কনকনে শীতে খেজুর রস ও সুস্বাদু পিঠা গ্রামবাংলার চাষীর প্রধান উৎসব
নজরুল ইসলাম তোফা

নজরুল ইসলাম তোফা: আবহমান গ্রামবাংলার অনেক চাষীদের শীতকালীন খুবই বৈচিত্র্য পূর্ণ উৎসবের প্রধান উপাদান হলো- ‘’খেজুর রস’’। গ্রামীণ সাধারণ মানুষদের জীবন-জীবিকায় এটিকে মুল হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। স্বপ্ন ও প্রত্যাশায় অনেকখানি খেজুরগাছের সঙ্গে চাষীদের অঙ্গাঅঙ্গিভাবে বসবাস হয়ে উঠে। নানানভাবে জড়িত চাষীর জীবন সংগ্রামে বহু কষ্টের মাঝেই অনেক প্রাপ্তি যুক্ত হয়। সমগ্র বাংলার জনপ্রিয় তরুবৃক্ষ- খেজুর গাছের সঙ্গেই- ভূমিহীন চাষী, প্রান্তিক চাষী, দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষের জন্য এই সময়টা অনেক আনন্দদায়ক। কারণ, এমন খেজুর গাছই তো চাষীর অন্নদাতা।
আরো জানা যাক, হেমন্তের শেষেই শীতের ঠান্ডা পরশে গ্রামবাংলার চাষী খেজুরগাছের মিষ্টি রসে নিজেদেরকে ডুবিয়ে নেওয়ার সুন্দর মাধ্যম সৃষ্টি করেন। গ্রাম বাংলার চাষীদের যেন একঘেয়েমির যান্ত্রিকতায় জীবনযাপনের অনেক পরিবর্তন আনে শীতের ঋতুচক্র। এই শীতকালে বৈচিত্র্যপূর্ণ গ্রামীণ সংস্কৃতির মাঝেই যেন ‘খেজুর রসের হরেকরকম পিঠা উৎসব’ শুরু হয়। তাযেন এক শৈল্পীক ঐতিহ্যের বহুমুখী সমারোহ বা প্রাণোচ্ছলতায় বারবারই ফিরে আসে।
চাষীরা সৃষ্টি কর্তার সৃজনশীল খেজুর গাছের যত্ন-আত্তি না করলে যেন রস মিলবে না। আর রস না মিললে গুড় হবে কি করে। পাটালি না দেখলে চাষীর যেন ঘুম আসে না। চাষী তাদের মেয়ে বা বউয়ের হাতের কাঁচা সুপারির কচি পান গালে ভরেই বাঁশের ডালি মাথায় করে গঞ্জে ও দূর্বতী হাট বাজারে যাবে কি করে। আর, পাটালি গুড়ের মিষ্টি মধুর গন্ধে তারা বিভোর হয়ে বিক্রয় কর্মে না থাকে তো পেটে ভাতে বাঁচবে কি করে। শীত কালের আমেজে প্রকৃতির মাঝ থেকে সংগীহিত ‘মিষ্টি খেজুর রস’ চাষীরা চষে বেড়ায় সকালে, বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় মেঠো পথ ধরে। তারই বহিঃ প্রকাশে যেন চমৎকার নান্দনিকতা বা অপরূপ দৃশ্যপটের সৃষ্টি হয, সত্যিই তা যেন শৈল্পীকতার নিদর্শন। শৈল্পীক আস্থা ও বিশ্বাসকে নিয়ে প্রকৃতির সৃষ্টি বিশাল আকৃতির ‘কুয়াশাচ্ছান্ন এবং ঝাপসা’ পরিবেশের দেখা মিলে, তা যেন চাদরের মতো। চাষী’রা সে চাদরের মধ্যেই নিজের ‘চাদরের মুড়ি’ দেয়। প্রয়োজনের তাগিদে সামান্য কষ্ট তাদের গায়ে লাগে না। এই শীতে কালে রূপ সৌন্দর্যের আরও একটি উপাদেয় সামগ্রী খাঁটি সরিষার তেল। যা তারা শরীরে মালিশ করে অনেকাংশেই ত্বকের মশ্রিণতা এবং ঠান্ডা দূর করে খেজুর গাছে উঠতে।

গ্রামাঞ্চলের চাষীরা ভোরবেলায় খেজুরগাছ হতে রসের হাড়ি নামিয়ে আনতে ব্যস্ত হন। রাতের এ হিমশীতল রস ভোরে হাড় কাঁপানি ঠান্ডায় গাছ থেকে নামিয়ে খাওয়ার যে স্বাদ তা একেবারেই আলাদা মাত্রা সৃষ্টি করে। ভোরে এই খেজুর রস খেলে শীত যেন শরীরে আরও জাঁকিয়ে বসে। তাদের কাছে এ শীতে শরীর কাঁপানি এক স্পন্দন চরম মজা দায়ক মনে হয়। শীত লাগে লাগুক না, তবুও রস খাওয়ার কোন বিরাম নেই। তারা এক গ্লাস, দু’ গ্লাস খাওয়ার পরপর কাঁপতে কাঁপতেই যেন আরো এক গ্লাস মুড়ি মিশিয়ে মুখে তুলে চুমক দেয়া, আর রোদ পোহানো সে কি আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা দূরহ। শীতের কুয়াশা ঢাকা সকালে গ্রামের ছেলে মেয়েরা ঘুম হতে খুব ভোরে উঠে হাত মুখ ধুয়ে খড় কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে হাত পা গরম করে। আর অপেক্ষায় থাকে কখন সকালের তীব্র বা মিষ্টি রোদের প্রখরতা আরও তীব্র হবে। তাদের রোদ পোহানোর আরামের সাথে সাথে আরো অপেক্ষা থাকে, তা হলো তাদের প্রিয় ‘খেঁজুর রস’। কখন যে আসে আর তখনই খাবে। সেই ‘রস’ আসলে যথা সময়ে হাজির হলে তাদের কাছে যেন আনন্দ উল্লাসের কোনোই কমতি হয় না। গ্রামাঞ্চলের খুব অভাবী মেয়েরা রংবেরংয়ের যেসব খেজুর পাতায় খেজুর পাটি তৈরী করে তার উপরই যেন চলে রস খাওয়ার আসর। উপার্যনের জন্য খেজুর পাতা শুকিয়ে তা দিয়েই নকশা খচিত খেজুর পাটি তৈরী পরে আর তা বিক্রি করে তাদের সংসারে কিছুটা হলেও অর্থ সংকোলান হয়। সুতরাং, এই খেজুরের পাটিতেই গ্রামের অনেক পরিবার ঘুমানো কাজে ব্যবহার করে। এ খেজুর পাতায় এক ধরনের ‘সাহেবী টুপি’ও তৈরি হয়। খেজুরের পাতা, ডাল এবং গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। আর মোরুব্বা তৈরিতেও এই খেজুর কাটার ব্যবহার প্রচলিত আছে। এককথায় বলা চলে যে খেজুর গাছের পাতার ও ডাল সেতো কবর পর্যন্ত চলে যায়।

খেজুর গাছ ছয় সাত বছর বয়স থেকে রস দেওয়া শুরু করে। ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত “রস” দেয়। গাছ পুরনো হয়ে গেলে রস কমে যায়। আবার অনেক পুরনো খেজুর গাছের রস অনেক মিষ্টি হয়। জানা যায় যে, ‘মাঝ বয়সী গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়’। বেশি বেশি রস সংগ্রহ করাও গাছের জন্য অবার অনেক ক্ষতিকর। রস সংগ্রহের জন্য কার্তিক মাসে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়। কার্তিক মাস থেকেই ‘রস’ পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। শীতের সঙ্গে রস ঝরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শীত যতো বেশি পড়ে ততোই যেন বেশি রস ঝরে। রসের স্বাদও তত মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ মাস হলো রসের ভর মৌসুম। অগ্রহায়ণ হতে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত একটি খেজুর গাছে মাসে ‘৪০ কেজি’ রস পাওয়া যেতে পাবে। খেজুরগাছ শুধু রস দিয়ে ক্ষান্ত হয় না। শুকনো খেজুরের “ভেষজ গুন” অনেক রয়েছে। আর খেজুরের বীজ গুলি বাহির করে নিয়ে দুধে খেজুর গুলো মিশিয়ে ভালভাবে ফুটিয়ে গরম করে এমন দুধ ও খেজুর গুলো ঠান্ডা করে শিশুকে খাওয়ালে শক্তি বাড়ে৷ একটি শুকনো খেজুর ফলের পুষ্টি মান প্রায়,- ৭৫-৮০% শর্করা, ২% আমিষ এবং প্রায়- ২.৫% স্নেহজাতীয় পদার্থ থাকে। খেজুরের ১০০ গ্রাম শাঁসে ২০ ভাগ পানি, ৬০-৬৫ ভাগ শর্করা, ২ ভাগ আমিষ, আর খুবই সামান্য পরিমাণ কপার, সালফার, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন- এ, বি-১, বা বি-২ কিংবা খনিজ লবণ খোঁজে পাওয়া যায়।

সুন্দর করে খেজুর গাছ ও খেজুরের রসের অন্তরঙ্গ ও আন্তরিক বর্ণনায় পাঠককে মুগ্ধ হয়ে পড়তে হয়। শহরের মানুষরা মোয়ায় সন্তুষ্ট হন। টাটকা রসে তৈরী সুস্বাদু মোয়া এখন মিষ্টির দোকানের অন্যতম মিষ্টান্ন দ্রব্য। এমজা বাংলাল নিজস্ব এক বৈশিষ্ট্য।
তবে শীতের ভোরে কাঁচা খেজুরের রস , তা ভোলার নয়। যিনি স্বাদ একবার পেয়েছেন তিনিই জানেন ঐ কাঁটা কাঁটা গাছে অমৃত রস কত মধুর। তা বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
লেখককে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ ভাই।
খেজুরের রস ভালোবাসি, খেজুর গুড় ভালোবাসি কিন্তু এই সবকিছুর পিছনে যে এমন সমস্ত কর্মকাণ্ড আছে তা জেনে অভিভূত হলাম।
কৃত্তিকার সাথে সহমত। খুব তথ্য সমৃদ্ধ এবং মূল্যবান লেখা।