গল্পঃ তৃণা আকাশ ছুঁতে চায় – ভূমিকা গোস্বামী

তৃণা আকাশ ছুঁতে চায় – ভূমিকা গোস্বামী


তোড়া স্কুলের গেটে ঢুকলেই পিছন ফিরে হাঁটা লাগায় তৃণা। ছ’ বছরের তোড়াকে ক্লাস ওয়ানে প্রাইভেট আধা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করেছে এবার।ওর অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলএই স্কুলে ভর্তি করার।স্বপ্ন দেখতো তোড়া ইউনিফরম পরে জুতো মোজা পরে রঙিন জলের বোতল রঙিন টিফিন বক্স নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। ঝরঝর করে ইংলিশে কথা বলছে।
বুবাই শুনে বলেছিল– এসব আমাদের জন্য নয় তৃণা। তুমি অসম লড়াই লড়ছো। চোখে হাজার বাতির আলো জ্বলে উঠতো ওর ।আত্মবিশ্বাসী সুরে বলেছিল – আমি অনেক পরিশ্রম করবো দেখো! ঠিক পারবো।ওর সব খরচ আমার। তুমি সংসারটা শুধু সামলাও ব্যাস।
ওকে এখন দিদার বাড়ি যেতে হবে। প্রায় কিলোমিটারখানেক পথ। জোড়ে পা চালালেও কুড়ি মিনিট তো ওর লাগবেই। যেতে যেতে সারে এগারোটা বেজে যাবে।দুটো বয়স্ক মানুষ বসে থাকে ওর পথ চেয়ে। ভাবলো- সাইকেল টা চালাতে জানলে পথের সময়টা বাঁচানো যেত। আজকাল রোজ ই ভাবে এ কথাটা। আসলে ওদের সময়ে তো স্কুল থেকে সাইকেল দিত না। তাহলে হয়তো ঠিকই ওর শেখা হতো। বাবা ছিল না, মা দিনরাত আয়ার কাজ করে সংসার চালাবে না সাইকেল কিনে দেবে! তখন ও বেশ ছিপছিপে ছিল। তাছাড়া জ্যাঠতুতো দাদারা ছিল । শেখাতে পারতো। এখন কেই বা শেখাবে ওকে। তাছাড়া শরীরটাও যা ভারি হয়ে গেছে ……
বুবাই সেই কাক ভোরে ট্রেন ধরে রানাঘাট যায়। কাঠের কাজ করে।অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ।তিনটের সময় উঠে তৃণা গরম গরম রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে দিয়ে দেয়। বিকেলে
ফেরার পথে বুবাই সবজি মাছ নিয়ে আসে।বাড়ি ফিরে স্নান করে খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।

সারাদিনে যখন প্রায় পাঁচ সাত কিলোমিটার হাঁটতে হয় না ওকে, এ গলি ও গলি করে। । তখন সাইকেল না চালাতে পারার শোকটা মাথার ভেতর কিলবিল করে।

বছর দুয়েক হল , দিদাকে আর দাদুকে রোজ তেল মালিশ করে দেয়। কিছুক্ষণ বসে গল্প করে। আসলে দুজন বৃদ্ধ মানুষকে ঘণ্টা দুয়েক সঙ্গ দেওয়া আর কি !
তোড়ার স্কুলছুটি হওয়ার মিনিট কুড়ি আগে ওখান থেকে বেরিয়ে আসে ও। মাধ্যমিক পাশ করার পরেই বিউটি পার্লারের কাজটা শিখতে গিয়েছিল। হাতে ধরে হয়তো কেউ ওকে কাজ শেখায় নি। দিদিদের হাতে হাতে ফাইফরমাইস খাটতে খাটতে , ক্রিম কাঁচি এগিয়ে দিতে দিতে কাজটা কখন যেন শিখে ফেলেছিল। ম্যাসাজ করাটাও শিখেছিল ভাল।
দিদার বাড়িতে ম্যাসাজ করা ছাড়াও ঘরের টুকটাক কাজও করে দেয়। বিনিময়ে মাস গেলে তিন হাজার টাকা।
সন্ধ্যের সময় তোড়াকে ঘুম থেকে তুলে টিচারের বাড়ি পড়তে দিয়ে প্রায় প্রতিদিন কোন না কোনখান থেকে কাজের ফোন আসেই। এটা করোনার সময় থেকে শুরু হয়েছে। এই এলাকায় সাত আট বছর রয়েছে ও। সবাই জানে ওর কাজের কথা। কিন্তু দু একজন ছাড়া তেমন কেউ ডাকতো না। করোনার সময় ঘরের মেয়ে বৌরা বেরতে পারতো না।পার্লারে যেত না । তাদের লোমশ হাত পা মুখ ও নিষ্প্রভ চুলের সৌন্দর্য রক্ষার ভার পড়লো তখন তৃণার।
আছ বৃহস্পতিবার। হাতে একটা পয়সা নেই । মাস পয়লা। তোড়ার টিউশন ফি দিতে হবে। দিদা দশ তারিখে টাকা দেয়। বললে হয়তো এ্যাডভান্স কিছু দিয়ে দিত, কিন্তু সকালেই বিশ্বাস বাড়ির দিদি ফোন করেছে।সন্ধ্যের সময় যেতে বলল।
গেটে কলিং বেল বাজাচ্ছে। কেউ খুলছে না। অনেকক্ষণ পর দিদির মেয়ে দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে বলল – আজকে বাড়িতে মিস্ত্রী কাজ করেছে । মা সারাদিন ওদের সাথে ছিল, খুব ক্লান্ত। এখন যাও।পরে তোমাকে ফোন করবে।
খুব রাগ হল। একটা ফোন করে দিলেই তো ও আজ আর বেরোতো না। কত ঝক্কি সামলে যে আসতে হয়েছে । ঘর গুছিয়ে জামাকাপড় তুলে, বুবাই কাজ থেকে ফিরেছে ওকে চা খাবার দিয়ে, মেয়েকে তৈরী করে পাশের বাড়িতে পড়তে পাঠিয়ে , সন্ধ্যে দিয়ে তবে বেরোন।
হঠাৎ মনে পড়লো, মুখার্জী কাকিমার সাতদিন আগে দু হাঁটুতে অপারেশন হয়েছে না ? এখন নিশ্চয়ই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন । ভাবলো এত কাণ্ড করে বেরিয়েছি যখন, একবার তাঁকে দেখেই যাই। কেমন আছেন উনি।
প্রথম এই কাকিমাই ওকে কাজ দিয়েছিলেন। তারপর প্রত্যেক সপ্তাহেই পেডিকিউর ম্যানিকিউর ফেসিয়াল করাতেন। ফুল বডি ম্যাসাজও করাতেন।
কি যে খুশি হয়েছেন না কাকিমা ওকে দেখে ! কত গল্প করলেন। মিষ্টি খাওয়ালেন। তারপর বললেন ― এসেছিস যখন ভুরুটা ঠিক করে দে। ফেসিয়ালটাও করে যা না হয়।
বাড়ির দরজায় এসে হাত ঘড়িতে সময় দেখল তৃণা, সারে আটটা। হাত ব্যাগের পকেটে চকচকে ছয়শ টাকা।মনে মনে বলল – এটা তোড়ার টিউশন ফি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *