ভাল্লাগছেনা
অনিরুদ্ধ সুব্রত
” মানব হৃদয় সিন্ধু তলে যেন নব মহাদেশ সৃজন হতেছে পলে পলে, আপনি সে নাহি জানে। শুধু অর্ধ-অনুভব তারি ব্যাকুল করেছে তারে; মনে তার দিয়েছে সঞ্চারি আকার-প্রকারহীন তৃপ্তিহীন এক মহা আশা—-
প্রমাণের অগোচর, প্রত্যক্ষের বাহিরেতে বাসা ।তর্ক তারে পরিহাসে, মর্ম তারে সত্য বলে জানে; “
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(কবিতা: সমুদ্রের প্রতি)
আজ আমরা ‘ভাল্লাগছেনা’-র মহাদেশ সৃজন করেছি। তর্ক থাকতে পারে সৃজিত হয়েছে। পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত ‘করোনা’ নামক ভিলেনটি শুধু মাত্র মানুষ খুঁজে খুঁজে আক্রমণ করে চলেছে। তারপর এক এক করে প্রাণবায়ু কেড়ে নিয়ে মেরে চলেছে। সত্যি বলতে কি, পৃথিবীর মানুষ নামক প্রাণিটি এখনও পর্যন্ত সেই ভয়াল দানবের সঙ্গে একটা ছায়া যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের পক্ষে এই যুদ্ধের মারণ-অস্ত্রটি এখনও তার হাতে নেই। ফলে পলকা তলোয়ার দিয়ে ভয়াল দানবের বিরুদ্ধে ছায়া-যুদ্ধের প্র্যাকটিজ চললেও, জয়লাভ এখনও আকার-‘প্রকারহীন তৃপ্তিহীন এক মহা আশা।’
প্রতিদিন সকালে উঠোনের ফুলগাছে যখন এক ঝাঁক প্রজাতির ওড়াউড়ি দেখি, যখন বৈশাখী বিকেলে মেঘের চিঠি আসতে দেখি, যখন ভরা ধানক্ষেত থেকে পাকা ধানের গন্ধ নাকে আসে, বুঝতে এতটুকু ভুল হয় না—- ওদের প্রত্যেকের মহাদেশটা ঠিক ঠিক আগেরই মতো আছে। মরণ অসুখে কেবল মানুষ পড়েছে। মানুষই ভুগছে, আর্তনাদ করছে, নিজের অধীগত জ্ঞানের কাছে ভিক্ষা চাইছে মুক্তি। এ যেন মনুষের মহাদেশে চরম সংকটকাল। অথচ সে হাত পাতবে কার কাছে আর, নিজেকে রক্ষার দানে !
‘অক্সিজেন’ নামক বায়ুর বিশেষ উপাদানটি একমাত্র মানুষই বোতলবন্দী করতে শিখেছে। জ্বলনের কাজে লাগিয়েছে সে । উত্তাপ আর গালনের কত কি যে জেনে গেছে মানুষ। শুনেছি অক্সিজেনের দখলে এগিয়ে থাকা মানুষের কাছে মাঝে মাঝে হাত পাতে অবশিষ্ট গাছের মহাদেশ।
অথচ বড় অসহায় সেই দখলী মানুষ আজ। যার নিজস্ব সংবিধানে পৃথিবীর সতীর্থ প্রাণের প্রতি সহমর্মিতা প্রায় শূন্য। কেবল দুচোখে তার জ্বল জ্বল করছে দখল। কিন্তু সেই আধিপত্য আশা কতখানি আত্মঘাতী গোল দেবে, কখনও ভেবে দেখেনি সে।
একটাই তো ঠিকানা, মানুষের মহাদেশ। একটাই তো পৃথিবীর বেশি তার বসবাস নেই। চাঁদ বা মঙ্গলপুরে সে বেড়াতে যেতে পারে, কিন্তু ফিরতে হবে গঙ্গা, টেমস অথবা নীল নদের পারে। অথচ কী আশ্চর্য দিন আজ মানুষের মহাদেশে ; ক্রমে কোন ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র আনুবীক্ষণিক শত্রুর চরম অত্যাচারে তছনছ একটা মাইক্রোফোন ফোকা, ইলেকশন করা, অহং সর্বস্ব মানুষের মহাদেশ।
প্রতিদিন ঝাঁক ঝাঁক, নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলা এই প্রাণিটি হারাচ্ছে। প্রতিদিন এখনও বেঁচে থাকাদের মনে বিভিষিকা, চোখে নিরুপায় কান্না।
মুক্তির পথ নিয়ে একমাত্র মানুষই হয়তো ভেবেছে বেশি। তার সখের ধর্ম, দেবতা, ভাগ্য বোধ সবই আছে। আছে হাজার মিথ থেকে নবতর মিথ্যে। রাজনীতি বিজ্ঞান মিলেমিশে আছে দারুন বাণিজ্য। তবু সারিয়ে তোলা থেকে সেরে ওঠার পরিকল্পনা রোজ রোজ শানাচ্ছে নতুন মিছিল।
তাই মানুষ নামক প্রাণিটির বেঁচে থাকার বাইরে যতই কালচার থাক ,যতই সৃজন সৃজন করে উত্তেজনা থাক। আসলে একটা শুয়োপোকার মতো বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা আজ সবচেয়ে বড় । ঝড়ে উড়ে যাওয়ার সময় নিতান্ত গাছপাতাদের মতো।
মানুষের মহাদেশে আজ অনেকেই বুঝে গেছে,অসুখ আর মৃত্যুর আক্রমণে মানুষই হচ্ছে শেষ। বাঘ সিংহ কেঁচো কেন্ন সকলেই হয়তো স্বপ্নে আছে,কেবল মানুষ বলছে ভাল্লাগছেনা।
সভ্যতায় মানুষের আগমনের পরে এমন অস্তিত্ব সংকটে মানুষের মহাদেশ, আজকে মানুষই ভাবতে পারছে না। কবিতা, গল্প, সিনেমা, সংগীত বহু কায়দা বানিয়ে মানুষের ভালোলাগার সংকীর্তন হয়েছে। আজ যেন কন্ঠ রুদ্ধ, আঙুল ছুঁচ্ছে না কলম। প্রত্যেক মনুষ্য-প্রাণে একটাই শ্লোগান— ভাল্লাগছেনা।
যদিও পৃথিবীটা মানুষের একার নয়, ফলে পাখি অথবা মাছেদের মহাদেশ কী ভাবছে জানিনা।
—– অনিরুদ্ধ সুব্রত, ৬.৫.৪
ভীষণ ভালো লিখেছেন। এমন বিপন্ন মানুষের অবস্থা যে গাছ পাখিরাও হয়ত শোক করছে।
খুব ভাল লেখা।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ কেবল পকেট ভরার জন্যে পাপ করে নিজেদের শেষ করে ফেলছে। যাদের পকেট নেই সেই সব পশুপাখি কিন্তু নিরাপদে ই আছে।