পেনেটির বাগানবাড়ি
সত্যকাম বাগচী
[”এই বাগানবাড়িটি ছিলো প্রখ্যাত ব্যাবসায়ী রামদুলাল দে’র ব্যাবসায়ী পুত্র আশুতোষ দে’র। বাড়িটির নাম ছিলো ”মোক্ষধাম”।তবে ওখানকার অধিবাসীরা বলতেন ”ছাতুবাবুর বাগানবাড়ি”, কারণ আশুতোশ দেব পরিচিত ছিলেন ‘সতুবাবু’ বা ‘ছাতুবাবু’ নামে।
ময়মনসিং জেলার শেরপুর (অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত।) এর জমিদার গোবিন্দ কুমার চৌধুরী বাড়িটি ক্রয় করেন ২২ শে ফেব্রুয়ারী ১৮৮৬ তে।তার ছেলে গোপাল দাস চৌধুরী ১৯২৮ এর ২৯ শে মার্চ বাড়িটি হস্তান্তর করেন এক বোর্ড অফ ট্রাষ্টীর ওপোর তার পিতার নামে একটি দুস্থ্য মহিলাদের জন্য একটি নিবাস, ”গোবিন্দ কুমার হোম” তৈরী ও তার সুষ্ঠ পরিচালনার জন্য।এই বাড়িটি এখন হেরিটেজ ভবন হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।” ]
(– সূত্র: panihatimunicipality ওয়েবসাইট।)
এখন কোভিডে আক্রান্ত পুরো ভারতবর্ষ। সকল ভারতবাসীর এখনও প্রতিষেধক টীকাকরণে অনেক দেরী। মহামারী বা নানা রোগের প্রকোপে অতীতেও এই দেশ বিশেষতঃ আমাদের বাংলা জর্জরিত হয়েছে।
১৯১১ সালের ভারতবর্ষ। কলকাতাসহ নানা জায়গায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে প্লেগ। চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে অগণিত মানুষ। অসহায় মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে প্লেগের হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ভগিনী নিবেদিতা। হঠাৎ ১৩৯ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিট থেকে একটি চিঠি এল। এই ঠিকানায় ববিবাবুর পরিচিত কেউ থাকে না। তবে চিঠি খুলে তিনি দেখলেন,–
সেটি লিখেছেন অকৃত্রিম সুহৃদ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। চিঠিতে তিনি লিখেছেন:
‘উপরের ঠিকানা হইতে বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আমি পলাতক প্লেগের অনুগ্রহে। আমার একজন ভৃত্য ছুটি লইয়া একদিন বড়বাজার গিয়াছিল। সেখান হইতে আসিয়া একদিন পরেই প্লেগ হয়। আর ৩০ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু। বাড়ি ছাড়িয়া উক্ত ঠিকানায় আছি। কতদিন পলায়ন চলিবে জানি না।’
জীবদ্দশায় ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, প্লেগ, ডেঙ্গু’র মতো প্রাণঘাতী বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সাহিত্যকর্মে এসব মহামারির জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে।
গত শতাব্দীর প্রারম্ভে গুটিবসন্তে ভারতবর্ষে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে। এই মহামারিতে প্রাণ হারায় অগণিত মানুষ। রবীন্দ্রনাথের ‘অভিসার’ কবিতায় রাজনর্তকী বাসবদত্তা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল। কবির ভাষায়,
‘নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ//রোগমসী-ঢালা কালি তনু তার//লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখার//বাহিরে ফেলেছে করি পরিহার বিষাক্ত তার সঙ্গ।’
সন্ন্যাসী উপগুপ্ত এই দুঃসময়ে সেবা করে বাসবদত্তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতায় পুরাতন ভৃত্য কেষ্টার মৃত্যুও হয়েছিল গুটিবসন্তে আক্রান্ত মনিবকে মনপ্রাণ দিয়ে সেবাযত্নের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলার পর। চতুরঙ্গ উপন্যাসের জ্যাঠামশাই প্রতিবেশীদের কাছে পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘নাস্তিক’ হিসেবে। যখন প্লেগের আক্রমণে সবাই দিশেহারা হয়ে নিরাপদ স্থানে পালাচ্ছে, তখন তিনি দায়িত্ব নিলেন অসহায় চামারদের নিরাপত্তা বিধানের। নিজের বাড়িতে প্লেগ রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল স্থাপন করলেন। মুসলমান ও গরিব রোগীদের সেবা করতে করতে নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায় অবনীন্দ্রনাথের শিশুকন্যা। অসংখ্য পরিবারে তখন মৃত্যুর আওয়াজ। হননের কালে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,—
‘’…ম্যালেরিয়া-প্লেগ-দুর্ভিক্ষ কেবল উপলক্ষমাত্র, তাহারা বাহ্য লক্ষণমাত্র—মূল ব্যাধি দেশের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। আমরা এতদিন একভাবে চলিয়া আসিতেছিলাম আমাদের হাটে বাটে গ্রামে পল্লীতে আমরা একভাবে বাঁচিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলাম, আমাদের সে ব্যবস্থা বহুকালের পুরাতন। তাহার পরে বাহিরের সংঘাতে আমাদের অবস্থান্তর ঘটিয়াছে। এই নতুন অবস্থার সহিত এখনো আমরা সম্পূর্ণ আপস করিয়া লইতে পারি নাই; এক জায়গায় মিলাইয়া লইতে গিয়া আর এক জায়গায় অঘটন ঘটিতেছে। যদি এই নতুনের সহিত আমরা কোনোদিন সামঞ্জস্য করিয়া লইতে না পারি তবে আমাদিগকে মরিতেই হইবে।’’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একেবারে বালকাবস্থায় ১৮৭২ সালে ডেঙ্গুজ্বরের মহাপ্রকোপের কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে রবীন্দ্রজীবনে বালক রবির প্রথম ‘বাহিরে যাত্রা’, বাংলার পল্লি ও প্রকৃতির সঙ্গে প্রথম পরিচয়৷ সেকথার রেশ ধরে বিখ্যাত
‘’পেনেটির বাগানবাড়ি’’ নিয়ে কিছু কথা।

‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,—
‘’একবার কলিকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের তাড়ায় আমাদের বৃহত্ পরিবারের কিয়দংশ পেনেটিতে ছাতুবাবুদের বাগানে আশ্রয় লইল৷ আমরা তাহার মধ্যে ছিলাম৷ এই প্রথম বাহিরে গেলাম৷ গঙ্গার তীরভূমি যেন কোন পূর্বজন্মের পরিচয়ে আমাকে কোলে করিয়া লইল৷’’
১৮৭২ সালের মে মাসে, গ্রীষ্মকালে কলকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ হলে অনেক সম্পন্ন পরিবারের মতোই ঠাকুর পরিবার পানিহাটির একটি বাগানবাড়িতে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণ করেছিল৷
আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বিভিন্ন সময়ে বহু স্থানেই সময় কাটিয়েছেন। সেরকমই নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কবিস্মৃতি বিজড়িত নানা স্থানের মধ্যে অন্যতম হল এই ‘পেনেটির বাগানবাড়ি’ যা ‘ছাতুবাবুর বাগানবাড়ি’ নামেও পরিচিত।
এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ চারবার এসেছিলেন। প্রথমবারের পানিহাটির বা পেনেটির এই বাগানবাড়িতে আসা তিনি সারা জীবনে ভুলতে পারেন নি।
১৮৯৫ সালের ৫ জুলাই তিনি তাঁর ভাইঝি ইন্দিরাদেবীকে লিখেছিলেন –
‘ছেলেবেলায় পেনেটির বাগানে থাকতুম। পাশে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির থেকে দিন রাত্রির মধ্যে তিন-চারবার করে নহবত বাজত। আমার তখন মনে হত, আমি বড় হয়ে স্বাধীন হওয়া মাত্রই একটা এইরকম নহবত রাখব…..।’
১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যালীলা চালাল ব্রিটিশ সরকার। এই ঘটনার খবর পেয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মন অশান্ত হয়ে ওঠে। শান্তির খোঁজে তিনি প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে সঙ্গে নিয়ে কিছুদিনের জন্য এই বাড়িতে চলে আসেন। তখন তাঁর বয়স আটান্ন বছর। এটাই তাঁর এই বাড়িতে দ্বিতীয়বার আসা।
এর প্রায় দশ বছর পর কবি তৃতীয়বারের জন্য আবার এই বাড়িতে আসেন। তখন এই বাড়িটির নাম গোবিন্দ হোম। অনাথ ছোট শিশুদের জন্য খোলা হয়েছিল একটি অনাথ আশ্রম। এই আশ্রম তৈরি করে দিয়েছিলেন ময়মনসিংহের শেরপুরের জমিদার গোপাল রায়চৌধুরী। তিনি পিতা গোবিন্দ রায়চৌধুরীর নামে আশ্রমের নামকরণ করেছিলেন। কবিগুরু এসেছিলেন আশ্রমের এক অনাথ বালিকার বিবাহ উপলক্ষে। সেবারে সঙ্গে ছিলেন ভাগ্নী স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা দেবী চৌধুরানি। সেই সময় আশ্রমের লোকেরা কবিগুরুকে দিয়ে ঘাটের কাছে একটি আম গাছ পুঁতিয়েছিলেন। গাছটি আজও আছে।
এরপর ১৯৩৪ সালে বাসন্তী কটন মিল উদ্বোধন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িতে শেষবারের মতো এসেছিলেন। মনে করা হয় জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও সেই বালকবেলার বাড়ির চারদেয়ালের বাইরের সুখস্মৃতি, বাংলার উদার পল্লীসমাজ বারাবার তাঁর মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। তিনি তাঁর মৃত্যুর সাত মাস আগে লেখা ‘আরোগ্য’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় এগারো বছর বয়সে প্রথম দেখা এই বাড়িটির পারিপার্শ্বিক পরিবেশের পরিচয় দেন। আজকের শহরায়নের যুগেও রোগের প্রকোপে খুঁজে পাওয়া বালক রবির সেদিনের পানিহাটির এই বাড়ির পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে সেইসব ইতিহাসের ছোঁয়া।
পরিশেষে আবার বলি, করোনা বিপর্যয় আমাদের সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। মানুষ সামাজিক জীব। সংঘবদ্ধতাই মানুষের ধর্ম। অথচ সামাজিক দূরত্ব তথা বিচ্ছিন্নতাই এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, সর্বোপরি ধরণির স্বার্থে এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের সামঞ্জস্যবিধান করতেই হবে।
‘’যদি এই নতুনের সহিত আমরা কোনোদিন সামঞ্জস্য করিয়া লইতে না পারি তবে আমাদিগকে মরিতেই হইবে’’—রবীন্দ্রনাথের এই সাবধানবাণী কাকতালীয়ভাবে বর্তমান মহামারির সময়ে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।।
–সত্যকাম বাগচী।
একজন নাট্যকর্মী, আবৃত্তি শিল্পী, ভ্রমণপিপাসু ও রবীন্দ্রপ্রেমী।
খুব সুন্দর লেখা। সত্যকাম বাবুকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
মূল্যবান লেখা। সম্মৃদ্ধ হলাম।
অনেক কিছু জানতে পারলাম । মূল্যবান লেখা। সমৃদ্ধ হলাম ।