নিবন্ধঃ ভূমিকা গোস্বামী

রসে বশ থাক
ভূমিকা গোস্বামী

ব্রহ্ম রসস্বরূপ। সেই রসস্বরূপ ভগবানের উপাসনাই আমাদের সাধনা। আট রকম রস। করুণ, বীর, রৌদ্র, বিভৎস, হাস্য, অদ্ভুত, ঘৃণা আর শৃঙ্গার। প্রথম সাতটিকে প্রাকৃতরস আর শৃঙ্গারকে দিব্যরস বলা হয়। শৃঙ্গার রস বা দিব্যরস পাঁচটি। শান্ত, দাস্য, সখ্য,বাৎসল্য, মধুর। শান্ত রসে কেবল ভগবানের প্রতি নিষ্ঠা। দাস্যতে ভগবানের প্রতি নিষ্ঠার সঙ্গে সেবা যুক্ত হয়। সখ্যতে তাঁর প্রতি নিষ্ঠা, সেবার সঙ্গে আত্মবৎ ব্যবহার যুক্ত হয়।বাৎসল্য রসে ভগবানের প্রতি নিষ্ঠা, সেবা, আত্মবৎ ব্যবহার এবং মমতাধিক্য। মধুররসে ভগবানের প্রতি নিষ্ঠা, সেবা, আত্মবৎ ব্যবহার, মমতাধিক্য এবং পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ।
তাহলে দেখতে পাচ্ছি প্রতিটি দিব্যরসে একটি বিদ্যমান,-সেটা হল নিষ্ঠা। সাধনায় যখন সামান্য সিদ্ধি সামনে আসে, তখন সেই আনন্দে সাধক নিজেই এগোয়। কিন্তু সিদ্ধির আভাসও যখন থাকেনা তখন নিষ্ঠা সাধককে পথে ধরে রাখে। ভক্তি জাগলে তো কথাই নেই, কিন্তু যখন হৃদয়ে ভক্তির আসন ফাঁকা, তখন নিষ্ঠাই একমাত্র আশ্রয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,সাধনায় যাকে পাওয়া যায় তাঁর প্রতি ভক্তিকেই আমরা ভক্তি বলি, কিন্তু নিষ্ঠা হচ্ছে সাধনার প্রতিই ভক্তি।
রস প্রাকৃত হোক বা অপ্রাকৃত আমাদের জীবনে এর মূল্য আছে। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন রসের ছোঁয়ায় আমরা রঙিন হই। তাই সিনেমা হলে লাইন দিই।গল্প, উপন্যাস পড়ি। ইতিহাসের পাতায় সেই রস খুঁজি। রসের বিহনে বিরস দিন মোটেই কাম্য নয়। আমরা অনেক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সাহিত্যিক শিল্পীকে পেয়েছি, যাঁরা তাঁদের কাজ দিয়ে রসের আস্বাদন করিয়েছেন।
আজকাল টিভির পর্দায় বিভিন্ন চ্যানেলে যে সব ধারাবাহিক সিরিয়ালগুলো হয়, সেগুলো বেশীর ভাগই হিংসা আর ভয়ানক রসকে উসকে দেওয়ার কাহিনী। বলা ভাল বড় বেশী কড়া ডোজের। কেউ কেউ আবার নিজেরাও সেই রসে মজে,জীবনে সর্বনাশকে ডেকে আনছে। মাত্রা জ্ঞান জীবনের ক্ষেত্রে বড় জরুরী। ওষুধ যথাযথ মাত্রায় দিলে রোগী নতুন জীবন পায়। মাত্রাতিরিক্ত হলে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। সত্যজিত রায়ের গুপী বাঘার কাহিনীতে বিভিন্ন রসের ব্যবহার আর তার মাত্রাবোধ আমরা সবাই আজও উপভোগ করি।
আমাদের ঘরে ঘরে টিভি। টিভিতে বহু চ্যানেল। তাতে বহু খবর, সিনেমা, সিরিয়াল পাশাপাশি ততোধিক বিজ্ঞাপন। শিশু থেকে বৃদ্ধ এর দর্শক। আমার মনে হয়, সমস্ত অনুষ্ঠানের সামনে বা পিছনে যারা রয়েছেন তাঁদের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে যথেষ্ট সাবধানি হওয়া উচিত। রস প্রয়োগে অনেক বেশী বিজ্ঞান সম্মত হওয়া জরুরী।কারণ ইতিপূর্বে এত দর্শক কখনো কেউ পায়নি।চ্যনেলগুলির ক্ষেত্রে –“সব দায় অনুষ্ঠান দাতার, আমরা কিছু জানিনা” লিখে দায় এড়ান মানায় না। এক্ষেত্রেও অনেক বেশি নিষ্ঠার প্রয়োজন।
দিব্য রসে মজলে ক্ষতি নেই।বরং কল্যানকর এই রসের অনুশীলন।নাটক,সিনেমা বা সিরিয়াল যাই হোক না কেন, লোক শিক্ষার জন্য, এ কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। আধুনিকতার নামে, প্রগতির নামে সমাজে ধীরে ধীরে বিষ ছড়াচ্ছে যারা, তারা শাস্তির যোগ্য। পৃথিবীকে আগামী দিনের বাসযোগ্য করতে দয়া করে একটু ভাবুন। রসে বশ থাকুক।

15 thoughts on “নিবন্ধঃ ভূমিকা গোস্বামী

  1. বাহ, সুন্দর বলেছেন। পৃথিবীকে আগামী তে বাসযোগ্য করে তুলতেই হবে ।

  2. যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু
    নিভাইছে তব আলো
    তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ
    তুমি কী বেসেছ ভালো?
    আমরা অন্তত প্রাইম টাইমের একটা বা দুটো সিরিয়াল বেছে ঘন্টা খানেক সময় দিয়ে বাকি সময় সাহিত্য পাঠে দিতে পারি।
    সত্যিই মাঝে মাঝে যুক্তিহীন ইলাস্টিকের মত টেনে বড় করা অনেক ভাল ভাল কাহিনীকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখে হতাশ হতে হয়‌।

  3. অল্প কথায় অনেক গভীর সত্য সরল ভাষায়। ভালো লাগলো।

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী। Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *