দীর্ঘ কবিতাঃ পার্থ-পারমিতা—১ – অনিরুদ্ধ সুব্রত

পার্থ-পারমিতা—১
অনিরুদ্ধ সুব্রত

শেষ রাতের স্বপ্নে
কী বলতে এসেছিলে,জানি না—

— কেন ?
জানো না কেন, তোমার স্বপ্নের সব
স্বাধীনতা— সে তো তোমারই।

— কিছু বলতে এসেছিলে মনে হয়,
যেন ওইটুকুই জানি।
কিছু বলতে তো দেখিনি—

— দেখতে গিয়েছিলাম পার্থকে,
যাকে আমি চিনি।

— ও ! বড় বিশ্বাসী চেনা—
পরম পারমিতা, রাণি…

— কেন,হতে পারে না ?

— পারে তো, সিনেমার মতো
সিকোয়েন্স হিসেবে যদি ধরো।
স্বপ্নের প্রসঙ্গ টেনে যেভাবে হিট হয়
ন্যাকা ছায়াছবি।

— উফ্ ! আবার সিনেমা ?
একদম ভাল্লাগে না।

— কেন শুধু ফ্লপ বলে ?
কিন্তু সমস্ত যন্ত্রণা তো দিয়েছি,
গল্প খাপছাড়া ছাড়া আমার যে চলে না
নষ্ট, ধষ্ট যখন পষ্ট পর্দায়
আমার সৃজন উৎসব শুরু হয়
ব্যর্থের অব্যর্থ রূপায়ণ— আমার সাধনা
সাধ্যে কুলায় এই, ফ্লপ-জীবন বা সিনেমা।

— ও ! শেষ রাতের স্বপ্নের প্রসঙ্গ এনে
ফের সিনেমার পাগলামিতে ?

  • হুম, মগজের অভ্যেস, বুকের উদ্দেশ্যের
    আর লেন্সের দোষ—
    অথবা হিট না হ‌ওয়া সব ছবির আফশোস,
    তবু মুভ করে বলে সবই মুভি–
    এমনকি বিশ্বাসও।

— না…, সব কিছুই সব সময় মুভ করে না,
থেমেও থাকে পাথরের মতো
হয়তো যুগ যুগও,

— মানে ? এসব ইয়ার্কি, না অতি ঈশ্বর ভাবনা ?
তাহলে কী পারমিতা হৃদয়ে পরিমিত,
আর আমাকে তার মতো করে
দৃশ্য বুঝিয়ে দিয়ে, দেখতে চায় দূরে দাঁড়িয়ে
কীভাবে সেলুলয়েডে ছাপ পড়ে যায়

পুরো একটা ফ্যান্টাসি— যার লোকাল নাম
ভালবাসাবাসি ?

— পরিচালক বনে যাওয়া উন্মাদনা
পার্থের পাগলামি যদি মনে করি— ঠিক আছে ,
কিন্তু তোমার গোপন ঈশ্বর বিশ্বাসী অভ্যেসে
এ অপলাপ। মিথ্যে। সবেতেই তোমার
খণ্ড খণ্ড সিনেমার সূত্র,
আমি তা খুঁজি না, ফ্যান্টাসিও বলি না
নতুন করে স্বীকারোক্তি চাও
নাকি তোমার অস্বীকার, জানিনা…

— পারমিতা, তুমি কি স্মৃতির সিনেমা
একটা দুটো তিনটে বা আরও অগণিত
আজকের অডিটরিয়মে বসে
একা একা দেখো না ?

— ইচ্ছে করেই দেখার ইচ্ছেটা করিনা,
পারিনা,
রোজকার ভাঁজ খুলে, ঝেড়েপুছে
প্যাকেট বন্দি করতে গিয়ে,
দেখি– খুলে গেছে আর একটা দিন।
রোজ, এক‌ই…
থাক, সে বলে লাভ কী !

— লাভ ? নেই তো—
আমার তো বোধ অন্য রকম–
সুদৃশ্য প্যাকেটে পোরার যত দিন
আর যত যত সাজানো দিন— সব সব
এলোমেলো করে মেঝেতে ছড়াতে ছিটাতে
আমার খুব খুব ভালো লাগে।
ছিঁড়ে ছিঁড়ে সুদৃশ্য সকাল সন্ধ্যে যত
সারারাত টুকরো টুকরো নিয়ে ছুঁড়তে মজা লাগে
জমাট অন্ধকারে।

— না, পার্থ—
তুমি ভাঁজ করা দিন
আর অনুশীলনে বাঁচা সম্পর্কে উদাসীন,
তাই খবর রাখো না।
বিশ্বাস করতেও চাও না, সবটা তো তোমার
প্রথা বহির্ভূত সিনেমা না।

— উঁহু, থাক ।
জানি বা জানি না—
কিন্তু রোজ সত্যিকে অস্বীকারের অনুশীলন
সত্যিই আমি চাই না।
অজস্র ভাঁজ, রং, গুছিয়ে, পালিশ করে
তুমি জানো—আমার সিনেমায় চলবে না,
অসুস্থ, কাতর, যন্ত্রণা ক্লিষ্ট সাজিয়ে বলবে
সে ডায়লগ আমার সিনেমায়
না, চলে না, কোনও দিনও চলবে না।

— তাহলে ? কী করতে পারবে তুমি ?
অস্পষ্ট চিৎকারকেই অনিয়ন্ত্রিত
রূপেই রাখবে ?
চলবে এই জীবনে তোমার ঐ চিত্রনাট্য ?
খাবে না এখানে চোখে প্রফেশনাল ছানিপড়া
আর কমার্শিয়াল চশমা পরা দর্শক।
বরং যেমন চলে, তেমন চিত্রনাট্য লেখো…

— কীসের চিত্রনাট্য ?
আমি তো অনন্ত নাটকের চিত্ররূপের সন্ধানে,
ঝাঁচকচকে ফ্লোরে ? চোখা কথা, চোপা মুখে
যুক্তি-প্রতিযুক্তি, কৌশল, বাহানা আর আদরে
নানাবিধ ন্যাকা অ্যাঙ্গেলে — আমার ক্যামেরা
আদৌ চিত্র গ্রহণ করবে না, খুলবে না লেন্স
শুধু ফাঙ্গাস জমে উঠবে স্বচ্ছ চোখে,
আর ল্যাবরেটরী বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে।

— ও ! তাহলে তো
তোমার সিনেমা গুলোতে
আমি থাকিস না…
মানে পারমিতা আছে, না ছিল‌ই না ?
না সময়ে মুছে ফেলতে হয়েছে বলে
ক্যানভাস ঢেকে রেখেছ ?
অন্তত স্থিরচিত্রে কোথাও
রয়েগেছি কিনা ?

— আগে তুমি বলো দেখি,
তোমার পুরস্কৃত ডকুমেন্টারিতে
আমি— কতটা এডিট হয়েছি ?
কাটছাঁট, চাঁচাছোলা, চাপা অনুশীলনের মাপে ?
তুমি তো ব্যর্থ জীবনের ফ্লপ সিনেমা
বানাবে না—
চির সাফল্যের মুকুটে বিজয়িনী হয়ে
হঠাৎ এই ভাঙা ঘরের নষ্ট বিছানার শেষ রাতে
শুধু দাঁড়াবে মুহূর্ত এসে,
চরম প্রেম-প্রহসন নির্বাক মুখে…

— ভুল পার্থ ভুল…

— ও ! তাহলে ঠিক কী আছে ?

— তোমাকে কোনও ভাবে এডিট করার কথা
কখনও ইচ্ছে করিনি আমি
রেখেছি সেই একই ভাবে, যেভাবে জানি।
অথচ ততবার করেছ ছারখার
হ্যাঁ, আমাকে তুমি—।

— কিন্তু পারমিতার ভাঁজ করা সুদৃশ্য প্যাকেটের
ঝাড়াপোছা গ্যালারিতে, সেই পুরনো ?
পুরো আনকাট হয়ে রয়েগেছি—
আমার খিস্তিওয়ালা স্বীকারোক্তি গুলো ?
অসভ্য শব্দ দিয়ে বারুদের কারবার গুলো ?
নাক-টানা শব্দের অসহ্য কান্না গুলো ?
জঘণ্য ন্যাকা কাপুরুষ ব্যর্থতার হুতাশ আর
ক্লিশে দিশাহারা সব কবিতা গুলো ?
কিছুই এডিট করোনি !

— জানিনা, জানিনা আমি—
শুধু আড়ষ্ঠ রাত যান্ত্রিক দিনগুলো জানি ।
এই পারমিতার জীবনের
মাঝখানে দাঁড়িয়ে— হাতটা তুলে ধরতে
পারিনি সত্যিই মে,
মাপা সিলিং-এ আটকেছে অসংখ্য বার
কিন্তু— বিশ্বাস করোনি একবারও।
হ্যাঁ, হ্যাঁ—- এডিট করেছি, তাই নিজেকে ;
ভাঁজ করে তাকে তাকে অথবা
প্যাকেটের মাপে— আঁটোসাঁটো করে নিতে।
তোমার সিনেমার আনকাট-ভার্সান হোতে
যদি মনে করো পারিনি, তবে তো সংলাপ নেই,
তোমার মিতার জবানীতে…।

— সেই ভালো,
বোকা প্রশ্নের চেয়ে, সংলাপ তুলে নেওয়া ভালো
পার্থের পথ যা জানে, তা চিরতরে জানে।
চিত্র আটকে থাকুক নাট্যের ছাঁচে— যদি সুখ বাঁচে,
যদিও মানুষ সবচেয়ে গভীরে গিয়েছে বেশি,
যত নির্বাক সিনেমার কাছে ।

— সত্যিই হয়তো, তুমি যত‌ই তাকে নির্বাক বলো
কিন্তু তারপরও
নিঃশব্দ অন্তঃক্ষরণে কেবল মানুষ মরেছে।

— উঁহু, মরে না মানুষ, মরা উপভোগ করে,
সিনেমার মতো করে— তীব্র শব্দ, উষ্ণ রক্ত,
অথবা পচনের মতো অসুখের ঢঙে
গাঢ় এক আবহ-সংগীত ধার করে।

— তুমি কি সিনেমা থেকে কোনও দিন
বেরবে না—- ? ভাববে না যে ভাবে প্রত্যেকে
সিরিয়াস জীবনে…

— ও ! সিরায়াস !
লাইট- ক্যামেরা- অ্যাকশন !
সাজানো মিথ্যের স্ক্রিপ্ট ধরে ধরে ?
জেনে শুনে বুঝে অসুস্থকে ‘সুপ্রভাত’
অথবা পারফিউম মেশানো ‘শুভ রাত্রি’
আর গোছানো মুখে সম্ভাষণ জানাতে !
পার্থ পেরেছে কখনও ?

— আমি কি একথা বললাম ?

— না, তা বলেনি পারমিতা—
চিত্রনাট্যে সেটা নেই, জানি রাখবেও না
বরং একটা রবীন্দ্রসংগীত রাখা ছিল ওখানে।
বেশ রোমান্টিক, চোখ ভেজে
ফুল আর বৃষ্টির ধ্বনি মাখানো আমেজে।

— কী যা তা বলছ ? কত দিন এইভাবে বলবে,
অপ্রকৃতিস্থ হয়েছ পার্থ ?
বলেছিলে যে, ছেড়ে দেবে…

— হুম, তুমিও তো বলেছিলে,
অনন্তের সাঁতারে ডানা মেলে দেবে
স্বপ্ন দেবে,সাধ আর স্বাদ দেবে
অফুরান অনর্গল কবিতা দেবে ?
অথচ তারপর—
প্রতিদিন এই ধ্যাতরা যাত্রাপালা লিখে
ভাড়াটে ঘুমের জন্য রাতে সাধ করে
নষ্ট-নেশা কিনতে
বেরতে হয় কেন যে পথে…

— ( কয়েকটি বিপ বিপ শব্দ)

-যা ! নির্বাক সিনেমার অফলাইন দৃশ্য—
সাময়িক সিনেমার আকস্মিক শেষ ?
যা ! আবার দুশো কিলোমিটার দূর…
রাতটা ভাঁজ হয়ে গেছে ঠিক

ফিটফাট প্যাকেটের মাপে
ঢুকে গেছে সুখ-পাখি, তার তার আকাশের
খাপ খাপ বুকে।।

4 thoughts on “দীর্ঘ কবিতাঃ পার্থ-পারমিতা—১ – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. ভীষণ ভালো লাগল। একেবারে অন্যরকম।💐🙂

  2. দীর্ঘ কবিতা। অভিনন্দন।

Leave a Reply to krittika Bhaumik Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *