আত্মগদ্যঃ বোঁদে দিয়ে বাসি ঠাণ্ডা লুচি – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

বোঁদে দিয়ে বাসি ঠাণ্ডা লুচি
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

হ্যাঁ, ঠিকই দেখছেন। বোঁদে দিয়ে ঠাণ্ডা লুচি। গত রাতে ভাজা গরম গরম লুচিগুলোর মধ্যে যেন হাতছানি ছিল। কিন্তু, সে পর্যন্ত আর পৌঁছনো হয়ে ওঠেনি।
– রাজু,তোর এন্ট্রি। যা ছুটে। হ্যা, বল্লমটা উইংসের পাশে রয়েছে। নিয়ে ঢুকতে হবে।”
সুব্রত প্রায় হাত ধরেই স্টেজের দিকে ঠেলে দিল। আমিও ভুল না করে বল্লমটা নিয়ে মঞ্চে ঢুকলাম।
আসানসোলের মাস্টারপাড়ায় অমিয় স্যার আর অম্বুজাক্ষ স্যারের দুই বাড়ির মাঝখানে ছোট একটা মাঠে ওরা মঞ্চ বানিয়েছে।
সেটে ঢুকেই সিংহাসনে বসা মহারাজকে প্রণাম ঠুকলাম। মহারাজ জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন – প্রতিহারি! যাওতো মন্ত্রী মশাইকে খবর দাও।”
আসলে মন্ত্রী মশাই তো আমারই করার কথা। কী করবো ভাবনা শুরু করতেই আবার ভাঙ্গা গলায় চিৎকার – কী হল, শুনতে পাও নি?”
বুঝলাম এই ডায়ালগটা স্ক্রিপ্টে ছিল না। থাকলে গলা দিয়ে মিউ মিউ শব্দ বের হতো না । দেখলাম উইংসের পাশ থেকে বৌদি, আমাকে হাত নেড়ে ডাকলেন। নাকে গরম লুচিভাজার গন্ধ পেলাম।
ঐ বৌদি হলেন পরিচালিকা। আজ থেকে ষাট বছর আগে একজন মহিলা সমস্ত কাজের দায়িত্ব পালনের পর পাড়ার ছেলেদের নিয়ে নাটকের পরিচালনার কাজ করেছেন ! আজ কোথায় আছেন কোন অবস্থায় আছেন ! পরের বছর এইচ এস হয়ে গেলে আমি তো আসানসোল থেকে কলকাতায় আর সুব্রতরা কেউ খড়গপুর, কেউ ভিলাই কেউবা দিল্লী মুম্বাই চেন্নাই ব্যাঙ্গালুরু পুনে হায়দরাবাদ চলে গিয়ে ছত্রভঙ্গ অবস্থা। আর সেই বৌদিরও কোনো খবর নেয়া হয়নি।
উইংস ছাড়িয়ে মেক আপ রুমের দিকে যেতেই বৌদি ধরে ফেললেন – না ভাই, তোমাকে আর ভেতরে এখন যেতে হবে না।” বলে আমায় ধরে গায়ে একটা চকোলেট রংএর বড় জোব্বা জাতীয় লম্বা কোট পরিয়ে দিয়ে বললেন – ভেতরে ঢুকে পড়। এখন তুমিই মন্ত্রী , রাজার পাশের সীটে গিয়ে বসে পড়। কোনো ডায়ালগ নেই, শুধু মাথা নড়িয়ে যেতে হবে।”
আমি সুব্রতদের পাড়ার নই। ওদের পাড়ার ছেলেরা যে যার পছন্দমতো চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বা বৌদিকে বলে তৈরী হয়েছে। কিন্তু, মৃত সৈনিক , প্রতিহারী, মন্ত্রীর মুখে কোন কথা বা কোন ডায়ালগ নেই। নাট্যাভিনয়ের জন্য এসব চরিত্র তো আর বাদ দিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করা যায় না! তবে নাটকে কারোর প্রয়োজন কারো থেকে কম নয়। লাগবেই। তাই বৌদির পরামর্শে আমার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়া সুব্রত একদিন আমার হাত ধরে অনুরোধ করেছিল – রাজু, তোর তো স্টেজে পা কাঁপেনা, তুই আমার বৌদিকে রক্ষা করতে পারিস। ডায়ালগ ছাড়া পার্ট কেউ করতে চাইছে না। তুই রাজী হয়ে যা। পরের দিন রবিবার স্কুলও থাকবে না। ভাই রাজু রাজী হয়ে যা প্লীইজ।”
আমি একবার বলেছিলাম – দু একটা কথা বলার মতো কোন পার্ট নেই?”
– আছে কিন্তু কতক্ষণ থাকবে বলতে পারিনা। ” সুব্রত বলেছিল – সে জন্য আমাদের হটন রোড মাস্টারপাড়ার ক্লাবের সেক্রেটারি আগে থেকেই বলে রেখেছে। শুধু এই পার্টগুলো করার কয়েকজন কিছুতেই যোগাড় করা যাচ্ছে না। প্লীইজ রাজু, তুই পারবি বলেই বলছি। স্টেজে তুই যখন তখন উঠতে পারিসও। রাজী হয়ে যা, তোকে পড়া বন্ধ করে রিহার্সালেও আসতে হবে না।”
কিছু দিন আগে আমাদের চাঁদমারী পাড়ার নাটকে আমার অভিনয় সুব্রত দেখেছে বলে মনে হয়েছিল। তা’ ছাড়া ইনটার স্কুল আবৃত্তি আর স্বামী বিবেকানন্দ নিয়ে বক্তৃতার প্রতিযোগিতায় কয়েক বছর ধরে প্রাইজ নিয়ে এসেছি, সুব্রত এসব জানতো। এখন সুব্রতর কথায় রাজী হয়ে চাঁদমারী থেকে হেঁটে হটন রোড মাস্টারপাড়ায় এসেছি।
একটার পর একটা দৃশ্য আসতে লাগলো আর বৌদি ও সুব্রতর কথামত মঞ্চে আমার প্রবেশ ও প্রস্থান এল , গেল। শেষ দৃশ্যে অভিনয় ছিল মৃত সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয় করা। বলে দেয়া হল , কেউ না বলা পর্যন্ত চোখ যেন না খুলি। তখনো নাকে আসছিল লুচি ভাজার গন্ধ।
আসানসোলের মাস্টারপাড়ায় অনেকেই আমার চেনাজানা ছিল । স্কুলের বন্ধুরা আর মাস্টার মশাইরা অনেকেই ওখানে থাকতেন।
লুচি ভাজার গন্ধ পেতে পেতে সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কয়েকজনের ডাকাডাকিতে চোখ খুলে উঠে বসলাম। মঞ্চের ড্রপ সিন পড়ে গেছে। সামনে সুব্রত বা বৌদি নেই, আছে এ পাড়ার ছেলেরা যারা আমার সঙ্গে বা এক ক্লাস এদিকে ওদিকে পড়তো। ঐযে ইশ্বরসিং, সুভাষ দাঁ, শ্রীশ্যামাদাস কোঙার, নিরঞ্জনরা বলছে – ওঠ রাজু। থিয়েটার শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।”
– ভাগ্যিস তোরা এলি!” আমি বললাম – বৌদি বলেছিলেন ডেকে দিলে যেন উঠি, তাঁর আগে নয়। “
তাড়াতাড়ি সৈনিকের পোষাক খুলতে খুলতে আমি বললাম – বৌদি , সুব্রত আমাকে না ডেকেই চলে গেলেন ?”
– আরে বৌদির মেয়ে খাট থেকে পড়ে গেছে শুনেই ওঁরা চলে গেছেন।” বলল ঈশ্বর সিং – শোন রাজু, তুই তো বাড়ি ফিরতে পারবিনা। জ্যাদা রাত হো চুকী।”
সুভাষ বলল – রাত বেড়ে গেছে, ওদিকে পথ ভাল থাকে না।”
– আমি আছেক না ! ” বলল শ্যামাদাস – আমি উগ্র ক্ষত্রিয় আগরী হন্ছি বটেক ! কোন ডর আমাদের দেখলে লিজেরাই ডরাইবেক আগে।”
ঈশ্বর সিং নিজের বুকে হাত ছুঁয়ে বলল – আমি সর্দার আছে। কোই ডর নেহি।….” না ঈশ্বর তোমাকে আর বীরত্ব দেখাতে হবে না।” বললেন সুব্রতর দাদা নামী ফুটবলার গোবরাদা – রাজু এখন আমাদের বাড়ি চল। কিছু মুখে দিয়ে সুব্রতর ঘরেই ঘুমোবে। কাল সকালে উঠেই বাড়ি চলে যেতে পারবে।”
এখনও লুচি ভাজার গন্ধ পেলাম।
পরদিন সকালে উঠেই চাঁদমারী ফিরে যাবার জন্য তৈরি হতেই বৌদি ডাকলেন – কিছু একটু না খেয়ে যাবেনা, বলে দিলাম।” বলেই আমার সামনে একটা বড় বাটিতে করে কয়েকটা বাসি লুচি আর বড় দুচামচ বোঁদে এনে দিলেন। লুচিগুলোর পাশগুলো কেমন যেন ফোলা ফোলা। গরম ভাজার গন্ধ নেই তবু ঠাণ্ডা লুচি আর বোঁদে খেতে খেতে মনে হল যেন অমৃত খাচ্ছি। সত্যিই আজও সে স্বাদ ভুলতে পারিনি। অমৃত না হলে ষাট বছর পরেও স্বাদ মনে থাকে !

One thought on “আত্মগদ্যঃ বোঁদে দিয়ে বাসি ঠাণ্ডা লুচি – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

  1. খুব মজাদার গল্প।
    এক নি:শ্বাসে পড়ে শেষ করা গেল।
    এইরকম আরো চাই।
    🙏

Leave a Reply to mr. x Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *