মুক্তগদ্যঃ রাস – ভূমিকা গোস্বামী

রাস
ভূমিকা গোস্বামী

ভগবানপি তা রাত্রীঃ শরদোৎফুল্লমল্লিকাঃ।
বীক্ষ্য রন্তুং মনশ্চক্রে যোগমায়ামুপাশ্রিতঃ।। (শ্রীমদ্ভাগবত)

শারদ পূর্ণিমার রাতে মল্লিকা ফুলে শোভিত ব্রজ কাননে অখিল রসামৃত সিন্ধু গোপীনাথ সব গোপীদের সাথে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা করলেন। যোগমায়াকে আশ্রয় করে এই লীলা করবেন ঠিক করলেন। প্রশ্ন হল, যোগমায়াকে আশ্রয় করে কেন ?
যোগমায়াকে চিনতে হলে প্রথমে মায়াকে চিনতে হবে। মায়ার দুটি কাজ। সত্যকে ঢাকা। মিথ্যেকে সত্যের মতো দেখানো।
শ্রুতি বলছেন –সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম। এই জগতের সব-ই ব্রহ্মময়। ব্রহ্ম ছাড়া কোন বস্তু নেই। এটাই পরম সত্য। কিন্তু মায়া এই সত্যকে দেখতে দেয় না। ঢেকে রাখে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন –“মম মায়া দুরাত্ময়া” । নিখিল জীবজগৎ এই মায়ার অধীন। তাই এই মায়াকে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য।

এবার যোগমায়াকে চিনতে চেষ্টা করি। মায়ার মতো যোগমায়াও ঢেকে রাখেন। ভগবান যে শক্তি দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখে পৃথিবীতে তিনি মানুষের মতো লীলা করেন তার নাম যোগমায়া। তিনি নিজেকে কেন ঢাকতে চাইলেন ? ভগবান হলেন সর্বজ্ঞ সর্ব শক্তিমান।এই শক্তিমত্তার প্রকাশ থাকলে মানব রূপে তাঁর লীলা অসম্ভব। মা যশোদা বাৎসল্য প্রেম প্রকাশ করার সুযোগ পেতেন না। গোষ্ঠে গিয়ে সখাদের সাথে খেলা , অন্য সখাদের উচ্ছিষ্ট খাওয়া সম্ভব হত না। গোপীরা কখনও জানতেই পারেন নি শ্রীকৃষ্ণ পরাৎপর পরব্রহ্ম। তাই এই ঢাকাঢাকি।

এ পরাখ্যা অচিন্ত্য শক্তি। পরা শক্তি অর্থ স্বাভাবিক শক্তি। অচিন্ত্য শক্তি অর্থ হল অঘটন ঘটন সামর্থ্য বিশিষ্টা শক্তি। এই যোগমায়া শ্রী কৃষ্ণের আজ্ঞাবহ। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় এই যোগমায়া যা ঘটান তা হল ঘটন। তাঁর আজ্ঞাবহ হলেও কখনো কখনো তাঁর লীলা সৌষ্ঠবযুক্ত করার জন্য তাঁর অজান্তে অনেক কিছু যোগমায়া ঘটান। এটা হল অঘটন। যোগমায়া যখন অঘটন ঘটান তখন পরম মাধুর্যের সৃষ্টি হয়। তিনি সবসময় যোগমায়াকে আশ্রয় করেই লীলা করেন। কিন্তু যে লীলায় বিশেষ অঘটন ঘটবে সেক্ষেত্রে আশ্রিত না হয়ে উপাশ্রিত হন।
“উপ- আধিক্যেন আশ্রিতঃ”। সর্বতোভাবে যোগমায়ার হাতে নিজেকে ছেড়ে দেন। রাসের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাই উপাশ্রিত পদ প্রয়োগ করেছেন।

রাসে প্রবেশ করতে চলেছি। রাসবিহারী ও রাধারানী কৃপা করুন। তাঁদের কৃপা ছাড়া এই আস্বাদন অসম্ভব। প্রবেশের আগে আমাদের একটা কথা মাথায় রাখতে হবে রাস কোনও পার্থিব নর নারীর জৈবিক মিলনের কাহিনী নয়। রাসলীলার কথা বলতে গিয়ে শ্রীধর গোস্বামী পাদ শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে বলেছেন—
কন্দর্পদর্পহারী শ্রীকৃষ্ণ জয়যুক্ত হোন। তিনি মন্মথমন্মথ । মদনকে পরাজিত করেছেন তিনি। শ্রীকৃষ্ণ আত্মারাম। ” আত্মনি আরমতে আত্মারামঃ” আত্মাতেই তিনি রমন করেন। দেহ ও ইন্দ্রিয়ের অতীত যে আত্মিক সত্তা আছে তা থেকেই তাঁর সব সুখ আনন্দ আস্বাদিত হয়ে থাকে।

সাধারণ মানুষ ইন্দ্রিয়ারাম। তাকে সুখ দেয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ। তাই হাটে মাঠে রাসের আলোচনা করা হয় না। গীতা বলছেন– ” জ্ঞাতুং দ্রষ্টুং প্রবেষ্টুম্ ” তাঁকে জেনে দেখে তবেই প্রবেশের অধিকার মেলে। অখিল রসামৃত সিন্ধু তিনি। এই রসের রসিকজনই রাস লীলা আস্বাদন করতে পারে। ভাগবত বলছেন -” মূহুরহ রসিকা ভুবি ভাবুকাঃ “

শ্রুতি বলছে –ঈশ্বরকে আকুল হয়ে ডাক। তিনি তোমার ডাকে সাড়া দেবেন। তোমার কল্যাণ করবেন।
ভাগবত সংবাদ দিয়েছেন –কিন্তু জীব তুমি যে ডাকতে জান না তোমার ক্ষীণ কণ্ঠের ধ্বনি তাঁর গোলকের আসন পর্যন্ত পৌঁছয় না। তাই তো অনুগ্রহায় ভক্তানাং তাঁর মানব জন্ম। বরং কান পেতে থাক তুমি। শোন , তিনি তোমাকে ডাকছেন। মধুর মুরলীর তানে তোমাকে আকুল প্রাণে ডাকছেন। তোমার থেকে সহস্রগুণ আর্তি নিয়ে তিনি তোমাকে তাঁর অভিমুখে আকর্ষণ করছেন।
উপনিষদ বলছে–শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ। অমৃতের পুত্র বিশ্বের আমরা সবাই। পিতা নোহসি, পিতা নোবধি। আমাদের বাবা আছেন। শুধুমাত্র আছেন না, আমাদের জন্যও তিনি আছেন। এক পিতার সন্তান বিশ্বের যে কোনও কোণে যেই রয়েছে সে আমার ভাই। বসুধৈব কুটুম্বকম্।

ভাগবতের বার্তা –তিনি আছেন। তিনি আসেন। তিনি ডাকেন।

নির্গুণ নিরাকার ধ্যানের অতীত সত্তা। যিনি ব্রহ্ম, পরমাত্মা, নিখিল জীবের আত্মার আত্মা, তিনিই ব্রজবনে নন্দনন্দন। শুরু করলেন তাঁর নরলীলা। নর লীলা সর্বোত্তম লীলা।

শ্রীকৃষ্ণের চারটি মাধুর্য। রূপ মাধুর্য, বেণু মাধুর্য, প্রেম মাধুর্য, লীলা মাধুর্য।
তাঁর ভুবন ভোলানো রূপ , বংশীর মধুর ও আকুল করা ধ্বনিতে ডাকছেন গোপীদের সপ্রেমে । রাস লীলা করবেন রাসবিহারী।

এই গোপীরাও কেউ সাধারণ নন । একেকজন নিত্যসিদ্ধা। সাধন সিদ্ধা। তাঁরা কান পেতে আছেন গোবিন্দের ডাকের অপেক্ষায়।

ব্রজবনের শোভা আজ মধুর মনোহর , মুগ্ধকারী। শারদচন্দ্রের বিচ্ছুরিত জোছনা। বাঁশির ধ্বনি যাঁরা শুনতে পেলেন তাঁরা শোনামাত্রই ছুটলেন শ্রীকৃষ্ণ অভিসারে। যাদের কান বধির তারা শোনেনি। কারো কান অজ্ঞতায় বধির, কারো বা অতি বিজ্ঞতায়। কেউ অলসতায় । কেউ অত্যন্ত কর্ম কোলাহলে। কেউ স্বর্গ কামনায়। কেউ আবার মোক্ষ কামনায় বধির। এতটুকুও আত্মসুখবাঞ্ছা যাদের আছে তারা মুরলীর তান শ্রবণে অযোগ্য। যাঁদের কানে বংশীর ধ্বনি পৌঁছেছে , তাঁরা যে অবস্থায় ছিলেন সেই ভাবেই শ্রীকৃষ্ণের কাছে চললেন। গো দোহনরতা গোপী , কেউ উনুনে দুধ বসিয়েছে , কেউ উনুনে ভাত বসিয়েছে, না নামিয়েই চলেছেন। এভাবে কেউ পরিবেশন অসমাপ্ত রেখে ছুটছেন। কেউ শিশুকে দুধ খাওয়ানো অসমাপ্ত রেখে, কেউ পতিসেবা অসমাপ্ত রেখে ছুটেছেন। কেউ একটি চোখে কাজল পরেছেন আর একটিতে পরা হয় নি। হাতের অলংকার পায়ে আর পায়ের অলংকার হাতে পরেছেন। ভাবতে পারছেন ! কতখানি ভাব তন্ময়তা থেকে এমন বিপর্যয় সম্ভব , সেটা মানব বুদ্ধির কল্পনার অতীত।
পদকর্তা গোবিন্দ দাস গেয়েছেন–” বিছুরি গেহ নিজক দেহ।”
গেহধর্ম ও দেহধর্ম দুই ভেসে গেল মুরলীর আহ্বানে। তাহলে গোপীদের সতীত্ব ?
কবিরাজ গোস্বামী কী বলছেন শুনি,– ” যাহার সতীত্ব বাঞ্ছে লক্ষ্মী অরুন্ধতী ” আগেই বলেছি গোপীরা সাধারণ নন। এ যেন গীতায় শ্রীকৃষ্ণের আদেশ—মামেকং শরণং ব্রজ। ভাগবতে জীবন্ত হল।

অনেক পথ পার হয়ে , অনেক বাধা অতিক্রম করে গোপীরা কৃষ্ণের কাছে যমুনার তীরে ছুটে এসেছে। যেন বর্ষার নদী। উদ্দামবেগে ছুটে এসেছে সাগরে। অবলা গোপীরা এত বাধা ঠেলবার শক্তি কোথায় পেল ? দুটি উৎস থেকে । এক – গোপীর অন্তরে কৃষ্ণানুরাগের তিব্রতা । দুই- শ্রীকৃষ্ণের অন্তরে আছে গোপীর জন্য প্রবল আকর্ষণ।

এবার গোবিন্দ বললেন- “স্বাগতং বো মহাভাগা।” হে সুন্দরী মহাভাগ্যবতী ব্রজরমণীরা। তোমরা এত রাতে বনের মধ্যে কেন এসেছ ? জান না বনের মধ্যে হিংস্র জন্তুরা আছে ? তোমাদের বাড়ির লোকজন হয়তো তোমাদের খোঁজ করছেন। তোমরা কি বনের শোভা দেখতে এসেছ ? ঠিক আছে দেখা হয়েছে তো? এখন ব্রজে ফিরে যাও। “প্রতিযাত ব্রজম্”

কী বলবেন গোপীরা ! লজ্জা যেন তাদের জিভকে বেঁধে রেখেছে। নিজের অনুরাগের কথা কীভাবে বলবেন। আবার ভাবছেন ,– বাঃ বেশ তো , নিজেই ডেকে এনে এখন চলে যেতে বলছেন। নন্দনন্দনের উপেক্ষায় চোখে জল এসে গেল ওদের। তবু ওরা এক পা ও নড়ল না। মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে লাগল। পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মাটিতে আঁচড় দিতে লাগল। এ কেমন ব্যবহার গোবিন্দের। মন প্রাণ হরণ করে উদাসীন হবার ভান করছে। আমরা যে তাঁর নিশুল্ক দাসী। তা কি তিনি জানেন না।

অন্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণ অবশেষে তাদের থাকতে অনুমতি দিলেন । রাসক্রীড়া আরম্ভ হল। শত কোটি গোপীর সাথে একাকী খেলবেন রাসবিহারী। সকলেই দেখেন তাদের পাশে শ্যামকে। মধুময় খেলা চলতে থাকলো।

গোপীর হৃদয় প্রেমের সিন্ধু । তার মধ্যে অগণিত তরঙ্গমালা। তার মধ্যে দুটি নতুন তরঙ্গ উঠল। একটি মদ, অপরটি মান। গোপীদের মনে মদ হল – আমরা কৃষ্ণ ধনে ধনী। ব্রহ্মাণী ইন্দ্রানীরও এমন ভাগ্য নেই। আমরাই ত্রিভুবনে শ্রেষ্ঠা।

এদিকে সব গোপীর শিরোমণি হলেন রাধা। যদিও ভাগবতে রাধার নাম নেই। “অনয়া রাধিতো” বলা হয়েছে । শ্রীজীব বলেন –রাধয়তি গোবিন্দং , গোবিন্দেন বা রাধ্যতে ইতি—– অর্থাৎ ,যে রমণী গোবিন্দকে আরাধনা করেন অথবা গোবিন্দ যাঁকে আরাধনা করেন তিনি রাধিকা। কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি।
সেই তিনি ভাবছেন — আমি সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠা । অথচ গোবিন্দ আমার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি কেন দিচ্ছেন না। তাঁর হল মান।
মদ আর মান দুই কৃষ্ণ প্রেমের বাধা।
রসিক -শেখর শ্যামসুন্দর তাই রাস মণ্ডল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন—অন্তর্ধান করলেন।

যাঁদের মন কৃষ্ণশূন্য স্থানে ঘুরছিল তাঁরা হঠাৎ দেখল তাঁদের পাশে প্রাণের দেবতা নেই। অমনি তাঁদের মদ প্রশমিত হল।
আর মানিনীকে নিয়ে একাকী নির্জন স্থানে গেলেন শ্রীকৃষ্ণ। এদিকে অন্য সব গোপী কৃষ্ণ বিরহে কাতর হয়ে কৃষ্ণের আচরণ অনুকরণ করতে লাগলেন– কৃষ্ণের মধুর গমন, মধুর হাসি। তাঁর বাল্য লীলা। গোপীরা পরস্পর পরস্পরকে বলতে লাগলেন — আমিই কৃষ্ণ। তারপর গোবিন্দের গুণগান করতে করতে বন থেকে বনান্তরে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলেন। গাছপালা , ফুল,পশু , পাখী সকলের কাছে তাঁদের গোবিন্দের সন্ধান পেতে চাইলেন। তাঁদের অন্তরে বাইরে তখন কৃষ্ণ স্ফুর্তি। স্থাবর জঙ্গম সর্বভূতে উন্মুক্ত আকাশের মতো কৃষ্ণতন্ময়তা।

কোথাও গোবিন্দকে পেলেন না। তখন মাটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন মাটির গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তৃণাঙ্কুর। ব্রজঙ্গনাদের মনে হল ধরণী দেবীর অঙ্গে পুলকাবলী। এত পুলক ! নিশ্চয়ই শ্রীগোবিন্দের চরণ-স্পর্শ পেয়েছে । –হে ধরণী বল, তিনি কোথায় ?

এমন সময়ে ওঁরা বনের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের চরণ দেখতে পেলেন। যাতে ধ্বজ , অঙ্কুশ, বজ্র, পদ্ম ও যব চিহ্ন ছিল। সেই পদ চিহ্ন ধরে অন্বেষণ করতে করতে সামনে কোন রমনীর পদচিহ্ন দেখতে পেলেন। তাঁরা দুঃখিত অন্তরে ভাবতে লাগলেন – তাহলে এই সেই রমণী–যাঁর জন্য গোবিন্দ তাঁদের ত্যাগ করেছেন। তাঁরা নিজেরা বলাবলি করতে লাগলেন — এই দেখ সখি , এখানে রমণীর পদচিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। মানে প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণ, তৃণাঙ্কুরে প্রেয়সীর সুকোমল পদতল ব্যথিত হওয়ায় তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আর এই দেখ, এই দেখ সখি, এইখানে গোবিন্দের পদচিহ্ন কত গভীর। নিশ্চয়ই প্রিয়তমাকে বহন করার জন্য ই এমনটা হয়েছে।

এদিকে আনন্দের আতিশয্যে রসিকশেখর রাধারাণীকে বললেন –“স্কন্ধ আরুহ্যতাং”আমার কাঁধে ওঠো। এই অতি আদর মাখা কথায় শ্রীরাধার প্রেমসিন্ধু উদ্বেলিত হয়ে আর একটি নতুন তরঙ্গের সৃষ্টি করল। সেই তরঙ্গের নাম প্রেমবৈচিত্ত্য। প্রিয়তমের কাছে থেকেও গাঢ় অনুরাগবশতঃ যে বিরহস্ফুর্তি, তার নাম প্রেমবৈচিত্ত্য। গাঢ় অনুরাগে শ্রীরাধার বুদ্ধি বৃত্তি অতি সূক্ষ্ম হয়ে যায়। এক সঙ্গে দুটি বস্তুতে মন নিবেশ করতে পারেন না। শ্রীকৃষ্ণ আর তার গুণমাধুর্য। “কাঁধে ওঠো “শোনার সাথে সাথেই রাধার মনে হল –আমার দয়িত এত মধুর ! এই মাধুর্য ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ-দয়িত হারিয়ে গেলেন। না দেখতে পেয়ে বিরহ জাগল।

ধুলোয় পড়ে আছেন জীবনের স্পন্দন হীন বৃন্দাবনের মূর্তিমতী শোভা , বিরহ -কাতর রাধারাণীর দেহ। অন্য গোপীরা দেখতে পেয়ে তাঁদের সকলের শুশ্রূষায় শ্রীরাধার দেহে আবার জীবনের স্পন্দন দেখা গেল। সকলের অন্তরে গভীর বিশ্বাস রাধারাণীকে যখন পেয়েছি তখন শ্যামসুন্দরের দর্শন মিলবেই।

সামনে নিবিড় বন। সকলেই বললেন –আমরা যত খুঁজব , গোবিন্দ তত পালিয়ে যাবেন । বনের কাঁটা ঝোপে তাঁর সুন্দর কোমল চরণ কন্টকাবিদ্ধ হবে। সেটা হতে দেব না। কৃষ্ণ সুখৈক তাৎপর্য। কৃষ্ণের সুখেই গোপীদের সুখ। তাঁরা ভাবলেন– আমরা বরং সেই কালিন্দী যমুনার তটে বংশী বটেই ফিরে যাই। যতক্ষণ সেচ্ছায় তিনি বেরিয়ে না আসেন, আমরা কাঁদব আর অপেক্ষা করব।

শ্রীকৃষ্ণকে না পেয়ে তাঁদের মন নিজের দেহসুখের অথবা গৃহসুখের চিন্তা করে নি। তাঁদের মন শ্যামসুন্দরের ভাবনায় বিভোর ছিল। এই অবস্থাটি কি সুন্দর, শ্রীশুকদেব দর্শন করে দেখাচ্ছেন –তাঁরা সকলে কৃষ্ণমনা, কৃষ্ণকথামগ্না, কৃষ্ণানুসন্ধানপরা, প্রেমতন্ময়তায় কৃষ্ণভাবে ভরা। অন্তরে বাইরে মনে প্রাণে সর্বতোভাবে তাঁরা কৃষ্ণময়ী। প্রত্যেকেই যেন ভক্তিদেবীর এক একটি মূর্তিমান বিগ্রহ।

স্মরণে আলাপে কৃষ্ণ-বিরহবেদনা ও দর্শনলালসা চরমে পৌঁছালো। ঠিক তখনই করুণার উদয় হল। দুর্বিসহ বিরহে গতপ্রাণাপ্রায় ব্রজগোপীমণ্ডলীর মধ্যে উদিত হলেন ব্রজ-জীবন। আসলেন তিনি হাসি মুখে। পীতবসন, বনমালাভূষিত , সর্বসৌন্দর্য-মাধুর্যের আকর সাক্ষাৎ মদনমোহন। প্রসন্নবদনপদ্ম, করুণনয়ন, স্নিগ্ধ। দর্শন মাত্রই দূর হয় সব তাপজ্বালার।

তখন প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণকে দেখে আনন্দে উৎফুল্ল নয়নে দেহে প্রাণ ফিরে এলে যে অবস্থা হয় গোপীদের তাই হল। ওঠার শক্তি নেই।

কোনরকমে তাঁরা সকলে মিলে গোবিন্দকে স্বাগত জানালেন।

স্বপক্ষা ভেদে দুই শ্রেণীর গোপীর কথা বলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গোপীদের প্রধানত দুটি ভাব। আমার কৃষ্ণ, ও আমি কৃষ্ণের। আমার কৃষ্ণ আমার ই সর্বস্ব, আর কারো নয় –এটি মদীয়তাময় প্রেম। এর অপর নাম মধুস্নেহ। রাধারানী ও তাঁর সখীদের এমন ভাব। এঁদের স্বপক্ষা বলা হয়।

আর আমি কৃষ্ণের দাসী। বহুদাসী আছে তারমধ্যে আমার ভাগ্য , আমি ও একজন হতে পেরেছি।– এই প্রেমের নাম তদীয়তাময় প্রেম। এর অপর নাম ঘৃতস্নেহ। –চন্দ্রাবলী ও তাঁর সখীদের এই ভাব। এঁদের প্রতিপক্ষা বলা হয়।

শ্রীরাধার প্রতি বেশী আকৃষ্টাকে বলা হয় সুহৃৎপক্ষা।
উভয়বিধ প্রেমাভিমান যাঁদের, তাঁরা মধ্যবর্তীনী বা তটস্থপক্ষা।

যাঁর যে ভাব সেই অনুসারে সকলে শ্রীকৃষ্ণকে স্বাগত জানালেন।

গোপীরা এবার বললেন–হে গোবিন্দ জগতের জীবকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা চলে। যেমন (১)– কেউ কেউ , যে ভালবাসে তাকেই সে ভালবাসে
(২)-কেউ আবার, ভাল না বাসলেও ভালবাসে।
(৩)-আবার কেউ , ভালবাসলেও ভালবাসেনা। না ভালবাসলেও ভালবাসে না।
বল তো, এদের মধ্যে কোন শ্রেণীতে তুমি আছ ?

গোবিন্দ উত্তরে বললেন—( ১) যারা ভালবাসার বিনিময়ে ভালবাসে তাদের আচরণ স্বার্থমূলক।
( ২) যারা , কেউ ভালবাসুক বা নাই বাসুক তারা ভালবাসে , এরা দ্বিবিধ–যেমন বাবা মা।

(৩) যারা কখনও ভালবাসে না ,এরা চার ধরনের হয়। ১)আত্মারাম বা ব্রহ্মনিষ্ঠ। ২)আপ্তকাম। ৩) অকৃতজ্ঞ। ৪) গুরুদ্রোহী।

এসবের কোনটাতেই আমি নেই। যাতে মানবের মনে আমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিরন্তর বাড়ে , তাই সহজে ধরা দিই না। কখনও একটু কৃপার পরশ দিয়ে সরে পড়ি।
যে কষ্ট দিয়ে থাকি সবই তাদের কল্যাণের জন্য। এই রহস্য না বুঝে অনেকেই আমাকে অকৃতজ্ঞ বা গুরুদ্রোহী মনে করে ।

রসরাজ শ্রীগোবিন্দ সুমধুর চাতুর্যপূর্ণ বাক্যজালে গোপীদের অন্তরের সব জ্বালা, সব ক্ষোভ , সব অভিমান হরণ করলেন। তিনি যে চোখের বাইরে থাকলেও প্রেয়সী ব্রজাঙ্গনাদের কখনও পরিত্যাগ করেন না , বা করতে পারেন না , এই প্রেমময় কথা শুনে গোপীদের সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে গেল।

আনন্দরসে পূর্ণ সকলের অন্তর। বিশ্বপ্রকৃতিও আনন্দমগ্না। শারদজোৎস্নাবিধৌত যমুনা পুলিনে প্রেমময় গোপীদের সঙ্গে পরম মাধুর্যময়ী সর্বলীলামুকুটমণী শ্রীশ্রী রাসলীলা আরম্ভ হল।

বহু নর্তকী যুক্ত বিশেষ একরকম নৃত্যের নাম রাস। শ্রীগোবিন্দ অপূর্ব ছন্দে গতিতে গোপী মণ্ডলীর প্রত্যেকের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তাঁদের কণ্ঠে আলিঙ্গন করলেন। সব গোপী মনে করছেন শ্রীকৃষ্ণ আমার কাছেই আছেন। মণ্ডলীর মধ্যে দাঁড়িয়ে দেবকীনন্দন মুরলীতে মধুর গান ধরলেন। যত গোপী তত কৃষ্ণ।

আচার্য গণ লীলার অন্য রকম আস্বাদনও দিয়েছেন। গোপমণ্ডলীর কেন্দ্রস্থলে আছেন শ্রীরাধাগোবিন্দ। এক পরমাণু সময়ের মধ্যেই অপূর্ব ক্ষিপ্তপতায় ছুটে এসে শতকোটি গোপীর পাশে থাকছেন। আলিঙ্গন করছেন। আবার কেন্দ্রে ফিরে যাচ্ছেন।
“নাচত ঘন নন্দলাল রসবতী করি সঙ্গে”। নৃত্যের অপূর্ব রঙ্গে চরাচর বিশ্বপ্রকৃতি আনন্দে নৃত্যপরায়ণা। স্বর্গের দেবতারা আনন্দের আবেশে মগ্ন। নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র রাসের আনন্দের সাড়া পড়ে গেছে। দেবতারা সস্ত্রীক বিমানে করে আকাশ ছেয়ে রয়েছে। তাঁরা পুস্প বৃষ্টি করছেন। গন্ধর্ব শ্রেষ্ঠরা সম্মিলিত কণ্ঠে গোবিন্দের যশোগাথা মধুর স্বরে কীর্তন করছেন।

ভক্ত আর ভগবানের এই রাস উৎসব এখনও হয়। চিরকাল হবে।
“দেখ, রাস মহাকাশে।
সেই রাস প্রকৃতিতে।
সেই রাসে মাত।
জয় জয় রাধারমণ।

14 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ রাস – ভূমিকা গোস্বামী

  1. নিত্য বা অহরহ জগৎস্রষ্টার রাস চলছে এই পৃথিবীতে বা অন্য কোনো গ্রহে।

      1. খুব ভালো লেখা‌। লেখিকার কলমের জোর পাঠক পাঠিকাদের শ্রীকৃষ্ণ অনুরাগী করতে যথেষ্ট সাহায্য করবে‌। ধন্যবাদ লেখিকার এবং সম্পদিকার অবশ্যই প্রাপ্য‌।

  2. নিত্য রাস চলছে এই জগতে। অন্য কোথাও কোন আর এক বিশ্বে, প্রতিটি বস্তুতে।

  3. অসম্ভব মাধুর্যপূ্র্ণ একটি লেখা। সুন্দর ললিত এর ভাষা। সহজ সুন্দর করে ব্যখ্যা করেছেন। শুধু শারদ চন্দ্র কেন বুঝিনি। রাস তো কার্তিক মাসে হয়। হেমন্তের চাঁদ নয় কেন? গীতা ও ভাগবতের প্রকৃতি ও মূল ভাবনা নিয়ে আলোচনা হোক না। বড় পরিসরে ধারাবাহিক ভাবে। প্রস্তাব রইল, সম্পাদক বিবেচনা করুন।

    1. কেন শারদ পূর্ণিমা , এর কোন ব্যাখ্যা আমি পাই নি। আমার মনে হয় চান্দ্রমাস ২৮দিনে হয়ে থাকে।সেই হিসেবে হয়তো শরত কালের দুটি পূর্ণিমা –একটি কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমা , অন্যটি রাস পূর্ণিমা।

  4. অসাধারণ একটি লেখা পড়লাম। অনেক কিছু জানলাম। মনের অনেক প্রশ্নের উত্তর পেলাম। এই ধরনের লেখা আরও পড়তে চাই। ভীষণভাবে সমৃদ্ধ হতে পারি।

Leave a Reply to Anindya Goswami Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *