ছোটগল্পঃ বাস্তুহারা – কৃত্তিকা ভৌমিক

বাস্তুহারা
কৃত্তিকা ভৌমিক

নতুন বাড়ির আনাচেকানাচে কোথাও নেই সেই পুরনো বাড়িটা। আজ নতুনের গন্ধ চারিদিকে। ঝলমল করছে চারিদিক। কাল নাকি উৎসব আছে এই বাড়িতে। আরে বাবা আগে কি এমন উৎসব হয়নি এই বাড়িতে !!

যখন বাড়ির কর্তা বেঁচে ছিল পরিবার ছিল অনেক বড়। আমিও তো ছিলাম বেশ। কেউ খেয়াল না করলেও এদিক সেদিক অবারিত ঘোরাঘুরি চলত। সে এক দারুণ সময় ছিল।

কর্তামশাই ছিলেন সজ্জন মানুষ। অমায়িক ছিল তার ব্যবহার। আত্মীয় স্বজনে বাড়িটা গমগম করত। পুজো পার্বণ বলে আলাদা কিছু ছিল না। সবসময়ই লোকজন লেগে থাকত। আর বাড়িও তো ছিল পেল্লাই। কতরকমের যে গাছ ছিল বাগানে! আগাছাও বড় কম ছিল না। হদ্দ কুঁড়ে এক মালি ছিল, সে মাঝে মাঝে একটু পরিস্কার করার চেষ্টা করত। সে যে যা করে করুকগে আমার কোনও অসুবিধা ছিল না।থাকতাম দিব্বি বেশ মনের সুখে। তবে বাড়ির গিন্নি কিন্তু ছিল বেশ দাপুটে। মাঝে মাঝেই এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে তিনি নিজের কাজ লোকজনদের দিয়ে করিয়ে নিতেন।

কর্তামশাই রাশভারী মানুষ হলেও মনটা ছিল ভারী নরম। একমাত্র ছেলে যখন বিদেশে পড়তে চলে গেল গিন্নী মন শক্ত করে রাখলেন কিন্তু কর্তামশাই চুপিচুপি খুবই কান্নাকাটি করতেন।
তারপর সেই ছেলে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে বড় চাকরিতে যোগ দিল। আমি তো সবই জানি। কর্তাবাবুর সে কি আনন্দ! লোকজন ডেকে সে একেবারে এলাহি ব্যাপার।

কেন! ছেলের বিয়ের উৎসব কি ভুলে গেছি! প্রায় মাসখানেক বাড়িতে আত্মীয় স্বজনে ছয়লাপ ছিল না!বৈশাখ মাসে হয়েছিল বিয়ে। আমার তো দারুণ আহ্লাদ। গরম কালটা আমার বেশ ভালো লাগে।

তারপর কালের নিয়মে কর্তামশাই চোখ বুজলেন। গিন্নীমা একা হয়ে গেলেন। ছেলে, বউমা আর ছোট্ট নাতি এই হল সংসার। সেই দাপুটে গিন্নীমার সংসারে আর কোনও কথাই চলত না। আত্মীয় স্বজনের আসাও কি করে যেন নিষেধ হয়ে গেল। সবকিছু সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করল বৌমা। তা সে নিতেই পারে। সংসার তো তারও। তবে কিনা গিন্নীমা বাড়ির একজন বয়স্ক মানী মানুষ, তার মান-মর্যাদা রাখাও তো ছেলেমেয়েদের কর্তব্য! সে যাকগে। আমিও তো বুড়ো হয়েছি আমারও বয়স বেড়েছে। তবে গিন্নীমাকে দেখলে আমার বড্ড মন খারাপ হয়ে যায়।

কর্তামশাই যেদিন মারা গেল সেদিন আমার খুব কষ্ট হয়েছিল কিন্তু তার থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম যেদিন গিন্নীমা এবং বাড়ির সব জিনিসপত্র নিয়ে ছেলে গাড়ি করে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। আমি সেদিন দেখেছি লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ির গিন্নীকে কাঁদতে। শুনেছি ছেলে নাকি মা কে নিয়ে গেছে তার কেনা বিশাল বড় ফ্ল্যাটে।
হুঁহ্ জানি না কত বড় সে বাড়ি! তবে হলফ করে বলতে পারি এই বাড়ির থেকে অনেক ছোট।

এতো বড় বাড়ি আমার চোখের সামনে ভেঙে ফেলা হল। বাগানের প্রায় সব গাছ কেটে ফেলা হল। পড়ে আছে কিছু আগাছা। সমস্ত অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছে পাঁচতলা একটা বাড়ি। ঝাঁ চকচক বিশাল বাড়ি। এর নাম নাকি শপিং মল। দোকানপাট হবে। কাল নাকি তার উদ্বোধন।

আশেপাশে যা কিছু ময়লা আগাছা আছে আজ সবকিছু পরিস্কার করার জন্য লোক এসেছে। আমাকেও আজ চলে যেতে হবে অন্য কোথাও। কোথায় তা জানি না। বাস্তুচ্যুত হয়ে বাড়ির মানুষজন চলে গেল আর আমিই বা কার মঙ্গলের জন্য ভিটে আঁকড়ে পড়ে থাকব।

বাস্তুহারা বাস্তুসাপ আমি দেখি কোথায় ঠাঁই পাই!!

6 thoughts on “ছোটগল্পঃ বাস্তুহারা – কৃত্তিকা ভৌমিক

Leave a Reply to Soma Sengupta Mukherjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *