মুক্তগদ্যঃ জয়দেব-কেন্দুলি মেলার বাউল উৎসব – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী(রাধু)

জয়দেব-কেন্দুলি মেলার বাউল উৎসব
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী(রাধু)

বছরে বেশ কয়েকবার অফিস ছুটি থাকলে বা ছুটি নিয়ে একা একা দিনের পর দিন কলকাতা থেকে ট্রেনের বাসের ধকল সয়ে জয়দেব-কেন্দুলি গ্রামে যাতায়াত করেছি। থাকার জায়গা ছিল। শ্রদ্ধেয় শ্রীপূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্যের (এখন বয়েস ১০১) “মহাভারতী” নামের পাকা বাড়ি। মেলা সংলগ্ন জমিতে জয়দেব সংক্রান্ত গবেষণার জন্য তৈরী করেছিলেন। সেই বাড়িতে বছরের পর বছর মেলার সময়ে এবং অন্য সময়েও যেতাম। স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অজিত কুমার দাস মহাশয়, যিনি জয়দেব ও মেলার উপর গবেষণা করে পিএইচডি করেছেন তাঁর জয়দেব-মেলা গ্রন্থটি আমাকে প্রীতিভরে উপহার দিয়েছিলেন। প্রায়শই ওখানে গিয়েও মেলার আদ্যোপান্তের অন্তত কিছুটা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছি।
জয়দেব-কেন্দুলি মেলায় দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার বাউলরা দল বেঁধে আসেন, ত়াঁবু খাটিয়ে থাকেন কয়েক দিন, প্রাণভ’রে গান গান।
এছাড়াও মেলা চত্বরে কয়েকটি স্থায়ী বাউল আখড়া রয়েছে। সেসব আখড়ার অধিকাংশতেই রয়েছে রাধারমণ বা রাধাগোবিন্দর বিগ্রহ। নিত্য পূজা, কীর্তন, বাউলের গান দিয়ে সারা বছরই জমজমাট করে রাখেন তাঁরা। এছাড়াও বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়, মিশন তাঁদের স্থানীয় কেন্দ্র স্থাপন করে রেখেছেন আর গ্রামের মানুষদের বিপদে আপদে পাশে থাকেন। প্রয়োজনে গ্রামবাসীরাও এই আখড়া গুলি শ্রদ্ধার সঙ্গে ভালোবাসার সঙ্গে রক্ষা করে আসছেন বহুদিন ধরে।
মেলাতে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে অনেক মূল্যবান সামগ্রী এমনকি কাঠের তৈরি আসবাবপত্র এবং অর্ডার মত তৈরি করে দেবার জন্য কাঠমিস্ত্রিও উপস্থিত হয়ে থাকেন। তাঁরা খরিদ্দারের পছন্দের আসবাব বানিয়ে দেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে। হালুইকররা মেলার আগেই তাঁদের স‍রঞ্জাম ও কাঁচা মালের ব্যবস্থা সহ হাজির হন এই মেলায়। রসগোল্লা, পানতুয়া, ল্যাংচা, লবঙ্গ লতিকা, মিহি দানা, সীতাভোগ, সরভাজা ইত্যাদি হরেক রকমের মিস্টি তৈরী করতে ব্যস্ত হয়ে থাকেন। মেলার পথে ফাঁকা মাঠে হাজার হাজার কলার কাঁদি কলাপাতা দিয়ে ঢেকে জাঁকে দিয়ে রাখা হচ্ছে, মেলা শুরু হলে সব বিক্রি হতে বেশী সময় নেবে না।জামাকাপড় শাড়ির দোকান লাইন করে মেলার আগেই বসতে শুরু করে দেয়। চাষ আবাদের সরঞ্জাম ইত্যাদির পসরা নিয়ে দোকানীরা আসেন দূর দূরান্ত থেকে।
তবে মেলা জমে ওঠে রাতের দিকে। স্থায়ী অস্থায়ী আখড়াগুলোয় শুরু হয় বাউল গানের আসর। এক একটা আসরে বিচুলি পাতা চটের উপর বসার জায়গা। একবার বসলে এক এক করে দেশবিদেশের খ্যাতনামা ও অখ্যাত অসংখ্য বাউলদের কন্ঠের গান শুনতে শুনতে সারা রাত পার করে দেয়া যায়। ইচ্ছে হলে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়েও নেয়া যায় বিচুলি শয্যায়।
রাতের খাবার যে কোন আখড়ার ঢালাও অন্নসত্রের সামনের লাইনে দাঁড়ালেই সেখানকার স্বেচ্ছাসেবকরা আদর করে মাটিতে বসিয়ে পেট ভরিয়ে খিচুরি খাইয়ে দেন। চেনা বা অচেনা, কোন বাছবিচার নেই। কোনো ধর্মের প্রশ্ন নেই। বাউলরা জানেন এই বিশ্বের সবাই পরস্পরই পরস্পরের আত্মীয় ভাই ভাই। কেননা তাঁরা বিশ্বাস করেন এক পরমেশ্বরের‍ সৃষ্টি আমরা সবাই।তাই কোন ভেদাভেদ নেই। পেটে ধরাতে পারলে যতগুলো খুসি ততগুলো আখড়ায় খিচুড়ি খাওয়া যায়।
ঠিক তেমনই আখড়ায় আখড়ায়ও ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন শিল্পীদের গান শোনা যায়। এঁরা শুধু আমাদের দেশ নয়, বাংলাদেশের, এমনকি সুদূর জাপানের বাউল শিল্পীও এই মেলায় এসে জড়ো হন।
দূর দূরান্ত থেকে শ্রোতাদের আগমন ঘটে। গ্রামের মানুষরা গরুর গাড়ি বা লড়ি বা বাসে আসেন কেউবা ট্রেনে করে আসেন, তবে সবাই সঙ্গে আনেন মুড়ি মুড়কি গুড় এসব নিয়ে।ম আশ্চর্য লাগে ছমাস এক বছরের শিশুকে কোলে নিয়েও মায়েরা এই কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে পোটলা পুঁটলি নিয়ে চলে আসেন। তাঁদের সাহস আছে বলতে হয়।এসময়টায় আমাদের বাংলায় জয়দেবের মেলা বা গঙ্গা সাগরের মেলার সময়ে বছরের শীত পড়ে সব চেয়ে বেশি। দশ ডিগ্রি বা তার নীচে নেমে যায় তাপমাত্রা। আসলে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল বলে শীতের তীব্রতা পনের ষোলোয় নামলেই গরম পোশাক পরে নিতে হয়। সেখানে দশ ডিগ্রি বা তার কম হলে ঠাণ্ডাটা যেন বেশিই লাগে। সেখানে শিশুদের কোলে নিয়ে গ্রামের বউ মেয়েরা শুধু বাউল গানের টানে মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে চলে আসেন। দেখে অবাক লাগে।
বাউলদের জমজমাট আখড়া গুলোর পূর্ব দিকে সরকারি জয়দেব মঞ্চেও বাউল গান ছাড়া এক সন্ধ্যায় চলে সাহিত্য পাঠের আসর। গ্রাম বাংলার সব বয়েসের কবি সাহিত্যিক থেকে কলকাতার অনেক নামীদামী ও অনামী কবি সাহিত্যিক উপস্থিত হন নিমন্ত্রিত হয়ে বা বাউল গানের টানে। সেখানে কয়েক বছর বর্ষীয়ান কবি পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য সহ আমাদের মত তখনকার তরুণতররাও হাজির হতাম।
এছাড়াও কাছাকাছি রয়েছে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের সমাধি। তাঁর স্মরণে কবিতা পাঠ গল্প পাঠ বাউল গান আলোচনা এসব সহ বিরাট মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এখানেও অনেক কবি সাহিত্যিক শ্রদ্ধা জানাতে ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। লাউড স্পিকার নিজের নাম ঘোষণা হতে এগিয়ে যাই নিজের ছোটগল্প পাঠ করার জন্য। পাঠ শেষ হলে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেন এক ভদ্রলোক। অচেনা লোক জড়িয়ে ধরতে অবাক হই। তিনি আমায় বললেন — আমি মেদিনীপুরের ‘নীলোৎপল’ ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক। আপনার লেখা মাঝে মাঝে ছাপা হয়, আমাদের আগে কখনোও সামনাসামনি দেখা হয়নি। আপনার নাম শুনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।” অনেকক্ষণ ধরে দুজনের মধ্যে কথোপকথন হল। তিনি আবার কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বিশেষ অনুরাগী, প্রতি বছর এখানে আসেন। দুজনের ভালো লাগার অন্ত নেই যেন।
আবার ফিরে আসি জয়দেব-কেন্দুলি মেলার বিরাট চত্বরে। এদিকে সারি সারি দোকান ওদিকে সারি সারি দোকান হরেক রকমের পসরা নিয়ে। চোখ জুড়িয়ে যায় যেন। এরই মাঝে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যায় মেলায় আসা দূরের মানুষের সাথেও, কলকাতার মানুষের সঙ্গে। — কবে এলেন, কোথায় উঠেছেন ইত্যাদি কথোপকথনের সম্ভাষণে সময় যেন গড়িয়ে যায়। দেখা হয় কলকাতার এক গুচ্ছ তরুণ কবিদের সঙ্গে, যাঁরা প্রায়ই টেমার লেনে দেবকুমার বসুর ‘বিশ্বজ্ঞান’ ঘরে। কয়েক জন স্বাভাবিক ভাবে আলাপ করেন, কয়েক জন স্বাভাবিক ভাবে চলতেই পারেন না। মেলায় প্রকাশ্যে নেশার জিনিস পাওয়ার কথা নয়। দেখিনি কখনও। অথচ এঁরা ঠিক খুঁজে পেয়েছেন।
এমনিতে কিন্তু এই মেলার আইন শৃঙ্খলা বেশ কড়া বলেই মনে হয়। বর্ষার বিশাল বিপুল দামাল অজয় নদের চেহারা এই পৌষের সংক্রান্তির দিনে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর রূপ নেয়। জয়দেব-কেন্দুলি থেকে দুর্গাপুর যাতায়াত করা যায় অজয়ের বুকে পায়ে হেঁটে। বীরভূম জেলা থেকে বর্ধমান জেলায় যেতে সংক্ষেপ পথ। মাঝখানে যেখানে তিরতির করে জলের ধারা চলেছে সেখানে নাকি আঠারো ক্রোশ উজানে স্বয়ং গঙ্গার ধারা আসে স্নানার্থীদের পুণ্যের জন্য। যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরা কোন মতে জল তুলে পুণ্যস্নানের সুযোগ গ্রহণ করেন। নারী পুরুষ নির্বিশেষে। সেখানে মেলায় আগত স্নানার্থীদের ছাড়া। অন্য সকলকে যেতে নিষেধ করেন স্বেচ্ছাসেবক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনী। শুধু তাই নয় একজন ক্যামেরা বাগিয়ে ফটো তোলায় ব্যস্ত থাকতে দেখেই পুলিশ তার ক্যামেরা কেড়ে নেন। সেই ফটোগ্রাফার ক্যামেরা ফেরত পাবার জন্য জোরাজুরি করলে তাকে ধমকে বলা হয় — শা মেয়েদের স্নানের ফটো তুলছিলি, চল্ থানায়।”
কিছুদূর গিয়ে পুলিশের লোকটি ক্যামেরার ফটো র রীল খুলে ক্যামেরাটা ফেরৎ দিয়ে দিলেন। বিনিময়ে –।
এঁদের প্রহরার আওতায় কী করে মেলায় আসা এবং আগে থেকেই কোন নেশার দোকান খুঁজে পান কবি হয়ে ওঠা বন্ধুরা, বুঝতে পারিনা।

কনকনে শীতের সকালে রোদে এসে অজয় নদের বিস্তীর্ণ বক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। একটু হাওয়া দিচ্ছে, মাথায় একটা টুপি থাকলে ঠাণ্ডাটা কম লাগতো। গায়ের শালটা ঘুরিয়ে মাথায় দিতে গিয়ে নজরে পড়ল এক দল মানুষ একটা মৃতদেহ নিয়ে শুকনো অজয়ের বালির উপর দিয়ে এগিয়ে আসছে। স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের পথ আটকে বলে দিল আরেকটু পিছিয়ে শশ্মান ঘাট হিসেবে চিহ্নিত জায়গায় শবদেহ দাহ করতে। লোকগুলো রাজী হয়ে বলল – ঠিক আছে। আমরা আসছি অনেক দূর থেকে। যিনি মারা গেছেন তিনি জয়দেব-কেন্দুলিতে তাঁর দেহ সৎকারের আকাঙ্খা করেছিলেন। তাই এখানে আসা। আমরা জানতাম না কোথায় ঘাট রয়েছে।”
ধীরে ধীরে হাঁটি হাঁটি পা পা’ করে কাছাকাছি গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ওঁদের সব কথা শুনতে পেলাম। বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম – আপনারা অত দূর থেকে, মানে বর্ধমান জেলা থেকে কাঁধে তুলে বডি নিয়ে এলেন ! “
ওঁদের একজন উত্তর দিলেন — না, আমরা ট্রাকে করে আসছিলাম, ট্রাফিক জ্যামে আর এগোনো গেল না।”
মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে উপরের দিকে হাত তুলে প্রণাম জানিয়ে সরে এলাম। এবার অজয়ের পাড় ধরে ফিরে এলাম রাধাগোবিন্দর মন্দিরের কাছে। সেখান থেকেই মূল মেলা পশ্চিম দিকে চলে গেছে টিকরবেতা গ্রামের অভিমুখে। টেরাকোটা কাজে সদ্য সংস্কার করা মন্দিরের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে বাঁদিকে মেলায় ঢুকবো ভাবছি, তখনই একটি ছোট আকারের এ্যম্বুল্যান্স সাইরেন বাজিয়ে ভীড়ের মধ্যে পথ করে কিছু দূর গিয়ে থেমে গেল। সেটি থামতে না থামতেই কয়েকজন মহিলা, সম্ভবত কোনো গ্রামের হবেন, ধরাধরি করে আরেকজন মহিলাকে ঐ ভ্যানে তুলে দিলেন আর তাঁদের পেছনে একজন গ্রামীণ মানুষ একটা কাপড়ের পুঁটলি কম্বল মুড়িয়ে ঐ ভ্যানে দুজন মহিলা সহ উঠে পড়লেন। এসব দেখতে একটা জটলার মধ্যে আমিও ছিলাম। জটলার লোকদের পারস্পরিক কথা বার্তায় জানলাম, এক গর্ভবতী মহিলা মেলায় বাউল গান সারা রাত শোনার পর সকালের দিকে তলপেটে ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েন। অবস্থা সঙ্গীন বুঝে বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা মহিলারা সেই আখরার এক পাশে কাপড় চাদর দিয়ে ঢেকে সন্তান প্রসব করান। নাকি ছেলে সন্তান হয়েছে। ভ্যানের দরজা বন্ধ হবার আগে কৌতূহল বশে উঁকি না দিয়ে পারলাম না। দেখি যিনি স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন তিনি চোখ মেলে সদ্য জন্ম দেয়া সন্তানকে খুঁজছেন, এক ঝলক দেখায় আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল, আরে এতো আমার মা। মা মা করে চিৎকার করতেই এ্যম্বুল্যান্স ভ্যানের দরজা বন্ধ করে সাইরেন বাজিয়ে ভ্যান ভীড় ঠেলে ছুটতে শুরু করেছে নিকটের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকে। আমার চিৎকার মেলার ভিড়ে মিশে গেল।

3 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ জয়দেব-কেন্দুলি মেলার বাউল উৎসব – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী(রাধু)

  1. এই লেখাটি পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। কি সুন্দর বর্ণনা! মনে হয় যেন নিজেই জয়দেবের মেলায় ঘুরছি। কত কিছু জানাও হয়। ধন্যবাদ।

  2. অনেক কিছু জানলাম। খুব সুন্দর বর্ণনা। শুভেচ্ছা রইল।

Leave a Reply to Krittika Bhaumik Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *