মুক্তগদ্যঃ জয়দেব মেলা – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

জয়দেব মেলা
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

জয়দেব মেলাকে অনেকেই কেন্দুলি মেলা বলে থাকেন। কেউবা বলেন জয়দেব-কেন্দুলি মেলা। বীরভূম জেলার অজয় নদের উত্তর তীরে কেন্দুলি গ্রামে বিরাট মেলা বসে পৌষ সংক্রান্তির দিনে চলে দীর্ঘদিন, কমপক্ষে এক মাস। মেলা শেষ হলেও অনেক পসারী পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন আরো কিছু দিন। বিশেষ করে, থালা বাসন বা ভারী ভারী কাঠের জিনিস নিয়ে, মায় ফার্নিচারের অবিক্রীত পসরা নিয়ে ফিরে যেতে মন চায় না। প্লাস্টিকের হরেক পসরা নিয়েও অনেকেই থেকে যান।

বিস্ময়ের সঙ্গে উল্লেখ্য এরকম সাতটি শুধু কেন্দুলি মেলার সন্ধান পাওয়া যায়:-

বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কেন্দুল বা কেন্দুলি গ্রামে, প্রবাদ আছে, কান্তকবি জয়দেব কিছুদিন বাস করেছিলেন। তাঁর স্মরণে প্রতি বছর কোন একসময় জয়দেবের নামে মেলা বসতো। তবে অনেক দিন আগেই উদ্যোক্তার অভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়।

আবার বর্ধমান জেলার খড়ি নদীর দক্ষিণ পাড়ে কেন্দুলি নামের এক মৌজায়, এই নামে এক সময় গ্রাম ছিল। যেখানে তিন দিনের জন্য এক স্নান মেলা বসে প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে। পাশের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা বলেন এই কেন্দুলিই কবি জয়দেবের জন্মস্থান। তবে এই ধারণার সপক্ষে কোন প্রমাণ আজও মেলে নি। এছাড়াও বীরভূম জেলার কেন্দুবিল্ব শব্দটি লোকমুখে কেন্দুলি হয়েছে। এই গ্রামের নাম পূর্ব থেকেই কেন্দুলি।

বর্ধমান জেলার জামুরিয়া থানার বনমালীপুর বা বেনালী গ্রামের পশ্চিম দিকে প্রতি বছরই ৫ই মাঘ থেকে ৭ই মাঘ তিন দিনের কেন্দুলি মেলা বসে। শ্রীচৈতন্যোত্তর সময়ে ছোট মন্দিরে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ ও শ্রীশ্রীগৌরনিতাই বিগ্রহের সেবাপূজা হয়। নাম সংকীর্তন, পালা গান, বাউলদের গান আর অন্নসত্রের ব্যবস্থা করা হয়।

পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল ছাড়িয়ে হীরাপুর থানার কালাঝরিয়া গ্রামে দামোদর নদের উত্তর পাড়ে পৌষ সংক্রান্তিতে তিন দিনের কেন্দুলি বসে প্রায় সাড়ে চারশ বছর ধরে। জনৈক বাউল জয়দেব ভক্ত পিয়ারীচাঁদ দাস। এখানেও স্নান যাত্রায় বাউল গান, পালা কীর্তন, নাম সংকীর্তন ও অন্নসত্রের বিপুল আয়োজন করা হয়।

দুর্গাপুর-বাঁকুড়ার রাস্তায় গৌরবেড়া গ্রামে বিরাট দামোদর নদের দক্ষিণ তীরে পৌষ সংক্রান্তিতে তিন দিনের স্নান যাত্রায় কেন্দুলি মেলা বসে। এই মেলাও বেশ প্রাচীন মেলা। এখানেও পূজা, নাম সংকীর্তন, পালা কীর্তন, বাউলরা গান গেয়ে মেলা প্রাঙ্গণ জমজমাট রাখেন।

কাছাকাছি মেটেলি গ্রামে মাকরী সপ্তমীতে তিন দিন ধরে কেন্দুলি মেলা বসে। জয়দেব ভক্ত গিরিমাতা নামের এক বৈষ্ণবী এই মেলার প্রবর্তন করেন। শোনা যায় মেলার পৃষ্ঠপোষক মালিয়াড়ার রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ হাতিতে চড়ে দ্বিতীয় দিনে মেলায় এসে প্রচুর দান করতেন। এই মেলায়ও পূজা, নাম গান, পালা গান, বাউল গান ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়।

ওড়িশার পুরী জেলার বালিপাটনা থানার প্রাচী নদীর তীরে কেন্দুলিশাসন বা কেন্দুলি গ্রামে এক সময় কান্তকবি জয়দেবের নামে মেলা বসতো। প্রাচী, কুশভদ্রা ও ধূময়া তিন নদীর মিলনে ত্রিবেণী সঙ্গমে প্রতি বছর মাঘ মাসের অমাবস্যা তিথিতে স্নান মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রায় একই নামে এই সাতটি মেলার সন্ধান পাওয়া গেলেও জয়দেব মেলা জয়দেব গ্রামে বা জয়দেব ধামের মকর সংক্রান্তি অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে প্রাচীন কাল থেকেই।

ডঃ গোপাল হালদার বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা গ্রন্থে (১ম খণ্ড, ২য় সং ) জানিয়েছিলেন – কেঁদুলীতে জয়দেবের মেলা পৃথিবীর প্রাচীনতম মেলা – জনতার কবি পূজা, জয়ন্তী উৎসব।”

ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন – The memory of Jayadeva by name as the author of the Gitagovinda has been kept green for nearly eight hundred years by means of the annual mela or fair in the village of Kenduli on the bank of the Ajaya river…”

ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশের ইতিহাস (১ম খণ্ড – প্রাচীন – ৫ম সং) গ্রন্থে লিখেছেন – প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে জয়দেবের স্মৃতি রক্ষার্থে কেন্দুবিল্ব (অজয়তীরস্থ) বিরাট মেলার অধিবেশন হয়।”

মেলা যাবার অনেকগুলো পথের একটা পথ হল,  বর্ধমান জেলার শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুর থেকে বাসযোগে বা শীতকালে মুচিপাড়া বামুন পাড়া মলান দীঘি হয়ে অজয় নদের বক্ষের উপর দিয়ে হেঁটে বা অস্থায়ী সাঁকোয় নদের তিরতির করে বয়ে চলা ধারা পেরিয়ে একেবারে জয়দেব-কেন্দুলি মেলা চত্বরে পৌঁছে যাওয়া যায়।
এছাড়া নিয়মিত পথ বোলপুর রেল স্টেশনে নেমে বাসে ইলামবাজার হয়ে জয়দেব বাসস্টপে নেমে। তবে মেলার কয়েক দিন আগে থেকেই বাস অনেক দূরে থাকতে বাধ্য হয়। কেননা হরেক রকম জিনিসের পসারীরা আসতে শুরু করে। সার দিয়ে তাদের যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকে।

এখন পৌষসংক্রান্তি আসতে কয়েক দিন বাকি আছে। মেলায় তখন ইচ্ছে হলে বা সাধক কবি জয়দেব টানলে আমরা যাবো মূল জয়দেব-কেন্দুলি।
আমাদের স্মরণে :–
মম শিরসি মণ্ডনং দেহি পদপল্লবমুদারম্।

আজ এই পর্যন্ত।

3 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ জয়দেব মেলা – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

  1. বেশ তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। ওপার বাংলা ছাড়াও , প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িষ্যা ছাড়াও এ বাংলার বিভিন্ন জেলা জুড়ে পৌষ সংক্রান্তির মেলার হালহদিশের সংক্ষিপ্ত হলেও বেশ উপভোগ্য এ লেখাটি। জয়দেবের মেলায় যাবার স্মৃতি আমারও আছে বলেই বোধহয় এই লেখাটির আবেদন আমার কাছে অন্যরকম সুন্দর। লেখককে ধন্যবাদ।

  2. কেন্দুলী মেলার কথা বহুশ্রুত। যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও কখনও যাওয়া হয়নি। তবে এই লেখায় যে সাতটি মেলার উল্লেখ রয়েছে সেই সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না। এই লেখা পড়ে অনেক কিছু জানলাম। ভালো লাগলো।

Leave a Reply to স্বপন নাগ Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *