শুভ নববর্ষ
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)
করোনার ভয়াবহ রূপের মধ্যে গতবছর আর এই বছরও নববর্ষ পালনের উদ্দীপনা বেশ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে, একথা মেনেই আবার সকলের কল্যান কামনায় সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
১৪২৭ বঙ্গাব্দ সারা বছর করোনার সাবধানতা সামলাতে পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা। অথচ আমাদের অনেক আত্মীয় প্রিয়জনের, অচেনা অজানা অজস্র দেশের ও পৃথিবীর কতজনকে যে প্রিয়জনহারা আত্মীয়হারা হতে হয়েছে তার হিসেব প্রায়ই দেখে আঁৎকে উঠতে হয়। আসছে ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। কম উৎসাহ হলেও সব মঙ্গলের জন্য তাকে স্বাগত জানাই।
নববর্ষ নিয়ে আবেগ ভালবাসা অনুভূতি সাধারণ মানুষের আর কবিদের ভাষায় তা প্রকাশিত হয়ে আসছে অনেক দিন থেকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আমাদের অন্তরের কথা প্রকাশ করেছেন অসংখ্য কবিতা গানে প্রবন্ধেও। তাঁকে ভালবাসার প্রণাম জানাই।
ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যাঁর জন্ম ১৮৮২ আর মৃত্যু ১৯২২ অর্থাৎ মাত্র চল্লিশ বৎসর বেঁচে ছিলেন, তাঁকে মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। তাঁর একটি দীর্ঘ কবিতা “বর্ষ-বোধন” -এ তিনি লিখেছিলেন —
” তোমার নামে নোয়াই মাথা ওগো অনাম ! অনির্বচনীয়,
প্রণাম করি হে পূর্ণ-কল্যাণ !
প্রভাত পেলে যে প্রভা আজ, সেই প্রভা দাও প্রাণে আমার প্রিয়,
আলোয় জাগো সকল আলোর ধ্যান!
আবার এই কবিতায় তিনি লিখেছিলেন —
“- – – আজ বরষের নূতন-প্রাতে আলোক-পাতে প্রাণ করে প্রার্থনা — ওগো প্রভু ! ওগো জগৎ-স্বামী!
প্রণব-গানে নিখিল প্রাণে নবীন যুগের কর প্রবর্তনা,
জ্যোতির রূপে চিত্তে এস নামি। – – -“
করোনা ভয়ার্ত মানুষের কাছে এর চেয়ে নিজ নিজ বিশ্বাসের জগৎ স্রষ্টার কাছে আর অন্য কীইবা প্রার্থনা থাকতে পারে ?
“বর্ষ বরণ” কবিতায় ছন্দের যাদুকর লিখেছেন —
“এস তুমি এস নূতন অতিথি!
ঊষার রতন প্রদীপ জ্বালি’;
রৌদ্র হয়নি অসহ
এখনো তাতেনি পথের বালি।
মধু যামিনীর মোতিহার ছিঁড়ে
ছড়ায়ে পড়েছে মহুয়া ফুল,
তোমার তুতিয়া রঙের নেশায়
বনভূমি আজ কী মশ্ গুল্।
রেশমী সবুজে সাজে দেবদারু
পশমী সবুজে রসাল সাজে,
আবৃত ধরার কিশোর-গরব
সবুজের মখমলের মাঝে ।
কত ফুল আজি পড়িছে ঝরিয়া,
পড়ুক ঝড়িয়া নাহিক ক্ষতি ;
হালকা হাওয়ার দিন সে ফুরাল,
উদিল জীবনে তপের জ্যোতি।
বসন্ত আজ মাগে অবসর
যৌবন-শোভা পড়িছে ঝরি’;
চির-নবীনের ওগো নবদূত !
তোমারে আজিকে বরণ করি।- – -“
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এভাবেই ছন্দ, শব্দ ও ভাষার যথোপযুক্ত ব্যবহারের জন্য এক সময় ছন্দের যাদুকর আখ্যা লাভ করেছিলেন। তিনি ভারতী পত্রিকা গোষ্ঠীর অন্যতম কবি ছিলেন। তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ও অক্ষডয়কুমার বড়ালের অনুপ্রাণিত হতেন। বাংলা কবিতায় আরবি ও ফারসি শব্দের ব্যবহার করে বাংলা ভাষার শক্তিবৃদ্ধির প্রাথমিক প্রয়াস ও সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার কাব্য সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা ভাষার কাব্য সাহিত্যের মেলবন্ধনের প্রয়াস সর্বপ্রথম তিনি করেন বলে মনে করা হয়।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের কথা (১৮৯০ – ১৯৭৫), যিনি বিশ্ব বিখ্যাত লেলিনে মৃত্যুর জন্য সুদূর মৈমনসিংহ গৌরীপুরে বসে কবিতা লিখে বৃটিশ সরকারের পুলিশের কাছে বিড়ম্বনায় পড়েন, সেই কবিও অজস্র বিদেশী ভাষার ছন্দ তাঁর বাংলা ভাষায় প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর কবিতাও ভারতী পত্রিকা গোষ্ঠীতে এক সময় পঠিত হত। দুই কবির মধ্যে, মাত্র আট বছরের তফাৎ হলেও, যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অকাল মৃত্যুতে যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য তাঁর স্মরণে একটি কবিতা লেখেন, যেমন —
“সত্যেন্দ্র তর্পণ
(সংস্কৃত মন্দাক্রান্তা ছন্দে)
বাঙলার সত্যেন অকালে গেল আজ, রইল স্থান তার অপূর্ণ !
অশ্রুর তর্পণ চলেছে বাঙালীর, বক্ষ-পঞ্জর বিচূর্ণ !
নিষ্ঠুর সংবাদ ছেয়েছে সারা দেশ, হায় কি আফ্- শোষ অশান্তি !
বুঝতাম কয় জন কি ছিল সে মোদের ! হায় রে হায় হায়, কি ভ্রান্তি !
অন্তর কাৎরায়, পাবো কি খুঁজে আর নব্য বঙ্গের এ রত্ন ! – – – – -“
সত্যি, বাংলা ভাষায় কাব্য সাহিত্যে যাঁরা অনলস সাধনা করে শক্ত ভিত্তি স্থাপন করেছেন তাঁদের সশ্রদ্ধ স্মরণ করা আমাদের, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করি।
খুব ভালো লাগলো। একদম সঠিক কথা।