ইলিশের ঘরকন্না
ব্রতীন দাস
সেই যে হুমায়ুন আহমেদ লিখলেন, মাত্র দু’টি বঙ্কিম রেখার টানে যামিনী রায়ের আঁকা ইলিশের ফিগার দেখে মনে হয়, গঙ্গা-রূপনারায়ণে ঘুরতে আসা ইলিশের দল তাদের ফিগার মেইনটেন করে। সরু মাথা। তাতে ধরা পড়ার সময় ব্যথা পেয়ে একবিন্দু রক্তের দাগ। মৃত্যুর ঠিক আগে তাকিয়ে থাকা দু’টি চোখ বিশেষ কোনও দিকে তাকিয়ে নেই। অথচ, আমি তাকালে মনে হবে, আমার দিকেই তাকিয়ে। অনেকটা যেন ছবির মানুষের চোখ। যেখান থেকে দেখি মনে হয়, আমার দিকেই তাকাচ্ছে। বুক বলতে মাঝখানটিই চওড়া। আবার লেজ মাথার মতোই সরু। একেবারে সই সই।
ঘড়ির কাঁটায় চোখ রেখে কেউ নদীর পাড়ে ওত পেতে বসে। কেউ আবার মৎস্যজীবীদের ট্রলার, বোটে চেপে ভেসে বেড়াচ্ছেন মোহনায় কিংবা গঙ্গার মাঝদরিয়ায়। দিন পেরিয়ে রাত। ভোর হচ্ছে রাত ফুরিয়ে। কখনও ‘তাদের’ দেখা মিলছে। কখনও আবার মিলছে না। তবে, হাল ছাড়তে নারাজ ওঁরা।
ওঁরা মানে একদল বিজ্ঞানী। অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটাচ্ছেন তাঁরা। এই দলেই রয়েছেন পুরুলিয়ার সিধো-কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক অসীম নাথ।
আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমা। কাকদ্বীপ ঘাটে অপেক্ষা করছেন অসীমবাবু। সঙ্গে রিঙ্কু পতি, ভুবন মাজি, লাবণ্য সরকার, অরিন্দম মণ্ডলরা। এঁরা সবাই রিসার্চ স্কলার। ওঁদেরই আর একটি দল অপেক্ষা করছে গোদাখালিতে।
হলদি নদীতে জোয়ার শেষে শুরু হবে ভাটা। এই মুহূর্তে জল একেবারে শান্ত। এবার একে একে রওনা দেবে বোট। অসীমবাবুদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে একটি বোটে। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন মৎস্যজীবীরা।
প্রণাম করে বোটে উঠলেন সবাই। ইলিশ যে ওদের কাছে ‘মা’।
দিন বদলেছে। আজকের ‘কুবের’দের নেংটিতে গোঁজা মোবাইল। ফোনে মাছ ঢোকার খবর আসছে। সেইমতো বদলে যাচ্ছে বোটের অভিমুখ। জলে পড়ছে জাল।
যেখান থেকে বোটে উঠেছেন অসীমবাবুরা, তারই একপাশে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে চালান লিখছিলেন আড়তদার। জেলেপাড়ায় তাদের পরিচয় ‘কাঁটাবাবু’।
বোটের ইলিশ ঢেউ ভেঙে পাড়ে আসতে না আসতেই কুবেরদের কাছে মোবাইলে নির্দেশ পৌঁছে যায় আড়তদারের। সবটা চাই কিন্তু। অন্য কাঁটায় যেন মাছ না যায়। দাদনের কথাটা মনে আছে তো! কতদিন শোধ দিস না!
অসীমবাবুদের অবশ্য এসবে খুব একটা মাথাব্যথা নেই।
ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর…। ওঁরাও খুঁজছেন। মা-ইলিশ। তাকে দেখতে কেমন? বয়সে পরিণত। চেহারাটা একটু থলথলে। পেটের কাছে আঙুলের চাপ দিলেই বেরিয়ে আসবে ডিম। পুরুষ ইলিশও দরকার ওঁদের! সে আবার কী! পুরুষ ইলিশ! অসীমবাবু বলছেন, হয়। আমাদের অবশ্য যেমন তেমন পুরুষে কাজ চলে না। তার বাবা হতে হওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। অর্থাৎ তাকে হতে হবে প্রজননক্ষম। সেই আশাতেই তো হা-পিত্যেস করে বসে থাকা। আমরা যেটা করার চেষ্টা করছি, তার পোশাকি নাম স্ট্রিপিং। ইলিশের প্রণোদিত প্রজনন। এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি।
বোট ছেড়ে দিয়েছে। গল্প শুরু করলেন অসীমবাবু। সে অনেক ভাগ্যের ব্যাপার, বুঝলেন। চাইলেই কি আর তাদের দেখা মেলে? ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন হতে হবে। তাহলেই তারা ধরা দেবে একসঙ্গে।
কেমন ভাগ্য দরকার?
অসীমবাবুর ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি। বলেন, কখনও ডিম পাড়ার মুহূর্তে মা-ইলিশ জালে ফাঁসে। কিন্তু গঙ্গা তোলপাড় করেও দেখা মেলে না পুরুষটির। আবার কখনও পুরুষ-ইলিশ জালে পড়লেও নাগালে আসে না মেয়েটি। জলের টান কমে। পাড়ে ফিরতে হয় আমাদের। পুরুষ-মহিলার যুগলবন্দি ছাড়া তো ডিম নিষিক্তকরণ সম্ভব নয়। তবে একবার সুযোগ এলেই কেল্লাফতে। এগিয়ে যায় অনেকটা কাজ। নিষিক্ত ডিম দ্রুত নিয়ে আসা হয় ল্যাবরেটরিতে। সেখানেই জন্ম নেয় ইলিশের বাচ্চা। চারদিন পর মুখ খোলে। কিছু বাঁচে। মারাও যায় অনেক।
ইলিশের ল্যাব! তখনও যেন ঘোর কাটছে না।
একটা সিগারেট ধরিয়ে বোটের প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেলেন অসীমবাবু। কিছু সঙ্কেত মিলছে?
লাবণ্য হেসে বলেন, এখনও অনেক পথ বাকি। আর কাজটা মোটেই মসৃণ নয়। পুরোটাই অনিশ্চয়তায় ভরা। ফি মরশুমে কম-বেশি ইলিশ ধরা পড়ে বটে। তবে আমাদের কাজের জন্য সবাই উপযুক্ত নয়। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ।
কিন্তু ল্যাবে ইলিশের বাচ্চা ফুটিয়ে তারপর?
ভুবন বললেন, আপনার বাড়ির পুকুরে বেড়ে উঠবে ওরা।
মানে? আবারও বিস্ময়ের ঘোর।
লাবণ্য বলেন, মানে পুকুরে ইলিশ-চাষ।
এটাও কি সম্ভব?
হ্যাঁ, তো। আমরা হাতেনাতে করে দেখিয়েছি।
বোট প্রায় ১০ কিমি চলে এসেছে। নদীটা এখন আরও চওড়া লাগছে। অসীমবাবুর নির্দেশমতো ইলিশের ঘরকন্নার প্রতিটি বাঁক আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁর স্কলাররা।
রিঙ্কু বললেন, আমরা এখন নিশিন্দাপুরের কাছে। সামনেই লট নম্বর এক। এটাই বঙ্গোপসাগরের মুখ। অর্থাৎ ইলিশ ঢোকার পথ।
কথাটা শুনেই শরীরের ভিতর কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। চোখেমুখে তৃপ্তির ছাপ। তাহলে আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো এক অসাধারণ দৃশ্যের সাক্ষী হতে পারব।
লাবণ্য নোটবুকে কিছু একটা চটপট লিখে নেন। তারপর যোগ দেন আমাদের আলোচনায়। বলেন, ইলিশেরেরর বাচ্চারা লবণ সহ্য করতে পারে না। তাই মা-ইলিশ ডিম ছাড়তে আসে মিষ্টি জলে। সঙ্গে থাকে বাবা। তাদের শুক্ররস মা-ইলিশের ডিম নিষিক্ত করে বাচ্চার জন্ম দেয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু, বর্ষা বঙ্গোপসাগরের ইলিশকে মায়ানমার, বাংলাদেশ হয়ে আমাদের দেশের দিকে টেনে আনে। আসলে কী জানেন, বঙ্গোপসাগরের চওড়া মহাদেশীয় তাক, যাকে আমরা কন্টিনেন্টাল বলি, মৌসুমি বায়ু, মাঝারি থেকে বেশি বৃষ্টি ও জলপ্রবাহ, জলের উপরিতলের তাপমাত্রা ২০-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, জলের উপরিতলের কারেন্ট, বর্ষায় উপকূলের জলে কম লবণের প্রভাব, এসবের উপরেই নির্ভর করে ইলিশ পাওয়া যাবে কি না। গেলেও তার পরিমাণ কী হবে।
লাবণ্যের কথাটা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই মেয়েটা ইলিশের ঘরকন্নার সঙ্গেই বাস করে। না হলে, বাড়ি-ঘর ছেড়ে এভাবে দিনের পর দিন গঙ্গার মাঝদরিয়ায় ভেসে বেড়াতে পারে? শুধুই কি কেরিয়ার! না, নেশা না থাকলে একাজ সম্ভব নয়।
লাবণ্যই বুঝিয়ে দিলেন আসলে সমস্যাটা কোথায়? বললেন, বর্ষায় গঙ্গার উপরের ঠান্ডা জল মোহনায় গিয়ে জলে নোনাভাব কমায়। সঙ্গে নিয়ে যায় জৈববস্তু যুক্ত পলি, যা প্ল্যাংটনের জন্ম দেয়। আর এই প্ল্যাংটনই হল ইলিশের খাবার। ১৯৭৫ সালে ফরাক্কা ব্যারেজ তৈরির পর গঙ্গায় উপর থেকে নীচের দিকে মিষ্টিজল আসার পরিমাণ কমতে শুরু করে। তখন থেকেই শুরু হয় ইলিশের ঘাটতি। গঙ্গায় প্রবাহ না থাকলে জলের উপরিতলের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। মাছ আসবে না। তাছাড়া বৃষ্টির ঘাটতিও অন্যতম একটি কারণ। বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলে সাগর ও নদীর সংযোগস্থলে নোনাভাব কমে, যা সমুদ্র থেকে ইলিশকে নদীতে আকর্ষণ করে। নদীর মিষ্টিজল ঢুকে ইলিশের গোনাডাল হাইড্রেশন হয়। এছাড়া ফেব্রুয়ারি-মার্চেও এদের মাইগ্রেশন দেখা যায়। ডিম ফোটার পর ৭০ থেকে ১১০ মিমি বা ওজনে প্রায় ৬০ গ্রাম হলেই ইলিশ নীচের অর্থাৎ উপকূলের দিকে নেমে যায়। তখন ওদের শরীরে লবণ দরকার। জানলে অবাক হবেন, একটা পরিণত মা-ইলিশ নদীতে প্রায় ১০-১২ লাখ ডিম পাড়ে। এর যদি ২০ শতাংশ আমরা বাঁচাতে পারি, তাহলে ইলিশের জন্য আমাদের আর হাহাকার করতে হবে না।
ভুবন বললেন, আপনারা কলকাতা শহরকে দেখেছেন? আর শুধু কলকাতা কেন, শহরতলিগুলোও কম যায় কীসে! লাগাতার গঙ্গায় নোংরা জল পড়ছে। নদীর সঙ্গে খালের লকগেট। চাষের সুবিধার জন্য করা হয়েছে এসব। কিন্তু লকগেট কিছুদিন বন্ধ থাকলেই বর্জ্যে ভরে যাচ্ছে। আর লকগেট খুলে দিলেই নোংরা জল হু হু করে পড়ছে গঙ্গায়। ওই জলের সঙ্গে গঙ্গায় মিশছে ভারী ধাতব বস্তু। কমছে জলের জৈবিক অক্সিজেনের মাত্রা। নষ্ট হচ্ছে মাছের চারা। আমার গবেষণার বিষয় এটাই। তাই আপনাকে বলতে পারলাম। আমি অবশ্য লাবণ্যের মতো জিনিয়াস নই। তাই ও আমায় পাত্তা দেয় না।
মজার ছলে কথাটা বলেই হাসলেন ভুবন। লাবণ্য বললেন, তুই পারিসও বটে। সবসময় লেগপুল করতে ভালো লাগে!
আমরা যখন ইলিশের গল্পে মশগুল, ততক্ষণে বোট এগিয়ে গিয়েছে আরও খানিকটা। চোখে পড়ল, দূরে ওত পেতে রয়েছে শিকারীরা। ফেলা হয়েছে বিশাল বিশাল জাল। কোনও কোনও জাল দু’কিমি লম্বা। চারদিকে যতদূর চোখ যায়, ভাসছে ট্রলার, বোট। কোনও বোট দুই সিলিন্ডারের। কোনওটি আবার চার সিলিন্ডারের। রয়েছে বিদেশি ট্রলারও।
লাবণ্য বললেন, ওদিকটাই সাত কিমি দূরে ট্যাংরার চর। আরও একটু নীচে অর্থাৎ ডায়মণ্ডহারবারের দিকে গেলে গোদাখালি। ওখানে অনিন্দিতা, রূপকরা রয়েছে। ওখানেও কি আপনি যাবেন?
অসীমবাবু যা বলবেন!
ও আচ্ছা।
অসীমবাবু আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন, এই যে জাল দেখছেন, এর মধ্যে অনেক পকেট জাল রয়েছে। মানে, হয়তো এক কিমি লম্বা একটা জাল। তার ভিতরে দশটা পকেট। দেড়-দুই লাখ টাকা খরচ করে এসব জাল বানিয়ে নিয়েছে মৎস্যজীবীরা। ওদের কাছে রয়েছে বিন-জাল, যার হাঁ-মুখ। পিছনেরর দিকটা চোঙার মতো। এই জালের ফাঁস খুব সরু হয়। ফলে ইলিশের বাচ্চারা একবার ঢুকলে আর বেরতে পারে না।
অসীমবাবু ঘাড় শক্ত করে বললেন, এর বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই। পকেট জালে ইলিশের বাচ্চা ধরার বিরুদ্ধে আমরা সচেতন করি মৎস্যজীবীদের। ওই যতটা পারি আর কী। খাতায়-কলমে অনেক নিয়ম রয়েছে, ৯০ মিমি-র কম ফাঁসের জাল, ২৩ সেমি-র কম দৈর্ঘ্যের ইলিশ ধরা যাবে না। কিন্তু মানা হচ্ছে কোথায়। আমরা তো বলেছিলাম, নদীর পাড়ে পুলিশ পাহারা বসান। জালের ফাঁস ১১০ মিমি করুন। ছোট ইলিশ ধরলেই শাস্তির জন্য চালু করুন মোবাইল কোর্ট। কিছুই তো হল না। সেই তো ছোট ইলিশ ধরার জন্য মনোফিলামেন্ট গিলনেট ব্যবহার চলছে দেদার। আমরা একটা কথা কিছুতেই পারছি না, ইলিশের জন্য অভয়াশ্রম দরকার।
অসীমবাবুর গলায় আক্ষেপের সুর। বললেন, জানেন, ওরা ইলিশকে বাঁচতে দিচ্ছে না। হাঁপিয়ে যাচ্ছে মাছগুলো। আগে কতদূর চলে যেত। এখন গঙ্গায় ডিম পাড়তে ঢুকে ২০ কিমিও সাঁতরাতে পারছে না। ফেরার পথ ধরছে। কিন্তু পালাবে কোথায়! দেখছেন তো, মোহনায় কীভাবে জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ইলিশের বাড়ি ফেরার পথ বন্ধ! পদে পদে বাচ্চা সমেত ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। বাধ্য হয়ে সমুদ্রে না ফিরে গঙ্গার মিষ্টি জলেই ছানা-পোনা নিয়ে সংসার পাতছে বহু ইলিশ। টিকে থাকার লড়াই বলে কথা! শুধু গঙ্গা নয়, ওপারের পদ্মা, মেঘনাতেও সারাবছর বিভিন্ন জায়গায় ইলিশের কলোনি রয়েছে। সারা বছর সেখানে ইলিশ মেলে। এরা রেসিডেন্সিয়াল। ভারত-বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্যোগে এইসব আবাসিক ইলিশ নিয়ে গবেষণা চলছে।
আপনি কখনও চাঁদপুরে গিয়েছেন?
মাথা নেড়ে বললাম, না।
অসীমবাবু বললেন, পারলে যাবেন। জায়গাটা বরিশালের কাছে। ওটা ইলিশের বাড়ি।
প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপকের মুখে এক একটা বিশেষণ শুনতে লাগলাম মুগ্ধ হয়ে।
অসীমবাবু বললেন, আপনার লেখার জন্য তো কিছু তথ্য দরকার? তা হলে শুনুন। সারাবছর কম-বেশি ১৪ হাজার ট্রলার জাল নিয়ে ইলিশের খোঁজে মোহনা চষে বেড়ায়। মরশুমে এক-একটি ট্রলারে গড়ে এক থেকে দেড় টন ইলিশ ধরা পড়ে। শিকারীদের জাল ফাঁকি দিয়ে কিছু ইলিশ গঙ্গার মিষ্টি জলে ঢুকে ডিম পাড়ার কাজটা সারতে পারলেও বাচ্চা নিয়ে ফেরার সময় বিপদের মুখে পড়তে হয় তাদের। আর সেই ভয় থেকেই হুগলির শ্রীরামপুর, বলাগড়, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মণ্ডহারবার, রায়চক, উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটি, বারাকপুর সহ গঙ্গার বিভিন্ন পয়েন্টে ইলিশ সংসার পেতেছে। ওখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে ওরা। সমুদ্রের প্রতি ওদের আর কোনও টান নেই। ঠিকানা ভুলেছে। বদলে ফেলেছে ওদের আচরণও।
নোটস নেওয়া থামিয়ে প্রশ্ন করি, কেমন?
অসীমবাবু বলেন, সময়ের আগেই ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ হয়ে যাচ্ছে ইলিশ!
লাবণ্য বললেন, স্যর, ইদানীং কিন্তু গঙ্গায় রেসিডেন্সিয়াল ইলিশের সংখ্যাটা অনেক কমে গিয়েছে।
আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে অসীমবাবু বললেন, হ্যাঁ, এতটা পথ আসতে পারছে না ওরা। কিন্তু এই তো ক’বছর আগেও ডিম পাড়তে ফরাক্কা চলে যেত ইলিশ। আর ফরাক্কায় যখন ব্যারেজ ছিল না, তখন তো পেটে ডিম নিয়ে এলাহাবাদ ঘুরতে যেত ইলিশের দল! গঙ্গা-পদ্মার ইলিশ যেত কাশী দর্শনে! ইলিশ যত উপরের দিকে উঠবে, অর্থাৎ সমুদ্র থেকে নদীতে পথ পেরবে, ততই তাদের শরীরে ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি হবে। স্বাদও বাড়বে। সমুদ্র থেকে ওরা মূলত ফ্যাট গলাতে আসে। এতেই এনার্জি পায় ওরা। বাংলাদেশে প্রথমে বঙ্গোপসাগর থেকে মেঘনা হয়ে তারপর পদ্মায় ঢোকে ইলিশ। অনেকটা পথ পেরয়। সেকারণেই ওপার বাংলার ইলিশের স্বাদ বেশি। আমাদের এখানে তো ঢোকার মুখেই ফাঁদ পাতা। লাবণ্য লাইনটা যেন কী…স্যর, প্রেমের ফাঁদ পাতা এ ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে…। হ্যাঁ, প্রেমেরই ফাঁদ বটে! ধরা পড়তেই হবে।
বছরের দু’টো সময় বোটে ভাসেন অসীমবাবু। একটা জুন থেকে সেপ্টেম্বর। অন্যটা এপ্রিল, মে, নভেম্বর। প্রথমটা ইলিশের ডিম ছাড়ার সময়। আর দ্বিতীয়টা চারা পাওয়ার সময়।
অসীমবাবু আচমকা প্রশ্ন করেন, আচ্ছা, বলুন তো, হ্যামিলটন সাহেব কি ইলিশ খেতে পছন্দ করতেন খুব?
এই রে, তা তো জানি না। আমার সরল উত্তর শুনে হাসলেন ইলিশ-গবেষক। তারপর বললেন, আমিও জানি না। তবে আমার মনে হয়, ইলিশ তাঁর প্রিয় ছিল। আর না হওয়ারই বা কী হয়েছে? ১৮২২ সালে হ্যামিলটন সাহেবই তো গঙ্গায় ২৭২টি প্রজাতির মাছের সন্ধান দিয়েছিলেন। আর তাতে ইলিশও ছিল। সেসময়ে হুগলি-ভাগীরথী নদীতে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত, তাতে খেলে ফেলেও উপচে পড়ত। আর আজ দেখুন, কী অবস্থা।
মনে পড়ল পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ভরা বর্ষায় নদী তার আঁচলে বিছিয়ে রাখত রূপোলি শস্য। পাইকারি আড়তে ইলিশের দর কম থাকলে কুবের-ধনঞ্জয়রা বলতেন, আজ হালার মাছ ধইরা জুত নাই। অর্থাৎ জেলেদের মর্জিমাফিক ইলিশ উঠত জালে। ইলিশে ইলিশে তখন গঙ্গা-পদ্মা একাকার। তাই তো লেখা হল, ইলিশের মরশুম ফুরাইলে বিপুলা পদ্মা কৃপণ হইয়া যায়। নিজের বিরাট বিস্তৃতির মাঝে কোনখানে সে যে তার মীনসন্তানগুলিকে লুকাইয়া ফেলে, খুঁজিয়া বাহির করা কঠিন হইয়া দাঁড়ায়।
কিন্তু সেটা তো ১৯৩৪ সাল। তারপর গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে বয়ে গিয়েছে বহু জল। বে-মরশুম তো দূরঅস্ত, এখন ভরা বর্ষাতেও ইলিশের দেখা মিলছে কই? বাগবাজার, ইছাপুরের ঘাটে বসে ইলিশ ধরা টিকে রয়েছে গল্পেই।
শুধু ফরাক্কা ব্যারেজ নয়, চাষের সুবিধার্থে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দামোদর নদকে আটকে তৈরি করা হয়েছে মাইথন, পাঞ্চেত বাঁধ। এর জেরে পলি পড়ে অগভীর হয়েছে নদীখাত। বন্ধ হয়ে গিয়েছে স্রোত।
৩০ বছর ধরে ইলিশ নিয়ে গবেষণা করছেন অসীমবাবু। ইলিশই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় তাঁর নখদর্পণে। বললেন, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হতে পারে, কিন্তু ইলিশের উৎপত্তি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে। অথচ, সেখানে ইলিশ পাওয়া যায় মাত্র ০.১ শতাংশ। এর থেকে কুয়েতে বেশি পাওয়া যায় ০.৩ শতাংশ। ইরানে পাওয়া যায় ১.১ শতাংশ, ইরাকে ০.২ শতাংশ, মায়ানমার ৪ শতাংশ, ভারত ৮ শতাংশ এবং বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ৮৬.৭ শতাংশ। সিন্ধুপ্রদেশের দেবতা ঝুলেলালের বাহন ইলিশ।
ইলিশের মরশুম দু’টো। কিন্তু দুই মরশুমে একই ঝাঁক আসে না। নিজেদের মধ্যে পালা করে নেয়। একেবারে দিনক্ষণ দেখে ওরা আসে। ভরা পূর্ণিমা ও অমাবস্যার আগে-পরে দু’টো দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই দু’দিনই জালে ইলিশ পড়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি থাকে। রাত-দিন বলে কোনও কথা নেই। এটা পুরোপুরি নির্ভর করে জলের টানের উপর। আড়াইশো গ্রামের বেশি ওজনের স্ত্রী ইলিশের পেটে ডিম আসে। মাছের ওজন যখন ৮০০ গ্রাম হয়, তখনই ওরা ডিম ছাড়ে।
ওরা তো জলের রানি! চাইলেই দেখা মেলে না। তিনি আসেন তার মতো করে। তার সময়ে। সেজেগুজে। মৎস্যকুলে তিনিই একমাত্র, যাকে প্রলুব্ধ করা যায় না। ধরুন, সবে জোয়ারের জল নামতে শুরু করেছে সরসর করে। অমনি শুরু হবে ওদের দৌড়। একেবারে সরলরেখায়। অন্য মাছেদের মতো এঁকেবেঁকে জলকেলি করতে করতে চলা এদের ধাতে নেই। এরা অনমনীয়। টানটান। সোজাসুজি সাঁতরায়। তিরবেগে। কথায় আছে না, ঝড়ের চেয়েও বেগবতী, ডিমভরা ইলিশের গতি! একবগ্গা ওই দৌড়ই ইলিশের কাল হয়। জালের প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে মুণ্ডু আটকে পড়ে।
আমাদের কথা শুনতে শুনতে তীক্ষ্ণ চোখে টলটলে গঙ্গার জল মাপতে মাপতে আধো আঁধারে মনসুর মিয়াঁ বললেন, আর কোনও মাছের জন্য এত কসরত করতে হয় না। ইলিশই একমাত্র মাছ, যার নোলা নেই। আর নেই বলেই তার জন্য চারের টোপ দরকার পড়ে না।
সত্যিই বড় বিচিত্র!
তাইতো বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে/ জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি রাশি ইলিশের শব/ নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
আর হুমায়ুন আহমেদের সেই উপলব্ধি, সে কি ভোলার!
এই যে বলা হয় কোলাঘাটের ইলিশ। পলতার ইলিশ। ডায়মণ্ডহারবারের ইলিশ। কথাটা ঠিক নয়। জলের রাজাধিরাজ ইলিশের কোনও ঠিকানা নেই। সে ডিম ছাড়তে গঙ্গায় ঢোকে। ঢোকে রূপনারায়ণে। ওপারের পদ্মায়। মেঘনায়। যেখানে ধরা পড়ে—সেখানকার নাম তার চিরস্থায়ী বন্দিদশার কপালে জুড়ে যায়। রূপনারায়ণে ধরা পড়লেও সে কোলাঘাটের। গঙ্গার বিভিন্ন জায়গায় সে ধরা পড়ে। আর সেই জায়গার নাম পেয়ে যায়। আসলে সে মোহনা দিয়ে নদীতে ঢোকে। ঢুকে ডিম ছাড়ার জায়গা খোঁজে।
ইলিশ নিয়ে বাঙালির এই যে বিহ্বলতা কত কালের, কে জানে। এত কাব্যি আর কোনও মাছ নিয়ে হয়েছে কি না, সেটাও সন্দেহ। এত আকচা-আকছি। ইলিশের বংশ ও কুলরক্ষায় এমন প্রাণান্ত প্রচেষ্টাও পৃথিবীর কোনও প্রান্তে অন্তত কোনও মাছের জন্য হয়তো হয় না। টুনা মাছ নিয়ে জাপানের যতটা গর্ব, ঠিক ততটাই দুশ্চিন্তাও। কিন্তু তা ইলিশ নিয়ে বাঙালির আবেগের কাছে ম্লান। দেখেশুনে মনে হয়, ইলিশের থাকা আর না-থাকার উপরই যেন টিকে রয়েছে বাঙালির বাঙালিয়ানার অস্তিত্ব!
বাঙালির সাধ ও স্বাদের ইলিশকে কীভাবে বাঁচানো যায়, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা হয়েছে। সেই গবেষণা বলছে, ডিম ফুটে ইলিশের বাচ্চা হওয়ার পরই সে সমুদ্রে পাড়ি দেয় না। প্রথম দু’বছর থাকে হুগলি নদীতে। তারপর আরও একবছর কাটায় উপকূলে। অবশেষে তার গন্তব্য হয় বঙ্গোপসাগর। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে এনভায়রন বায়োল ফিশ পত্রিকায়। সমীক্ষক দলে রয়েছেন প্রসেনজিৎ ঘোষ, বীরেন্দ্র সিং রাজাওয়াত, আফাক নাজির, যোগরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসীম নাথ এবং তামিজহরসান শক্তিভেল। তাঁদের মধ্যে প্রসেনজিৎ, বীরেন্দ্র, আফাক ও তামিজ বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে কর্মরত। যোগরাজ কাজ করেন তাইওয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, তাইপেই-এ। ২০১৮ সালে গবেষণা শুরু করেন তাঁরা। দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডায়মণ্ডহারবারকে তাঁরা বিভাজক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যার একদিকে রয়েছে হলদিয়া-কাঁথি, অন্যদিকে উলুবেড়িয়া, কলকতা, হাওড়া, বারাকপুর, শেওড়াফুলি, বলাগড়, ব্যাণ্ডেল। এগুলিই ইলিশের মিঠে জলে নিবাসস্থল নামে চিহ্নিত। এসব জায়গাতেই ওরা ডিম পাড়তে ভালোবাসে। গবেষকরা, ওটোলিথ নামে ইলিশের কর্ণগহ্বরের একটি অংশ পরীক্ষা করে মাছের বয়স, অভ্যাস এবং তারা কতদিন কোন জলে কাটায়, তা জানতে পেরেছেন। এজন্য ওটোলিথের আইসোটপিক পরীক্ষা হয়েছে বেঙ্গালুরুর গবেষণাগারে। পরীক্ষার জন্য গঙ্গার এগারোটি জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল বিভিন্ন মাপের ৩০টি ইলিশ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ৪০০-৫০০ গ্রাম বা তার চেয়ে বড় মাপের ইলিশ অক্টোবর এবং ফেব্রুয়ারিতে ডিম ছাড়ে। তারপর ডিম ফুটে বড় হওয়া পর্যন্ত তারা প্রায় দু’বছর মিঠে জলে কাটায়। অবশেষে তারা উজানের দিকে পা বাড়ায়।
সৈয়দ মুজতবা আলি বলেছিলেন, বেহেস্তে ইলিশ পাওয়া যায় না, তাই তিনি বেহেস্তে যাবেন না।
মনে পড়ল, সুনীল গাঙ্গুলী লিখেছিলেন মুজতবা আলির বলা সেই গল্পের কথা। সম্রাট মহম্মদ বিন তুঘলক। ইতিহাসে যাঁকে ‘পাগলা রাজা’ও বলা হয়। সেই তুঘলক গিয়েছেন গুজরাতে, বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য। জলে নৌকা নিয়ে তাদের তাড়া করছেন। এরই মধ্যে এক বিকেলে হঠাৎ একটা মাছ লাফিয়ে পড়ল তাঁর নৌকায়। ঝকঝকে তার রং। গড়নটিও চমৎকার। মাছটি দেখে খুবই কৌতুহলী হলেন সম্রাট। বললেন, এটা কী মাছ! এখনই কেটে এটাকে রান্না করে দাও। শুনে আঁতকে উঠলেন পারিষদরা। সম্রাট, এই মাছ আমরা তো চিনি না! যদি খারাপ কিছু হয়। তাছাড়া এখন রোজার মাস চলছে। এবার ধমক দিলেন তুঘলক। যা বলছি, তাই করো। অগত্যা ঝকঝকে সেই মাছ কেটে রান্না হল। পরিবেশন করা হল সম্রাটকে। আয়েশ করে খেলেন তুঘলক। সম্ভবত, সবটাই চেটেপুটে খেলেন। আর অনেকটা মাছ খেয়ে তাঁর পেট ছেড়ে দিল। সেই কারণেই কি না জানা নেই, তবে ওই মাছ খাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হল তাঁর। এতটুকু বলে, মুজতবা আলির মন্তব্য, অচেনা মাছটি ইলিশই ছিল। এবং ইলিশ খেয়ে সম্রাটের যখন মৃত্যু হয়েছে, তখন তিনি নিশ্চিত বেহস্তে গিয়েছেন।
সুনীল বলছেন, এই কাহিনীর ঐতিহাসিকতা নিয়ে কেউ আমায় প্রশ্ন করবেন না প্লিজ। তবে একথা সত্যি, গুজরাতে ইলিশ পাওয়া যায়। তার নাম পাল্লা। পৃথিবীর বহু দেশেই ইলিশ রয়েছে। নানা নাম তার। যেমন আমেরিকায় ইলিশকে বলে শ্যাড।
মুজতবা আলির গল্প বলার পরই সুনীলবাবু রবিঠাকুরের ইলিশ-প্রীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলছেন, রবীন্দ্রনাথের দেড়শো বছর উপলক্ষ্যে কতরকম নতুন নতুন গবেষণাপত্র বেরল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও মাছ নিয়ে কেউ কিছু লিখেছেন কি না আমার চোখে পড়েনি। তাছাড়া রবিঠাকুরের ইলিশ-প্রীতি নিয়ে আমার তেমন কিছু জানা নেই। কিন্তু একটা প্রশ্ন মনের কোণে রয়েই গিয়েছে, তিনি পদ্মায় বোটে চেপে এতগুলো দিন ঘুরে বেড়ালেন। একবারও কি ইলিশ চেখে দেখেননি?
এ প্রসঙ্গেই বিবেকানন্দের ইলিশ-প্রীতি বর্ণনা করেছেন সুনীল। শেষের ক’বছর স্বামীজি নানা ব্যাধিতে ভুগছিলেন। কিন্তু সাঙ্ঘাতিক ভোজনরসিক তিনি। ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা গ্রাহ্য করেন না। তো হল কী, পূর্ববঙ্গে গিয়ে স্টিমারে ঘুরছেন। হঠাৎ দেখলেন ইলিশ ধরা হচ্ছে। অমনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। চোখের সামনে এত টাটকা ইলিশ! সঙ্গে সঙ্গে কানাইকে বললেন, খান কতক ইলিশ কিনে আন। স্বামীজির সঙ্গে সাতজন রয়েছেন। কানাই তিনটে বড় ইলিশ চাইলে তাঁকে ধমক দিলেন স্বামীজি। বললেন, আমরা খাব আর স্টিমারের খালাসি, মাঝিমল্লারা চেয়ে দেখবে? শেষমেশ কেনা হল ১৬টা ইলিশ। দাম কত? একটির দাম চার পয়সা। এটা যে মোটেই গালগল্প নয়, স্বামীজি তাঁর প্রামাণ্য জীবনীতে ওই দামের উল্লেখ করে গিয়েছেন। আর একদিন স্বামীজির শরীর বেশ খারাপ। প্রায়ই বলতেন, শিগগিরই চলে যেতে হবে। চল্লিশ বছরের বেশি বাঁচবেন না তিনি। একদিন স্বামীজি উপোস করেছেন। পরদিন পরমহংসদেবের ঘরে বসে ধ্যান করলেন প্রায় তিনঘণ্টা। তারপরই তাঁর খুব খিদে পেয়ে গেল। ঠিক করলেন, আজ তিনি ভাত, মাছ, তরকারি সব খাবেন। একেবারে ঝাল-মশলা দিয়ে। গঙ্গায় তখন ইলিশ ধরা চলছে। প্রেমানন্দ স্বামী জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ কিনে আনলেন। টাটকা ইলিশ আনা হয়েছে শুনে স্বামীজি এসে একবার দেখে গেলেন। বেলুড়ে সেদিন বেশি লোকজন নেই। স্বামীজি প্রেমানন্দকে বললেন, শুধু ঝোল নয়, খানকতক ভাজা রাখতে। ভাজা ইলিশের স্বাদ অপূর্ব। আর পারলে একটু ইলিশের টক করে দিও। সেদিন তিনি ইলিশ মাছে তেল দিয়ে ভাত খেলেন অনেকটা। সঙ্গে ইলিশ ভাজা। ঝোল। ঝোলে তেমন ঝাল হয়নি বলে ডলে নিলেন কাঁচালঙ্কা। শেষ পাতে পড়ল ইলিশের অম্বল। সবটা চেটেপুটে খেয়ে স্বামীজির শরীরে শক্তি এল। লাইব্রেরিতে বসে কয়েকটা ছাত্র পড়ালেন। তাঁর মন এখন ফুরফুরে। পানিনির ব্যকরণের মতো নিরস ও শক্ত বিষয়ও পড়িয়ে দিলেন একেবারে হালকা মেজাজে। অনেকদিন পর একটু হাঁটতেও বেরলেন। যাঁদের সঙ্গে দেখা হল, গল্প করলেন। তারপর সেই রাতেই রাত মৃত্যু হল।
সুনীল বলছেন, কোনও মৃত্যুর সঙ্গেই ইলিশ ভক্ষণের নিশ্চয়ই কোনও সম্পর্ক নেই। আসল কথা হচ্ছে, খুব ভালো জিনিস একসঙ্গে আহার করতে নেই। ইলিশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতাও বলেছেন সুনীল। বলেছেন, আমরা জ্যান্ত ইলিশ লাফাতে দেখেছি। ছোট ইলিশ কখনও খেতাম না। আর বরফের ইলিশ তো ছুঁয়ে দেখার প্রশ্নই ছিল না। কথায় কথায় একটা বিস্মৃত কাহিনীও বললেন সুনীল। অনেককাল আগের কথা, তখনও দেশভাগ হয়নি। এক কলকাতার বাবু বেড়াতে গিয়েছেন পূর্ববঙ্গে। গ্রামের এক কিশোরের সঙ্গে ভাব জমানোর উদ্দেশ্যে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, খোকা, আজ কী দিয়ে ভাত খেলি রে দুপুরে? ছেলেটি বলল, কলমি শাক আর দুইখান মাছ ভাজা দিয়া দুগ্গা (কিছু) ভাত খাইলাম। তারপর মাছের ঝোল দিয়া ভাত খাইলাম। তারপর পুঁটিমাছ আর তেঁতুলের চুকা (টক) অম্বল। ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, সে কী, তোরা ডাল খাস না? ছেলেটি ততোধিক অবাক হয়ে বলল, কত্তা, আমরা কি বড়লোক যে ডাইল খাব?
এপার বাংলায় ইলিশ রান্নায় পেঁয়াজ-রসুন, আলু-আদার প্রচলন নেই। যুক্তিটা মোক্ষম। পেঁয়াজ-রসুন ইলিশের চমৎকার গন্ধ কেড়ে নেয়। বারোটা বাজিয়ে দেয় ইলিশের নিজস্ব অনন্য স্বাদের। বাংলাদেশে কিন্তু ইলিশ রান্নায় পেঁয়াজ-রসুনের চল মারাত্মক। মাংসের বিরিয়ানির পাশে ইলিশের সহাবস্থানও লক্ষ্যনীয় সেদেশে। সৈয়দ মুজতবা আলি অবশ্য এসব মানতে পারতেন না। ইলিশের চেয়ে মাংসের বিরিয়ানি কাছে টানার ‘অপরাধে’ এক অধ্যাপকের সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলা বন্ধ রেখেছিলেন তিনি। তাঁর সাফ কথা, দাওয়তে ইলিশ থাকলে সেটাই হবে এক ও অদ্বিতীয়। দাওয়াত হতে হবে ইলিশময়। মাংস নৈব নৈব চ।
সত্যিই, ইলিশের নিয়ে কত কাহিনীই না রয়েছে। বাংলার বটতলা থেকে ইস্ট বেঙ্গল তাঁবু, ইলিশের গল্পে মশগুল। গুমোট বাতাস ভিজতে না-ভিজতেই ইলিশের জন্য মন আনচান।
আর ইলিশ তো ওপার বাংলার জাতীয় মাছ। তাই সেখানে খানদানি ইলিশকে নিয়ে গৌরবেরও অন্ত নেই। ডজন ডজন রেসিপি।
আর এ-পারে?
রিঙ্কু বললেন, বাঙালির রসনায় সুখ নেই! ব্যাজার মুখে আক্ষেপ, আগের মতো এখন আর ইলিশ মেলে না। একে তো কমছে জোগান। তার উপর স্বাদে ঘাটতি ষোলোআনা। আরে ইলিশগুলোকে আগে তো বাঁচতে দে।
ইলিশের গল্প শুনতে শুনতেই গোটা রাত কেটে গেল। ভোরের আলো ফুটছে। অসীমবাবু বললেন, জলের টান কমছে। এবার আমাদের ফেরার পালা। বোটে বেশ ভালোই ঝাঁক উঠেছে। কিন্তু আমরা পরশপাথর খুঁজে পাইনি। যাই হোক, লুৎফরকে বলে দিয়েছি, ওর পরিচিত একটা বোটে তুলে দেবে আপনাকে। এলেনই যখন, একবার গোদাখালিটাও দেখে আসুন। ওখানে বিজয়কালী আর প্রেম কুমার আছে। আপনার কথা ওঁদের দু’জনকেই বলে রেখেছি।
কেন্দ্রীয় মৎস্য শিক্ষা সংস্থানের (কলকাতা) প্রাক্তন মুখ্য বিজ্ঞানী ড. বিজয়কালী মুখপাত্র। ইলিশ নিয়ে তাঁর ঝুলিতেও রয়েছে নানা মজার গল্প। গোদাখালি ঘাটে চায়ের দোকানে বসে বললেন, বহু বছর আগে গুজরাতের তাপ্তি নদী দিয়ে কিছু ইলিশ উকাই জলাধারে চলে এসেছিল। ওরা আর ফিরে যায়নি। সেই মিষ্টি জলাধারেই থাকতে শুরু করে তারা। ডিম পাড়ে। বাচ্চা হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, গুজরাতের ওই ইলিশ এবং বাংলায় গঙ্গার রেসিডেন্সিয়াল ইলিশ একই প্রজাতির। উকাইতে যে মানসিকতা নিয়ে থাকতে শুরু করেছিল তারা, এখানেও ওদের মধ্যে একই চরিত্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।
চা খেতে খেতেই বিজয়বাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ব্রাকিশ ওয়াটার অ্যাকোয়া কালচারের বিজ্ঞানী ড. তাপস ঘোষালের সঙ্গে। অসীমবাবুর নাম বলায় কথা এগোতে সুবিধা হল। বললেন, থাকা হয় কোথায়? খড়দহ শুনে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, আপনার বাড়ির পাশেই তো সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটছে। জানেন না?
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কী হচ্ছে?
আরে, ওখানেই তো দেবনারায়ণ চাটুজ্জেরা পুকুরে ইলিশ চাষ করছে। রুই-কাতলার সঙ্গেই বাংলার পুকুরের মিষ্টি জলে তরতরিয়ে বেড়ে উঠছে রূপালি শস্য। আজ না হোক কাল, এ রাজ্যের পুকুরে জাল ফেললে উঠবে ইলিশ!
সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফ্রেশ ওয়াটার অ্যাকোয়া কালচারের (রহড়া) শাখায় এসে বুঝলাম, সেদিন মোটেই নিছক আবেগে ভেসে কথাগুলো বলেননি তাপসবাবু। ইলিশ নিয়ে মিথ ভেঙেছেন বিজ্ঞানীরা। বাঙালির হেঁশেলে যে রূপালি শস্য মহার্ঘ, তা যে পুকুরেও চাষ করা সম্ভব, সেটাই করে দেখিয়েছেন ওঁরা।
অবশ্য রাতারাতি কাজটা সম্ভব হয়নি। বছরের পর বছর কসরত করছেন বিজ্ঞানীরা। সত্যিই, ইলিশ নিয়ে এ এক অন্য গল্পগাঁথা!
দেবনারায়ণবাবুদের রিসার্চ স্টেশনে বিশাল বিশাল জলাশয়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছে ইলিশের খোকারা। রুই-কাতলাদের সঙ্গে ভাব জমেছে ভালোই। একটার পর একটা চৌবাচ্চার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি আর মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।
দেবনারায়ণবাবু বললেন, সালটা ২০১২। রাজ্যে প্রথম এনিয়ে গবেষণা শুরু হয়। সাতটি গবেষণা সংস্থা আলাদা আলাদাভাবে কাজ শুরু করে। পুকুরের জলে ছাড়া হয় ইলিশের বাচ্চা। কিন্তু দেখা যায়, বড়জোর দিন দশেক। তার মধ্যেই মারা যাচ্ছে। একই ঘটনা ঘটতে থাকে বারবার। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে, আমরা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না। রাত-দিন এক করে মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করি। এগোতে থাকে গবেষণা। কিছুদিন পর দেখতে পাই, হ্যাচারি বা নার্সারি পুকুরে বিশেষ পরিচর্যায় কিছুটা বড় করে তারপর পালন পুকুরে ছাড়লে ইলিশের বাচ্চার মৃত্যুর হার খানিকটা কমানো যাচ্ছে। কিন্তু পুরোটা নয়। বুঝলাম, কাজটা এখনও শেষ হয়নি। ফের শুরু হয় গবেষণা। এরপর আসল বিষয়টা আমাদের সামনে ধরা দেয়। বুঝতে পারি, আসলে সঠিক খাবারের অভাব ঘটছে।
প্রশ্ন করলাম, কিন্তু আপনারা তো খাবার দিচ্ছিলেন?
দেবনারায়ণবাবু বললেন, এটাই তো মজার। পুকুরে অন্য মাছ যা খায়, ইলিশ কেন আর কেন খাবে? তাহলে সে কুলীন হল কী করে? ওর জন্য চায়, স্পেশাল মেনু। ছোটবেলায় উদ্ভিদ ও প্রাণীকণা। কিন্তু তাতেই কি চাহিদা মিটবে? না, দরকার আরও কিছু। তবেই তো তরতরিয়ে বেড়ে উঠবে। ওটুকু আপাতত গোপন থাক।
বুঝলাম, সবটা ভাঙলে বিজ্ঞানীর কদর থাকে না। কিন্তু নিজের চোখে স্পষ্ট দেখতে পেলাম, দেবনারায়ণবাবুরা তৈরি করেছেন ফর্মুলেটেড ফিড। আর তা চেটেপুটে খাচ্ছে ইলিশের ছেলেপুলেরা।
অফিসঘরে বসার পর মিলল পরিসংখ্যান। দীর্ঘ গবেষণায় গর্বের হাসি দেবনারায়ণবাবুর মুখে। বললেন, এখন ইলিশের ডিমপোনা থেকে ধানিপোনা পর্যন্ত ৮৮ শতাংশ বাঁচাতে পারছি আমরা। আমাদের তৈরি খাবার খেয়ে মিষ্টি জলের পুকুরে বছরে ইলিশের ওজন বাড়ছে ১০০-১২৫ গ্রাম। আমাদের কাছে এই মুহূর্তে সাড়ে পাঁচশো গ্রামের ইলিশ রয়েছে।
বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফলকে কাজে লাগিয়ে হুগলির মগরায় শ্যামাচরণ চাটুজ্জে পুকুরে ইলিশ চাষ শুরু করেছেন। তাঁর পুকুরে খেলা করছে পাঁচ হাজার ইলিশের ছানা। বললেন, আমার দু’টো পুকুর। একটাতে মিষ্টি জল। অন্যটাতে নোনা। মিষ্টিজলে কিছুদিন ইলিশের বাচ্চাগুলোকে বড় করে তারপর নোনাজলে ছাড়ি। ধীরে ধীরে জলে লবণের পরিমাণ বাড়াতে হয়। ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত অসুবিধা নেই। তারপরই ইলিশের স্যালিনিটি শক প্রয়োজন। অর্থাৎ নোনা জলে একটা ধাক্কা।
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম এই ইলিশের স্বাদ কেমন? দেবনারায়ণবাবু বললেন, ইলিশের স্বাদ অনেকটাই নির্ভর করে ইলিশ কী খাচ্ছে, তার উপর। আমরা পুকুরের ইলিশ অনেককেই খাইয়েছি। তাঁরা স্বাদে কোনও পার্থক্য বুঝতে পারেননি।
ম্যাগাজিনে কভার স্টোরি লেখার জন্য ডায়েরি ভর্তি নোটস আর মনের সুখ মিটিয়ে তোলা ছবি নিয়ে যখন অফিস ঢুকছি, একটাই কথা মনে হল, অসীমবাবু, দেবনারায়ণবাবুদের নিরলস চেষ্টাকে সফল করে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সত্যিই বাংলার পুকুরে জাল ভরবে রূপালি ঝিলিক তুলে। আর সেই মাছ হেঁশেলে ঘরণীর হাত-যশে তল্লাট মাতাবে সুঘ্রাণে। বর্ষামুখর দিনে জমে উঠবে বাঙালির আড্ডা।
ততদিনে সৈয়দ মুজতবা আলির কথা ধার করে বলা যেতেই পারে, দূরে কোথায় দূরে দূরে মন ঘুরে বেড়াক ইলিশের ঘোরে!
ইলিশ নিয়ে বাঙালির এই পাগলামি থাকুক। ভিনদেশিরা স্যামন, টুনা, বাসা, ভেটকি নিয়ে থাকুক ব্যস্ত। ক্যাভিয়ার সহযোগে ওয়াইন উপভোগ করুক তারা। ফিশ অ্যান্ড চিপসে মাতোয়ারা হোক সাহেব। আমরা বিভোর হয়ে থাকি ইলিশ আর তার পেটভরা ডিমে।