আমার রবি ঠাকুর
কৃত্তিকা ভৌমিক
অত্যন্ত সাধারণ মানুষ হিসেবে বলতে পারি আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ এক অপার বিস্ময়!! ভেবে ভেবেও কূল পাইনা যে একজন মানুষ কি একাধারে এতকিছু হতে পারে!! তাই আমার তাঁকে ঈশ্বর মনে হয়।
“আমার রবীন্দ্রনাথ” বলতে গেলেই ছোট থেকে পাওয়া কিছু স্মৃতি চোখের সামনে হুড়মুড় করে চলে আসে।
আমাদের বাড়িতে বিশাল বড় একটা রেডিও ছিল। আমার বাবার বড়ো শখের ছিল সেই রেডিও। সকাল ছটা বাজলেই আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠান শুরু হত। দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম গান আমরা শুনতাম। যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদের গান, রজনীকান্তর গান, আধুনিক গান। শুনে শুনে প্রায় মুখস্থ হয়ে যেত। তবে অন্যান্য গানের তুলনায় রবীন্দ্রসংগীত শুনতে বেশি ভালো লাগত কেন জানি না! যদিও রবি ঠাকুরের কত গানের শব্দের কোনও মানেই তখন বুঝিনি।
যেমন “সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা, মোরা সুরের কাঙাল” ভাবতাম সুরের আবার কাঙাল হয় নাকি!!
“তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে, সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে” এই গান শুনে কিছুতেই ভেবে পেতাম না সুরে আগুন ধরে কি করে!!
খুব ছোট্ট তখন। আরও কত কত গান এভাবে মনকে নাড়া দিত। কোনদিন অবশ্য কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি। বড় হয়ে যখন গানগুলো শুনে অনুধাবন করেছি তখন বুঝেছি কি তার অপূর্ব অর্থ!
আমার দিদিরা গান শিখত। আমাদের বাড়ি বরাবর একটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ছিল। মা খুব গান ভালোবাসতেন। নিজে গান করতেন না কিন্তু দিদিদের খুব উৎসাহ দিতেন। আমার বড়দি, মেজদি খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। দিদিরা, তাদের বন্ধুরা সবাই মিলে নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্যের রিহার্সাল দিত বাড়িতে। এখনও মনে আছে “মায়ার খেলা” “চিত্রাঙ্গদা” নৃত্যনাট্যের মহড়া দেখতাম, কিছু বুঝি না বুঝি ভালো লাগত। আমাদের পাড়ায় “ডাকঘর” নাটক দেখেছি। অমলের জন্য মন কেমন করত কিন্তু মনে মনে আমি সুধা হয়ে যেতাম।
তারপর “সহজপাঠ” দিয়ে পড়াশোনা শুরু হল। পরে পাঠ্যক্রমের বাইরেও অনেককিছু পড়েছি। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা। আরও কত কত বাকি। মহাসমুদ্রের জল কি ঘটি ঘটি করে মাপা যায়!!
আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন স্কুলের দিদিমণি বললেন “সাগরিকা” কবিতাটি নাচের মাধ্যমে মঞ্চস্থ করতে হবে। “সাগর জলে সিনান করি, সজল এলোচুলে, বিসিয়াছিনু উপল উপকূলে” সেই হলুদ রঙের শাড়ি আর লম্বা পরচুলা পরে। উফফ কটা রাত যে ঘুমোতে পারিনি উত্তেজনায় সে কথা ভাবলে এখনও ভালো লাগে। কিছুই বুঝিনি সেই কবিতার অর্থ তবে দিদিমণির নির্দেশ মতই সব করেছি। ভীষণ ভালো লেগেছিল।
এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ সাথে নিয়েই বড় হয়েছি। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় গরমের সন্ধ্যায় হস্টেলের সামনের মাঠে বসে আমরা গান, কবিতা আবৃত্তি এসব করতাম। আমার এক বন্ধু ছিল মৌসুমি। কি ভালো যে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। ওর গাওয়া অনেক গানের মধ্যে “গানগুলি মোর শৈবালেরই দল” এখনও কানে বাজে।
সেই দিনগুলো তো আর ফিরে পাব না কিন্তু রবি ঠাকুরের গানের মধ্য দিয়ে সেই সময়টা আমার মনে সারাজীবন রয়ে গেল।
জীবনের সবরকম অনুভূতির প্রকাশ আছে তাঁর বিভিন্ন গানে। প্রেম, বিরহ, আনন্দ, কষ্ট সব অনুভূতির জন্য তাঁর গানই আশ্রয়। তাঁর গানে আনন্দ যেমন উপভোগ করি তেমনই দুঃখকেও একইভাবে জয় করতে পারি তাঁর গানের মাধ্যমে।
জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে আজ গীতবিতান ও সঞ্চয়িতা পড়তে সবথেকে বেশি ভালো লাগে। বারবার পড়েও আশ মেটে না। অনেক গান ও কবিতা যেন মনে হয় আমারই মনের কথা। আমি জানি রবীন্দ্র অনুরাগী সকলেরই এমন কথা মনে হয়।
সুখেও যাকে অন্তরে পাই, দুঃখেও যে থাকে অন্তরে, তাকে প্রাণের ঠাকুর ছাড়া আর কিইবা বলব। রবীন্দ্রনাথ হলেন আমার “প্রাণের ঠাকুর”।
এভাবেই রবি ঠাকুর আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। খুব ভালো লাগলো এই স্মৃতি আলেখ্য।
ধন্যবাদ
একদম সহমত । রবিঠাকুর আমাদের প্রাণের ঠাকুর । খুব ভালো লাগলো । অনেক শুভেচ্ছা রইলো ।
ধন্যবাদ