ধারাবাহিকঃ সাম্প্রতিক ২ – অনিরুদ্ধ সুব্রত

সাম্প্রতিক— ২

অনাগরিক – অনিরুদ্ধ সুব্রত

যে দেশের রাজ-উদ্যোগ দেশের জনসাধারণের নাগরিকত্ব সুস্পষ্ট করতে প্রবল ভাবে সক্রিয় ।  কিন্তু  বিশ্বব্যাপী ভয়ঙ্কর করোনা মহামারী কালে সেই দেশ তার ভ্রাম্যমান শ্রমিকদের যেন ঠিক  চিনতে পারল না। নির্মাণ শিল্প থেকে শুরু করে  অজস্র ক্ষুদ্র শিল্পে অথবা ঠিকা মজুরিতে নানা ক্ষেত্রে কর্মরত ছিল কয়েক কোটি মানুষ । নারী পুরুষ নির্বিশেষে তো বটেই এমনকি বয়সে কিশোর , প্রবীণও শতাংশে কম ছিল না এদের মধ্যে । মূলত শিল্প প্রধান শহরগুলোতে নির্মীয়মান বাড়ির খোলা অংশ থেকে শুরু করে গলি ঘুজি বা তস্য বস্তিতে এই অগণিত শ্রমিকরা কোনও মতে রাত কাটাত। কারও কারও স্ত্রী সন্তান সহ এদের বেঁচে থাকার ঐ ছিল  একমাত্র  ঠিকানা ।      ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির ইঁট বওয়ার কাজ থেকে সস্তা প্লাস্টিক সামগ্রীর সাফ সুতরের কাজ , একেবারে নিচের তলার প্রায় সমস্ত কাজ চলত এই ভ্রাম্যমান শ্রমিকদের হাতেই। আজ মহারাষ্ট্র তো কাল দিল্লি, দীর্ঘ মেয়াদি গ্যারান্টিহীন কাজ আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠিকাদারের মজুরি কমানোর মোচড় । চরম দারিদ্র্যে জীবন অতিবাহিত করার পরও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের সঞ্চয় সামান্য । যা তাদের পাঠাতে হতো জন্মগত গ্রামীন ঠিকানায়। অধিকাংশ জায়গায় কারখানা বা কর্মক্ষেত্রের মালিক এই শ্রমিকদের জন্য নূন্যতম মাথা গোঁজার স্থান, স্বাস্থ্য বা জীবন-বিমা, প্রফিডেন্টফান্ড এর কোনও ব্যবস্থাই রাখে নি। তা ছাড়া কাজের ধরন অনেক ক্ষেত্রেই ছিল অস্থায়ী, বিপজ্জনক এবং নির্দিষ্ট মেয়াদি । যে রাজ্য বা যে শহরে এই ভ্রাম্যমান শ্রমিকদের এই অক্লান্ত শ্রম বিনিময়, সেই রাজ্য বা শহর প্রকৃত পক্ষে তাদের সরকারি ভাবে চিনতে চায়নি কোনও দিনই  । না ছিল তাদের সেই রাজ্যের শ্রমিক তালিকায় নাম, না জুটত রেশন বা নূন্যতম সরকারি অনুদান মূলক পরিষেবা । অথচ সেই রাজ্যের সরকারের কাছে এই বিষয়ে যে আদৌ কোনও ধারনা ছিল না — সে অজুহাত মোটেই বিশ্বাস যোগ্য নয়। এবং পাশাপাশি যে সব রাজ্য থেকে দলে দলে এই সব শ্রমিকরা কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে এসেছে, তাদের সেই নিজের রাজ্যের সরকারি হিসেবে এই বহির্গামী শ্রমিকদের কোনও তালিকা কোনও দিন তৈরিই হয় নি ; অথবা  তেমন কোনও তালিকা তৈরির প্রয়োজন আছে বলে সরকারি স্তরে মনেও হয় নি।     এই দেশে প্রতি বছর নানা ধরনের সার্ভে হয়ে থাকে, যে গুলো সাধারনত গ্রামে পঞ্চায়েত স্তরে এবং শহরে পৌর স্তরে। কিন্তু  দীর্ঘদিন ধরে এই ভ্রাম্যমান শ্রম বিনিময়ে দেশের বিরাট অংশের কাজ ত্বরান্বিত হয়ে চলেছে। তবু না তাদের নিজস্ব গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে লিখিত হিসাবে পরিযায়ী শ্রমিক নামে স্বতন্ত্র তালিকাবদ্ধ হতে পেরেছে, না তাদের কাজের জায়গায় একটা নির্দিষ্ট তালিকায় তাদের কেউ হিসাবে রেখেছে। ফলে তারা চিরকালই রয়েগেছে খাতার বাইরে।              আজকে যখন পৃথিবী উজাড় করতে শুরু করেছে মহামারী, এই দেশ যখন অনির্দিষ্ট হারে লকডাউনের পথে নেমছে, তখনই রাস্তায় বেরিয়ে এলো সেই হিসাবহীন ভ্রাম্যমান শ্রমিক শ্রেণী । রাষ্ট্র যখন ঘোষণা করলো ‘ঘরে থাকুন’, তখন ঐ মানুষ গুলো তো ঘরই খুঁজেছে। কিন্তু যে শহরে সে শ্রম দিয়েছে এতকাল, সেখানে তার ঘর কোথায় ? সেখানে মালিকই কাজের সময় ছাড়া চিনতে পারে না, প্রশাসন, সরকার চিনবে কী করে । বিশেষ করে তাদের তো স্বীকৃত কোনও তালিকাই তৈরি হয় নি। আর শুধু মাত্র আপত্কালীন সময়ে  চিনতে হলে যে দায়ভার নিতে হবে, সে দায় নিতে সেই শহর বা রাজ্য একেবারেই অনিচ্ছুক । এমনকি যে রাজ্য থেকে তারা এসেছিল, সেখানেও তাদের জন্য পরিবারের অপেক্ষারত সদস্য ব্যতীত অন্য কারও উৎকন্ঠা দেখা গেল না। আর সর্বশেষ যে মহারাজ-উদ্যোগ ? সে এতোই মহা উদ্যোগ যে মিডিয়ার ভাঙানো ঘুমের পরে অ্যামিবার নড়েচড়ে বসা। দৈনিক রেলের তালিকা লেখা আর কাটা। শুধু তাই নয়, এতো যে কাঙালেরা ঘরে ফিরবে তো রেলের খরচ কে দেবে ? টিকিটের দাম ঐ সর্বস্বান্তদের কাছ থেকে নিতে পারলেই যেন ভালো । তবু সেই অনুগ্রহের ব্যবস্থার এতোটাই বিলম্ব যে তা তৃতীয় পর্যায়ের লকডাউন স্পর্শ করলো ।                ইতিমধ্যে কাজহীন,খাদ্যহীন,এবং সম্পূর্ণ রূপে দিশাহীন অর্ধনগ্ন শরীর নিয়ে কোটি কোটি শ্রমিক চির অভিভাবকহীনের মতো হাঁটতে শুরু করেছে  নিজস্ব দূরবর্তী ঠিকানার উদ্দেশ্যে । শত, হাজার কিলোমিটার পথকেও তারা যেন ভয় পেলো না ।  এতটুকু বিশ্বাস আর অবশিষ্ট রইল না মহান রাস্ট্রের উপর। তাদের সামনে কিম্বা পিছনে কোথাও দেশ নেই, নাগরিকত্ব শব্দটি তাদের জীবনে এক প্রকার ঘৃণা ব্যতীত কিছুই নয়। স্ত্রী, কোলের সন্তান, অশক্ত শরীর, অন্তঃসত্ত্বা, যুবক,বৃদ্ধ,শিশু একটা সমবেত পায়ে হাঁটা স্রোত চলতেই থাকলো বহু দূরের ঘরের উদ্দেশ্যে। তৃষ্ণা, খিদে,অসুস্থতা, মৃত্যু,দুর্ঘটনা এই সত্য গুলোই একটু একটু করে গিলতে শুরু করেছে তাদের। কখনও ক্লান্ত শরীরের মিছিল শুয়ে পড়ল রেলওয়ে ট্রাকে । মিটে গেল সে সব হিসেব লৌহ চক্রের নিদারুণ আঘাতে । কখনও মাঝরাতে শ্রমিক বোঝাই ট্রাক অন্য গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুর্ঘটনার বিপর্যয়ে। কখনও সন্তান সম্ভবা পথেই প্রসব করল সন্তান । কিছু শতাংশ শেষ পর্যন্ত জীবন্ত পৌঁছাতে পারল না স্বজনের কাছে।       কতগুলি অগণিত সংখ্যার আন্দাজ করা অনাগরিক মেঘ ভেঙে ভেঙে ক্রমশ উড়ে যাবে দূরে। একটা কুড়ি লক্ষ কোটির বিশাল ফানুস উড়তে থাকবে দেশের আকাশ জুড়ে ।কিন্তু  সময়ে আবার বক্তৃতা শুরু হয়েছে রাজনীতি নিয়ে,  জাতীয়তা নিয়ে, মাইক বাঁধা শুরু হচ্ছে আবার  সেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে । ফাঁটা পায়ের ঘা শুকোয় নি যে এখনও ।                                    একটা রাংতা মোড়া উৎসবের বিজ্ঞাপনে আবার সাজিয়ে তোলা শুরু হয়েছে চারদিক । প্রভাবশালী উচ্চবিত্ত নাগরিকদের সখের আর সুখের উঠোনে আলো জ্বলবে আবার, তারই তোড়জোড় । সিমলা, উটি বেড়ানোর আলোচনা একটু একটু করে জায়গা করে নিতে চলেছে হাঁপিয়ে ওঠা মনে। নেতৃবৃন্দ ক্ষেপে উঠবেন অতি দ্রুত আসন্ন ইলেশনের প্রতিশ্রুতি ছিঁটোতে।        কিন্তু  ঐ যে কয়েক কোটি অণাগরিক  ? শুধু মাত্র ভোট দেয় ওরা। কখনও পরিযায়ী শ্রমিক, কখনও রেলের হ’কার, ফুটপাতে খুচরো দোকানদার, ফেরিওয়ালা, ঠিকা কাজের মজুর সব সবাই এই মুহূর্তে প্রায় সম্পূর্ণরূপে বেকার। রেশনের চাল আর গমে এই জ্বলন্ত জীবনের কতটুকু দাহ কমে ! কাজ হারাতে এক মিনিটও লাগেনি, ভয়ংকর অসুখের আতঙ্কে সাবধানী হয়েছে দেশ,জাতি,রাষ্ট্র । কিন্তু কাজ ফিরিয়ে দেয়ার যেন আজ আর কেউ নেই। কেউ নেই খোঁজ নেবার এই অগণিত মানুষের দৈনন্দিন চলছে কীভাবে । শুধু না খেতে পেয়ে মৃত্যুর খতিয়ান নয়, আত্মহত্যারও খতিয়ান আছে। একটা চরম অবসাদের স্বীকার আজ এই দেশের কোটি কোটি কাজ হারা ,আয়হীন মানুষ ।                ভালবাসার দেশ,রাস্ট্রের নাগরিকত্ব পেতে কে না চায় ! পিতৃপরম্পরায় যেখানে ঘাম রক্তের টান। মাটিতে মিশে থাকা শ্রদ্ধার সেই দেশে যদি বেঁচে থাকার নূন্যতম সন্ধান আজ সত্যিই না পায় কোটি মানুষ । যদি কেবল হা হুতাশে,জীবন যন্ত্রণায় দিন যায় ,তবে কী সেই মোহময় নাগরিকত্ব  ? যা থাকা না থাকার পার্থক্যটাই পৌঁছাতে পারে না বোধে। 

5 thoughts on “ধারাবাহিকঃ সাম্প্রতিক ২ – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. খুব ভালো লাগলো। সমস্ত সচেতন নাগরিক নিশ্চয়ই এমন করেই ভাবেন।

Leave a Reply to Mandira Ganguly Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *