কিছু জুঁই বেল হাস্নুহানা
পৃথ্বী ব্যানার্জী
আমার ছেলেবেলায় ঠাকুরদা মা বাবা তিন ভাই এক বোনের সংসারে অঢেল বিদ্যা ছিল আর স্বল্প বিত্ত ছিল।তার মধ্যেই বড় হতে হতে একটা মিঠা শৈশবের , রোদ ঝলমলে কৈশোরের মালিক হতে কোন অসুবিধা হয় নি।আমার বাবা হায়ার সেকেন্ডারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।সে সময়ের স্কুল শিক্ষকদের সামাজিক সম্মান প্রচুর ছিল। সাথে (প্রায়) দারিদ্র্যই ছিল। কিন্তু দারিদ্র থাকলেও দারিদ্রবোধ ছিল না। ঠাকুরদা ওপার বাংলার নামী শিক্ষক ছিলেন। এপারে এসে ব্রত হিসাবে শিক্ষাদানকে নিয়ে মাঝির ছেলেকেও পড়িয়ে ডাক্তার বানিয়েছেন।কারোর কাছ থেকে একটা আধলাও নিতেন না। এক পিসেমশাই ছিলেন লম্পট বদমাশ। সেই পিসির সংসারও বাবাকে টানতে হতো। ফলে মোটা ভাত, ডালের বেশী স্বামী সন্তান শ্বশুরের পাতে দিতে পারতেন না আমার অন্নপূর্ণা মা। বছরে একবারই পরণের কাপড় জুটতো।পুজোর সময়। মোটা কাপড়ের জামা হাফ প্যান্ট (আর একটা পুজো বার্ষিকী সাহিত্য পত্রিকা ছোটদের। দেবসাহিত্য কুটিরের অথবা শিশুসাথী বা সন্দেশ বা মৌচাক)। আর ছিল আনন্দ। কারণে অকারণে এত আনন্দ কেন ছিল, কোথার থেকে আসতো আজ ভাবি! গর্বও কি ছিল না ‘বন্দ্যোপাধ্যায় স্যারের ‘মাইজ্যা পোলা’ হবার? আমার শৈশব কৈশোরের এই ছিলো পরিপ্ৰেক্ষিত। আর আমরা ছিলাম কঠিন বাঙাল উদ্বাস্তু পরিবার। আমি কোলকাতায় জন্মেছি বড় হয়েছি। তবু ছেলেবেলায় অনেকদিন পর্যন্ত বাড়ির চল অনুযায়ী বাঙাল উচ্চারণেই কথা বোলতাম বাড়ির মধ্যে। আগেই বলেছি আমরা তিন ভাই এক বোন। বোন বলতে আমার দিদি। আমার দাদা সবার বড়। তারপর দিদি, আমি ও সবার ছোট ভাই । দাদা বয়সে আমাদের বাকী তিনজনের থেকে অনেক বড়। সম্মানে মর্যাদায় কিছুটা দূরের। আমরা বাকী তিন ভাইবোন একজোট। বলা বাহুল্য নেতা দিদি। আমি দিদির পায়ে পায়ে ঘুরি,ভাই আমার। শিক্ষিত পরিবার হবার গুনে কি না জানি না আমাদের পরিবারে চিরদিনই কন্যা সন্তানের আদর বেশী। মা লক্ষ্মী এসেছে সংসারে। দিদির বাড়িতে দাপট ছিল খাতিরও ছিল। তবে বাড়িতে আদর প্রশ্রয়ের সাথে বাপ ঠাকুরদার শাসনও ছিল। মা সন্তানদের গায়ে কখনো হাত তুলতেন না। তা বলে যখন তখন বাড়ির বাইরে বেরোতে দিতেন না। দিদি ছিল স্বভাব চঞ্চল(দুষ্টু) তার উপর পরমা সুন্দরী।তাই দিদির বেলায় নিষেধাজ্ঞা আরো কঠিনভাবে বলবৎ ছিল। পৃথ্বী ব্যানার্জী
মাএর ধারণা ছিল ‘পান্তা খাইলে ম্যান্থা(মন্থর,অমেধাবী)হয়। তাই সন্তানদের কিছুতেই পান্তা খেতে দিতে চাইতেন না। মা ডালে ডালে চড়লে দিদি চড়তো পাতায় পাতায়। গরম পড়লেই রাতে পড়ার ফাঁকে কখন উঠে গিয়ে মা এর রান্না করা ভাত থেকে সরিয়ে জল ঢেলে পান্তা করে রাখতো। পরদিন স্কুল থেকে ফিরে থেকে যাওয়া মুসুরী ডালকে পাকা তেঁতুল মিশিয়ে জ্বাল দিতে দিতে শুকিয়ে ফেলতো আর কুচো কুচো আলু পেয়াঁজ ভাজতো। এবারে পাথরের বাটিতে ঐ পান্তা শুকনো লঙ্কা পোড়া নারকোল কুচি আর গন্ধরাজ লেবু দিয়ে মাখতো। সঙ্গে ঐ ডাল শুকনো আর আলু পেয়াঁজ ভাজা। একদিকে মায়ের বকা আর অন্যদিকে পাথরের বাটিতে হাপুস হুপুস করে আমরা তিন ভাইবোন ঐ পান্তা নামের অমৃত আস্বাদন করে যাচ্ছি। গরমের দিনে এ আমাদের প্রায় নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো।দিদির মাথায় অনেক দুষ্টু বুদ্ধি খেলতো। গরমের দিনে স্কুল ফেরতা দিদি মাঝেমাঝেই বাড়ি ঢুকতো না। দিদির সক্রিয় সাগরেদ আমি জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতাম।আমার পাশে ভাই। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিদির হাত থেকে বই নিয়ে পড়ার টেবিলে রেখেই মা এর নজর এড়িয়ে দিদির পিছনে আমি,আমার পিছনে ভাই সোজা দৌড়াতে দৌড়াতে মৈত্রদের বড় পুকুর। আমার হাতে গামছা। ডুবে ভেসে বিস্তর স্নান করে আর গামছায় চিংড়ি মাছ ধরে যখন দু চক্ষু লাল,আমার ঠাকুরদা এসে হাজির। চুলের মুঠি ধরে তিনজনকে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে যেতেন। দিদি মেয়েসন্তান হওয়াতে ঠাকুরদার মারের হাত থেকে বেঁচে যেত। আমার আর ভাইয়ের পিঠে পড়তেই থাকতো যতক্ষণে না মা এসে তার সন্তানদের বাঁচাতেন। আগেই বলেছি আমার দিদির মাথায় নানা দুষ্টু বুদ্ধি খেলতো। এরকমই এক গরমের সন্ধ্যায় ঘরের এক কোনে দাদা পড়ছে। আর এক কোনে দিদি ,আমি আর ভাই। দিদি বললো,”কাইল স্কুল ফেরত আমি আইয়া ডাকলেই তরা দুই ভাই বাইরাইয়া আসবি। দাদু রোজ চুল ধইরা টাইন্যা আমগো পুষ্করিণী থন খেদাইয়া আনে। কাইল তগো লইয়া গিয়া তিনোজনেই লাইড়া(ন্যাড়া)হইয়া ফিরুম।”যেমন কথা তেমন কাজ। ধরণী মামার রাস্তার উপর ইট পাতা সেলুন। ধরণী মামা ওপারবাংলায় আমাদের পাশের গ্রামের লোক ছিলেন। দিদি আমাদের দুভাইকে দু হাতে ধরে মামাকে বললো,”মামা আমরা বন্দ্যোপাধ্যায় স্যারের মাইয়া,পোলা। গরমে খুবই কষ্ট পাইতাছি। তয় মায় পাঠাইলো ‘যা ধরণীদার সেলুনে গিয়া নাইড়া হইয়া আয়। পয়সা যেন তোর বাপের থন লইয়া যায়’।”ধরণী মামা,”অয় সেইদিনের ছেড়ি তুই দেহি চইখ্যে মুহে (চোখে মুখে) কথা কও। তগো আবার পয়সার চিন্তা। জিগাইস তো তর ঠাউদ্দারে তোগো বাপ মায়ের বিয়ার সম্বন্ধটা করলে কেডা। এই ধরণী আছিল তাই জাতেপাতে অতবড় কুলিন ঘরে তর মায়ের বিয়াডা হইলো। আর এখনে কস্,,,,,,,,!” সেদিন ন্যাড়া হওয়ার পর তিন ভাইবোন যখন ডুবিয়ে স্নান করছি ঠাকুরদা আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যেতে এসে আমাদের দেখে হা হয়ে গেলেন। বোধকরি অতবড় রাশভারী শিক্ষাব্রতীর ভিতরের মজালোভী শিশুটা বেরিয়ে এসেছিল। বাড়িতে বকাঝকার উপর দিয়েই গিয়েছিল। মার পিঠে পড়ে নি।গ্রীষ্মের ঐ গরমে টক হয়ে যাওয়া দুপুরে অপেক্ষা করতাম কখন মা ঘুমোবে। দিদি লুকিয়ে রাখা জায়গা থেকে কাচা আম ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গীতে বের করে ছুরি দিয়ে ছুলে চাকচাক করে কাটা আম নুন মিষ্টি মেখে নিজে খেত আমাদের দিতো। আমরা ছিলাম তার দুষ্টুমির সহচর বিশেষ করে আমি। অস্বচ্ছল পরিবারের গৃহিণী হয়েও আমার মা ছিলেন সৌখিন স্বভাবের। উঠোনে জুঁই,বেল ,হাস্নুহানা লাগাতেন।গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় তাদের সুবাস আজো নাকে লেগে আছে। এই সুবাসের সাথে মায়ের শাড়ির গন্ধ কেন যে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বড় বড় কালবৈশাখীর ঝড় আসতো। আমাদের খুব সখ হতো ঝড়ে আম কুড়োতে যাওয়ার।এক সন্ধ্যায় সুযোগ এসেও গেলো। মা বাবা গেছেন বিয়ে বাড়িতে, দাদা ফিজিক্সের টিউশন পড়তে আর ঠাকুরদা শিশু শিক্ষার উপর কোন মিটিংয়ে। ঘন ঘন বাজ পড়ছে,আকাশ ফালাফালা করে বিদ্যুতের চমক। আমরা (এক সদ্য কিশোরী আর তার দুই বালক ভাই) বাড়ি খালি রেখে দৌড়াতে দৌড়াতে জগা দার বাগানে ঝড়ে পড়া আম কুড়োতে। এই জগা দা জীবিত অবস্থায় তার দিদির ননদের প্রেমে পড়ে। জগাদা খুঁড়িয়ে হাঁটতো। দিদির ননদ জগাদার গলায় মালা পরাতে রাজী হয় নি। তখনও সমাজে শরচ্চন্দ্রের দেবদাসের প্রভাব ছিল। ব্যর্থ প্রেমিকরা আত্মহত্যা করে ফেলতো। জগাদা আমবাগানে এসে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মরে। সেই থেকেই ওটা ভূতের বাগানের কুখ্যাতি লাভ করে। অথচ প্রথম শ্রেণীর হিমসাগর ন্যাংড়া ফলে থাকতো। ঘন জঙ্গলে দিনের বেলাতেও কম লোক যেতো। দিদি আর আমার হাতে ছোট থলে।ভাইয়ের হাত খালি। প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টার পর আমরা মাত্র দুটো আম কুড়োতে পেরেছি।একটা থুরথুরে বুড়ি আমাদের সাথেই আম কুড়োচ্ছিল।তার একটা ঝোলা শেষ হতেই আর একটা ঝোলা কোথা থেকে বার করে মুহূর্তে অর্ধেক ভরে ফেললো। আমি আর ভাই বুড়িটাকে দেখলেও দিদি এতক্ষণ দেখে নি বা দেখলেও খেয়াল করে নি। দিদিকে দেখাতেই চিৎকার করে উঠলো,”ওরে বাবা ওটা যে আমতুকি বুড়ি।পেত্নী। দৌড়া দৌড়া।” দু ভাই এর হাত ধরে দিদির মরণ বাচন দৌড়। পিছনে আমতুকি বুড়ির খিটখিট হাসি। বাড়িতে এসে তিনজনেরই জ্বর এসেছিলো।পৃথ্বী ব্যানার্জীআরো এক বৈশাখী রাত। গুমোট গরম। অনেক রাত ঘুম আসছে না। হাস্নুহানার গন্ধে বাতাস ম ম করছে।দিন সাতেক আগে কয়েক বাড়ি পর আমার বন্ধু শ্যামা মারা গেছে। হঠাৎই কে যেন আমার নাম ধরে ডেকে উঠলো,”মন!মন”। একটু দূরে দিদি শুয়েছিলো।হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলো। আমার কাণের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,”তয় আমিও শুনছি! সাড়া দিস না। ঐটা শ্যামার নিশি। তরে ডাইক্যা লইয়া গিয়া আন্ধারে ঘুরাইয়া মারবো।”এই ঘটনার পরেও আমার জ্বর চলে এসেছিলো।ভূতপ্রেত,জিন, দানো অঢেল ভালোবাসা কিছু শাসন,অপার আনন্দ কিছু মন খারাপ এসব নিয়েই আমার বাল্যকাল,আমার কৈশোর। একবার অর্জুনপুরের বৈশাখী মেলার থেকে ফেরার পথে বর্ষায় ঝুলনপূর্ণিমার জন্য কষ্ট করে জমানো পয়সায় কেনা সব মাটির পুতুল কালবৈশাখীর ঝড় বৃষ্টিতে গলে মাটি হয়ে গিয়েছিলো পর দিদির সেই কান্না আজও শুনতে পাই। সাথে আমরা দুভাইও কেঁদেছিলাম। পরে মায়ের কথায় বাবা টাকা দেওয়ায় আমরা পরের দিন আবার মেলায় গিয়ে সব পুতুল কিনে হাসিমুখে ফিরেছিলাম।কিছু কথা বলতে গিয়ে অনেক কথাই না বলা রইলো।আদৌ আপনাদের পরিবেশন যোগ্য হলো কি না জানি না।তবু এ আমার নিজের কথা। ভালোবাসার ছেলেবেলার কথা আপনাদের শোনালাম।
সুন্দর স্মৃতিচারণ। ভালো লাগলো ।
সাবলীল লেখা। স্মৃতিচারণ। বেশ ভাল লাগল।
ভাল লেগেছে। স্মৃতি কথা পড়তে ভালই লাগে।
খুব সুন্দর সাবলীল লেখা ।
জীবন কথা” কিছু জুঁই” স্বাভাবিক ভাবেই অনেক কথার সমাহার। সে সব কথা যদি কলমে জীবন্ত হয়ে ওঠে তাহলে গল্পের জন্য আলাদা নির্মাণের প্রয়োজন থাকে না। লেখক ও সম্পাদক কে ধন্যবাদ।