ধারাবাহিকঃ সাম্প্রতিক –৩
অনিরুদ্ধ সুব্রত
অনলাইন বিপ্লব
আমাদের সভ্যতায় ‘ছাপাখানা’ আবিষ্কার একটা বিপ্লব, আর আধুনিক কালে যে ডিজিটালাইজেশন হয়েছে তাও এক সুদূর প্রসারী বিপ্লব। সৌভাগ্যবসত একবার এক ঐতিহ্যশালী পুরনো জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকার সুযোগ হয়ছিল। ঢুকে আশ্চর্য হয়েছিলাম— সে তো ঠিক বৈঠকখানা নয়, যেন এক ন্যাশানাল লাইব্রেরি । মোটা কাপড়ের বাঁধাই ঢাউস ঢাউস বইয়ের অসাধারণ এক প্রদর্শনী । দেশ বিদেশের নানান বই ঘরের লম্বা দেয়াল জুড়ে বিশাল বিশাল আকারের আলমারিতে থরে থরে সাজানো । এতো বই কোনও ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকতে পারে পূর্ব অভিজ্ঞতায় ছিল না । অথচ জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, ‘এতো সংগ্রহের সামান্য কিছু, বাকিটা নতুন কলেজে দান করেছিলেন বাপ কাকারা’। অর্থাৎ এই বই সংগ্রহের একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ছিল। নিশ্চয়ই তা পড়ার মানুষ ও কম ছিল না। তার মানে জমিদার হোন বা ধনী , যদি তারা শিক্ষিত হতেন তা হলেই অন্তত একটা গ্রন্থাগার বাড়িতেই থাকত। অবশ্য আমাদের দেশে শিক্ষানুরাগী রাজা বাদশাহ কোনও কালেই কম ছিলেন না । রাজা রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ একাধারে ধনী এবং সাহিত্য শিক্ষা সংস্কৃতির পথ প্রদর্শক । কিন্তু আমাদের আলোচনা সাধারণ স্তরের মানুষ নিয়ে । যারা শিক্ষিত হয়ে করে কম্মে, খেয়ে পরে বেঁচে থাকার বেশি ভাবতে ভয় পাই। যারা প্রয়োজনের শিক্ষা টুকু পেয়েই পূর্ণ তৃপ্ত হন না, সারা জীবন কাজের ফাঁকে, অফিস ডিউটির পরে আলাদা করে বই,পত্রিকা খোঁজেন এবং পড়েন। এই সভ্যতায় তাদের সংখ্যা মোটেও কম নয়। আর ঠিক এই শ্রেণির জন্যে এখনও সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির ভাবনা শুকিয়ে যায় নি। প্রতিদিন যেমন রাশি রাশি সংবাদ পত্র ছাপা হচ্ছে, তেমনি সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক নানা পত্র পত্রিকা প্রকাশে বিরাম নেই । সৃজনশীলতাও ধনীর একার হাতে ছিল না, বরং তা দরিদ্র, লড়াকু, খেটেখাওয়া সকলেরই অধিকারের। অথচ এক বিরাট হতাশা বহমান— ছাপা কাগজ, কালি, শ্রমের ক্রমবর্ধিত দাম। তাই বই সংগ্রহ আজ রীতিমতো একটা ব্যয়বহুল ব্যাপার। একাধিক পত্র পত্রিকা কেনা একটা সাধারণ মানুষের পক্ষে যথেষ্ট চাপের। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধ থাকলেও সাধ্য হচ্ছে না । কিন্তু ইতিমধ্যে এই চরম হতাশার এক বিকল্প পথ নেমে এসেছে। অচিরেই প্রায় প্রতিটি মানুকে এর সুফল নিতে হবে। বিশেষ করে একুশ শতকের এই নবতম সংযোজনকে নতুন দিনের দিশারী না মনে করলে ক্ষতি আমাদেরই। বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানের সমস্ত পাবলিকেশন এখন প্রায় আপনার হাতের মুঠোয় । খুব অল্প খরচে বই, পত্র পত্রিকা, জার্নাল, গবেষণাপত্র আমরা সহজে পড়তে পারি ডিজিটাল মাধ্যমে । ঢাউস আকারের বই নিজের বাড়ির আলমারিতে সাজিয়ে রেখে আভিজাত্য প্রমাণের কোনও দায় আমাদের নেই। কেননা দামী বই বা আলমারি কোনওটাই আমাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে পড়ে না । অথচ ডিজিটাল মাধ্যমে আমাদের পাশে সর্বক্ষণ হাজির বই এবং পত্রিকার সমুদ্র সমান জগত । যদিও হৃদয়ে একটা ধরে ছুঁয়ে দেখার সাধ চিরকাল থেকে যাবে । কিন্তু বিশ্বভ্রমণের সখও তো গরিবের হয়। সখ থাক, সখ আছে বলেই তো নেট সার্চ করে সুইজারল্যান্ড দেখতে খুব বেশি খরচ হয় না। বরং এই নতুন মাধ্যমে সুইজারল্যান্ড সম্পর্কে হাজার একটা তথ্য সংগ্রহ অনেক বেশি সোজা । বাঙালি দুর্গাপূজা এলে একটু বেশিই সাহিত্য প্রেমী হয়ে ওঠে। ফলে এক গুচ্ছ পত্র পত্রিকার পুজো সংখ্যা কেনার হিড়িক জাগে তার। কিন্তু সেটা যদি ফেসবুকে পোস্ট করে সমীহ আদায়ের উদ্দেশ্যে না হয়ে থাকে, তাহলে তো হার্ড কপি না কিনে সফ্ট কপি ডাউনলোড করে পড়াই শ্রেয়। কেননা তাতে একটি পত্রিকার দামে অন্তত হাফডজন পত্রিকা পড়া যেতেই পারে । বাঙালির শারদ সাহিত্য প্রেমের ফসল হিসেবে হাজার হাজার লিটিলম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। বেছে টেছে নিয়ে যদি দশ বিশটাও সংগ্রহ করতে হয় তার আর্থিক মূল্য একেবারে কম না। তাছাড়া লিটিলম্যাগাজিন সব সময় হাতের কাছে কেনার সুযোগও মেলে না। এই ক্ষেত্রে একটা দারুন রেভলিউশন এনেছে সাম্প্রতিক কালের ওয়েব ম্যাগাজিন বা ই পত্রিকা । বড়ো বড়ো বাণিজ্যিক পত্র পত্রিকার যেমন নিজস্ব ই-ভার্সান রয়েছে, প্রয়োজনে তা থেকে কম্পিউটারে, ট্যাবে,মোবাইলে পড়তে পারা যায় নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচ দিয়ে ।তেমনি একটা বিরাট বিবর্তনের পথে আজকের ওয়েব পত্রিকা গুলো । সবচেয়ে বড় কথা ওয়েব পত্রিকার অধিকাংশ গুলোই সম্পূর্ণ নিঃখরচায় পড়া যায় । যে ক্ষেত্রে খরচ দিতে হয়,তা কিন্তু ছাপা পত্রিকার চেয়ে অনেক কম। আসলে পড়ার আগ্রহটাই আসল, সময় ঠিক এনে দিয়েছে সুযোগ । সাম্প্রতিক করোনা কালে মানুষের সামনে সামাজিক দূরত্ব বিধি এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামগ্রিক ভাবে সাধারণ মানুষের আর্থিক পরিস্থিতি অনকটাই বিপর্যস্ত, সেখানে ছাপা কাগজের বই, পত্র পত্রিকা সবই যথেষ্ট খরচ সাপেক্ষ। এই দুর্দিনে বরং অনকটাই আশার আলো দেখাতে পারে ডিজিটাল মাধ্যমে সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার নতুন অভ্যাস । শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের ক্রমে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াকে সড়গড় করে নিতে হচ্ছে , যাতে তাদের লাভ। পাশাপাশি জ্ঞান ও সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার জন্য আমাদেরও একটা পুরনো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা দরকার । বিভিন্ন অনলাইন বা ডিজিটাল পত্র পত্রিকা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নানা আঙ্গিকে নতুন নতুন কনটেন্ট নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে । আমরা যদি সত্যিই সাহিত্য, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকি, তবে হাত ছুঁয়ে কেন পৌঁছবোনা সেখানে । একই সঙ্গে আমাদের আত্ম তৃপ্তি এবং পকেট সাশ্রয় , এই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে আমরা কি চাই না ! মনে রাখতে হবে, আমাদের আর্থিক পরিস্থিতি যেন কখনওই আমাদের বিদ্যা ও মনন চর্চাকে স্তব্ধ করে দিতে না পারে।
বাহ্, ভালো বলেছেন।
প্রত্যেকটি কথার সঙ্গে সহমত। ডিজিটাল ব্যবস্থা সেই সুযোগ করে দিয়েছে। বক্তব্যের বিষয়টি খুব সুন্দর।আর বাঙালির পড়ার অভ্যাস তথা বিনামূল্যে বই পড়ার ইচ্ছা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আরণ্যক ‘ এ লিখে গিয়েছেন।
ঠিক। ঠিক বলেছেন। হাজার হাজার বই সংগ্রহ করেও না হলে গ্রন্থাগারের দরজায় গিয়ে প্রয়োজনের বই লিখে দিলেও হয়তো সেদিন পাওয়া গেল না। এখন হাতের মুঠোয়, হতে পারে নতুন প্রজন্মের কাছে সাহায্য নিতে হবে।
লেখাটা সময়োপযোগী, ধন্যবাদ আপনাকে।
লেখাটি খুবই সময়োপযোগী এবং একেবারে সঠিক তবে হাতে বই নিয়ে তার পৃষ্ঠা উল্টে পড়ার মজা কিন্তু অন্যরকম। তবে সময়ের সাথে চলতে গেলে এটাই ঠিক পথ।
এই পরিস্থিতিতে ওয়েব ম্যাগাজিন সত্যিই দারুণ ব্যাপার। পাঠকরা ও খুশি।লেখকরাও খুশি।