নিবন্ধঃ কেঞ্জাকুড়ার মুড়ি মেলা – মধুসূদন দরিপা (বাঁকুড়া)

কেঞ্জাকুড়ার মুড়ি মেলা
মধুসূদন দরিপা

” চপ জিলিপি মুড়ি
তিন মিলে বাঁকড়ি”

বাঁকুড়া শহর থেকে কুড়ি কিমি দূরে দ্বারকেশ্বর নদের তীরে কাঁসা-পেতল-বাঁশ-গামছা শিল্পের জন্য বিখ্যাত কেঞ্জাকুড়া গ্রাম । হাজার পাঁচেক মানুষের এই গ্রামেই ফি-বছর মাঘ মাসের চার তারিখে ভিড় করেন পঞ্চাশ হাজার মানুষ । মুড়িমেলা উপলক্ষে ।
ঊনিশ শতকে নিকটবর্তী ভান্ডারবেড় গ্রামের জমিদার ছিলেন রায়কিশোর চট্টোপাধ্যায় । জমিদার পরিবারে জন্ম হলেও তাঁর মন প্রাণ জুড়ে ছিল ইশ্বরীয় ভক্তি । তাই বেশি দিন তিনি সংসারে আবদ্ধ থাকতে পারলেন না । যুবক বয়সেই সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগ করলেন । বেশ কিছু বছর পর তিনি গ্রামে ফিরে এলেও নিজের বাড়িতে বসবাস করতে সম্মত হলেন না । এমন কি গ্রামের অন্য কারও বাড়িতেও থাকতে রাজি হলেন না । বললেন, সাধু সন্ন্যাসীর কোন গৃহ থাকতে নেই । কথায় আছে, ‘ রমতা সাধু বহতা পানি ‘ ।
দ্বারকেশ্বর নদের তীরে একটি নিম গাছের নিচে তাঁর জন্য গ্রামবাসীরা কুটির নির্মাণ করে দিল । কুটির থেকে আশ্রম, আশ্রম থেকে মন্দির । সঞ্জীবনী মাতার মন্দির । সিদ্ধ সাধকের টানে কালে কালে মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করল সেই মন্দিরে । মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে প্রতি বছর শুরু হল হরিনাম সংকীর্তনের আসর । এক রাত্রি দুই রাত্রি বেড়ে বেড়ে আজ তা পঞ্চরাত্রি হয়েছে । এক সময় এই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গল আকীর্ণ । নিকটবর্তী গ্রাম ধোবারগ্রাম, ধুলকুমারী, দুপসাড়া, কাঁটাকুলি, কেশ্যাডোবা, মাটিখোলা, পাথরবাইদ, বনকাঁটা, গোপালপুর, মনোহরপুর, গোঁসাইডিহি, রাধাকান্তপুর, মোলবনা, কালপাথর, কুমিদ্যা, কাশীবেদা, কালাবতী এবং উত্তরে আট কিমি দূরে ছাতনা -ঝাঁটিপাহাড়ি সংলগ্ন গ্রামসমূহ খড়বনা, ঘোষেরগ্রাম, কমলপুর, আঁচুড়ি, শুশুনিয়া ইত্যাদি অঞ্চল থেকে শুরু করে আরও দূর দূরান্ত স্থান থেকে ভক্তের দল হরিনাম শুনতে আসতেন আশ্রমে । হিংস্র জীবজন্তুর ভয়ে রাতে তারা নিজেদের গ্রামে ফিরতে পারতেন না । সারা রাত নাম গান শুনে পরের দিন সকালে দ্বারকেশ্বরের জলে নিজেদের সঙ্গে আনা মুড়ি ভিজিয়ে খেয়ে বাড়ি ফিরতেন । ভক্তদের এই মুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ আজ পরিণত হয়েছে উৎসবে । মুড়ি মেলার উৎসব ।
পঞ্চরাত্রি উৎসবের শেষ দিনে অর্থাৎ ৪ঠা মাঘ দ্বারকেশ্বর নদের চরে বসে মুড়ি মেলা । সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমতে শুরু করে । দলে দলে আসা মানুষ চপ, সিঙ্গাড়া, তেলেভাজা, ঘুগনি, চানাচুর, কাঁচা লংকা, শশা, মূলা, পেঁয়াজ, টমেটো, মটরশুঁটি, ধনেপাতা, নারকেল, বাদাম, গুড়পিঠে, নারকেল নাড়ু, তিল নাড়ু ইত্যাদি উপকরণ সহ মুড়ি খান । দ্বারকেশ্বর নদের নরম বালি হাত দিয়ে সরিয়ে গর্ত তৈরি করে ‘ চুয়া ‘ কেটে বের করা মিষ্টি জলে গলা ভিজিয়ে নেন । শেষ পাতে থাকে কেঞ্জাকুড়ার বিখ্যাত জিলিপি । এক শো গ্রাম থেকে শুরু করে এক কিলোগ্রাম ওজনের জিলিপি । দু’ টাকা থেকে শুরু করে দেড় শো টাকা দামের জিলিপি কিনতে ভিড় জমে যায় দোকানে ।
শীতের আমেজি রোদ গায়ে মেখে সঞ্জীবনী মাতার মন্দিরে পুজো দিয়ে দ্বারকেশ্বর নদের চরে বসে শুধুমাত্র মুড়ি খাওয়ার নির্ভেজাল আনন্দে আজ জেলা, রাজ্যের গন্ডি ছাড়িয়ে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা থেকে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে মেলায় হাজির হয়ে যান অসংখ্য মানুষ । আর এই সমকালে সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে মুড়ি মেলার জনপ্রিয়তা একেবারে তুঙ্গে উঠেছে । জাতি- ধর্ম -ধনী -দরিদ্র নির্বিশেষে সমাজের সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে কিভাবে এক করতে পারে নিতান্ত ছোট্ট আকারের খাবার একটি সাদা মুড়ি, তা এই মেলার চেহারা কেউ স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না । আধুনিক প্রজন্মের যুবক যুবতীরাও আজ রাজ্যের তথা দেশের বিভিন্ন শহর থেকে এসে মুড়ি খাওয়ার এই অভিনব উন্মাদনার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে দ্বিধা করছেন না । মেলার ভিড়ে নিজস্বী তুলে সোস্যাল মিডিয়ায় তাদের পোষ্ট মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র বিশ্বে । বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ এই বাংলায় কেঞ্জাকুড়ার ঐতিহ্যপূর্ণ এই মুড়ি মেলা আজ লালমাটির বিস্তীর্ণ রাঢ় জনপদে লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক গৌরবোজ্জ্বল স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

One thought on “নিবন্ধঃ কেঞ্জাকুড়ার মুড়ি মেলা – মধুসূদন দরিপা (বাঁকুড়া)

  1. বাহ্!!! বড় সুন্দর এই ঐতিহ্যময় মুড়ি মেলার সুন্দর বর্নণা বেশ ভালো লাগলো । আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই ।

Leave a Reply to বাবলু গিরি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *