দীর্ঘ কবিতাঃ জল-পোকা – অনিরুদ্ধ সুব্রত

জল-পোকা
অনিরুদ্ধ সুব্রত

মানুষের জন্ম নিয়েছি আমরা পৃথিবীতে
আরও কত শত ইতর জন্ম ছিল,
মানুষের পরিচিত পাঠশালা মতে
আমাদের বসতে হয়েছে, দাঁড়াতে হয়েছে
তোমাকে আমাকে —
বলেছি, নদী হ‌ও,পারে বসি
বলেছি, যাপন লিখব— ফকিরের জবানিতে,
অথচ দেখেছি– শ্যাওলা বাণিজ্যের ঘরে
সেই প্রত্ন-প্রবাহ, থেমে গিয়ে থেকেছে মরে,
শিকলে বেঁধে রাখা আঘাটের নৌকোর মতো
কাদায় পচনের পাটাতনে আধ-ডোবা
খেলেছে আমাদের বুকের পরে,শুধু জল-পোকা ।

মানুষের জন্ম নিয়েছি আমরা পৃথিবীতে
হাজার মাথার ভিড়ে বারবার হারিয়ে যেতে,
কিছুতেই যেন মুখোমুখি হতে নেই
এমন‌ই খেলার কাছে বন্ধক রেখে
সময়কে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি দেহ-মনে,
তারপর অযাচিত স্বপ্নের প্রান্তরে
পাখি-জন্ম নেমেছে এক পথ-গাছের শাখায়
ক্লান্ত দুপুরে, সৃজনের স্বপ্ন-পুরে
গাছ বলেছে, বাসা আছে ? পাখি বলেছে দূরে
পাখি বলেছে, উড়তে পারো ?
—গাছ বলেছে, নোঙর ফেলা যে শিকড়ে,
মানুষের জন্মের এই পৃথিবীর অব্যর্থ বা ব্যর্থতা
সব যেন আগে থেকে সংবিধানেই আছে
নাগালের সীমান্তে দাঁড়ালে, খর্ব টের পায়
যখন বোধ যায় আসল সত্যির কাছে,
নগরের নাগরিক পাখি—পালকে, ডানায়
যতবার বলো— ‘ভালো আছি’
কালো মেঘ আর ধুলো বাতাসের ঝড়ে
উদ্ভ্রান্ত প্রতিদিন, প্রত্যহ ধূ ধূ মাঠে ন্যাড়া মাথা ওড়ে, নিচু নিচু মানুষের উঁচু উঁচু ঘরে ।

মানুষের জন্ম নিয়েছি আমরা পৃথিবীতে
এই চির ক্ষমা-হীন অপরাধে
আমরা চিনি নি আমাদের কোন‌ও মতে,
জানার খবরের ছোটো ছোটো কলামে কেবল
নজর এড়াবার অছিলার মতো করে রাখা ছিল,
ছিলাম নিষিদ্ধ-বিজ্ঞাপনের আশেপাশে —
জুড়ে গেছি অজস্র এড়ানো খবরের ঘন হরফে
ভাঁজ করে রেখে দেওয়া সম্পর্ক কবরে,
হয়তো, মানুষের জন্ম নিয়েছি আমরা
ভুল করে শুধু সেই মানুষের‌ই ভিতরে।

মানুষের জন্ম নিয়েছি আমরা পৃথিবীতে
দেখেছি, স্বপ্নের নদীতে ধ্বংসের বাঁধ উঠে গেছে
ঝড়ে জলে উত্তাপে ভবঘুরে ফকির, মরেছে অপঘাতে, অথবা স্তব্ধ নদীতে
ডুবে থেকেছে আকন্ঠ পাঁকে সাধ-নৌকো জন্মে,
স্রোত-হীন মরা নদী ধীরে—মানচিত্র থেকে
মুছে মুছে গেছে, অপেক্ষাকৃত লঘু দাগে—
তবু অন্ধকারে কোন‌ও এক নক্ষত্র লক্ষ্য করে
আলোর উৎস আবিষ্কারের মন্ত্র, যন্ত্র বারংবার হাতড়ে মরেছি, হয়তো পেয়েছি— হয়তো নয়,
সুড়ঙ্গের দুই মুখে দুইটি গাঁইতির খনন চলেছে
যা ভুল গহ্বরে গিয়ে শেষমেষ হেরেছে,
কালো খাদ থেকে জমাট কয়লার উত্তোলনে, জ্বলে পুড়ে শেষ হবে বলে, জমে থাকা যত,
তুলেছি নষ্ট কষ্ট খনিজ
আপ্রাণ এই পৃথিবীতে মৃত বারুদে উষ্ণতা দিতে
সব প্রত্ন-প্রাচীন চাপাপড়া সবুজের আগুন
জীবনের কোনও কাজে যদি লাগে
হয়তো বা ইচ্ছের বায়নায়, বিনা কাজে
শুধু তা ভিজে হয়ে আজ অথর্ব স্তূপের আধারে
আছে পড়ে, শব রয়ে গেছে, সন্ধান রাখিনি—
তবুও আমরা, তুমি ও আমি, গাছ বা পাখিতে
নদী বা ফকিরে, ভালবাসার মাঝখানের সব দমবন্ধ অন্ধকারকে, এতটুকু সরাতে পারিনি।

One thought on “দীর্ঘ কবিতাঃ জল-পোকা – অনিরুদ্ধ সুব্রত

Leave a Reply to Soumi Chakraborty Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *