প্রবন্ধঃ বিশ্বকবির দেশ প্রেমের ধারা – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

বিশ্বকবির দেশ প্রেমের ধারা
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

অতীতকালে ভারত ভূখণ্ডকে সংহত করে জাতীয় জীবনে ঐক্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতেন অনেকেই। সবাই যে ভারতীয় মানুষের মধ্যে ঐক্য সংহতি নিঃস্বার্থ ভাবে করার পরিকল্পনা করতেন তা নাও হতে পারে।
আমাদের ভারতের প্রয়োজন আগে জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা করা। আসলে এই ‘ জাতীয় সংহতি ‘ শব্দ অভিধানের না ওল্টানো পৃষ্ঠা থেকে তুলে আনতেই হবে। বিশেষ করে বর্তমানের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে জাতীয় সংহতি কথাটা এড়িয়ে ভেদ বিভেদের বিষ ছড়ানো হচ্ছে, এরকমটা মনে হতেই পারে।
যাঁরা নিজের দেশকে ভালবাসেন তাঁরাই জাতীয় সংহতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ জন্য দেশ বা স্বদেশ ভাবনা এক আন্তরিক ভাবনা হতে হবে।
আমরা আমাদের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ কি ভাবনায় ভাবিত হতেন সেকথা আগে আলোচনা করে নিই।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ জন্মজয়ন্তী পালন উপলক্ষে তাঁর দেশ তথা স্বদেশ প্রেমের ধারা নিয়ে আলোচনা করার সময় মনে পড়ে তিনি ছিলেন বিশ্বকবি। শুধু ভৌগোলিক দেশ নয়, দেশ এবং সমগ্ৰ ভূখণ্ডকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন । তাঁর হৃদয়ে, বিশাল প্রশস্ত হৃদয়ে অফুরন্ত ভালোবাসা তিনি পোষণ করতেন, তাই তিনি বলেছেন সকলের দুঃখ বেদনার কথা, সকলের সুখের কথা, সকলের সুন্দরের কথা –
আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত ওঠে ধ্বনি
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি। …..

একথা নতুন নয় যে, জাতি ধর্ম ভাষা সম্প্রদায় নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম সনিষ্ঠ দায়িত্ববোধ, সর্বজনীন প্রেম আর শুভকামনা। এই বৈচিত্র্যময় বিশ্বে যেখানে যতদুঃখ,আনন্দ,যন্ত্রণা, যত পরাজয়, যত বিজয়, সব কিছুই তাঁকে স্পর্শ করত। এসবের বিক্রিয়ায় কখনো হতেন উদ্বেলিত, হতেন বিহ্বল, হতেন ব্যথিত। কখনো নীরবে দুঃখানলে দগ্ধ হতেন। আবার সোচ্চার হয়ে বিদ্রোহে প্রতিবাদে সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলতে চাইতেন, হাতে তুলে নিতেন তাঁর অমর লেখনী।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গীতাঞ্জলিরও কবি। গীতাঞ্জলির শুধু অধ্যাত্ম চেতনাই নয়, তাঁর নিজের দেশ ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষের সব মানুষের এবং তাঁদের সকলের একত্রিত হয়ে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র ও নিরস্ত্র হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে বলিদানে প্রস্তুতি – এসব নিয়ে অজস্র গীত রচনা করেছেন।

এক ভারত চিন্তায় আন্তরিক কবি অকৃত্রিম আবেগে ও আশায় গেয়েছেন অবশ্যই বঙ্কিমচন্দ্র কৃত বন্দেমাতরম্ মন্ত্রকে স্মরণে রেখেই –
এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন,
এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন
বন্দেমাতরম্।……

কবির দৃঢ় প্রত্যয় –

  • টুটে তো টুটুক এই নশ্বর জীবন
    তবু না ছিঁড়িবে কভু এ হৃদয় বন্ধন-
    বন্দেমাতরম্।……

সঙ্ঘবদ্ধ জাতীয় আন্দোলনের শুভযাত্রায় তিনি গেয়েছেন ও গাইতে বলেছেন –
….আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।….
আমরা কারা ? অবিভক্ত ভারতবর্ষের মানুষ। সেখানে ধর্ম জাতি সম্প্রদায় নির্বিশেষে আমরা এক সূতোয় বাঁধা ভারতীয় মানুষ। আমরা যে যেখানেই থাকিনা কেন, আমরা যা-ই মত পোষণ করিনা কেন, যে ভাষাতেই কথা বলিনা কেন, আমাদের মধ্যে এক অন্তর্নিহিত বাঁধনে আমরা এক হয়ে আছি। এই বাঁধনের নাম জাতীয় সংহতি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনী –
…..যেথায় থাকি যে যেখানে বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে,
আবার –
…কতদিনের সাধন ফলে মিলেছি আজ দলে দলে–
আজ ঘরের ছেলে সবাই মিলে দেখা দিয়ে আয়রে মাকে।

উনিশশো ছয় সালে প্রকাশিত ভারতবর্ষ গ্রন্থে নববর্ষতে বলেছেন – আজ নববর্ষে এই শূন্য প্রান্তরের মধ্যে আর একটি ভাব আমরা হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করিব। তাহা ভারতবর্ষের একাকিত্ব। এই একাকিত্বের অধিকার বৃহৎ অধিকার। ইহা উপার্জন করিতে হয়। ইহা লাভ করা, রক্ষা করা দুরূহ। পিতামহগণ এই একাকিত্ব ভারতবর্ষকে দান করিয়া গেছেন। ….”

বিজয়া-সম্মিলন প্রবন্ধে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বাংলার মানুষের মিলনের আকাঙ্খা প্রত্যক্ষ করেছেন বঙ্গভঙ্গ রোধের আন্দোলনে।…..তিনি সমস্ত দেশকেই ‘ আমি ‘ বলে জানতে চেয়েছেন।

কবিগুরুর কাছে দেবত্ব পুরাণ বা অন্যান্য বিশ্বাসের শাস্ত্রের অতি মানব দেবতাদের চরিত্রের মত নয়। দেবত্ব তাঁর কাছে ছিল মনুষ্যত্ব। তাই তিনি আগে চরিত্রবলের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন – আমরা দলাদলি ঈর্ষা ক্ষুদ্রতায় জীর্ণ। আমরা একত্র হ ইতে পারিনা, পরস্পরকে বিশ্বাস করিনা। আপনাদের মধ্যে কাহার ও নেতৃত্ব স্বীকার করিতে চাহিনা।”
‘দেশ’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে আবেগ থাকে তাতে সবটাই থাকে অকৃত্রিমতা। কিন্তু, দেশের জন্য কিছু করে ফেলার মধ্যে আবেগ যথেষ্ট তাতে থাকলেও তাতে অনেক সময়ই থাকতে পারে অপরিণততা। একটা বিরাট যুদ্ধের প্রয়োজন তো শুধু আবেগ দিয়ে মেটানোর কাজ নয়। প্রয়োজন প্রস্তুতির, প্রয়োজন প্রতিজ্ঞার আর প্রতীক্ষার।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর শারদোৎসব নাটক রচনার আগে মনে করতেন ” …আমাদিগের সকল দাবিই আমাদিগকে জয় করিয়া ল ইতে হ ইবে – হীনতার দ্বারা নহে, কিন্তু মহত্বের দ্বারা, মনুষ্যত্বের দ্বারা।”

ভারতবর্ষের নায়ক হবেন যিনি তা নিয়ে কবিগুরুর ভাবনা জীবন্ত হয়ে উঠেছে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগী সর্বত্যাগী সর্বজয়ী সন্ন্যাসী রূপে।

কবির একান্ত প্রিয় ভারতবর্ষ সম্পর্কে ‘রাজা প্রজা ‘ গ্রন্থে ভারতবর্ষকে নানান বৃহৎ শক্তির মিলন তীর্থ রূপে দেখেছেন। সকলকে তিনি দেশ মাতৃকার মুক্তি মন্ত্রে দীক্ষিত হবার জন্য আহ্বান করেছেন —
“এসো হে আর্য এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃষ্টান।।”

ভারতবর্ষের মানুষের কাছে কবিগুরু এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, বরিশাল সাহিত্য সম্মেলন, ‘ সন্ধ্যা’ ‘বন্দেমাতরম্’ ‘যুগান্তর’ ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, শ্রীঅরবিন্দ, মানিকতলা বোমা মামলা, স্বাধীনতার জন্য দেশবাসীর জীবনপণ করা সহিংস অহিংস আন্দোলনের সাধনা – এসব কবিহৃদয়ে কমবেশি প্রতিফলিত হত। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে স্বয়ং সম্পর্কিত হয়েছেন। কবির একান্ত কামনা ‘ সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে ‘ অভিষিক্ত হোক ভারতবর্ষ।
মানুষের গুণ মনুষ্যত্ব। ছিন্ন ভিন্ন বিপর্যস্ত মনুষ্যত্ব নিয়ে জাতি বিভাজন কবিগুরু মেনে নিতেপারতেন না। কোন ভাষাগত বিভেদ, কোন আঞ্চলিকতার বিভেদ, জাতপাতের বিভেদ, সাম্প্রদায়িক বিভেদ ইত্যাদি কোন বিভেদকেই মানতেন না। Unity in Diversity ভাবনায় ভাবিত থাকতেন এবং তাঁর রচনায় সব সময় সেই চিন্তা ধারা ধরে রেখেছেন। কিছু প্রাচীন কবি বড়ু চণ্ডীদাসের শাশ্বত কথা ‘ সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই ‘কে তিনি শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মত মানতেন।
আব্দুর রহমান সিদ্দিকী যথার্থ ই বলেছেন – Tagore is an Indian to the core of his heart and yet he is no less International. He will live through his works for generations to come.”

এস সি চ্যাটার্জী রবীন্দ্রনাথ ও ভারতীয় জাতীয়তা প্রসঙ্গে বলেছেন –Tagore preached a new ideal possibly the grandest conception of Truth and Beauty….”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী এই সবার মিলনের আদর্শে তৈরী করেছিলেন এবং তাঁর মত “Visva-Bharati represents India where she has her wealth of mind which is for all.”

আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর ‘পান্থজনের সখা’ গ্রন্থে এক জায়গায় লিখেছেন –“…..আধুনিক কালের মুক্ত বুদ্ধির সঙ্গে ক্রমোন্নত ধর্ম বোধের মিতালিতে রবীন্দ্রনাথ আস্থাবান ছিলেন। বুদ্ধি ও বুদ্ধিপ্রসূত জ্ঞানের একাধিপত্য না জানলেও এমন কোনো ধর্মমত তাঁর পক্ষে শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নয় যা বুদ্ধিকে খর্ব বা খণ্ডিত করে।…ধর্ম প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – “My religion is in the reconciliation of the super personal Man, the Universal human spirit , in my own individual being.” তিনি আরও বলেছেন মানুষ যখন সম্প্রদায় বিশেষের ধর্ম সাধনাকে আধ্যাত্মিক সাধনা বলে গ্রহণ করে, তখন ধর্ম সাধনা খণ্ডিত ও বাধাপ্রাপ্ত হয়। রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্ম কোনও বিশেষ কালের মধ্যে শাস্ত্র ও আপ্ত বাক্যের মধ্যে আবদ্ধ নয়।”

রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা গ্রন্থে ডঃ নীহার রঞ্জন রায় যথার্থ ই বলেছেন –“…..রবীন্দ্র মানসের মধ্যে আমাদের জাতি, ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, সাধনা ইত্যাদি সব কিছু ল ইয়া একটা অখণ্ড জীবনাদর্শ, সমগ্ৰ জীবন দর্শন গড়িয়া উঠিতে আরম্ভ করে। ব্রাহ্মণ, চীনাম্যানের চিঠি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ভারতবর্ষের ইতিহাস, অত্যুক্তি, রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি প্রভৃতি প্রবন্ধ ও আলোচনায়; রাজকুটুম্ব, ঘুষাঘুষি, ধর্মবোধের দৃষ্টান্ত, ধর্মপ্রচার প্রভৃতি বক্তৃতা ও প্রবন্ধে এই অখণ্ড জীবনাদর্শের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।”

ডঃ অরবিন্দ পোদ্দার যথার্থই ব্যক্ত করেছেন — ….সমকালীন কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই একমাত্র কবি, যিনি সমগ্ৰভাবে ও সত্য অর্থে জাতীয় কবি, অর্থাৎ আমাদের অসম্পূর্ণ অতৃপ্ত জাতীয় জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।”

কবিগুরু নববর্ষে তাঁর দেশমাতৃকাকে পূজা করতে চেয়ে চরণে প্রণাম জানিয়ে বলেন –
হে ভারত, আজি নবীন বর্ষে শুন এ কবির গান।
তোমার চরণে নবীন হর্ষে এনেছি পূজার দান।….
এই বন্দনায় তিনি বলেছেন –
….দৈন্যের মাঝে আছে তব ধন, মৌনের মাঝে রয়েছে গোপন।
তোমারি মন্ত্র অগ্নিবান তাই আমাদের দিয়ো।….

কী সে গোপন মন্ত্র! স্বাধীনতার জন্য মন্ত্র নয় কি ? একসময় কবি যাঞ্চা করেছেন – মৃত্যু তরণ শঙ্কাহরণ দাও সে মন্ত্র তব।

পরমেশ্বরকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মিনতি করে বলেন –
…. এ ভারতে রাখো নিত্য প্রভু, তব শুভ আশীর্বাদ।

One thought on “প্রবন্ধঃ বিশ্বকবির দেশ প্রেমের ধারা – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

  1. কতকিছু জানতে পারি এই ধরনের লেখা পড়ে। ভীষন ভালো লাগল।

Leave a Reply to Krittika Bhaumik Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *