাপির ঘুম এলো বিষাদের মতো— শেষ রাত গড়িয়ে।
রাত বারোটা দশ পলাশপুর স্টেশন চত্বরে একটিও টোটোর দেখা পেল না সুমিত। যদিও মনে মনে পাবে যে তেমন আশা করেওনি সে। কিন্তু আজ যেন শরীরটা একটু বেশিই ক্লান্ত লাগছিল তার। বিকেলের দিকে বইমেলার মাঠের বাইরে অমৃতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা বেকারি বিস্কুট ভিজিয়ে দুধ চা খেয়েছিল। তারপর রাত এখন বারোটা ছাড়িয়ে গেছে। সেই কোন সকালে গরম ভাতে আলু সেদ্ধ আর ঘি । তারপর গোটা একটা দিন পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে পলাশপুর থেকে কলকাতা শহর, বইমেলার মাঠ আর লোকাল ট্রেন ঘুরে, এই ফেরা। সত্যিই আজ একটু বেশিই রাত হয়ে গেছে সুমিতের।
ভাবে, রণিতা আজ হয়তো বেশিমাত্রায় ঝামেলা করবে। আজ রণিতার বিশেষ কোনো বিজনেস প্রোগ্রাম ছিল কিনা, সেটাও শুনে দেখেনি সুমিত। তাছাড়া ক্লাস টুয়েলভের মেয়েটা যদি একা একা সারাদিন বাড়িতে থাকে, সত্যিই সুমিতের একজন বাবা হিসেবে সেটাও চিন্তার মধ্যে থাকা উচিত ছিল।
অথচ পলাশপুরে পা দেবার আগে পর্যন্ত সুমিতের মাথায় স্ত্রী রণিতা বা মেয়ে ঋতাভরীর প্রসঙ্গ ছিল ঠিকই কিন্তু বইমেলা, কবিতার নতুন বই এগুলোর প্রাধান্যই ছিল বেশি। এখন শুনশান অল্প আলোর রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে পলাশপুরের জীবনটা মনে হচ্ছে খুব বেশি।
তাই একটা অপরাধ বোধও কাজ করছে কেন যেন। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, ” কবি হিসেবে সফল হবো কিনা আদৌ অজানা কিন্তু উপযুক্ত স্বামী এবং সন্তানের বাবা হতেও তো পারিনি। এ ব্যর্থতা তো একান্ত আমারই। এ অপরাধের শাস্তি কী !”
মনে মনে খুব ছোটো হয়ে যায় সুমিত, “প্যারাটিচার সুমিত রায় মাসে মাত্র বারো হাজার টাকা মাইনে পেয়ে পুরো সংসারের প্রয়োজনটাই চালাতে পারে না সে । তার আবার কবিতা লেখার সাধ ! আবার নতুন কাব্যগ্রন্থ !”
মনে মনে রণিতার কথাও ভাবে, ” ওর আজকের সক্রিয়তার জন্য মেয়ের পড়াশোনার খরচপাতিটা ঠিক ঠাক চলছে । তা না হলে কী যে হতো.. ।”
এই সব নানা কিসিমের ভাব ভাবনা মাথায় ঘুরতে ঘুরতে সুমিত স্টেশন রোগ ছেড়ে, শিব মন্দিরের পেছন দিয়ে শর্টকাটে হেঁটে পৌঁছে যায় বাড়ির দরজায়।
চোখ তুলে দেখে মেয়ে ঋতাভরী চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। দরজায় মেয়েকে এতো রাতে এইভাবে আগে কখনও অপেক্ষা করতে দেখে নি সুমিত। তাছাড়া জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ, জাঁকিয়ে শীত না হলেও যথেষ্ট ঠাণ্ডা পড়েছে। বাতাসে ভরাট কুয়াশা। একটা সাধারণ সোয়েটার গায়ে, মাফলার ছাড়া এতো রাতে মেয়েটা দরজার একটা কপাট খুলে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে !
খানিকটা আশ্চর্যই হয় সুমিত। মুহূর্তে আশঙ্কা করে, তবে কি ঋতাভরীর সঙ্গে তার মায়ের কোনো রকম মনোমালিন্য হয়েছে ? না কি একান্তই বাবার প্রতি মাতৃবাৎসল্য ? কিন্তু সে সব নিয়ে ভাববার সময় কোথায় সুমিতের, সে বড্ড ক্লান্ত। তবু দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই,
“– বাবা ? তুমি এতোটা দেরি করে এলে কেন ?
— আগের ট্রেনটা মিস্ করেছি রে । কিন্তু তুই এই ঠাণ্ডার মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে কেন ঋ ?
— তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম ।
— ও ! বাবা ! তা বলে এই শীতের মধ্যে ?
— আমার ভালো লাগছিল না। আজ আমার মন খুব খারাপ।
—- কেন রে মা কী হয়েছে ?
— তুমি আগে ঘরে এসো, তারপর তোমাকে সব বলব।
— আচ্ছা চল্ , আমারও ভীষণ খিদে পেয়েছে ঋ। তুই খেয়েছিস, তোর মা…”
ঘড়িতে রাত একটা, সুমিত একাই খেতে বসে।ঋ কে খেতে দিলে সে সামান্য খেয়ে উঠে গেছিল বলে, সেই থালায় রণিতা খানিকটা ভাত আর ডিমের ঝোল নিয়ে খেয়েছে কিছুক্ষণ আগে।–রণিতা সুমিতের সামনে থালা এগিয়ে দিতে দিতে সেকথা বলে।
সুমিত থালার ভাত ভেঙে তাতে ডিমের ঝোল বাটি থেকে ঢেলে এক পিস আলু মুখে নিয়ে খেতে শুরু করে। খিদেয় তার পেট চোঁ চোঁ করছে। রণিতা একটা জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে, “শোনো, আমি শুয়ে পড়লাম, কাল খুব সকালে বেরিয়ে যাব। মেয়েরও সকালে টিউশন আছে। তুমি কাল সকালে ভাতটা শুধু ফুটিয়ে রাখবে, সঙ্গে আলু দেবে। সকালে সেদ্ধ খেয়ো, আমি বিকেলে ফিরে কিছু রান্না করে দেব।”
মাথা তুলে সুমিত বলল,
“কিন্তু তুমি সকালে কিছু খাবে না ? না খেয়েই বেরবে ?
— না, চা খেয়ে বেরিয়ে যাব। কাল আমাদের বিজনেস টিমের একটা মিট আছে দুপুরে। আমি ওখানে খেয়ে ফিরব। তুমি মেয়েকে দেখো। যেখানে সেখানে বেরিয়ে যেও না আবার।
— ঠিক আছে, কাল তো আমার স্কুল নেই।
— স্কুল নেই, সেতো আমিও জানি। কিন্তু তোমার ঐসব কবিতা টবিতার প্রোগ্রামে কোনো এদিক ওদিক যাওয়া কাল রেখো না।”
বলে মেয়েকে নিয়ে শোবার ঘরে চলে যায়। সুমিত মাথা নেড়ে আগামীকালের বাড়িতে থাকার সম্মতি জানিয়ে ভাত খাওয়ায় মেতে ওঠে।
মাত্র দুটো মাঝারি সাইজের ঘর, মাঝখানে অর্ধেক-বারান্দার মতো জায়গা, সেখানে রান্না খাওয়া। এটা সুমিত-রণিতার ভাড়া বাড়ি। ঘর গুলো “দেখলেই যেন মনে হয় ভাড়া দেওয়ার জন্য তৈরি–” রণিতা প্রথম দিন ঘর দেখতে এসে এ কথা বলেছিল।
সুমিতদের নিজেদের বাড়িটা প্রায় পলাশপুর স্টেশন লাগোয়া। সে বাড়িতে অনেক গুলো বড় বড় ঘর। একতলা দোতলায় লম্বা বারান্দা। সামনে কাঠা তিনেক জায়গা। সেখানে কয়েকটা ফলের গাছ, ফুলের গাছও আছে। সুমিতের আবাল্য যাপন সেখানেই। কিন্তু সেই শৈশবের প্রিয় বাড়ি ছেড়ে আজ সুমিত এই ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে। মুশকিল হয়েছিল ওর বিয়ের পর থেকেই। যার রেশ কখনও শেষ হয়নি।
গত তিন বছর হলো সুমিত বাড়ি ছেড়ে এই ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেছে। একদিন সুমিতের অনুপস্থিতিতে, পারিবারিক বাড়িটা তিন ভাই-এর মধ্যে ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত নেয় মা। মূল বাড়িটা মেজ ভাই অমিতের ভাগে— এটা মায়ের সিদ্ধান্ত।
কারণ সংসারে অমিতই দীর্ঘদিন সবচেয়ে বেশি খরচ করে আসছে। ভালো বাজার করা থেকে আত্মীয় স্বজন, দেওয়া থোয়া সব তো সেই করে। যদিও অমিতই তিন ভাইয়ের মধ্যে প্রথম চাকুরে। সরকারি খাদ্য দপ্তরের বড় অফিসার সে।
এখনও সবাই একসঙ্গে থাকলেও মা চান সুস্থ শরীরে সব ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে যেতে। ছোটো ভাই অনিকেত ইঞ্জিনিয়ার, ভালো মাইনে। একবছর আগেই সে বউ আর কোলের মেয়ে নিয়ে রাজারহাটে নতুন ফ্লাটে উঠে গেছে।
মায়ের কথা, একমাত্র মেজভায়েরই একটা ছেলে, সে-ই পরিবারের পরম্পরা। অতএব বাড়িটা তার হওয়াই উচিত। তবু বড়ভাই হিসেবে সুমিতের একটা ভাগ থাকে । আর সেটা নীচের তলার অ্যাটাচ রান্না ঘর বাথরুম সহ সিঁড়ির বাম দিকের অংশটা। তাতে একটা বেডরুম আর একটা ছোট্ট রিডিং। যদিও ভাগ হিসেবে কমন বারান্দার আংশিক সে ব্যবহার করতে পারবে।
তাছাড়া বড় ও ছোটো যদি মনে করে এই বাড়িতেই থাকবে, তবে তারা সামনের তিনকাঠার এক ভাগ পাবে। পারলে সেখানে ঘর করে নেবে।
সিদ্ধান্ত মোটামুটি ঠিক সুমিতরা জানে, মায়ের কথার নড়চড় হয় না কখনো। আর তাদের বাবা
অমলেন্দু রায় চিরকালই পারিবারিক বিষয় ঘটনা সিদ্ধান্ত নিয়ে পুরোপুরি স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল ও আস্থা রাখেন।
সুমিত দুইদিনের মেদিনীপুর সাহিত্য উৎসব থেকে ফিরে মায়ের বাড়ি ভাগের সিদ্ধান্ত শোনে। আশ্চর্য হয়। রাতে ছুটে যায় মেজভাই এর ঘরে। চেষ্টা করে তাকে বোঝানোর, ” বাড়ি কি ভাগ হয় নাকি ! সবাই একসঙ্গে আছি তো। জানি হয়তো আমার কন্ট্রিবিউশন খুবই কম , তবু এটা তো আমাদের সবারই বাড়ি বল !”
অমিত সুমিতের কথায় তেমন পাত্তা দেয় না। বরং নিচের তলায় যে অংশটুকু দাদা পেয়েছে সেটা নাকি তার পক্ষে যথেষ্ট। এই বলে সুমিতকে প্রতিহত করে।
এরপর সুমিত ছুটে যায় মায়ের ঘরে। মা পরিস্কার করে সুমিতকে বুঝিয়ে দেন যে “বাড়ির উপযুক্ত ছেলে অমিত। কর্তব্য কর্মে তার তুলনা চলে না। বাড়িটা তো তার হাতে দিয়ে মরব না কি অ্যাঁ ? তাছাড়া এই বাড়ির উত্তর পুরুষ তো আমার নাতিই। এটা তার পাওনা।আর তোকে তো বঞ্চিত করিনি। তোর বউকে আমি কোনো দিনই ‘পরের মেয়ে’কে মেনে নিইনি, তা তুই ভালোই জানিস। তবু তুই আমার ছেলে, নীচের তলার একটা অংশ তোকে দিয়েছি। ওটা নিয়ে শান্ত থাক। “
সুমিত জানে, মা চিরকালই এমন চাঁচাছোলা ভাবে কথা বলে। রণিতাকে সুমিত নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিল, কাউকে না জানিয়ে। তখন সে নিতান্তই বেকার, টিউশন-মাস্টার। ব্যাপারটা পরিবারের কেউই ভালো ভাবে নিয়েছিল না। কিন্তু সবচেয়ে বেশি রাগ করেছিল মা। নতুন বউ-এর প্রণাম নেওয়া তো দূরের কথা, ছায়া দেখলে রেগে যেত। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রণিতাকে সুমিতের মা ‘পরের মেয়ে’ সম্বোধনে অন্যের কাছে তার প্রসঙ্গ বলে আসছেন। ধীরে ধীরে এই বাড়িতে রণিতার সমান্তরাল নাম— ‘পরের মেয়ে’
মায়ের কথা শেষ হলে সুমিত বলে, ” দেখো মা পারিবারিক বাড়িটা ভাগ হওয়াটা ভালো দেখায় না । বাবা এই তৈরি করেছেন, এটা আমাদের সবার বাড়ি। এখানে সবাই মিলে থাকলে কী ক্ষতি হতো ?”
“—- হ্যাঁ, খুব তো সবার সবার করছিস,
তা সংসারের খরচ দেবার সময় মেজর উপর সব চাপ যায় কেন ?
—- আমি তো আলাদা করে কোনো চাপ দিই না মা। হ্যাঁ ও হয়তো বেশিটাই করে । কিন্তু আমি যতটুকু পারি তার বেশি কী করে করব বলো ?
—- বেশ, যদি না পারো তো আলাদা ভাবে খাও।
এক সঙ্গে থাকবে অথচ খরচ খেয়াল করবে না, তা আর কতদিন ? অমিত যদি এখন নিজের মতো গুছিয়ে নিতে চায়, আমি তো তাকে অন্যাজ্য বলতে পারব না।
— কী সব বলছ মা ?
—- যা বলছি তুমি ঠিকই বুঝতে পারছ।
— কিন্তু ছোটো ভাই ? সে বাড়ির কোন অংশ ?
— ওর এই বাড়ির ভাগে কিছুই নেই। ও পলাশ পুরের বাড়ি ছেড়ে কলকাতা গিয়ে উঠেছে। ঠিক আছে, ওর তো বাড়ির দরকার নেই। নতুন ফ্লাট কিনেছে। সেখানে থাকুকগে।
— তাই বলে আমাদের ছোটো ভাই অনিকেত পৈতৃক বাড়িতে অধিকার পাবে না ?
—- না। বললাম তো পুরোটা তো আর মেজকে দিতে পারলাম না, তোমাকেও তো একটু দিলাম। — হয়তো তুমিই ঠিক বলছ মা। কিন্তু তোমার এই ঠিকটা আমারও কিছুতে সহ্য হবে না। বরং আমার অংশ হিসেবে যেটুকু দিতে চেয়েছ, সেটাও আমাকে দিতে হবে না। বাড়িটা অন্তত গোটা বাড়ি হিসেবে থাক। সামনের মাস থেকে আমি ভাড়া বাড়িতে চলে যাবো ।
— তুমি ভাড়া বাড়িতে গিয়ে ঘর ভাড়া দিয়ে ঠিক ঠাক সংসার চালাবে কীভাবে ?
সে খেয়াল আছে ?
—- যেভাবে হোক, সে তুমি ভেবো না মা। কিন্তু আমি ভাবছি, বাবার কাছে একবার এই বিষয়ে তার মতামতটা শোনা দরকার ছিল ?
—- একদম না। শোনো সুমিত, তোমার বাবার সঙ্গে এই ব্যাপারে কোনো কথা বলবে না। তাঁর শরীর এমনিতেই এখন দুর্বল, বয়স হয়েছে। তাছাড়া মাথাটা একটু এলোমেলোও, সবসময় ঠিক ঠাক কথা বলেন না। আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মনে করবে সেটা তারও সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে নতুন করে ঘাঁটিও না তাকে।”
সেদিন রাতে মায়ের ঘর থেকে ফিরে সুমিত খুব কেঁদেছিল। রণিতা “এই পরিণতি অনেক আগেই জানতাম” বলে বলে সুমিতের কাটা ঘায়ে দিয়েছিল নুনের ছিটে।
রণিতা সুমিতকে আলাদা ঘর ভাড়া করে মেয়ে আর তাকে সেখানে নিয়ে যেতে বলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। সুমিতের সঙ্গে বিয়ের পর থেকে কথায় কথায় এ বাড়িতে নতুন বৌ রণিতা শ্বাশুড়ির কাছে অপমানিত হয়ে এসেছে।
এমন কথাও শ্বাশুড়ির মুখে শুনতে হয়েছে যে,
” আমার ছেলের মাথাটা এতো সুন্দর করে খেতে পারলে, আর কাপড়জামা কাচতে শিখলে না ?
এই সংসারটা তো যাকে তাকে ফ্রি খাওয়ানো জন্য নিজে হাতে তিল তিল করে গড়ে তুলিনি ! পড়াশোনাতেও তো তেমন কিছু না, তা সাধ করে যখন ঝুলে পড়েছ— তখন সংসারের সব কাজই সামলাতে হবে। আর তাতে যদি অপছন্দ হয়, তবে বাপু সোজা রাস্তা। যেখানে খুশি যাও । আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার নির্দেশ মেনেই থাকতে হবে। একে তো ছেলে এখনও বেকার, তাতে ‘পরের মেয়ে’ তুলেছে ঘরে। সাহসে বলিহারি !”
মেজভাই চাকরি পেলে সঙ্গে সঙ্গে নিজেই মেয়ে দেখে রাতারাতি তার বিয়ে দিয়ে দেন সুমিতের মা। আদর আর প্রশ্রয়ে মেজবৌ প্রিয়াঙ্কা হলো সুমিতের মায়ের একমাত্র পছন্দের বৌমা।
কিন্তু ছোটো ভাইয়ের চাকরির পরে সে মাকে আর নতুন ছোটো বৌ আনার সুযোগ দেয়নি। তাই ছোটো বৌ বিপাশাকে মায়ের চরম অপছন্দ।
বিপাশা চাকরি করে কলকাতার কাছাকাছি একটা স্কুলে। সে বিয়ের পর এই বাড়িতে থেকেছে হাতে গোনা কয়েকদিন। স্কুলের কাছাকাছি বলে, আগে বেশির ভাগ দিন বাপের বাড়িতেই থাকত । এখন তো নিজেদের নতুন ফ্ল্যাট রাজারহাটে।
আসলে বেকার বয়সে হঠাৎ করে রণিতাকে বিয়ে করে সুমিত পড়েছিল সমূহ বিপদে। সে কথা না হয় অবকাশে বলা যাবে। কিন্তু শুধু টিউশনি করে তো আর চলতে পারে না। তাই আনন্দ নগর হাইস্কুলে প্যারা টিচার হিসেবে যোগ দেয়ার সুযোগ সে হাত ছাড়া করতে পারেনি। ভেবেছিল এই কাজটা করতে করতে নিশ্চয়ই এস এস সি টা পেয়ে যাবে সে। কিন্তু স্কুল, টিউশনি, কবিতা-প্রেম শেষপর্যন্ত চাকরির পড়াশোনা আর শুরুই হলো না তার। যদিও সে সব ব্যর্থ রেলিং এ এখন আর হাত রাখে না সুমিত। তাতে তার অস্তিত্ব ঝিনঝিন করে।
তা না হলে তিন ভাইয়ের মধ্যে সুমিতই ছিল সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে থেকে কীভাবে যেন বড্ড কবিতায় পেয়ে বসল সুমিতকে । ছোটো বেলা থেকে সাহিত্য-প্রীতি থাকলেও এমন ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মতো সম্ভাবনা কেউ ভাবেনি। মাধ্যমিকে যে ছেলে অঙ্কে একশোতে আটানব্বই, উচ্চ মাধ্যমিকে সে অঙ্কে কোনো প্রকারে পাশ নম্বর উত্তীর্ণ।
বাবা মার ইচ্ছে স্বপ্ন তছনছ। অবশেষে বি এস সি বায়োসায়েন্স কম্প্লিট করে বেকার টিউশন মাস্টার। আর সারাক্ষণ কী এক কবিতা কবিতা নেশা। খামখেয়ালে হঠাৎ করেই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বিয়ে করে ফেলল সুমিত। যেন স্বাভাবিক বিবেচনা নির্ভর জীবনের চেনা রাস্তায় ইচ্ছে করেই হাঁটল না সে। না কি সে মনে মনে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল কবিতার ছন্নছাড়া পংক্তির মতো, কে জানে। কিন্তু বাস্তবের সময়,পরিবার পরিজন কোনো একটি চরিত্রের পাগলামিকে শুধু শুধু প্রশ্রয় দেবে না— এটাই স্বাভাবিক।
সুমিতের কবিতা লেখার নেশাও বিয়ের পর থেকে চরম ভাবে বিঘ্নিত হতে শুরু করল। সকাল সন্ধেয় মা আর স্ত্রী দুজনের কেউই সুখী নয়। সুমিতের মনে হয়েছিল, মা হয়তো সংসারের ব্যাপারটা সামলাবে নিজের ঔদার্য দিয়ে। ভেবেছিল, রণিতা বুঝবে যে তাদের এই বিয়েটা এই পরিবারে একটা চরম দুর্ঘটনার মতো ঘটে গেছে। ফলে মা এবং রণিতা দুজনেই যদি পরস্পর চেষ্টা করে মেনে নেয়, তাহলে পারিবারিক শান্তি স্থিতি ফিরে আসা অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু সুমিতের এই জাতীয় বোকা বোকা চিন্তা কোনো কাজেই আসে নি। রণিতাকে সে প্রাথমিক ভাবে বেশ বুঝিয়ে নিতে পেরেছিল ভালবাসার কমিটমেন্ট দিয়ে। কিন্তু মাকে কখনো একটি বাক্যও বোঝাতে সমর্থ হয় নি সুমিত। দিন দিন সুমিতের উপর সাংসারিক খরচের একটা অংশ চাপিয়ে দেওয়াই ছিল মায়ের উদ্দেশ্য। মা যেন ছেলেকে শিক্ষা দিতে চাইছিলেন, ” দেখ অবাধ্য ছেলে সংসারের ঘানির ভার কাকে বলে।”
যদিও মা সেই কাজে আংশিক সফল হলেও সুমিত হয়ে যাচ্ছিল পাগল। একমাত্র টিউশন করে সংসারের প্রয়োজনীয় খরচ জোগাড় করতে গিয়ে সুমিত ক্রমেই কবিতাকে হারিয়ে ফেলছিল। তবু আনন্দনগর হাইস্কুলে প্যারাটিচারিটা পেয়ে সুমিত খানিকটা হলেও সান্ত্বনা পেয়েছিল মনে ।
কিন্তু প্যারাটিচারের আয় কম। যে কারণে সংসারের কারও চাহিদা তো নয়ই, এমনকি সাধারণ সব প্রয়োজন সে মিটিয়ে উঠতে পারে নি। টিউশনও খুব কমই করে সুমিত, সময়ের সমস্যা। কবিতা কবিতা করে দিন যায় তার।
তারপর টানা এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে একদিন রণিতা নিজেই একটা কসমেটিক প্রোডাক্ট বিক্রির চেন-মার্কেটিং বিজনেস -এ জয়েন করে। সে জন্য তাকে প্রায়ই সময়ে অসময়ে বেরিয়ে যেতে হয় কাজে।
মোটামুটি একটা অল্প স্বল্প স্যালারি ঢুকতে শুরু করেছে রণিতার একাউন্টে। তুলনায় এখন সে সুমিতের চেয়ে বেশিই আয় করে, বছর দেড়েক কাজে জয়েন করে,এটাই তার উন্নতি। আপার-বস এখন মাসে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কামায়। সে রোজই কোনো না কোনো বিজনেস আলোচনায় ভালো গাড়ি বাড়ির হ্যান্ডসাম লাইফের গল্প শোনায়। রণিতাদের উৎসাহিত করতে। রণিতাও একটা নিজস্ব বাড়ি আর সম্ভব হলে একটা গাড়ির অস্ফূট স্বপ্ন দেখে। মেয়ের এবং নিজের খরচ পাতি নিজেই চালিয়ে এখন থেকেই একটু একটু জমাচ্ছে রণিতা।
সে কথা সে কখনওই সুমিতকে বলে না। মনে ভেবেছে,
” ওকে কেন বলব ? সুমিত আমাকে কী দিয়েছে জীবনে ! ওর পরিবারের লোকেরা যেমন আমাকে কোনোদিন মর্যাদা দেয়নি, ও তেমনি সব ব্যাপারে থেকেছে উদাসীন। সেই কুড়িটা বছর ধরে দেখছি, সুমিত যতখানি ওর ঐ সব লেখালিখি নিয়েই পাগলামি করে গেছে, তার এক বিন্দুও সক্রিয় হয়নি অর্থ উপার্জনে। অথচ টাকা ছাড়া যে জীবন অচল, সেটা ও কি বোঝেনি ! কোনো স্বপ্ন নেই, লক্ষ্য নেই, অথচ মেজাজ আছে ! কী করে যে সেদিন ওকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম, এখন সত্যিই বুঝতে পারিনা। “
অপেক্ষাকৃত ধনী বাড়ির মেয়ে ছিল রণিতা। বাবার বাড়িতে তার ইচ্ছে মতো ব্যায়ের হাতটা সুমিতের সংসারে এসে পুরো কুঁকড়ে গিয়েছিল। প্রায় কুড়ি বছর পরে আবার একটু একটু করে সেই হাত প্রসারণের সম্ভাবনা আজ তার সামনে। কিন্তু রণিতার এই কাজ তাকে ভীষণই পরিশ্রম করায়। মেনে চলতে হয় আপার-বসদের নির্দেশ।
তারা কথায় কথায় বলে, ” শুনুন রণিতা একটা টার্গেটে পৌঁছানোর ইচ্ছে নিয়ে কাজটা করে যেতে হবে। আর সেই জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব আরও আরও মানুষের মধ্যে কোম্পানির কমিটমেন্ট থেকে প্রোডাক্ট ছড়িয়ে দিতে হবে। আর যতটা সম্ভব দরকার নতুন ছেলেমেয়েদের জয়েনিং। যাদের নার্সিং করিয়ে নামিয়ে দিতে হবে ট্র্যাকে। তারপর সেই দৌড় থেকে আপনার উন্নতির ঊর্ধমুখী গ্রাফ সুস্পষ্ট দেখতে পাবেন। আজকের ভোগবিলাসের জীবনে কত কত না পাওয়া আছে আমাদের, অথচ আপনারা একটু বেশি অ্যাক্টিভ হলেই দেখবেন সব স্বপ্ন পুরণ হওয়া আপনাদের হাতের মুঠোয়। বি পজিটিভ রণিতা ।”
ভাড়া বাড়িতে ওঠার পর থেকে শোবার বিছানা আলাদা হয়েছে সুমিতদের। ওদের পারিবারিক বাড়িতে ঋতাভরী ঘুমোত ঠাম্মার কাছে। কখনও খুব ইচ্ছে হলে রাতে মা বাবার কাছে চলে আসত। এখন এই নতুন ভাড়া বাড়িতে এসে মাত্র দুটোই ঘর। এক ঘরে ঋতাভরী একা থাকতেও ভয় পায়। ফলে সে আর মা এক ঘরে, আর বাবা এক ঘরে।
রাতের খাওয়া শেষ করে থালা বাটি সিঙ্কে রেখে দেয় সুমিত। এরপর শোবার ঘরে এসে বিছানায় বসে। খানিকটা জল খায়। মনে মনে ভাবে আজকের বইমেলা থেকে কেনা নতুন বই দুটো একটু নেড়ে চেড়ে দেখবে । হঠাৎ মনে পড়ে দরজার কপাটে ঝুলিয়ে রাখা পাঞ্জাবির পকেটে একটা সিগারেট রয়েছে এখনও। তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে সেটা খুঁজে আনে।
লাইটার জ্বালিয়ে ফুস করে ধরিয়ে টানতে টানতে এক মুহূর্তে মনে পড়ে,
“ঋ কী যেন বলবে বলেছিল ? মেয়েটার মন খারাপ, দেখেই মনে হয়েছিল। কিন্তু সে কথা তো শোনা হলো না !”
সুমিত ব্যস্ত হয়ে উঠে, এগিয়ে যায়। পাশের ঘরের ভেজানো কপাটে ধাক্কা দিতে গিয়ে দেয় না। থামে, দাঁড়ায়, ভাবে, তারপর ফিরে আসে নিজের ঘরে। মুখে বিড়বিড় করে,
” ওরা যখন শুয়েই পড়েছে, তখন থাক। তাছাড়া ঋ নিশ্চই কথাটা ওর মায়ের সামনে বলবে না। রণিতার শাসন বড্ড এক তরফা মেজাজ। হতে পারে মেয়ে কোনো মানসিক কষ্ট বা দ্বন্দ্বের কথা বাবাকেই শুধু বলতে চায়। যদি খুব স্বাভাবিক কিছু হয় তাহলেও রাতের বিছানা থেকে তুলে শোনার দরকার নেই। বরং কাল রণিতা যখন বাড়িতে থাকবে না, তখন না হয় ঋ এর কথাটা মন দিয়ে শোনা যাবে।”
পরদিন সকালে সুমিতের ঘুম ভাঙে বাপ্পাদিত্য চ্যাটার্জির এন্ডফিল্ড-বাইকের তীব্র হর্ণে।
(এরপর পরবর্তী পর্বে)
উফফফ্, এতো তাড়াতাড়ি শেষ হল কেন❓ দারুণ…
খুব ভালো লাগছে ।
লেখাটা দারুণ টানছে। অভিনন্দন।