সাম্প্রতিক ৫ঃ মনীষা বাল্মিকী এবং আজকের ভারতে দলিত আইডেন্টিটি – অনিরুদ্ধ সুব্রত

মনীষা বাল্মিকী এবং আজকের ভারতে দলিত আইডেন্টিটি 

বৈদিক উপনিষদের যুগ থেকে শুরু করে আজকের ডিজিটালাইজেশনের ভারতবর্ষ কত বিচিত্র জনজাতি, গোষ্ঠী, শ্রেণির গল্প গাথা বলেছে। কিন্তু একটু হাতড়ে দেখুন বর্গ, শ্রেণি, জাতি যাই বলুন সে মাত্র দুটি । একেবারে সোজা মোটা দাগে ভাগ হয়ে থাকা দুটি মুখোমুখি ভাগ — এক দলনকারী, দুই দলিত।        
যদিও বাঙালি ‘দলিত’ শব্দটি ব্যবহার করে না, তার সম্ভ্রমে লাগে। তাই বিকল্প নানা শব্দ ব্যবহার করে— নিম্নবর্গ, পিছিয়ে পড়া, গরিব, আদিবাসী, নিচুতলার ইত্যাদি ইত্যাদি । মধ্য ও পূর্ব ভারতীয়রা সরাসরি দলিত শব্দে বুঝিয়ে দেয় সামাজিক ভাবে অকুলীনদের। আর দক্ষিণ দ্রাবিড়রাও নিজদের মধ্যে স্তরবিন্যাসে নিম্নস্তরীয় শ্রেণির ভেদ যথারীতি রাখে।      
ভারতীয় ইতিহাসে আর্য সভ্যতার যে ধারণা, তা যদি নিছক আনুমানিক গল্প বলে প্রমাণিতও হয়, তবু চার-বর্ণ ভেদ মিথ্যে বলে প্রমাণ  হবে না। অর্থাৎ প্রাচীন ভারত যে চতুর্বর্ণ বিভক্ত সামাজিক অভ্যাস গড়ে তুলে ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আমাদের  বাংলাদেশে হাজার বছরের বেশি বল্লালি বালাই যেন তেন প্রকারে ধরে রাখার পুরনো ধারাবাহিকতা এখনও খানিকটা রয়েছে ।
            কিন্তু একদা স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, “এ দেশের কথা কি বলিব ? শূদ্রদের কথা দূরে থাকুক  ; ভারতের ব্রহ্মণ্য এক্ষণে অধ্যাপক গৌরাঙ্গে, ক্ষত্রিয়ত্ব রাজচক্রবর্তী ইংরেজ, বৈশ্যত্বও ইংরেজের অস্থিমজ্জায় ; ভারতবাসীর কেবল ভারবাহী পশুত্ব, কেবল শূদ্রত্ব।” (প্রবন্ধঃ শূদ্র-জাগরণ, রচনাবলী প্রথম খণ্ড) বিবেকানন্দ হয়তো ব্রিটিশ-ভারতের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এমন উক্তি করেছেন। ইংরেজ শাসকের ঘাড়ে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য উভয় ধর্মের গুণ চাপিয়ে, বিদেশি অধ্যাপকদের ব্রাহ্মণত্বে আর বাকি পূর্ণ ভারতকে শূদ্রত্ব বৈশিষ্ট্যের কোয়ালিটিতে দেখেছেন । ভারতের শুধু পরাধীনতায় দলিত হওয়াই নয়, সকল ক্ষেত্রে মুখ বুজে চলা আর নিঃচেষ্ট থাকাই সেই ভারবাহী পশুত্ব। যদিও সে অনেক দিনের আগের কথা ।
        দেশটার স্বাধীনতা প্রাপ্তির খবর পেলে বিবেকানন্দ যে কী প্রতিক্রিয়া দিতেন ,আমরা জানি না। তবু যদি মেনেও নিই যে এই দেশের সকলেই শূদ্র নয়, সকলেই নিম্ন বর্গের নয়, তা হলেও পদে পদে আমাদের অভিজ্ঞতা অন্য বাস্তবতা দেখায়। যেখানে ভারতীয় সমাজে সরাসরি ঠিক দুটিই শ্রেণি সুস্পষ্ট হয়ে  ওঠে — দলনকারী আর দলিত।
      সেই লম্বা যে ইতিহাস, সেখানে সাধারণত দলনকারীদের কীর্তি গাথাই লেখা। যা মুখস্থ না হলে মাস্টারমশাই এখনও কান মলে দিতে বিলম্ব করেন না । অবশ্য সম্রাট অশোক, চন্দ্রগুপ্ত, হর্ষবর্ধন, শশাঙ্ক প্রমুখ হাতে গোনা কয়েকজনের নাম বাদ দিলে ঐ ইতিহাস বইতে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করে আছেন সাম্রাজ্যবাদী, লুটেরা বা ঔপনিবেশিক দলনকারীর দল। সুতরাং ইতিহাসে যাদের নাম কোথাও নেই তারা হল দলিত। রথের চাকার ধুলো আর চাবুকের চাপে এরা ঢাকা পড়ে গেছে পুরো ইতিহাসে।
        আসলে এই দেশে ইতিহাস লেখার অভ্যাসটা ছিল না কোনও কালেই । বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ লিখেছেন,  “সময়ের এই নতুন ধারণা যে- ইতিহাসবিদ্যার প্রাণশক্তি, ইংরেজ এ দেশে আসার ফলে তা আমাদের চিন্তায় প্রতিষ্ঠিত হলো ।” ( প্রবন্ধঃ নিম্নবর্গের ইতিহাস, রণজিৎ গুহ) । কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, শাসকের নির্দেশে যে ইতিহাস লেখার সূচনা— তা যথারীতি সেই দলনকারীর আড়ম্বরের ইতিহাস । অর্থাৎ সেখানে দলিত হওয়া কোটি কোটি মানুষের উপস্থিতি নেই।
             অতএব ধারাবাহিকতার প্রতি চির আস্থা বজায় রেখে আজও দখল কেবল দলনকারীর । আর ধুলো মাটিতে পড়ে থেকে বিস্মৃত হওয়ার কথা শুধু দলিত শ্রেণির। ক্ষমতা না থাকলে তাকে দলনকারী বলা সঙ্গত হবে না। আবার ক্ষমতার হাতে উঠে আসা মুগুর, লাঠি, অস্ত্র— এই গুলোও দলনে সহায়তা করে নিজেদের দলনকারী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
           তবে একমাত্র ক্ষমতা বা রাজনৈতিক শক্তির বলে দলন প্রক্রিয়াকেই শেষ এবং অদ্বিতীয় দলনকারী বলা চলে না। বৃহত্তর সামাজিক উঠোনে প্রতিনিয়ত এক দল দলিত পীড়িত করেই চলেছে আর বিপরীতে অন্য দলটি পদে পদে পেষিত হয়ে চলেছে।  ধর্ষণ, খুন, লুটপাট যারা চালাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে হয়তো তারা সাধারণ দরিদ্র, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছে । কিন্তু মানসিকতায় বাসা বেঁধেছে এক প্রকার দলনকারী প্রবৃত্তি । হয়তো তার পিছনে ক্রিয়াশীল রয়েছে দখল, বশ্যতা, হত্যা বা বিকৃত যৌন অধিকারের প্রবল অত্যাচারী প্রবণতা । কখনও কখনও এই সব আচরণের জন্য জোর সরবরাহ হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা, শক্তি থেকে। অর্থনৈতিক উচ্চতাও অনেক সময় ব্যক্তিবিশেষকে এই প্রকার দলনকারী করে তোলে অনায়াসে । ফলে দেশের মধ্যে দুটি জাতির উপস্থিতি নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট ।
     স্বাধীন ভারতে একটা মান্যতা দিয়ে সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছে । আইন আদালত বিচার প্রশাসন তৈরি করা হয়েছে । শাসন পরিচালনার জন্য গণ ভোট ব্যবস্থাও স্বীকৃত হয়েছে । কিন্তু দলনকারীর দলন সর্বক্ষণ ধেয়ে চলেছে দলিতের দিকে। ওসব মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, শূদ্রে এই দলিত হওয়া থেকে বিন্দুমাত্র রেহাই নেই। হ্যাঁ, হয়তো  রাজনৈতিক ক্ষমতাই মুখ্য আর তার অর্থ সরবরাহকারী সংস্থার ব্যক্তিবর্গ এবং সহায়তাকারী খুনি,মস্তান, লম্পট, লুটেরা — এরাই নব্য ভারতের দলনকারী । তবু ব্যক্তিগত পরিসরেও সংসারে, অফিস, আদালতে,কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাসে ,ট্রেনে,স্কুলে, বাজারে, রাস্তায় প্রতি মুহূর্তে একটা শ্রণি দলনকারীর ভূমিকা নিচ্ছে । আর যারা টেবিলের উল্টো দিকে, অফিসে, মাঠে,রাস্তায়, মিছিলে, হাটে,বাজারে,কারখানা, খাদানে এমনকি পরিবারে বারংবার আক্রান্ত হচ্ছে  — এরা সবাই দলিত। প্রতি মুহূর্তে প্রবল ভীতি, যন্ত্রণা, অত্যাচার, অবমাননায় যারা দলন আর পীড়নের শিকার হয়ে চলেছে। একটা সাম্য বোধ, একটা সমানুভূতি কোথাও যেন আজ আর সহজে পাওয়া সম্ভব নয়। নারী,শিশু, অসহায়, দরিদ্র, কর্মহীন বেকার প্রত্যেকে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দলনের পীড়নের শিকার ।
       আইনি দলন, প্রশাসনিক দলন, রাজনৈতিক দলন, পুলিশি দলন তো আছেই, পাশাপাশি অর্থনৈতিক চলমান দলনে আজকের সিংহভাগ ভারতবাসী প্রকৃত অর্থে দলিত, পীড়িত ।
সামাজিক ব্যবস্থা সংকীর্ণ অর্থে জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণাধীন অতীতে ছিল । সেদিনের ক্ষেত্রে  উচ্চ নীচ ভাগ রেখা দিয়ে সামাজিক বৈষম্য তৈরি করে একটা সমান্তরাল শোষণ চলত সে কথা মিথ্যে নয়। যেখানে শিক্ষার অধিকার থেকে দূরে রেখে,সামাজিক সম্মানের থেকে দূরে রেখে প্রকৃত অর্থে অপাংক্তেয় করে রাখা হতো দলিতদের। অথচ পীড়নের জন্য তাদেরই দিকে ধেয়ে যেত তথাকথিত উচ্চকিতরা।
         কিন্তু সে বিভেদ রেখার গভীরেও ক্ষমতা, দখল, অর্থ, প্রতিপত্তি, প্রভাব আর বিকৃত স্বভাব  ছিল মুখ্য। আর আজকের ডিজিটালাইজেশনের যুগে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র, নাগরিকদের নূন্যতম  অধিকার, নারী নিরাপত্তা, বেকারত্ব দূরীকরণের প্রশ্নে পদে পদে রাজনৈতিক শক্তির মিথ্যে আস্ফালন, ভীতি,আতঙ্ক  । বরং ছত্রছায়ায় হাজার অনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা । যেন আইন,শৃঙ্খলাও ক্ষমতার কাছে দাস। বিচারের প্রতি আস্থা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও যেখানে  ক্ষীণতর ।
            মনীষা বাল্মীকি একজন তথাকথিত দলিত মেয়ে, মাত্র কয়েকদিন হলো তাকে ধর্ষণ করে চরম আহত করা হয়েছে । শেষপর্যন্ত হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, তার মৃত দেহ পরিবারের হাতে না দিয়ে পুলিশ নিজ উদ্যোগে পুড়িয়ে ফেলে। এমনকি শেষ পাওয়া খবরে, পুলিশের বিবৃতি প্রবল হতাশাজনক — পুলিশ জানিয়েছে মনীষার শরীরের মেডিকেল রিপোর্টে নাকি ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। কয়েকদিন চিকিৎসা হওয়ার পর যার মৃত্যু হলো,তার মেডিকেল রিপোর্ট প্রকাশ করা হলো দেহ পুড়িয়ে ফেলার পরে । এই অপলাপ মেনে নিতে হবে ? তার মানে দেহ পরিবারের হাতে না দিয়ে পুলিশ যে পুড়িয়ে ফেলেছে তা পুরোপুরি সুপরিকল্পিত ঘটনা। আর ঠিক এখানেই আমরা বৃহত্তর ভারতবাসী দলিত । আমরা সংবিধান রক্ষাকারী প্রশাসনের কাছেও নিরাপদ নই। বরং দলনকারী শ্রণি ধর্ষকের পক্ষে , আর ধর্ষক নিজেই এক মারাত্মক হিংস্র দলনকারী ।
     দেশ জুড়ে একটা চরম প্রতিবাদের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে ।  কিন্তু  এই প্রতিবাদকে আরও সংগঠিত হওয়া দরকার । সেটা বৃহত্তর দলনকারী শক্তির বিরুদ্ধে । শুধু এক বিশেষ রাজ্যের বিষয় এটা নয়, সমগ্র দেশে বিস্তীর্ণ দিক থেকে যদি দলিত হওয়া, পীড়িত হওয়া, অত্যাচারিত হওয়া মানুষ সোচ্চার না হয়ে উঠলে, দলনকারীরাই জিতে যাবে বার বার।
      মনীষা বৃহত্তর দলিত শ্রেণির এক প্রতিনিধি মাত্র । আমরা প্রত্যেকেই প্রায় ঐ একই শ্রেণিতে পড়ি। ক্ষমতা আর আস্ফালন,  পীড়নের কাছে আমরা সাধারণ মানুষেরা প্রত্যেক ক্ষেত্রে  দলিত। প্রতিদিন, প্রতিক্ষেত্রে কোনও না কোনও ভাবে অসহায়ের মতো ধর্ষিত হয়ে চলেছি। ক্ষমতা আর প্রবৃত্তির পাণ্ডারা আড়ালে, আবডালে, সুযোগে, সময়ে, অসময়ে অসম্মান, অপমান, অত্যাচার করে চলেছে। যার বিরুদ্ধে একটা সম্মিলিত প্রতিবাদ আজ ভীষণই দরকার । সেটা বৃহত্তর দলিতদের ঐক্যের ।
       যারা ক্ষমতার অহংকারে,  খুন আর লুঠতরাজের অভ্যাসে , অবাধ যৌনতার তাড়নায়  সাধারণের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ভুলে গেছে, তাদের দলনকারী মানসিকতায় আজ আঘাত করুক কোটি কোটি দলিত মানুষ, ক্ষুদ্র কৌলীন্যের আবিলতা সরিয়ে রেখে। সাধারণ সিংহভাগ নাগরিকের আজ এটা অস্তিত্বের লড়াই বললে এতটুকু বোধ হয় ভুল বলা হবে না। মনীষার মতো মেয়েরা তো আমাদেরই সহোদরা। প্রতিদিন এতো স্বজনের অপমান, মৃত্যু আর কতদিন মুখ বুজে সহ্য করবো আমরা  ?  ধুলো ঢাকা ইতিহাস থেকে আমাদের উঠে এসে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে দাঁড়ানো দরকার । ঋজু ভঙ্গিতে জেগে উঠুক বৃহত্তর পীড়িত, দলিত সমাজ ।                                                                                                                        —– অনিরুদ্ধ সুব্রত ।                                                                                                                                         

5 thoughts on “সাম্প্রতিক ৫ঃ মনীষা বাল্মিকী এবং আজকের ভারতে দলিত আইডেন্টিটি – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. ভীষণ দরকার এই চুলচেরা বিশ্লেষণের। ধন্যবাদ আপনাকে।

  2. লেখাটার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

  3. সমস্ত বর্ণের লোকেদের প্রয়োজন এই জগতে। কেউ ছোট কেউ বড় নয়। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ কাউকে কাউকে দলিত করে দলন করেছে। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন- চতুর্বর্ণ ময়া সৃষ্টম্ গুণ কর্ম বিভাগস। সবটাই তাঁর সৃষ্টি।

Leave a Reply to PRABIR GANGULY Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *