পান্না হলো সবুজ (দ্বিতীয় অংশ)
কাজরী বসু
(৪)
কথাটা শুনে একটু চমকেই গেলাম। এরকম হতে পারে সেটা আসলে মাথাতেই আসেনি।
বিষয়টা এতটাই ব্যক্তিগত যে এরপরে কী জিজ্ঞেস করব তা বুঝতে পারছিলাম না।
তিস্তা নিজেই আবার বলল,
…আসলে আমার মুখের দিকে চেয়েই তো মানি রাজি হয়েছিল বিয়েতে,কিন্তু মানি যে অন্য একজনকে আগে থেকেই ভালোবাসত। বাপিকে হাজবেন্ড হিসেবে কখনো মেনে না নেওয়ার শর্তেই মানি বিয়েতে রাজি হয়। বাপিও আমার জন্য সেই শর্ত মেনে নেয়।
….হুম বুঝলাম।
….মানি এখনো মনে মনে তাকেই ভালোবাসে যাকে প্রথম থেকেই ভালোবাসত। আর শুনলে অবাক হবেন, তিনি কিন্তু আজও বিয়ে করেননি।
….বলেন কী!
….হ্যাঁ। বাপি সেটা জানত বলে এই ভয়টা পেত যে বাপির অবর্তমানে মানি যদি তাকে বিয়ে করে নেয়! সেক্ষেত্রে আমার আর্থিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। তাই এত রকমের সাবধানতা। আমায় জেম দিয়ে যাওয়া। সব ওই ভয় থেকে। কিন্তু শেষরক্ষা আর হলো কই!
….কেন,আপনার মানি কি সত্যি সত্যিই…
…..দেখুন,আমি জানিনা সেটা কিন্তু মানিই বা সারাজীবন আমার জন্য কেন নিজেকে বঞ্চিত করে যাবে বলুন তো! মানির এই কষ্ট তো আমারই জন্য,নয়?.. মানি বিয়ে করুক আমিও তা চাই। সেই সঙ্গে বাপির দিয়ে যাওয়া জিনিসগুলোও চাই। আমি নিজেরও ক্ষতি চাই না।
….আচ্ছা বলছিলাম যে,এত কথা আপনি কীভাবে জানলেন?
….মানি আর আমার ফ্রেন্ডশিপটা মোটেই হেলাফেলা করার মতো নয়। শি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। ইনডিড।
বাড়ি ফিরে স্নান করলাম ভালো করে। সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। স্নানের পর ধোঁয়া ওঠা চা আর অনন্ত সোমের নোটপ্যাড নিয়ে বসলাম।
খাতাটা জুড়ে প্রচুর কাটাকুটি , আর অনেক কিছু লেখাও। আর হাতের লেখাটিও পরশু পাওয়া চিরকুটের সঙ্গে মিলছে।
এখানেও সূত্রের মতো কিছু ছেঁড়াছেঁড়া লেখা।
যেমন
তুমি এক গুজুবুজু বুজুবুজু এলে।
একদম তাকাবে না। দেব চোখ গেলে!
কি করে তা জানবে না। ওরা যাবে খুঁজে।
তারপর? ঘুম দিও চক্ষুটি বুজে।
আবার এক জায়গায়..
তুরু রুরু তুরু রুরু
আমি লঘু তুই গুরু!
আজ থেকে হোক শুরু
প্লাক কর। কই ভুরু!
যদি সত্যিই এগুলো ক্লু হয়,তাহলে এই এত ধাঁধা কেন লিখে গেলেন অনন্ত সোম,তাই ভাবছি। মেয়েকে একবার ডেকে কোথায় কি রেখেছেন বলে দিলেই ল্যাটা চুকে যেত। এত রহস্য সৃষ্টি করা কি খুব জরুরি ছিল?
নাকি এসব কিছুই কোনো রহস্য নয়! এ এমনিই ছড়া লেখার প্রয়াস মাত্র।
বোঝা যাচ্ছে না। দেখি,কাল আবার ভাবব। আজ একটা টানা ঘুম দরকার।
….হ্যালো, তিস্তা তোমাদের, আই মিন আপনাদের যে জুয়েলারি শপ আছে সেখানকার কোনো কর্মচারীকে কি চেনো,আই মিন চেনেন?
…এই আপনি আজ্ঞেটা সত্যিই আর টলারেট করাই যাচ্ছেনা, আমাকে কেউ আপনি বলে জিন্দেগিতে দেখিনি। আমি কি মধ্যবয়সী মহিলা?
….আর আমিও কি সাত বুড়োর এক বুড়ো নাকি,আশ্চর্য!
….ওকে ডান। কী যেন বলছিলে! হ্যাঁ আছেন একজন। নরেশ জেঠু। বাপির সময় ছিল। এখন তো আর দোকানে যান না। বাপি চলে যাবার পর রিটায়ার করে গেছেন।
….তাহলে তো আরও ভালো। তোমার মানির আড়ালে কথা বলা যাবে। নাম্বার আছে?
…..ছিল তো,ওয়েট,ওয়ান মিনিট…
হুম,সেন্ড করে দিচ্ছি। দেখে নাও।
নরেশ বাগচি থাকেন জামির লেনের এক পুরোনো বাড়িতে।
বয়েস তো হয়েইছে,শরীরও তেমন ভালো নয়। খুব অমায়িক সজ্জন,খাতির করে আমায় বসালেন।তক্তাপোশ ছাড়া আর কোনো বসার জায়গাও অবশ্য নেই ঘরে।
…চা খাবে ?
….না না,এই ভাত খেয়ে বেরোলাম।
……তাহলে বলো কী জানতে চাও।
…আপনি তো দুর্গা জুয়েলারি স্টোর্স এ বহুদিন কাজ করেছেন। অনন্ত বাবু যে বেশ কিছু দামী পাথর নিয়ে যেতেন বাড়িতে মেয়ের জন্য, আপনি কি তা জানতেন?
….হ্যাঁ জানতুম। ওর নিজের দোকান,নিজের জিনিস,নিত,কার কি বলার আছে।
….সেটাই তো কথা। তাহলে পাথর নিয়ে এত লুকোছাপা কেন?
….অনন্ত কাউকে মনে হয় ঠিক বিশ্বাস করতে পারত না। ও ভাবত পাথরের কথা জানতে পারলে তা বেহাত হয়ে যেতে পারে। ও লুকিয়ে রেখে যেতে চাইত সব।
….কিন্তু আপনাকে তো বিশ্বাস করতেন উনি। বিশ্বাস করে এত সব বলতেন।
…হ্যাঁ,কারণ আমাকে ও চিনত। জানত আমার দ্বারা ওর পরিবারের কারো ক্ষতি হবার নয়।
….কিন্তু নিজের স্ত্রীকেও…
…প্রিয়া ওর স্ত্রী আবার ছিল কবে? প্রিয়ার সঙ্গে ওর কাজের কথা ছাড়া আর কোনো কথাই হতো না। একটা মানুষ কেমন তা জানতে গেলে তো তার সঙ্গে টাইম স্পেন্ড করতে হয়! তবে তো জানা যায় সে ভালো না মন্দ,রাগী না শান্ত,ঠগ না বিশ্বাসী! স্ত্রীকে অনন্ত চিনতই তো না,তাকে বিশ্বাস করবে কেমন করে?
….অনন্ত বাবুর ব্যক্তিগত কথা আপনি তার মানে অনেকটাই জানতেন। তাহলে এটাও কি জানতেন না যে পাথরগুলো উনি কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন?
…..দেখো ভাই, সেটা জানলে আমি কি আর তিস্তাকে সে হদিশ অ্যাদ্দিনে দিতুম না? সে কি আমার শত্তুর?
….অনন্ত বাবুর কথায় কখনো কোনো আঁচ পাননি?
….না,এত কথা তো হতই না। কঠিন রোগে বেচারি একেবারে কাবু ছিল। কীভাবে সুস্থ হবে সেই চিন্তা করত সর্বক্ষণ।
….পাথরগুলো উনি কি স্ত্রীর ভয়ে লুকিয়ে রাখতেন তাহলে?
….ওই যে বললাম,স্ত্রী বিশ্বাসযোগ্য কি না তা বোঝার সুযোগ ওর হয়নি। আসলে কি বলো তো, কোনো বাপই তার সন্তানের সৎ মাকে বিশ্বাস করে না। সেই মা তার মাসিই হোক বা অন্য কেউ। অনন্তও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
…কিন্তু উনি এই লুকোনোর জায়গাটার কথা মেয়েকে কেন বলে গেলেন না?
….. অনন্ত অনেকদিন অবধি নিজেই জানত না কোথায় ওগুলোকে রাখবে। আমায় বলত,নরেশ দা,এই সব দামী দামী জেমগুলো কোথায় যে রেখে যাই। মেয়েটা যাতে খুঁজে পায় তেমন জায়গায় তো রাখতে হবে। তারপর ওকে ডেকে চুপিচুপি বলে দেব। এই সব কথা ও আমায় বলেছে বেশি দিন আগে তো নয়! মারা যাবার কয়েকদিন আগে বলল,নরেশ দা,একটা জায়গার কথা অনেক ভেবে বের করেছি। আমি আগে সেফলি ওগুলোর গতি করি। ক্লুও রাখছি, কাজটা শেষ হলেই মেয়েকে আসতে বলব। ওরও তো বললেই আসা হয় না,পড়ার খুব চাপ। নিজের পায়ে তো দাঁড়াতে হবে ওকে। আমি তো এই আছি এই নেই। তাই না! কিন্তু এত কিছু মেয়েকে জানাতে আর পারল কই, তার কয়েকদিনের মধ্যেই তো…
জামির লেন হয়ে আসতে গিয়ে আজ একটু দেরিতে ঢুকলাম।
….তিস্তা,তোমার বাবা কোন ঘরে থাকতেন?আজ সেই ঘরটা দিয়ে স্টার্ট করি।
….বাপি ওদিকের কিচেনের পাশের ঘরে একাই থাকত। ঘরটায় আমি ঢুকিনা। খুব মন খারাপ হয়।
…আচ্ছা আমি তবে একাই যাই।
….তুমি যাও,আমি আসছি।
অনন্ত সোমের ঘরটা বেশ গুছিয়ে রাখা। আসবাব অবশ্য খুব কম। একটা সিঙ্গল বেড, তার একদিকে আয়না দেওয়া স্টিলের আলমারি,অন্যদিকে একটা কাঠের ওয়ার্ডরোব,তার পাশে ছোট একটা এল ই ডি টিভি দেয়ালে লাগানো। জুয়েলারির দোকানের মালিক,ঘরে কোনো গুপ্ত সিন্দুক টিন্দুক নেই? দেয়ালগুলো টোকা দিয়ে দেখব? সিরিয়ালে যেমন দেখায়,দেয়ালে একটা রঙের তফাত,তার মধ্যে লুকোনো মণিকোঠা। ভেবে নিজেরই হাসি পেল অবশ্য। এ ঘরে সেরকম কিছু আছে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না। থাকবেই বা কোথায়! দুদিকে বড়ো বড়ো দুটো জানলায় অর্ধেক দেয়াল কভার করে গেছে। কিন্তু তাহলে পাথরগুলো ভদ্রলোক রাখলেন কোথায়?
জানলাগুলো খোলা,ঘরে বেশ আলো। বাঁদিকের জানলার ঠিক পাশে ওপাশের বাড়ির জানালা। অন্য দিকের জানলা দিয়ে নিচে তাকালাম। সেদিনকার সেই টবগুলো না! ছোট্ট বাটির মতো লাগছে উপর থেকে। কাগজের টুকরোগুলো নিশ্চিত ভাবেই এই জানলা দিয়েই ফেলা হয়েছে। হয়তো ভদ্রলোক মারা যাবার পর ঘর পরিষ্কার করতে যাবার সময় উড়ে নিচে পড়ে গেছে। কিংবা উনিই লিখে ফেলে দিয়েছেন।
….নিচে কী দেখছ?
তিস্তা এসে পড়েছে কখন যেন।
….না,এই একটু দেখছিলাম..
….তোমার তল্লাশি কদ্দূর?
…
…চলছে ম্যাডাম,কিন্তু ক্রমশ হতাশ হচ্ছি..
বাড়ি ফিরে ছড়াগুলো নিয়ে বসলাম। লেখাগুলোর মধ্যে কোথাও একটা কিছু ঘুরছে। কী সেটা তা না বুঝতে পারলেও একটা কিছু যেন মাথার মধ্যে…
কোথায় গেল নখ
ভেজাস না আর চোখ
সব কি থাকে কন্যে
শুধুই দেখার জন্যে!
মন না দিলে আমার কথায়
খুঁজবি হয়ে হন্যে
তুমিও যেমন মিষ্টি
তেমনটা এই পিস টি
কিন্তু তুমি এও কি জানো
ওর যে সজাগ দৃষ্টি!
তুমি এক গুজুবুজু বুজুবুজু এলে
একদম তাকাবে না। দেব চোখ গেলে।
কী করে তা জানবে না। ওরা যাবে খুঁজে
তারপর ঘুম দিও চক্ষুটি বুজে।
তুরু রুরু তুরু রুরু
আমি লঘু তুই গুরু
আজ থেকে হোক শুরু
প্লাক কর। কই ভুরু?
এই এতগুলো সূত্রের সাহায্যে ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন ভদ্রলোক?
(৫)
আজ নিয়ে প্রায় বারো দিন হয়ে গেল অনুসন্ধানের, একটাও পাথর উদ্ধার করতে পারিনি। আমার প্রতিদিন যাওয়ার পরিশ্রম আর বাসভাড়া, সবটাই পণ্ড হবে মনে হয়। এই কেসটার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি,অনেক ছুটি জমা ছিল তাই। আর দিন তিনেক সময়,তারপর তিস্তাও কর্ণাটক ফিরে যাবে,আমারও অফিস শুরু, তিস্তাদের ফ্ল্যাটে গোপনে রাখা রত্ন পড়ে থাকবে, পড়ে থাকবে গোয়েন্দাগিরির ব্যর্থতা। শর্ত অনুসারে এই কেসের জন্য এক পয়সাও পাব না,উল্টে বদনামের একশেষ।
তিস্তাদের ফ্ল্যাটে বেল দিতে যিনি দরজা খুললেন তাঁর বয়স চল্লিশের সামান্য বেশি হবে, চোখের মোটা কাচের চশমার নিচে চোখদুটো বুদ্ধিদীপ্ত অথচ মায়াবী। হালকা বাদামী রঙের হাউসকোট পরিহিতা মেদহীন ছিপছিপে এই ভদ্রমহিলা কে ঠিক বুঝছি না। তিস্তার মানি? সেরেছে,তাহলে তো কেলেঙ্কারি।
ভদ্রমহিলা হাসিমুখে বললেন,
…তুমি তিস্তার বন্ধু তো? ভিতরে এসো। ওর ঘরে যাও, দেখো না কাল রাত থেকে জ্বর বাধিয়ে বসে আছে।
তিস্তার জ্বর? কী কাণ্ড! জানি না তো!
বিছানায় শুয়ে আছে তিস্তা,লাল কালো জংলা একটা নাইটি ওর পরনে।
…কী হল হঠাৎ?
….আর বোল না। কাল সন্ধ্যেবেলা স্নান করেছি একটু বেশিক্ষণ। তার পরেই হাঁচি শুরু। রাত থেকে টেম্পারেচার। মাঝখান থেকে মানির আজ আর দোকানে যাওয়া হলো না।
…আজ তো তাহলে..
….হুম, সময়টা একদিন কমে গেল,তাই না,? আমারই বোকামি, কেন যে অতক্ষণ ধরে স্নান করলাম….
কথা বলতে বলতে তিস্তার মানি এসে ঢুকলেন, ট্রেতে দুটো চায়ের কাপ আর প্লেটে বিস্কিট নিয়ে।
…তোমার নাম কি?
….কিংশুক,আন্টি।
…চা খাও। তোমরা কথা বলো,আমি সেই ফাঁকে স্নানটা সেরে নিই। সেই থেকে দেখো আমায় বসিয়ে রেখেছে,নড়তেই দেয়নি মেয়ে..ভালো কথা,তুমি লাঞ্চ করবে তো?
….না আন্টি, আমি তো খেয়েই এসেছি,আপনি ব্যস্ত হবেন না। অন্যদিন হবে খন।
….তোমাকে আগে অবশ্য এ বাড়িতে কখনো দেখিনি,তুমি কি…
…ওহ মানি,কাম অন, শুরু হয়ে গেল তোমার অবান্তর কোয়ারিস…
…. ওকে ওকে। চেঁচামেচি করিস না…
আন্টি চলে যেতে বললাম,
…..তোমার বাবা মিথ্যেই এত আশঙ্কা নিয়ে মারা গেলেন। আন্টি কিন্তু খুব কিউট।
আজ আর খোঁজার কাজ হলো না। খুঁজে কিছু পাওয়াও আর যাবে না সম্ভবত। এসব ট্রেজার হান্ট জাতীয় খেলায় কোনোকালেই আমি জিতি না। এবারেও অবধারিত হার। কিছুক্ষণ তিস্তার সঙ্গে গল্প করে চলে আসার আগে একবার ওয়াশরুম গেলাম, আসার সময় দেখি তিস্তার ঘরের দরজা খোলা,তিস্তা ওর মানির কোলে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে নির্ভরতায় শুয়ে আছে, মানি ওর কপালে বিলি কেটে দিচ্ছেন।
আশ্চর্য! বিশ্বাস করেননি অনন্ত মিত্র একজন মাকে!
থাক,এত মণিমাণিক্যের দরকার নেই,তিস্তার সেসব না পেলেও কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
পরের দিন দরজা তিস্তাই খুলল। সাদা একটা ফ্রক পরে আছে,বাচ্চাদের মতো দেখাচ্ছে।
…এসো।
তিস্তার ঘরে গিয়ে দুজনেই বসলাম ওর খাটে।
…আজ তোমার মানি বেরোতে পেরেছেন তাহলে।
….হ্যাঁ, জ্বরটা তো আর নেই। মানিকে বললাম,আজ যাও। তবে বিনুমাসি আজ সারাদিন আছে,মানি বলে গেছে।
…তিস্তা,আই অ্যাম সরি, তোমার কাজটাই হলো না, ট্রাস্ট মি,আমার দিক থেকে চেষ্টার কোনো কসুর….
…ও তিস্তাদিদি, তোমাদের ছুঁচের বাস্কে ছুঁচ নেই কেন?
একজন বয়স্কা মহিলা ঘরে এসেছেন,সাদা শাড়ি,পরিচ্ছন্ন বেশবাস।
…তা আমি তার কী জানি,হঠাৎ ছুঁচের কী দরকার হলো বিনুমাসি?
বাজারের ব্যাগটার একদিকের সেলাই খুলে গেছে,কাল বাজার করে এনে দেখি অর্ধেক ভিণ্ডি নেই, পড়ে গেছে রাস্তায়,একটু সেলাই করব ভাবলাম,জানো তো এখন কোনো দোকানে পেলাস্টিক দিতে চায় না..
ছুঁচ যাবে কোথায়,খোঁজো ভালো করে।
..আরে বাবা না খুঁজে কি আর বলছি, সুতোর বান্ডিল পড়ে আছে,ছুঁচ হাওয়া…
কেউ তো আর জায়গার জিনিস জায়গায় রাখে না, বাবুর স্বভাবও এমনই ছিল..তোমরাও ঠিক তাই,আমার হয়েছে যত ঝামেলা…
বিনুমাসি গজগজ করতে করতে চলে গেল।
….তিস্তা,তোমায় কিছু সাহায্য করতে তো পারলাম না। খুব খারাপ লাগছে। সময়ও তো শেষ হয়ে এল।
….তোমাকেও কোনো পারিশ্রমিক দিতে পারলাম না, আসলে কী বলো তো,আমার নিজের তো আলাদা কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, একটা আছে যেটা বাপির সঙ্গে ছিল,ওটায় আমার কলেজের ফিজটা রেখে গেছে বাপি,আর কিছু টাকা আছে। ক্যাম্পাসিং এ আমি জব পেয়েছি,জব শুরু হলে তখন আর সমস্যা থাকবে না,কিন্তু এই মুহূর্তে তো…
…আরে কী আশ্চর্য, আমি তো কিছু চাইনি,কাজটাই করতে পারলাম না,কোথায় কী যে রেখে গেলেন তোমার বাপি…
…না তুমি চাওনি,কিন্তু তোমার এই কদিনের আসা যাওয়া পরিশ্রম.. কিংশুক তোমায় একটা কিছু দিই,কী দিই বলো তো! আমার প্রিয় কোনো জিনিস দিতে চাই.. আমাদের বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে… তুমি নেবে না?
….বেশ,কী দিতে চাও দাও,আমি যত্ন করে রেখে দেব..
…কিংশুক,আমার কোন জিনিস খুব প্রিয় তুমি তো জানো, তোমার যেটা ইচ্ছে নাও না, বাছাই করার দায়িত্ব তোমাকেই দিলাম..
আজ খিদেটাও তেমন পায়নি। ডিনারে অল্প কিছু খেয়ে আধশোয়া হয়ে খাটে বসে আছি। কী জানি কেন মন খুব খারাপ। গত কয়েকদিন ধরে কেয়াতলা রোডে তিস্তাদের বাড়িতে যাওয়া একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পরশু তিস্তা ফিরে যাবে। আমিও অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। মধ্যে মধ্যে মেসেজ করব ওকে। ফোনও করতে পারি। বড্ড ভালো লেগে গেছে মেয়েটাকে। এটা কি প্রেম? না কি নেহাতই ইনফ্যাচুয়েশন? না কি এখনকার ভাষায় যাকে বলে ক্রাশ? কী জানি..
কখন যেন চোখটা লেগে এসেছিল,ঘুমের চটকাটা ভেঙে গেল,কোমরের কাছে কি একটা ফুটল যেন,বেশ জোরে,ডাই পিঁপড়ে কামড়ালো নাকি,ধড়মড় করে উঠে বসলাম।
কোমরের কাছে কিছু একটা বিঁধছে ..
একি,এটা তো একটা ছুঁচ,বেশ বড়ো গুনছুঁচ, ওটাই ফুটছিল,খাটের মধ্যে ছুঁচ কোত্থেকে এল! আমার ঘরে তো ছুঁচ টুঁচ কিছু নেই ..পায়জামার মধ্যে ছুঁচের মুখটা অর্ধেকটা ঢুকে রয়েছে।
ছুঁচটা ধরে টান দিতেই..
ও মাই গড..
ও মাই গড..
আমার চোখ ছানাবড়া।
ধাঁধাগুলো কী যেন? মনে করি..
তুমি এক গুজুবুজু বুজুবুজু এলে
একদম তাকাবে না। দেব চোখ গেলে।
কী করে তা জানবে না। ওরা যাবে খুঁজে
তারপর ঘুম দিও চক্ষুটি বুজে !
ইয়েস! কী বোকা আমি!
এই সামান্য জিনিসটা মাথায় ঢুকলই না !
…. হ্যালো,তিস্তা, রিডল সলভড!
…..রিডল! কিসের রিডল!
কাল সকালে এসে বলছি সব…একটা রাত ওয়েট করো প্লিজ…
(৬)
দুটো ঝলমলে ঘন সবুজ পাথর হাতে নিয়ে বিস্ফারিত চোখে বসে আছে তিস্তা।
…..কিংশুক,ইউ মিন…কিংশুক, আর দিজ এমারেল্ড?
হ্যাঁ। একেকটা মোটামুটি এই কোয়ালিটির পান্নার প্রাইস এখন অ্যাপ্রকসিমেটলি ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা মতো হবে। আর এই রকম বেশ কিছু জুয়েল যদি রেখে যান মিস্টার সোম,তাহলে তো সেটা র দাম অনেকই হবার কথা…
….. কিন্তু কোথায় পেলে তুমি আর কীভাবেই বা?
বলছি। আগে চলো তোমার পুতুল আই মিন সফট টয়রা আমায় ডাকছে,ওদিকে যাই…
সফট টয়?
ইয়েস। প্রতিটা সফট টয় আমি দেখতে চাই আগে।
কিন্তু…
ওয়েট তিস্তা…
বসার ঘরের ডিভানের উপর রাখা একটা সাদা কুকুরছানাকে তুলে নিলাম হাতে।
….সিজার আছে তিস্তা?
…..আছে,কিন্তু তুমি কি…
…..কিচ্ছু করব না। তুমি দাও না।
কুকুরের কুতকুতে চোখের মণিটার পাশে সেলাইয়ের একটা সুতো দেখা যাচ্ছে। কাঁচি দিয়ে আলতো করে কেটে দিলাম সেলাইটা। মণিটা খুলে এল আর বেরিয়ে এল একটা ঝলমলে লাল পাথর।
….ও মাই গড! দিস ইজ রুবি! ইজ’নট ইট?
…তাইতো মনে হচ্ছে। জুয়েলারি শপ এর মালিকের মেয়েকে আমি জুয়েল চেনাব নাকি?
….কিংশুক,আমার প্রত্যেকটা সফট টয়ের মধ্যেই কি…
….সেটা না দেখে এক্ষুণি বলতে পারছি না।
কুকুরের অন্য চোখ থেকেও বের হলো আর একটি লাল টুকটুকে চুনি।
…তিস্তা আমি একদিক থেকে প্রত্যেকটার চোখ খুবলোতে থাকি, আর তুমি এক এক করে প্রতিটার চোখ সেলাই করতে থাকো,ঠিক যেভাবে আঙ্কল তোমার প্রাণের জিনিসগুলোকে নষ্ট না করে অ্যাজ ইট ইজ রেখে তোমাকে খাজানা দিয়ে গিয়েছেন,ঠিক তেমনি করে।
….কিন্তু কিংশুক ছুঁচ তো নেই..
….আছে,ধরো।
পকেটের মধ্যে সাবধানে প্লাস্টিকে মুড়ে নিয়ে আসা ছুঁচটা ওর হাতে দিলাম।
…এই ছুঁচটাই কাল আমায় রহস্যভেদী বানিয়েছে,নইলে হয়ে যেত ফেলুদাগিরি।
….মানে?
…..মানে পরে বলছি। আগে দেখি তুমি আজ কত টাকার মালকিন হলে। ভয় নেই,এই জেমগুলো সব আঙ্কল নিজের নামে কিনে তোমায় গিফট করে গেছেন, প্রতিটা জুয়েলের ওজন মেপে পার্চেজের বিল টিল সব করা আছে,কাঁচা কাজ কিছু করে যাননি তোমার বাবা। আজ সকালেই নরেশ কাকুকে ফোন করে জেনে নিয়েছি। সম্ভবত অনন্ত বাবুর আলমারির লকারেই সব বিল থাকে ওঁর, সেখানেই এগুলোর পাকা রসিদও পেয়েই যাবে। ইমিডিয়েটলি ব্যাঙ্কে একটা লকার খুলবে নিজের নামে,সেখানে সব পাথর রেখে আসবে।
সারাদিনের চেষ্টায় বেশ অনেকগুলো মহার্ঘ পাথর বেরিয়ে এল টেডি পুতুলদের চোখের মধ্যে থেকে। সব মিলে নেই নেই করেও পঁচিশ তিরিশ লক্ষ টাকা দামের পাথর।
অনন্ত সোম নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স প্রায় শূন্য করে মেয়ের জন্য মণিমাণিক্য জমিয়েছেন,কিন্তু এর রি সেল ভ্যালু কি আশান্বিত হবার মতো? আমার জানা নেই,জুয়েলারির কারিগর হিসেবে মিস্টার সোমের তা জানার কথা। স্ত্রীর জন্য দোকান আর ফ্ল্যাট আছে,তাঁকেও অবশ্য বঞ্চিত করেননি।
তবে মণিমুক্তোর দাম পাক না পাক প্রিয়া আন্টি তো আছেন,তিস্তার মাথার উপরে মণি হয়ে। তিস্তার কিসের চিন্তা!
দু কাপ চা নিয়ে বসেছি দুজনে। তিস্তা খুব এক্সাইটেড।
….প্লিজ বলো না সবটা।
….বলছি শোনো। অসুস্থ হয়ে যাবার পরেই তোমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া শুরু হয় আঙ্কলের। তোমার মানির উপর ভরসা করতে পারেননি,আমি জানি এটা তাঁর ভুল। কিন্তু মৃত্যু যাঁর ঘনিয়ে আসছে তাঁর মন দুর্বল হতেই পারে। উনি ভাবছেন তোমার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করে দিতে না পারলে তুমি বিপদে পড়তে পারো। এই সব ভেবেচিন্তে উনি জেম কিনতে থাকলেন আর তা রেখে যাবার জন্য ইউনিক যে উপায়টা ভেবেছিলেন তা তো দেখলে, কিন্তু এই কাজটা করে যে ধাঁধাগুলো দিয়ে গিয়েছিলেন তা আমার আরও বেশি ইউনিক লেগেছে জানো।
….ধাঁধা!
…হ্যাঁ,ধাঁধা। আঙ্কল তো পাথরগুলো রেখেছিলেন পুতুলের চোখে। তুমি ধাঁধাগুলো শোনো।
আমি কাগজগুলো পকেট থেকে বের করলাম।
….শোনো
কোথায় গেল নখ
ভেজাস না আর চোখ
সব কি থাকে কন্যে
শুধুই দেখার জন্যে!
মন না দিলে আমার কথায়
খুঁজবি হয়ে হন্যে
তুমিও যেমন মিষ্টি
তেমনটা এই পিস টি
কিন্তু তুমি এও কি জানো
ওর যে সজাগ দৃষ্টি!
তুমি এক গুজুবুজু বুজুবুজু এলে
একদম তাকাবে না। দেব চোখ গেলে।
কী করে তা জানবে না। ওরা যাবে খুঁজে
তারপর ঘুম দিও চক্ষুটি বুজে
তুরু রুরু তুরু রুরু
আমি লঘু তুমি গুরু
আজ থেকে হোক শুরু
প্লাক কর। কই ভুরু?
খেয়াল করো,প্রতিটা ধাঁধায় চোখ হলো কমন ফ্যাক্টর। কখনো তা চোখ হিসেবে,কখনো তা দৃষ্টি, কখনো তা ভুরু। আর সেটা বুঝে গেলেই বারবার পড়লে এই সফট টয়ের কথা মনে হবেই..হবে কি না বলো!
….ইয়েস, গট ইট।
….কিন্তু আঙ্কলের দেওয়া এই সূত্রটা আমার চোখকে খুলতে পারল না,সবটাই অর্থহীন হয়ে যেত, যদি তোমার দেওয়া প্যাঁচাটার মধ্যে তোমার বাবা ভুল করে ছুঁচটা রেখে না দিতেন। কাল প্যাঁচাটাকে কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলেই না ছুঁচটা কোমরে বিঁধল আর আমি ছুঁচটা ধরে টান নিতেই প্যাঁচার চোখের সেলাই খুলে এল আর তোমার কান্না বদলে গিয়ে হলো পান্না।
….ইউ আর গ্রেট কিংশুক। বলো তুমি কোনটা চাও।
ফুরফুরে মন নিয়ে ফিরছি। আমি কোনো মণিমাণিক্য দাবি করিনি। গতকাল পান্নাদুটো নিয়েও চেপে যেতে পারতাম না কি!
কিন্তু যে রহস্য আমি ভেদ করিনি তার জন্য পারিশ্রমিক নেওয়া কি উচিত! ধাঁধাও আমি উদ্ধার করতে পারিনি,আঙ্কল ভুল করে ছুঁচ বিঁধিয়ে রেখে এ রহস্যের সমাধান নিজেই করে গেছেন। অন্যায় ভাবে পারিশ্রমিক দাবি করলে আমার পাপ লাগবে না?
এনি ওয়ে,আমার পারিশ্রমিক আমি অবশ্য অন্যভাবে পেয়েই গেছি..
সেই গল্পটা নাহয় আর একদিন হবে।
শেষ
খুব ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা রইল।