প্রবন্ধঃ মহাকাব্যের রণক্ষেত্রে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ – উত্তম বেহারা

মহাকাব্যের রণক্ষেত্রে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ
উত্তম বেহারা

ডিরোজিওর মৃত্যুর ২বছর পর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন ১৮৩৩ খ্রিঃ। ডিরোজিও তখন না থাকলেও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের বা নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর প্রভাব বা প্রতাপ যে তখনও ছিল বেশ অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও মধুসুদন দত্ত নব্যবঙ্গীয়দের মতো কোন সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেননি। তাঁর কাছে মূল উপজীব্য বিষয় ছিল – কবিতা – কবিতা – একমাত্র কবিতা ও কবি হয়ে ওঠা । তৎকালীন বাঙালী ছাত্রদের মতো বাংলা ভাষার প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না তাঁর এমন কি ভূগোল, বিজ্ঞানও ছিল সে তালিকায়। যা ছিল তা শুধু ইতিহাস ও পাশ্চাত্য সাহিত্য। দাঁতে দাঁত চেপে অসংখ্য যন্ত্রণা আর বুকের রক্তক্ষরন-এর মধ্য দিয়েও এভারেস্টের শৃঙ্গ জয়ের ন্যায় তিনিসবকিছুকে পরাজিত করতে পেরেছিলেন তার সৃষ্টির মধ্যে।
হিন্দু কলেজের মেধাবী ছাত্র – মধুসূদন দত্ত হঠাৎই একদিন সেলুন থেকে ফিরিঙ্গি কায়দায় চুলের ছাঁট দিয়ে এলে অবাকই হয়েছিলেন অনেকে। বাঁকা চোখের দৃষ্টিতে বাঁকা-বাঁকা মন্তব্য ও এসেছিল সেদিন কিন্তু বন্ধুদের কথায় কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেনি। অথচ প্রতিবাদী স্বভাবের মধুসূদন যে অস্বাভাবিক ভাবে চুপ করেছিলেন তার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে ছিল তাঁর জীবনের পরিবর্তনময় এক গোপন রহস্য। পরের দিনই বাড়ি থেকে নিখোঁজ হলেন কবি। দত্ত পরিবারে শোরগোল পড়েগেল। কিছুদিন পর জানা যায় তাঁকে শেষ দেখা যায় দ্বিগম্বর মিত্রের ভাই মাধব মিত্রের সাথে। আরও কিছুদিন পর মাধব মিত্রবাড়ি এলেও মধুসূদন ফিরে এলেননা।
কোন আবেগে, কার পরামর্শে তিনি নিজে থেকেই নিখোঁজ হয়েছিলেন ? এভাবনার অবসান হয়, অবশেষে কিছুদিন পর নিখোঁজ তরুণের সন্ধান পাওয়া গেল এভাবেই যে – খ্রিষ্টান মিশনারীরা ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গের ভেতর তাঁকে লুকিয়ে রেখেছেন। এই লুকিয়ে রাখার খবর সবাইকে বিস্মিত করেছিল সেদিন, নানান অনুসন্ধানের পর জানা যায় মধুসুদন দত্ত অর্থাৎ দত্ত পরিবারের এক বাঙালী সন্তান খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হতে চলেছেন – অর্থাৎ – ধর্মান্তরিত। হিন্দু ধর্মের সূর্য ডোবার পালা কবিরজীবনের সম্মুখে যে হাজিরতা বন্ধু-বান্ধব, মা- বাবা এমনকী বাঙালী সমাজের কেউ কয়েকদিন আগে টের পাননি। অথচ ফিরিঙ্গি কায়দায় তাঁর চুলের ছাঁটের মধ্যেই যে এর ইঙ্গিত ছিল তা আজ খুব সহজেই বোঝা যায়। এ-ভাবনা একারণেও না আসতে পারে যে কলকাতার একজন নাম করা উকিলের ছেলে, হিন্দু কলেজের মেধাবী তরুণ ছাত্র খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়া মানে আকাশ কুসুম। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত জোর করে পুত্রকে ধর্মান্তরিত করতে না দেন এবং দুর্গ থেকে বাড়ি নিয়ে চলে যান তারজন্যই ইংরেজ মিশনারীরা কবিকে তাদের প্রটেকশানে নিয়ে নেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে মিশনারীদের চেয়ে বলা ভাল কবি নিজেই ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হতে চাওয়া স্বইচ্ছুক প্রার্থী। কেন না রাজনারায়ণ দত্ত পুত্রকে ফিরিয়ে আনতে কোন কসুর করেন নি। সরকার ঘনিষ্ট জমিদার- সত্যচরণ ঘোষাল, শিক্ষক রামচন্দ্র মিত্র হিন্দু কলেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গৌরদাস বসাক কবির কাছে উপস্থিত হলেও তিনি একচুলও সরে এলেন না তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে। অন্যদিকে কবিকে ধর্মান্তরিত করাও মিশনারীদের কাছে সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সালটা ১৮৪৩ এর ৯ই ফেব্রুয়ারী ওল্ড মিশন চার্চে ধর্ম যাজক টমাস ডিয়ালটি – মধুসূদনের শরীরে পবিত্র জল ছিটিয়ে অতীতের সব হিন্দুত্ব ধুইয়ে দীক্ষা দান প্রদান করেন। মধুসূদন নিজের লেখা গান Hymn গাইলেন “Long sunk in superstition’s night” | কবির নামের আগে বসল মাইকেল। ধর্মান্তরিত হলেন কবি, মাত্র ১৯ বছর বয়সেই মাইকেল শব্দে নিজেকে যুক্ত করেনিয়েছিলেন। মধুসুদন ইংরেজদের কাছে কবি স্বীকৃতি পাওয়ার লক্ষেই এই ধর্মান্তরিত হন। কেন না ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপ এর একটি কথা মধুসূদন সেই সময় মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, কথাটি হল – কবিতার জন্য দরকার হলে – আপনজনদের এমনকি বাবা-মা কেও ত্যাগ করতে হবে। কবি চিরদিনই তাঁর কবিতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, বলা বাহুল্য অহংকারী ছিলেন বেশি। এই অহংকারকে আরো প্রতিষ্ঠিত করতেই তিনি মনে মনে ভাবতেন বিদেশ যাওয়ার কথা, অর্থাৎ ইউরোপিয় সাহিত্য, সাংস্কৃতি ও সাহেবি চর্চায় মনোনিবেশ করতে। যদিও তাঁর মনের মনি কোঠায় তখন বাসা বেঁধে ছিলেন কবি – মিলটন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস, শেলি, লর্ড বায়রন, ক্যাম্বেল প্রমুখ সেকালেরজগৎ বিখ্যাত কবিগন, আবার যাদের বাস সেই ইংলেন্ডে। মিলটনের মতো বড়ো কবি হয়ে ওঠার আত্মবিশ্বাস থাকলেও লর্ড বায়রনই ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কবি। এই টানেই যে তাঁর বিদেশ যাত্রা তা সবাই জানেন। আরো একটি কারন ছিল খ্রিষ্টান হওয়ার কিছু দিন আগে একটি গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে বিবাহের আয়োজন ঠিক হয়েছিল। কবি এথেকে মুক্তি পাওয়ারজন্যও ধর্মান্তর গ্রহনের সহজ উপায় খানি গ্রহন করে থাকতে পারেন ।
এ-সব আলোচনার পর পরই একটি প্রশ্ন বারবার উকি মারে – খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত, নিজেকে সাহেব বলে পরিচিতি দান, ইংরেজী কাব্য সাহিত্য চর্চা, বিদেশী কালচার রপ্ত করার পরেও কবি কেন হাত দিলেন হিন্দুর দুই প্রাচীন মহাকাব্য ও পুরানকে কাটা ছেঁড়া বিশ্লেষণে ? বাংলা সাহিত্যে দুই মহাকাব্য সৃষ্টির পর আবার মহাকাব্য রচনার ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিলো কিনা, নাকি বাঙালীদের চিরাচরিত চিন্তা-ভাবনা-সংস্কৃতি, ধর্মীয় ভাবাবেগকে নতুন করে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন কিনা তিনি, তা আজও বিস্ময়। তিনি কৃত্তিবাসী রামায়নের মত মহাকাব্যকে নতুন করে অনুবাদ করলেন না বরং যা করলেন তা বাঙালির চিরাচরিত ধ্যান, জ্ঞান, ধর্মীয় ভাবনাকে ভেঙে চুরমার করে দিলেন। যে বাঙালী ভগবানের রূপে রামকে পূজা করে আসছিলেন প্রাচীনকাল থেকে, সেই বাঙালীকেই তিনি যুক্তিতর্কে, বিশ্লেষনের মধ্য দিয়ে ভেঙে ভেঙে দুই রাবণ-মেঘনাদকে নতুন নকশা করা আসনে ডেকে বসালেন ধর্ম বীর হিসেবে। ধর্মান্তরিত হওয়া বা পরিবারের বিরাগভাজন, কিংবা হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্যুতির কারন স্বরূপ – হিন্দু ধর্মকে আবার ঘুরে ভালোবাসা নাকী অন্য ধর্মে – ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু মহাকাব্যের ভাবনা, ত্রুটিগুলোকে নতুন করে তুলে ধরতে চেয়েছেন ? কোন ঋতুর কোন বৃষ্টিতে মাইকেলের মন ধুয়েছিলো যার জন্য তিনি ইংরেজী কাব্য মহাকাব্য নয়নিজ হিন্দু কাব্যেই ডুব দিলেন ?
“মেঘনাদ বধ” (১৮৬১ খ্রিঃ) কাব্যে কবি যে মেঘনাদ কে মানসরূপে সৃষ্টি করে বিভীষণের উদ্দেশ্যে শেষ পর্বে যা যা বলেছেন – নিজজাতি, স্ব-দেশ, ধর্মীয় জ্ঞান সবি কি শেষজীবনের আত্মগ্লানিময় বাক্য নয় ?
“কোন্ ধৰ্ম্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি, – এ সকলে জলাঞ্জলি ? শাস্ত্রে বলে, গুণবান যদি
পরজন, গুন হীন, স্বজন, তথাপি
নির্গুন, স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা।”
১৮৪৮ সালে শুরুর দিকেই কবি মাদ্রাজে চলে যান। মাদ্রাজে থাকাকালিন তিনি তামিল ভাষায় রামায়ণ নিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন। তামিল রামায়ণে রামকে নয় শয়তান রাবণকে বড়ো করে দেখানো হয়েছে। সেভাবনা থেকেও রাবণকে নতুন করে বাংলা
সাহিত্যেভাবিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
আবার বীরাঙ্গনা কাব্যের (১৮৬২ খ্রিঃ) কথা আমি অন্য ভাবেও বলতে পারি। এই পত্র কাব্যে এগারোটি নারী চরিত্রকে যে অর্থে বীরাঙ্গনা রূপে ভূষিত করেছেন সে অর্থে এ- কাব্যের নায়িকারা কোন ক্ষেত্রেই বীর নন। যদিও বীরত্ব তাদের নির্ভিকত্বে, বীর্যে, এবং অ- কুণ্ঠিত ভাব প্রকাশের মধ্যে। কবি তাদের বীরত্ব প্রকাশ করেছেন – তাদের শ্রেষ্ঠত্বকে আরসুন্দর দেহও মনের রূপকে।
“টুটকিরীটির গর্ব্ব আজি রণস্থলে।
খন্ডমুন্ডতার আনশূল-দন্ড-শিরে।
অন্যায় সমরে মূঢ়নাশিল বালকে;
নাশ, মহেশ্বাস, তারে। ভুলিব এ জ্বালা,
এ বিষম জ্বালা, দেবভূলিবসত্ত্বরে।”
— বীরাঙ্গনা
একাদশসর্গ
নীল ধ্বজের প্রতিজনা
বাংলার নবজাগরনের প্রেক্ষাপটে মধুসূদন দত্ত – সতীদাহ, বিধবা বিবাহ, বহুবিবাহের বিরোধীতায় সরাসরি কোন আন্দোলনে নিজকে কোন রূপ ভাবে নিয়োজিত না করলেও তাঁর সাহিত্য ও লেখনী ছিল প্রতিবাদের অন্যতম মাধ্যম। তাঁর রচনায় তাই বার বার নারীস্বাধীনতার কথা ফুটে উঠেছে—
“কি বালিয়া সম্বোধিবে, হেসুধাংশু নিধি,
তোমারে অভাগী তারা ? গুরুপত্নী আমি
তোমার পুরুষরম; কিন্তু ভাগ্য দোষে,
ইচ্ছা করে দাসী হয়ে সেবি পাদুখানি।”
আবার-
“গুরুপত্নী বলি যবে প্রণমিতে পদে,
সুধানিধি, মুদি আঁখি, ভাবিতাম মনে,
মান-ভঙ্গ-আশেনতদাসীর চরণে।
মানিনীযুবতী আমি, তুমি প্রাণপতি,
আশীর্ব্বাদ-ছলেমনেনমিতাম আমি! ”
— বীরাঙ্গনা
দ্বিতীয়সৰ্গ
সোমের প্রতিতারা
গুরু পত্নী তারা দেবীর এই প্রেম নিবেদন তৎকালীন সমাজ না মেনে নিলেও তিনি যে নারীস্বাধীনতাও নারী প্রেম, কামনাকে অন্য মর্যাদায় নিয়ে গিয়েছিলেন তার অন্যতম কারন- নিজের মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা। ১৮৫১ তে মায়ের মৃত্যু সংবাদ তাঁকে গোপনে কলকাতায় আসতে বাধ্য করেছিল। তিনি মায়ের জীবনের যে যাবতীয় যন্ত্রনার উৎস এবং অধম সন্তান সেই থেকেই হয়তো তাঁকে সম্মান জানানোর জন্য বীরাঙ্গনার তিনজন স্বামী বিদ্রোহী নারীকে জাহ্নবী, কৈকেয়ী ও জনাকে স্বামীর পরিচয় অপেক্ষা মা করে – তুলেছিলেন।
কিন্তু আবারও প্রশ্নে ওঠে – যে প্রশ্ন এক জটিল মনোস্তাত্ত্বিক। পুরানের এগারোটি নারীর মনের গভীরের রুঢ় মর্ম বেদনাকে অনুভব করে – বীরাঙ্গনা রচনা করলেন, সেই কবি নিজের দুই পত্নীর এক পত্নীর মনের কন্ঠ বা অনুতাপের আগুনের স্পর্শ পেয়েছিলেন কিনা সে এক জটিল রহস্য। ১৮৫৫ সালের শুরুতেই চার সন্তানের জননী রেবেকার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করলেন, বিবাহ করলেন হেনরীয়েটাকে। এ-ক্ষেত্রে নিজ পত্নীর প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন তাকে অনেকে কবি বায়রনের আত্মজীবনীতে মগ্ন হওয়া বা তাঁকে অনুসরন করার ফলশ্রুতি মনে করেন।
কবির ব্যক্তি জীবনকে বাদ দিলেও সামাজিক ক্ষেত্রেও তাঁর যে অনেক পাগলামি ছিলো সে কথা না বললেও চলে। তবুও বলতে পারি এই ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের মধ্যেই যে ‘মাইকেল’ও কবির‘মহাকাব্যের’ রনক্ষেত্রের পটভূমি রচিত হয়েছিল তা এক কথায় স্বীকার করতেই হয়। এ-দূর্গ থেকে যে বাংলা সাহিত্যের অনেক বারুদ-ই বেরিয়েছে তা অনস্বীকার্য।
মাইকেলের সাহেবী পোশাকের ভেতরেই কিন্তু লুকিয়ে ছিল তাঁর বাঙালী মন, স্বদেশ প্রীতি, নিজ মাতৃভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উন্নতি সাধনের একান্ত গূঢ় সদিচ্ছা – এজন্যই তিনি মধুকবি। তাঁর কাব্যের মধুরতা ও মিষ্ঠতায় আজও বাংলা সাহিত্য মিষ্টি স্বাদে ভরপুর। যে কবির আয়ুষ্কাল পঞ্চাশও পেরোই নি আর বিস্ময়ের ব্যাপার যার রচনাকালের বয়স মাত্র ২৩ বছর প্রথম বই “The Captive Lady”। বাংলা সাহিত্য চর্চা মাত্র সাত বছরের কাছাকাছি। যদি জীবন আরো বেশি পেতেন তাহলে বাংলা সাহিত্যে আরো নতুন কি কি কান্ড ঘটতো তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। জীবনের অন্য সব কিছু বাদ দিলেও আমরা তাঁর কাব্যকে, কাব্যগুনকে, নতুন পথে চালিত হওয়ার দিক নির্দেশকে এই দুশো বছরেও ভুলতে পারিনি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *