নিবন্ধঃ অবলা আর সরলা — দুই আলোকবর্তিকা – মৌসুমী ঘোষ

অবলা আর সরলা — দুই আলোকবর্তিকা 

মৌসুমী ঘোষ

নামে কিবা আসে যায়। কানা ছেলের নাম তো হয় পদ্মলোচন। ঠিক যেমন, অবলা বসু আর সরলা রায় — দুই মহীয়সী উনিশশো শতাব্দীর প্রথমার্ধে শিক্ষার প্রসারে বিদ্যালয় স্থাপন করেন শুধু তাই নয়, দুই বোনই স্ব স্ব ক্ষেত্রে খ্যাত ছিলেন। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে প্রথম মেডিকেল শিক্ষার্থী অবলা, শিক্ষাবিদ দিদি সরলার সাহায্যে ১৯২০ সালে গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। দুই বোনেই ব্রাহ্মবালিকা শিক্ষালয়ে সম্পাদিকার ভূমিকা পালন করেন। এঁরা আইনজীবী ও ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারক দুর্গামোহন দাশের কন্যা ছিলেন। মা ব্রহ্মময়ী দেবী। তাদের ভ্রাতার নাম সতীশ রঞ্জন দাশ, যিনি ছিলেন বাংলার একজন অ্যাডভোকেট জেনারেল। এঁদের খুড়তুতো ভাই ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ।  

 অবলা বসুর স্বামী জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। সরলা বসুর স্বামী ছিলেন প্রেসিডেন্সী কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার রায়। তাই জগদীশ চন্দ্র বসু ‘নাইট’ উপাধি লাভ করার পর অবলা বসু ‘লেডি অবলা বসু’ হিসেবে খ্যাত হন, এবং সরলা রায় মহান সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ ‘মিসেস পি কে রায়’ হিসেবে খ্যাত হন। 

রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আদর্শে উদ্বুদ্ধ অবলা বসু নারী শিক্ষার প্রসার ও বিধবাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯১৯ সালে ‘নারী শিক্ষা সমিতি’ নামক একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠন মহিলাদের জন্য মুরলীধর মহাবিদ্যালয় ও বিভিন্ন গ্রামে প্রায় দুশোটি বিদ্যালয় স্থাপন করে। এই সমস্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯২৫ সালে বাণীভবন ট্রেনিং স্কুল, বিদ্যাসাগর বাণী ভবন, ১৯২৬ সালে মহিলা শিল্প ভবন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যেখানে বিধবাদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের শিক্ষিত করা হতো। এই সংস্থার মাধ্যমে অবলা বসু ৮৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৪টি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। এছাড়া এই সংগঠনের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং শিশু ও মাতার স্বাস্থ্যরক্ষা ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও করা হতো। সরলা রায় গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও, ঢাকায় থাকাকালীন একটি মহিলা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। কলকাতা শহরে সরলা অভিজাত পরিবারের মহিলাদের নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুপ্রেরণা যোগান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা রায়ের অনুরোধে ১৮৮৮ সালে নারী উন্নয়ণের কথা চিন্তা করে ‘মায়ার খেলা’ নামক নৃত্যনাট্য রচনা করেন এবং তাঁহাকেই উপহার স্বরূপ সমপর্ণ করেন। সখীসমিতির মহিলা শিল্পমেলায় অভিনীত হবার উপলক্ষে এটি প্রথম মুদ্রিত হয় ও বেথুন স্কুলে তৎকালীন সভ্রান্ত ঘরের নারীরা এই নাটক মঞ্চস্থ করেন।  

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর মৃত্যুর পর তার সঞ্চিত এক লক্ষ টাকা দিয়ে অবলা বসু ‘সিস্টার নিবেদিতা উইমেন্স এডুকেশন ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফান্ডের মাধ্যমে অ্যাডাল্টস প্রাইমারি এডুকেশান নামক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন। বেঙ্গল গর্ভমেন্টের সাম্মানিক বৃত্তি নিয়ে ১৮৮২ সালে অবলা ডাক্তারি পড়তে পাড়ি দিয়েছিলেন মাদ্রাজে। বস্তুতঃ অবলাই হলেন বাঙালি মেয়েদের মধ্যে প্রথম মেডিকেল শিক্ষার্থী। কিন্তু মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে সে সময় মেয়েদের পড়াশুনার জন্য কোনো হস্টেল ছিল না। তাই মিঃ জেন্সেন নামক এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে তিনি থাকতে শুরু করেন। দুঃখের বিষয়, যে স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি এতটা পথ পাড়ি দিয়েছিলেন তা পূরণ হয়না। দুই বছর পড়াশুনার পর শারীরিক অসুস্থতার জন্য ডাক্তারি পড়াশুনা শেষ না করেই অবলা কলকাতায় ফিরতে বাধ্য হয়। তবে দুবছরের একটি নির্দিষ্ট পাঠক্রম শেষ করার জন্য মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের তরফে তাঁকে একটি ‘সার্টিফিকেট অফ অনার’ দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে বিবিধ গুণের অধিকারিণী সরলা রায় ছিলেন মার্গারেট কুজিনস প্রতিষ্ঠিত ‘অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স’এর একজন নেতৃস্থানীয়া সদস্যা। সমাজকর্মী ও প্রথম মহিলা ঈশান স্কলার, চারুলতা মুখোপাধ্যায় তাঁর একমাত্র কন্যা ছিলেন। সিনেটের প্রথম ভারতীয় মহিলা সদস্য ছিলেন সরলা রায়, যাঁর নাতনি  রেনুকা রায় ছিলেন সমাজ কর্মী , রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা। 

জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বিশ্বের যে প্রান্তেই গিয়েছেন তার সফরসঙ্গী হিসেবে থেকেছেন অবলা বসু। ইংল্যান্ড, ইতালি, আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, এমন অনেক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দেশ ভ্রমণ করায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মহিলাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, ভ্রমণপিয়াসী অবলা বসু সেসব ভ্রমণের স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু প্রবন্ধ
ও হৃদয়গ্রাহী ভ্রমণকাহিনি। তৎকালীন নামী ইংরাজী পত্রিকা ‘মর্ডান রিভিউ’-এ নারীশিক্ষা – নারী স্বাধীনতা বিষয়ক তাঁর একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এসব প্রবন্ধে তাঁর চিন্তা চেতনা ও আদর্শের  স্ফুরণ ঘটতে দেখা যায়। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর রচনাগুলো, শকুন্তলা শাস্ত্রী প্রকাশিত বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও লেডি বসুর ‘প্রবন্ধাবলী’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ হয়। কর্মের ও কলমের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়। আর সেখানেই তিনি সম্পূর্ণা। ভ্রমণকে তিনি জীবনদর্শন করেছেন, কর্মে তাকে কাজে লাগিয়েছেন।

 ১৮৯৭-৯৮ সালে ‘মুকুল’ পত্রিকায় তিনটি কিস্তিতে প্রকাশ পায় তাঁর ইংল্যান্ড ভ্রমণের কাহিনি। ঊনবিংশ শতকে তাঁর ইতালি ভ্রমণ নিয়ে ‘আগ্নেয়গিরি দর্শন’, ‘লুপ্তনগরী’ এবং ‘ভেনিস’ এই লেখা তিনটি পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীতে তাঁর আমেরিকা নিয়ে লেখাটি সম্ভবত বাঙালি মেয়ের লেখা প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ কাহিনি। ১৯১৬ সালের প্রথমদিকে ‘মুকুল’ পত্রিকায় অবলার ‘জাপান ভ্রমণ’ কাহিনিটি প্রকাশিত হয়। অবলা বসু ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে জাপান যান। ঊনবিংশ শতকে বাঙালি মহিলারা যখন গল্প কবিতা উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন তখন কৃষ্ণ ভাবিনী- প্রসন্নময়ী- স্বর্ণকুমারী-অবলারা অন্যান্য লেখালেখির পাশাপাশি ভ্রমণকাহিনি লেখার জন্য কলম ধরেছিলেন। অর্থাৎ মেয়েদের ঘরের বাইরে পা রাখার কথা বলা শুরু হল সেটাতে নিঃশব্দে নারীর সামাজিক অবস্থান বদলেরও একটা সূচনা ঘটল বলাই যায়। 

তবে অবলা বসুর লেখা ভ্রমণ কাহিনি পড়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে তিনি ছোটোদের পত্রিকা ‘মুকুল’এ ছোটোদের কথা ভেবেই সহজ সরল ভাষায় লিখেছিলেন এগুলি। নারী শিক্ষা নারী স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর জোরালো মতামত থাকলেও ভ্রমণ কাহিনিতে তার ছাপ পড়েনি। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় সব ভ্রমণ লেখিকার রচনাতেই সমাজে নারীর অবস্থানের বিষয়টি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে। বাংলা ১৩০২ সালের অগ্রহায়ণ ও পৌষ সংখ্যায় ‘মুকুল’ এ তাঁর কাশ্মীর ভ্রমণ কাহিনির শুরুতে তিনি নিজেই লিখেছিলেন, ‘ইংল্যান্ড প্রভৃতি সুসভ্য দেশের বালক-বালিকাগণ বাল্যকাল হইতেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়িতে ভালোবাসে, তাহার সুফল এই হয় যে, বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া তাহারা নতুন দেশ আবিষ্কারের জন্য প্রাণ পর্যন্ত ত্যাগ করিতে প্রস্তুত হয়। …আমাদের এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত পাঠ করিয়া এতটা না হইলেও আশা করি তোমাদের মধ্যে অনেকের মনে নানাস্থান দেখিবার আগ্রহ জন্মিবে।’ এই যে ভ্রমণকে জীবনের বৃহত্তর অর্থে খুঁজে পাওয়া এটাই বোধহয় অবলা বসুর লেখার সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য। 

অবলা বসুর ভ্রমণ কাহিনিতে একটি আধুনিক বৈশিষ্ট্যও লক্ষ করা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জায়গাটির ভৌগোলিক অবস্থান ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন, কোথাও কোথাও দিয়েছেন যাওয়ার পথের নির্দেশ। ১৩৩২ সালে ‘প্রবাসী’তে তাঁর প্রথম ইউরোপ ভ্রমণের কথা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঙ্গালী মহিলার পৃথিবী ভ্রমণ’ লেখাটি। আমেরিকা হয়ে ১৯১৫ সালের এপ্রিলে জাপানে পৌঁছান অবলা ও জাপানি মহিলাদের দেখে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন। তাঁর মনে বাংলার মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের ভাবনাটি শুরু হয়েছিল। ‘নারী শিক্ষা সমিতি’ নামে একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমি যখন ১৯১৪ সালে জাপান ভ্রমণ করিতে যাই তখন সেখানে শিক্ষার বিস্তার দেখিয়া নিজের দেশের অজ্ঞতা স্মরণ করিয়া অত্যন্ত দুঃখ হয়। তখনই আমার মনে নারী শিক্ষা সমিতি স্থাপন করিবার কল্পনা উদয় হয়।’ লেখাগুলি পড়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় একথা ভেবে যে, একশো বছর আগে একজন মহিলা কিভাবে নিজের জীবন ও যাপনকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বৃহত্তর উদ্দেশ্যে।

বিদেশের কথা লিখতে গিয়ে প্রকৃতির বর্ণনার পাশাপাশি বারবার করে ছোটদের কথাই লিখেছেন অবলা বসু। জাপানেতো তখন ষোলো বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের কোন শাসন করাই হতোনা। তাই বলে ভেবনা যে তারা যা ইচ্ছে করত। বিদেশের লেখার মধ্যে সেরা কাহিনি ইতালির ‘লুপ্তনগরী’। ইতালির পম্পেয়াই শহরটি ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতে লুপ্ত হয়ে যায়। তিনি লেখেন, “একটি গৃহ ক্রমে ক্রমে ভষ্মে ঢাকিয়া যাইতেছিল। সেই গৃহে একটি নারী দুহাতে তার শিশুটিকে উচ্চে ধরিয়া রহিয়াছিল। ভগ্নস্তুপ ক্রমে ক্রমে উন্নত হইয়া দুঃখিনী মাতাকে নিমজ্জিত করিতেছিল। কিন্তু সেই অগ্নির প্রসার হইতে শিশুকে রক্ষা করিতে হইবে। জ্বলন্ত ভগ্নস্তুপ তিল তিল করিয়া দগ্ধ করিয়াও জননীকে একেবারে অবসন্ন করিতে পারে নাই; কি যেন এক মহাশক্তি, দুঃসহ যন্ত্রণা দমন করিয়া রাখিয়াছিল! মাতার হস্ত দুইটি মৃত্যু যন্ত্রণাতেও অবশ হইয়া পড়ে নাই। দুই সহস্র বৎসর পরে সেই উর্দ্ধোত্থিত করপুটে সন্তানটি পাওয়া গিয়েছে। সেই মাতার স্নেহ স্পর্শে যেন অতীত বর্তমানের সহিত মিলিয়া গেল। একই দুঃখে। একই স্নেহে, একই মমতায় সেকাল ও একাল, পূর্ব্ব ও পশ্চিম যেন বান্ধা পড়িল! তখন পম্পেইর মৃত রাজ্য সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল এবং রাজপথ আমার চক্ষে অকস্মাৎ লোকজন পূর্ণ হইল।” অবলা বসুর সন্তান জন্মের সময়েই মারা যায়। পরবর্তী জীবনে আর কোন সন্তান না হলেও অবলা বসুর মাতৃহৃদয়ের মমতা ছড়িয়ে গেছিল সব শিশুর জন্যই। এই লেখাটির শেষে যেন তারই পরিচয় মেলে। 

১৯৫১ সালের ২৬ শে এপ্রিল ৮৭ বছর বয়সে এই মহীয়সী নারী প্রয়াত হন। তিনি বলতেন, মেয়েরা শেষ পর্যন্ত কী করবে আর কী করবে না, সেটা আলাদা বিষয়, “কিন্তু ক্ষমতা থাকা দরকার, না হলে পুরুষরা মেয়েদের সম্মান করবে কী করে?” এমন ভাবেই নারীদের সবলা হবার অনুপ্রেরণা দিতেন অবলা বসু।      

———————–

2 thoughts on “নিবন্ধঃ অবলা আর সরলা — দুই আলোকবর্তিকা – মৌসুমী ঘোষ

  1. অনেক কিছু জানতে পারা গেল।ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *