রবি ঠাকুর ও তাঁর নোবেল প্রাপ্তি
তড়িৎ চক্রবর্তী
বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোটেনস্টাইন ১৯১০ সালে কলকাতায় আসেন। অবন ঠাকুরের ছবি দেখতে কলকাতার ঠাকুর বাড়িতে উপস্থিত হন। সেখানেই তাঁর সাথে দেখা হয় রবি ঠাকুরের ও বন্ধুত্ব হয়।
পরে তাঁর অনুরোধে অজিত চক্রবর্তী কবিগুরুর কিছু লেখা ইংরাজিতে অনুবাদ করেন ও তাঁর কাছে পাঠান। এছাড়া জাহাজে লণ্ডন যাত্রার আগে কবি অর্শ রোগে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিশ্রাম নেবার সময়ে গীতাঞ্জলি থেকে ৫২ টি আর অন্য নটা কাব্যগ্রন্থ থেকে ৫১ টি কবিতা কবি সহজ ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রমথলাল সেন আর ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের কাছ থেকে রবি ঠাকুরের সাহিত্য চর্চা সম্পর্কে বিশদ জানতে পারেন ও কবিকে লন্ডনে আমন্ত্রণ করেন। তিনি আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস আর পরে জর্জ বার্নডশকে চিঠি লিখে কবির কবিতাগুলি পড়তে বলেন।
এরপরে লন্ডনে এক সাহিত্য সভায় কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে রবি ঠাকুরের কবিতা পাঠ ও আলোচিত হয়। ওই একদিনেই লন্ডনের সাহিত্য মহলে ছড়িয়ে পড়ে কবিগুরুর নাম।
রবি ঠাকুরের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে রয়েল সোসাইটি অফ লিটারেচার অফ ইউ কে -র সভ্য টমাস স্টার্জ এস মুর কবির অজ্ঞাতেই যখন তাঁর নাম সুপারিশ করেন,তখন তাঁর হাতে ছিলো রবি ঠাকুরের একটি মাত্র বই। আর ঠিক সেই কারণে সেই সময়ের নোবেল কমিটির সভাপতি হোয়েন কবি গুরুর নামের বিরোধিতা করে বলেন ‘একটা মাত্র বই দেখে নোবেল প্রাপ্তির বিচার করা সম্ভব নয়’।
বাংলা ভাষার সাথে পরিচিত প্রাচ্যবিদ এসাইস টেঙ্গার ও সুইডিশ কবি হাইডেস্টাম রবি ঠাকুরের নামের পক্ষে মত দেন।
১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের সেরা সম্মান নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।
বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রবক্তা, যিনি একটি বিশাল ক্যানভাস তৈরি করেছিলেন যাতে রয়েছে পেইন্টিং, স্কেচ এবং ডুডল আর কয়েকশত কবিতা, প্রায় দুহাজার গান।
তাঁর নোবেল প্রাপ্তির ঘোষণা হয়েছিল, নয় অক্টোবর উনিশশো তেরো সালে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে খবরটি পাঠান পনেরোই নভেম্বর।
নোবেল পুরস্কারের অনুষ্ঠানটি ছিলো ওই সালের দশই ডিসেম্বর।
এটি সর্বজনবিদিত যে, তিনি এশিয়ার প্রথম ব্যক্তি আর প্রথম অ-ইউরোপীয় যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান- গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদ ‘O Song offering’ এর জন্যে।
বইটিতে গীতিমাল্য, খেয়া, শিশু, নৈবেদ্য, কল্পনা, চৈতালী, উৎসর্গ, স্মরণ, অচলায়তন ইত্যাদি কাব্য থেকে ৫৩টি কবিতার সাথে আরো ৫০টি কবিতা নিয়ে নতুন ইংরাজি নামে ১৯১২ সালে লন্ডনে ইন্ডিয়া সোসাইটির আনুকূল্যে প্রধানতঃ সভ্যদের মধ্যে বিতরণের জন্যে সাতশো পঞ্চাশটি কপির মুদ্রণ হয়।
বইটির ভূমিকা লেখেন প্রখ্যাত ইংরেজ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস।
যদিও অমর্ত সেনের কথায়, ’যে কেউ ঠাকুরের কবিতাগুলিকে তাদের আসল বাংলায় জানে তার যেকোনও অনুবাদে (ইয়েটসের সাহায্য বা ছাড়াই তৈরি) সন্তুষ্ট বোধ করতে পারে না।’
বইটি শুরু করেছিলেন যে কবিতাটি দিয়ে গুরুদেব যেন তাঁর স্বাভিমান আর অহংকারকে চূর্ণ করেছেন।
Thou hast made me endless,such is my pleasure. This frail vessel thou emptiest again and again,and fillest it ever with fresh life.
(আমারে তুমি অশেষ করেছ
এমনি লীলা তব।
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
জীবন নব নব।)
অনেক ভাবনার পরে কবি বইটির নাম গীতাঞ্জলি দেন যার মানে, ‘গানের অর্ঘ্য’ মূল বিষয় ‘ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি’।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বাংলা পলিম্যাথ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘তাঁর গভীরভাবে সংবেদনশীল,তাজা এবং সুন্দর শ্লোকের কারণে, যার দ্বারা , তিনি তাঁর কাব্যিক চিন্তাকে নিজের ইংরাজিতে প্রকাশ করেছেন,,,,,,,’।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির খবর রয়টারে প্রকাশিত হয়।
এছাড়া টাইমস সাপ্লিমেন্ট অন লিটারেচার খবরটির আলোচনা প্রকাশ করে।
কবির নোবেল প্রাপ্তি সকলে ভালো চোখে নেননি।
ইউরোপ থেকে বিশেষকরে ইংরেজরা অভিযোগ করে টমাস হার্ডি থাকতে, ফ্রান্স থেকে অভিযোগ আসে আনাতোল ফ্রাঁস থাকতে, জার্মানীর লেখক সাহিত্যিকরা বলতে থাকে রোসেগাগার থাকতে একজন নেটিভ ভারতীয় সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি করে এই পুরস্কার পেতে পারেন!
রবীন্দ্রনাথের আগে কোন অ-ইউরোপীয় যে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেতে পারেন তা কেউ ভাবতে পারেননি। আসলে কবির লেখায় যে কালের ডাক ছিলো বা লেখাকে শিল্পের স্তরে উন্নীত করা সেটা রবি ঠাকুর তাঁর নোবেল প্রাপ্ত বইটির মধ্যে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন যা সেই সময়ের ইউরোপের সংখ্যাগুরু সাহিত্যিকদের মধ্যে সঠিক পক্ষের আলোড়ন তৈরী করতে পেরেছিল।
এরপর ভারতের নানান প্রদেশের নানান লেখক তাঁদের লেখা অনুবাদ করে ইংল্যান্ডে পাঠাতে শুরু করেন।
২৩/১১/১৯১৩ কলকাতা থেকে এক বিশেষ ট্রেনে বহু মানুষ শান্তিনিকেতনে আসেন কবির সাথে দেখা করে তাঁকে সম্বর্ধনা দিতে।
এসেছিলেন বিচারপতি আশুতোষ চৌধুরী, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, পি সি নাহার, ডাঃ প্রাণকৃষ্ণ আচার্য্য প্রমুখ।
তাঁরা বক্তব্য রাখেন, আনন্দোৎসব হয়।
এবার রবি ঠাকুরের বলার পালা। তিনি মনের দুঃখে কিছু ক্ষোভের কথা বলেন। এই ক্ষোভের কথার বিরুদ্ধে সমস্ত অতিথিরা অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করে। পরে থাকে কলকাতা থেকে আনা রাধুনির এত মানুষের জন্যে সব রান্না , নষ্ট হবার আগে শান্তিনিকেতনের ছাত্ররা তিন মাইল দূরে বোলপুর স্টেশনে অতিথিদের কাছে এই খাবার পৌঁছে দেয়।
যদিও বিপিনচন্দ্র পাল শেষ অবধি তাঁর বঙ্গদর্শন পত্রিকায় রবি ঠাকুরের কবি প্রতিভার প্রশংসা করেন।
বর্তমান দেশীয় পরিস্থিতিতে রবি ঠাকুর প্রতিদিন প্রাসঙ্গিক। তাঁর কবিতায় যে বহু’র প্রকাশ ও মিলন পাওয়া যায় তা কোন ভাবেই অন্য কোন সময়ে আর মেলেনি।
পিতা দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম মতের থেকে তিনি বিন্দুমাত্র সরে যাননি কোন দিন কোন সময়ে।
ভাবলে অবাক হতে হয়। কতটা প্রতিকূলতার মধ্যে সেই সময়ে রবি ঠাকুরকে সমাজের পাঁক পরিষ্কার করে এগোতে হয়েছে।
তবে অনুশোচনার বিষয় ২০০৪ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুরক্ষিত সিকিউরিটি ভল্ট থেকে রবি ঠাকুরের নোবেল পদকটি আরো কিছু মূল্যবান জিনিস চুরি যায়। সি বি আই তদন্ত ভার গ্রহণ করার কুড়ি বছর পরেও এই চুরির কোন কিনারা হয়নি।
বাঙালির সাহিত্য চেতনায় রবীন্দ্রনাথ যে চির প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ কারের উপস্থাপনায় তাহারই পরিচয় মেলে, তবে লেখক কবির ক্ষোভের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখিলে মোর ন্যায় অধমের খানিক জ্ঞান বৃদ্ধি পাইত। যাহা হউক হয় নাই যখন আগ্রহ থাকিল কোনো এক সময়ে লেখক নিশ্চিত এ বিষয়ে আলোকপাত করিবেন, আপাতত রবির কিরণে চিত্ত সুদ্ধি করি, জয় হউক বাংলা সাহিত্যের জয় হউক মাননীয় তড়িৎ বাবুর লেখনীর।
একরাশ ধন্যবাদ।
মূল্যবান লেখা। কবির এমন কি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন যে সকলে শান্তিনিকেতন থেকে না খেয়ে চলে এসেছিলেন জানার আগ্রহ আছে। এই বিষয়ে আলোকপাত করলে ভাল হয়।
এটা সত্যিই আমার জানা ছিলনা যে কবিগুরুর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের কারনে কলকাতার অতিথিরা সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন । এটুকু জানার পর আগ্রহ রইল রবীন্দ্রনাথের ক্ষোভের বক্তব্য জানার ।
লেখা অত্যন্ত সহজভাবে সহজবোধ্য করে সুন্দর লেখা হয়েছে। এজন্য তোকে অনেক আশীর্বাদ ও অভিনন্দন সাহেব।