ধারাবাহিকঃ সাম্প্রতিক১ – অনিরুদ্ধ সুব্রত

ইমিউনিটির যুদ্ধ 

অনিরুদ্ধ সুব্রত

দু’হাজার বিশ ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের’ বছর, তা হয়তো ইতিহাস বইতে লিখবেন না ঐতিহাসিকরা।কিন্তু যুদ্ধকালীন তৎপরতা এতটুকু কম হচ্ছে কী ? আসলে আমরা ইতিহাসের ইতি কথা পড়ে পড়ে, যুদ্ধ বলতে ধরেই নিয়েছি লড়াইটা মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে। অথচ কোভিড-১৯ এর রূপ দেখে আর তার চরম ঔপনিবেশিক চরিত্র দেখে ‘বিশ্বযুদ্ধ’ ব্যাপারটা বোধ হয় নতুন মহিমা সৃজন করল। একটা ভাইরাস ঘটিত অসুখে প্রথম বিশ্ব থেকে তৃতীয়  বিশ্ব, উষ্ণ থেকে শীতল, ধনী থেকে দরিদ্র অথবা সাদা বা কালো কোথাও কোনও স্বতন্ত্র সমীহ দেখায়নি । ফলে এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধটা ঘটে চলেছে , সেটা সারা পৃথিবীর মানুষ একদিকে আর বিপরীতে একটা ভাইরাস। যদিও ইতিহাসের পরিচিত মহামারী ছিল, ডায়রিয়া এবং প্লেগ। যা এক এক সময়ে পৃথিবীকে যথেষ্ট উদ্বেগ দিয়েছে, কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে আক্রান্তের সংখ্যায় এই করোনা মহামারীকে অনায়াসে এক নম্বরে পৌঁছে  দিচ্ছে আজকের হিসাব । অর্থাৎ বিংশ শতকের দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসকে প্রায় লঘু করে দিয়ে একুশ শতকের ‘কোভিড নাইনটিন’ মারণ-কামড়ের ভয়াবহতা শ্রেষ্ঠ মুকুট ছিনিয়ে নিতে চলেছে।                     সাম্প্রতিক তম ‘তৃতীয় বিশ্ব ভাইরাস যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি’ নিয়ে পরবর্তীতে এই কলামে নিশ্চিত আলোচনা থাকবে । আজকে বরং এক নতুন যুদ্ধের কথা বলা যাক— “ইমিউনিটির যুদ্ধ “।                    করোনা আক্রান্ত হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবেশী দেশ  চিন থেকে সুদূর ইতালি অথবা মার্কিনযুক্তরাস্ট্র থেকে ব্রাজিল বা ফ্রান্স থেকে রাশিয়া নির্দিষ্ট ওষুধের জন্য প্রবল অণুসন্ধান । কিন্তু গত ডিসেম্বর থেকে এই সেপ্টম্বর, টানা দশ মাস একমাত্র উপসর্গের দিকে খেয়াল রেখেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক চরম পরীক্ষা । তবু নজর সেই ধ্রুবতারার দিকে— কোথায় কখন উদিলো ভ্যাকসিন… !          যদিও সে সঠিক ওষুধ বা ভ্যাকসিন যতক্ষণ অধরা মাধুরী, ততক্ষণ মেডিক্যাল পরিভাষা সংগ্রহ থেকে অনায়াসে লাফিয়ে পড়লো একটি শব্দ— “ইমিউনিটি”। সঙ্গে সঙ্গে  শব্দটি অতি দ্রুততায় ডাক্তার নার্সদের ছুঁয়ে ছুটে গেল দেশের আপামর লকডাউন অধ্যুষিত সাধারণের হৃদয় পর্যন্ত । সন্ধ্যের নিউজ চ্যানেলের টক শোয়ে বিশিষ্ট ডাক্তার বাবুর পরামর্শ, জনগণ শরীরের ইমিউনিটি বৃদ্ধি করুন । সকালের খবর কাগজে করোনা আপডেটের বিশেষ নির্দেশনামায়— ইমিউনিটি বাড়ানোর গুরুত্ব । এমনকি দেশের বড়ো বড়ো মন্ত্রী শান্ত্রীদের আশ্বাস বাণীতেও ঐ একই প্রস্তাব— শরীরের ইমিউনিটি পাওয়ারই একমাত্র যে ডিফেন্স করতে পারে কোভিড নাইনটিনকে। অর্থাৎ মানুষের শরীরের ইমিউনিটিই হলো এই ‘বিশ্ব কোভিড যুদ্ধে’র অন্যতম প্রতিরক্ষা বা এক অর্থে সৈনিক ।           চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ইমিউনিটি( immunity) হলো মানবদেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা । যা মূলত দুই প্রকার — এক, innate immunity বা জন্মগত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা  এবং  দুই, acquired immunity বা অর্জিত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা । innate immunity সাধারণত শিশু মাতৃগর্ভে থাকার সময়ে তার শরীরে জন্ম নেয় । অন্য দিকে acquired immunity সাধারণত পৃথিবীতে মানুষ জন্মের পর কোনও জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হওয়ায় অর্জিত হয়  এবং বারংবার সংক্রমিত হলে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।আবার  এই দ্বিতীয় প্রকার acquired immunity কে স্বতন্ত্র দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয় — প্রথমটি, natural active immunity,যা বসন্ত বা ঐ জাতীয় অসুখে আক্রান্ত হলে শরীরে যে ধরনের ইমিউনিটি তৈরি হয় । এবং দ্বিতীয়টি  artificial active  immunity ,যা কৃত্রিমভাবে টীকা বা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে মানব দেহে অগ্রিম ভাবে সংক্রমণ ঘটিয়ে সৃষ্টি করা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ।           তাহলে , আমাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি যে অনেকখানিই আমাদের জন্মগত অধিকার— তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না । আর ভ্যাকসিন যতক্ষণ না হাতে আসছে ততক্ষণে কৃত্রিমভাবে শরীরে ইমিউনিটি সৃজনের তেমন কোনও সুযোগও নেই । তবু  ডাক্তার বাবুর পরামর্শ অনুযায়ী কিছু নিয়ম, রীতি, খাদ্যাভ্যাস করে যদি শরীরকে সুস্থ, সচল,স্বাভাবিক রাখা যায় তাতে আমাদের শরীর অন্তত তার জন্মার্জিত ইমিউনিটি পুরোপুরি প্রয়োগ করতে পারে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। অতএব চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেটুকুই নির্দেশনামা ।              পৃথিবীর একাধিক দরিদ্র দেশের সঙ্গে আমাদের ভারতবর্ষে এই জন্মগত অধিকারের ইমিউনিটির সঠিক হাল যে কী, তা সহজেই অনুমেয়। দারিদ্র্যের পাশাপাশি, অশিক্ষা, অপুষ্টি, অপরিচ্ছন্নতা এখানে অঙ্গাঙ্গী । গর্ভকালীন মায়ের দেখভাল, যত্ন,উপযুক্ত অবসর, নিরুদ্বিগ্নতা, চিকিৎসা সহায়তা এবং স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় খাদ্য, ব্যবহার্যর ব্যবস্থা এখনও এই দেশের সর্বত্র পুরোপুরি আশা করা বৃথা। প্রতি বছর শিশুমৃত্যুর যে হার — তা সেই সত্যিকেই প্রমাণ করে । বহু ক্ষেত্রে সন্তান সম্ভবা মা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক । কোথাও কোথাও এখনও কুসংস্কারের আচ্ছন্নতা, অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি, অসচেতন জীবন যাপন এবং  চিকিৎসা ব্যবস্থার অধীনে না পৌঁছবার সমস্যা । ফলে আপামরের ইমিউনিটির লেখচিত্র ভারতবর্ষের মতো দেশে অনেকখানিই অনুভূমিক ।           কিন্তু এই মহান বিজ্ঞাপনের দেশে, গরিবকে ভাওতা দেওয়ার দেশে, অশিক্ষিতকে বিভ্রান্ত করার দেশে এবং মধ্যবিত্ত নামক চঞ্চল শ্রণিকে দিশাহীন করে তুলবার দেশে প্রতি মুহূর্তে টিভিতে, কাগজে, ইন্টারনেটে সস্তা ইমিউনিটি বৃদ্ধির প্রচার কেন  ? যে যার মতো হেঁকে চলেছে— এটা খান, ওটা খান ইমিউনিটি বাড়ান। সেটা আর শুধু খাদ্য খাবারে আটকে নেই, কেউ কেউ ঘরের মেঝে পরিষ্কারের ক্লিনার থেকে গায়ে মাখা ক্রিমে ইমিউনিটি বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে চলেছেন সানন্দে। ভাবা যায় না কী অসীম মিথ্যে আর বিভ্রান্তির সময় চলছে।চলছে সমান্তরালে একটা অসাধু বাণিজ্য । কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না,যে টিভিতে কোনও সেলিব্রিটি যদি বলেন— অমুক কোম্পানির ইনার-অয়ার গায়ে চড়ালেই ইমিউনিটি চড়চড় করে বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে ওটা কিনতে উন্মাদ হয়ে উঠবেন না ।           তাছাড়া একটা কথা মনে রাখা দরকার বিজ্ঞান বলে, শরীরে অধিক মাত্রায় ইমিউনিটি ক্রিয়াশীল হলে, তাতে কিন্তু শরীর তার নিজস্ব ইমিউনিটি ব্যবস্থা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সেই হাইপারসেন্সিটিভ বিজ্ঞাপনের খুল্লামখুল্লা বিপনন থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে । এদেশে মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়ে মিথ্যের যন্ত্রণা অনেক বেশি । বরং সাবধানতা সর্বাগ্রগণ্য। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন; পরবর্তী লেখার জন্য পরের সপ্তাহে এই কলামে নজর রাখুন ।
                                                                                       

6 thoughts on “ধারাবাহিকঃ সাম্প্রতিক১ – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. একদম প্রাসঙ্গিক লেখা।এত সুন্দর ভাবে ভয়াবহতার মূর্তিটি সকলের সামনে আনার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

    1. অসাধারণ লাগলো লেখাটি । খুবই প্রাসঙ্গিক । পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় থাকলাম ।

  2. খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বলেছেন। খুব ভালো লাগলো ।

Leave a Reply to Soma Sengupta Mukherjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *