ছোটগল্পঃ পুরনো স্কুলবাক্স – অলকানন্দা ঘোষ সেনগুপ্ত

পুরনো স্কুলবাক্স
অলকানন্দা ঘোষ সেনগুপ্ত

বাবা চলেছেন অফিসে, চামড়ার ভারী ব্যাগ নিয়ে, পিছনে চলেছি আমি – দু বেণী, লাল স্কার্ট, সাদা শার্ট, জুতো মোজা, হাতে বইখাতার বাক্স। বাস স্ট্যাণ্ডে খনিকক্ষণ দাঁড়ানোর পর স্কুলবাস এলে তাতে আমাকে চড়িয়ে দেওয়ার পর বাবার ছুটি, মানে অফিসের জন্য ছোটা – এ ছিল সোম থেকে শুক্র সকালবেলার রুটিন ! বাসে উঠে কিচিরমিচির পাখিদের দলে ভিড়ে যাওয়ার আগে স্কুলবাক্স সুখেন দা’র হাত হয়ে দড়াম শব্দে আমার আগে পেত বসার জায়গা – ড্রাইভার জয়ন্ত কাকুর পাশে কেবিনের মধ্যে। স্কুলে পৌঁছে সুখেন দার হাতেই আবার সশব্দ অবতরণ ! যার যার বাক্স বুঝে নিয়ে তাকে রেখে আসতে হত ক্লাসরুমের নির্দিষ্ট ডেস্কের ওপর। ক্লাসে সবারই তো ওই রকম চৌকো সাদা বাক্ম ছিল। আমাদের ছোটবেলায় ওটাই ছিল চল – ধাতব বাক্স টা দোলাতে দোলাতে মহানন্দে আমরা প্রায় সবাই যেতাম স্কুলে, তখনও স্কুল ব্যাগের প্রচলন হয়নি। বাক্সের মালিকানা নির্ধারিত হত বাক্সের ওপরে লাগানো কাগজের চৌকো লেবেলে লেখা নাম, ক্লাস সেকশন আর রোল নম্বর দিয়ে। তবুও, হামেশাই সেটা বেহাত বেদখল হওয়ার ঘটনা আকছার ঘটতে দেখা যেত।
স্কুলে বিশিষ্ট ভুলোদের মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। এমনই সু( নাকি দু)নাম ছড়িয়েছিল যে কারোর বাক্স হারালেই অমুক ক্লাসের তমুকের কাছে খোঁজখবর করতেও আসত লোকজন। সব সময় অবশ্যই দোষী আমি ছিলাম না। আসলে তখন তো, আমার কখনই মনে হতনা যে ভুল টা আমার, মনে হত কেউ আসলে ভুল করে, আর আমি পরিস্থিতির শিকার হই। অজানা কারও অপর খুব অভিমানও হত। বেশ কয়েকবার বাক্স হারিয়ে, বদল করে টীচার দের বকুনি, বাড়িতে শাসানি, বন্ধুদের হুঁশিয়ারি তে তিতিবিরক্ত হয়ে আমিও সবাইকেই সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছিলাম। মনে মনে এই হেনস্থা র একটা জবাব দেওয়ারও ইচ্ছে ছিল। তখন বাবার অফিসের লাইব্রেরী থেকে আসা বইয়ের কল্যাণে আগাথা ক্রিস্টি আর কোনান ডয়েল পড়ে, মিস মেপল অথবা শার্লক হোমস হয়ে গেছি প্রায়, ভাই আমার অ্যাসিস্ট্যাণ্ট । যে কোন ঘটনাতেই রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি, কোন কোন টা নিজেদের মত করে সমাধানও করে ফেলছি। আত্মবিশ্বাস বাড়ছে বেশ। প্রতিদিন স্কুলে বাক্সখানি যথাস্থানে রাখার পর মাঠে চলত জোরদার খেলা। একদিকে চু কিতকিত, অন্যদিকে বুড়ি বসন্তী, বা ঘাসের মাঠে পা ছড়িয়ে ‘কলাগাছ’ খেলা। একদিন খেলতে খেলতে জল তেষ্টা পাওয়ায় মাঠের পাশের কলে জল খেতে গিয়ে নজেরে পড়ল ক্লাসরুমে আমার সীটটার দিকে, একেবারে করিডোর ঘেঁষেই ছিল আমার বসবার জায়গা। আধো অন্ধকারে মনে হল আমার সীটের কাছে যেন কেউ? জেগে উঠল গোয়েন্দা সত্তা! তড়িৎ গতিতে নির্বিকার মুখে গিয়ে ঢুকলাম সেখানে, দেখি ক্লাসরুম ঝাড়পোঁছ করছে স্কুলের ক্লিনিং এর লোক অ্যাণ্ড্রু আর গোমস কাকু, কিন্তু আমাকে দেখে খুব খুশি হল না, নিজেদের মধ্যে আবার নিচু গলায় কি সব আলোচনাও চলছে দেখলাম! যদিও এরাই রোজ পরিষ্কার টরিষ্কার করে, স্কুলের গাছের আমটা, জামটা লিচুটা ভালবেসে কখনো সখনো দু একটা প্রাপ্তিও ঘটে ওদের থেকে, স্পোর্টসের মাঠে চুন দিয়ে যে লাইন কাটে গোমস কাকু, তা গেমস টীচার মৃদুলা দি বলেন, স্কেল ফেলে কাটলেও অত সোজা হবেনা ! এ হেন গোমস কাকু কেন কাউকেই তো বাদ দেওয়া যাবেনা সন্দেহের তালিকা থেকে ! পাকা গোয়েন্দার মত করিডোরে চলে বেড়াচ্ছি, খেলার আশা ত্যাগ করে, বন্ধুদের আহ্বান উপেক্ষা করে ! একটু পরে সুবিধে হলনা দেখে ওরা চলে গেল অন্য দিকে। পরদিন আবার মাঠে চলছে খেলা, আমার মনে চলছে অনুসন্ধানের উত্তেজনা, নজর ক্লাসরুমের দিকে এবং আবারো গোমস এণ্ড কোং এর আবির্ভাব সরঞ্জাম হাতে ! আমি তো তৈরিই ছিলাম, এদিক ওদিক করছি, রুমে ঢুকছি না কিন্তু নজর থাকছে। ঝাড় দেওয়া, পরিষ্কার করা হল, এরমধ্যে মাঠে আবার ‘কলাগাছ’ অনেক উঁচু হয়ে যাওয়ায় একজন লাফাতে গিয়ে উলটে পড়েছে, খুব হৈচৈ চলছে, দৃষ্টি পলকের জন্য চলে গিয়েছিল ওদিকে, পরক্ষণেই যেই ক্লাসরুমের দিকে এসেছি, কী কাণ্ড ! আবার আমার সীটের কাছে ওই দুজন, আর নিচু হয়ে কিছুর আলোচনা চলছে দেখছি ! নাঃ এবার আর অসাবধান হলে চলবেনা, একটু আড়াল থেকে লক্ষ্য করতে থাকলাম। হুঁ হুঁ বাবা রোজ রোজ আমার নামে দোষ দেওয়া, এবার হাতে নাতে ধরব! আমার বাক্সটা নিয়ে অ্যাণ্ড্রু রাখল ব্ল্যাকবোর্ডের দেওয়ালের কাছে, এবার তাহলে ওটা নিয়ে অন্য কারোর ডেস্কে রেখে, তার টা রাখবে আমার জায়গায়! আর ভুলো বলে দোষ পড়বে আমার ওপর! এটাই তো বুঝতে চাইছে না কেউ! বেঞ্চটাকে তুলে সরানোর চেষ্টা চলতে লাগল! সর্বনাশ বেঞ্চসুদ্ধু সরিয়ে দেবে নাকি! ভারি ইয়ে তো! নিজের গোয়েন্দা সত্তা একেবারেই ভেঙে পড়ার অবস্থা, বেশ দলা পাকানো কান্না আসছে, কেন আমি কী ই বা দোষ করলাম, এভাবে আমার সাথেই কেন এসব হয়? ভাবছি অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসব, তখনই ‘পেয়েছি ‘ বলে গোমস কাকু অ্যাণ্ড্রুকে একটা জিনিস দেখাল। যদিও গল্পে পড়েছি, গোয়েন্দার মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ থাকবে, কিন্তু এত সব থিয়োরি মাথায় রাখতে না পেরে অকুস্থলে অবতীর্ণ হলাম ! আমাকে দেখে অ্যাণ্ড্রু বলল এই যে তুমি এই ক্লাসে পড় না? দেখতো এটা কার জান কিনা? আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম দু সপ্তাহ আগে জন্মদিনের সময় মাসীমণি, মিষ্টি দিদিরা পুণে থেকে যে চার রঙের রিফিলওয়ালা পেন দিয়েছিল এবং কয়েকদিন পরে হারিয়ে গিয়েছিল সেই পেনটা যে ! কোনমতে বললাম যে সীটটায় আমিই বসি আর পেনটাও আমারই ! একটু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে অ্যাণ্ড্রু বলল দেখো, তোমার তো? না হলে অফিসে জমা দিয়ে দেবো। গোমস কাকুর সংযোজন, এটাই নাকি বেঞ্চের তলায় বেকায়দায় আটকে গেছিল, বলে কিছুতেই সোজা করে বসানো যাচ্ছিলনা বেঞ্চ টাকে। এমন একটা জিনিস উদ্ধার হল, কিন্তু আমার মুখে হাসি ফুটল না তেমন, ওরা খানিকটা হতাশ হয়েই চলে গেল। কিন্তু নব্য গোয়েন্দা ভাবছিল এটা কি করে সম্ভব হল? এ তো একেবারে উল্টোপাল্টা হয়ে গেল! পেন টা হারিয়ে মনের দুঃখে নিজেরাই অনেক আলোচনা পর্যালোচনা করে কেস টা সল্ভ করেও তো ফেলেছিলাম ! গত রবিবার বাবার সাথে দুই ভাইবোন যখন বাজারে যাই, পেনটাও যায় হাতে হাতে, একবার ভাই, তো একবার আমি – স্প্রিংটা টেনে নামালেই একটা রিফিল ঢুকে গিয়ে, আর একটা তার জায়গায় উঠে আসে, পেন টা দিয়ে লেখার থেকে এই খেলাটাই বেশি মজার ! ইলিশ মাছ কেনার পর মায়ের দেওয়া জিনিসপত্রের লিস্টিতে দাগ দেবার জন্য বাবার যখন পেনের দরকার পড়ল, তখন তো এই পেনটাই দিয়েছিলাম। বাবাও পেনটার প্রসংশা করেছিলেন! তারপর থেকেই তো নিপাত্তা পেন ! ভাইয়ের সাথে রীতিমত ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে, বাবা কেও জিজ্ঞাসাবাদ করে, দোষী আমরা ঠিক করেও ফেলেছিলাম, ঠিক ছিল সামনের রবিবারে বাবার সাথে আবার বাজারে গিয়ে ওই মাছের দোকানের কাকুকে জিজ্ঞাসা করলেই সব জল্পনার ইতি হবে। এতসব কিছুর পরে এটা এখানে স্কুলে কিভাবে এল? সেটা রহস্যই থেকে গেল অবশ্য! যাই হোক, এরপর কথায় কথায় রহস্যের গন্ধ পাওয়ার অভ্যাস টা ত্যাগ করেছিলাম! তারও কয়েক বছর পর কাঁধে উঠেছিল স্কুলব্যাগ, তখন নাইন টেন। বাক্সবিদায় হয়নি, মালিকানা ছিল স্থায়ী, কিন্তু স্কুলবাক্সের ভূমিকা বদল হয়েছিল। ক্রমে তা হয়ে উঠেছিল কিশোরী বয়সের সুখ দুঃখের নিজস্ব কুঠুরী। বড় হওয়া, বেড়ে ওঠার জীবনে দৈনন্দিন তুচ্ছাতিতুচ্ছ সোনা মানিকের টুকরো, , সরস্বতী পুজোয় পাওয়া প্রথম হলুদ গোলাপ, কারোর অর্থহীন ভাললাগার দুকলম পক্ষীরাজি পরোয়ানা, যৌথ পরিবারে অমনোযোগে বেড়ে ওঠা, মনোজগতের নানা ওঠাপড়ার একান্ত নিজস্ব স্বাক্ষর সাদরে সযত্নে বহন করত সে। চিলেকোঠার ঘরে সন্ধান করলে এখনও হয়তো পাওয়া যাবে, সেই স্কুলবাক্স ধূলিধূসরিত মলিন, কিন্তু স্মৃতিতে উজ্জ্বল! ডালা খুলতেই বেরিয়ে পড়বে উথলে ওঠা ফুটন্ত দুধের পাত্র, উনুনের আঁচের আভায় লাল হয়ে ওঠা মায়ের ঘোমটা ঘেরা প্রোফাইল, আমলকীর আচার, ডালের বড়ি, শীতের রোদ পিঠে দিয়ে কমল ভট্টাচার্য্যের টেস্ট ক্রিকেট কমেণ্ট্রি আর থরে থরে সাজানো চিচিং ফাঁক হওয়া আলিবাবার গুপ্তধন !

12 thoughts on “ছোটগল্পঃ পুরনো স্কুলবাক্স – অলকানন্দা ঘোষ সেনগুপ্ত

  1. Sundar lekha. Aneker chotobelar kotha mone koralen. Memory kom holew sokole chotobelata burobelateo mone korte pare. Anek bishoy I hariye jai. Kintu o I somoy ta sokoler smriti te ujjal thake. Porer lekhar opekhai thaklam.

  2. অপূর্ব ,এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম গল্পটা আর টাইম মেশিনে চড়ে পৌঁছে গেলাম সেই স্কুল জীবনের বর্ণময় দিনগুলিতে– লেখকের অনবদ্য কলমে যা হয়ে উঠেছে টাটকা ও তরতাজা , তখন আমারও ছিল এক স্কুল বাক্স যেই বাক্স হাতে আমরা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম ভাবতেও রোমাঞ্চ অনুভব করি, এখনও সযত্নে রাখা আছে আমার বাক্সটি কিশোরী বেলার স্মৃতিটুকু বহন করে l এমন মনকাড়া গল্পের আরও দাবি রইল l অভিনন্দন জানাই লেখক মহাশয়া কে l

  3. Khub khub sundor lekha… Onek purono katha mone porlo.. Primary school e amio ei bakso nie jetam… Tao se amar chhilo na.. Masir.. Masir haat bodol hoe didi… Tarpor ami… Daarun smriti jorano lekha ❤🌹

    1. চমৎকার একটি গল্প। অনেক কিছু ফিরিয়ে দিল। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত সঙ্গে ছিল। তার পর হল “খাজানা বচপনকি।”লে এখন রং করে ছবি এঁকে সি ডি র বাক্স কিন্তু প্রাণে ধরে কাউকে দিতে পারিনি। ধন্যবাদ অলকাদি। আমাদের ষাটের দশক জিন্দাবাদ।

  4. তোমাদের মন্তব্য আমার মনের জোর বাড়িয়ে দিচ্ছে। সবাইকে ধন্যবাদ সময় করে পড়েছ বলে।

    1. 💕কবির মূল্যায়ন এই অকবির কাছে খুব দামী

  5. বাহ্, ভারী আরাম পেলাম লেখাটা পড়ে । স্মৃতিমেদুর, ঝরঝরে, মনকেমন করা একটা লেখা …একটা সময়ের দলিলও বলতে পারো …..

  6. চমৎকার।আমার ছোটবেলা মনে পড়ে গেল।

  7. অপূর্ব লাগলো। কতো কতো কথা যে মনে পরে গেল, ওই রকম স্কুল বাক্স আমাদের বয়সের সকলেই প্রায় ব্যবহার করেছি। আর পরবর্তী সময়ে তাই হয়ে উঠেছে গুপ্তধন লুকিয়ে রাখার জায়গা।
    দারুন লেখনী তোমার। আর ও চাই।

  8. কী ভালো লেখা! এক টুকরো ছেলেবেলা ফিরে এল যেন! আমার সেই বাক্সটা এখনও রাখা আছে, মায়ের কাছে। 🥰

Leave a Reply to Sangita Chakraborty Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *