কবিতাঃ সূত্রপাত – পার্থ রায়

সূত্রপাত

পার্থ রায়

-“যদি কিছু মনে না করেন, জানালার ধারের সিটটাতে বসতে পারি?”একটা রিনরিনে কণ্ঠস্বরে ঘাড় ঘোরাল অর্জুন। হাওড়া থেকে বিকেলের পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে নিজের রিজার্ভড সিটটার নাম্বার মিলিয়ে সবে গুছিয়ে বসতে যাচ্ছিল ও। পুরু লেন্সের চশমায় পান পাতার মতো মুখে একটা দারুন মিষ্টি  ভাব রয়েছে। রিনরিনে কণ্ঠস্বরের অধিকারিণীর যে জিনিষটা অর্জুনকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করল, সেটা হল ওর চোখ দুটো, যেন হাসছে। মাঝারী গড়নের এক প্রজাপতি দাঁড়িয়ে। মনে মনে বলল, “ধেড়ে মেয়ের খুকী খুকী আবদার। তবে খুকী, তোমার ওই চোখ দুটো আর ঝর্ণার বয়ে যাওয়ার মতো গলার জন্যে, সিটটা দিতেই পারি। তাছাড়া একটা সুন্দরী মেয়েকে না বলতে পারার মতো বীর এই অর্জুন নয়, বুঝেছ খুকী সোনা?”।একটু অকারণ গাম্ভীর্য এনে মুখে বলল, ‘হুম, বসুন”। মুখে এমন একটা ভাব করল যেন জানালার ধারের সিট ছেড়ে দিয়ে যথেষ্ট স্যাক্রিফাইস করেছে । আসলে অর্জুনেরও জানালার ধারের সিটের প্রতি বরাবরের একটা লোভ আছে।      দু বছরের চাকুরীতে এটা সেকেন্ড পোস্টিং। নুতন মুরগীতো, ডিপার্টমেন্ট খুব দৌড় করাচ্ছে। কোথায় বাঁকুড়ার বারিকুল থানা, আবার এখন পুরুলিয়ার বড়বাজার থানা। কোলকাতায় বাবা, মা, বোন চিন্তায় থাকে খুব। অর্জুনের অবশ্য খারাপ লাগেনা। বড়বাবু পুরুলিয়া ষ্টেশনে একটা গাড়ী রেখে দেবেন ওর জন্যে। হাওড়া থেকে কেনা নুতন ম্যাগাজিনটা সবে বের করে পড়তে যাবে, এমন সময় মেয়েটির পাশে বসা মাঝ বয়েসি  ভদ্রলোক বললেন, “বুঝলে বাবা, তুমি কিছু মনে করো না। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই জানালার ধারের সিটে ওকে বসতেই হবে। এতো বড় হয়েছে, তবু দেখো। এই দ্যাখো তোমায় তুমি বললাম”। আলাপচারিতা গড়াল। ভদ্রলোক মেয়েটির বাবা। যা জানা গেল- মা মরা মেয়ে। এসএসসি পাশ করে পুরুলিয়া শহরেই একটা স্কুলে নুতন জয়েন করতে যাচ্ছে। ভদ্রলোকের আর এক বছর আছে সরকারি চাকুরী থেকে অবসর নেবার। অর্জুন বলছে কম, শুনছে বেশী। পুলিশ শুনে ঘাবড়ানোর কোন লক্ষণ নেই বাপ, মেয়ের। কারণ, কোলের ওপর রাখা ম্যাগাজিনটা সুন্দরীর সুন্দর হাতের বাঁধনে ধরা পড়ল। এক চোট হাসি কুলকুল করে বয়ে গেলো অর্জুনের বুকে। বেশ ভালো, বাপ এদিকে বকে যাচ্ছেন, আর মেয়ে ওদিকে ছিনতাই করছে। প্রথমে জানালার ধারের সিট, তারপরে ম্যাগাজিন-আরও কী ছিনতাই হবে কে জানে? এমনিতেই তো চোখের হাসি আর রিনিরিনি গলা দিয়ে আধা গ্রেফতার করেই ফেলেছ পুলিশবাবুকে। বাবা যে হারে বকে যাচ্ছে, তা দেখে মেয়ে মাঝে মাঝেই আনটিদের মতো ভ্রু কুঁচকে শাসন করছে কিন্তু কে শোনে কার কথা। আপাতত একটা পিজি তে থাকবে খুকী সোনা। অর্জুন মনে মনে এই নাম দিয়েছে, আসল নাম তো জানাই যাচ্ছে না। বাবাটি না থাকলে নাড়ি নক্ষত্র বের করে নেওয়া যেত। তবে মাঝে মাঝেই দু-জোড়া চোখের দৃষ্টি মিলে গেলে এক জোড়া চোখের হেসে দৃষ্টি নামিয়ে নেওয়ার মাঝে কিছু মিষ্টি কবিতা কামরাকে ভরিয়ে দিচ্ছিল। অন্য যাত্রীদের অজ্ঞাতেই। অর্জুন বেশ উপভোগ করছিল। এমন অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম। চোখের ঝর্না হাসি কখন যে ওর বুকের ভেতরে ছেয়ে ফেলেছে টের পায়নি। রাত প্রায় পৌনে এগারোটা নাগাদ পুরুলিয়া ষ্টেশনে ট্রেন ঢুকতেই, অর্জুন উঠে দাঁড়াল। ম্যাগাজিনটা ফেরত নেবার সময় আশ মিটিয়ে শেষ বারের মতো চোখে চোখ রাখল অর্জুন। ওর মনে হল ওর খুকি সোনা যেন দুই চোখের ঝিলিকে ম্যাগাজিনটা দেখিয়ে একটা ইশারা করল। অর্জুন বিহ্বল দৃষ্টি নামিয়ে দেখতে পেল ম্যাগাজিনটার কভার পেজের এক কোণায় সুন্দর হাতের লেখায় দুটো লাইন। নিশিগন্ধা সেন, সেল ফোন নাম্বার…। অজান্তে ভাল লাগার এক ঝর্না হাসি অর্জুনের দুই চোখেও সংক্রামিত হল। ব্যাগ আর বেডিংটা এক ঝটকায় তুলে নিতে নিতে অর্জুন সিদ্ধান্ত নিল শিমুল পলাশের দেশে নিশিগন্ধাও নাহয় পাশে থাকুক।

8 thoughts on “কবিতাঃ সূত্রপাত – পার্থ রায়

    1. এই লেখকের সব লেখা আমার খুব পছন্দের। দারুণ লাগলো । একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প।

Leave a Reply to Krittika Bhaumik Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *