গল্পঃ পূর্বজন্ম – দেবাশিস মল্লিক

পূর্বজন্ম
দেবাশিস মল্লিক

সারাজীবন আমার নামের পিছনে আবর্তের মতো বসে থাকা লাকি শব্দটা নিয়ে কম কনফিউশান তো হল না।এখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। আর নিতে পারি না।কপালের একটা গুন যদি জাগতিক সুখসাচ্ছন্দ্যের কথামালা হয়, তবে আমি নিশ্চিত ভাবে লাকি।কিন্তু একজন নারীকে যদি প্রকৃতির কাছে বারবার মগ্নতা আর জাদুবোধের আঁচড় ভিক্ষা করতে হয় তবে আমার কপালটা সত্যিই খারাপ।এখন যদি নামের পিছন থেকে শব্দটা বাদ দিতে যাই, তো কমিউনিটি আগন্ডা প্রশ্ন তুলবে।যেখানেই যাবো সবাই চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে, আপু… হইল ডা কি! ক্যামনে হইল আপু!
কি বিড়ম্বনা বলুন তো।এই লাকের কারনেই ইউনিভার্সিটির চৌকাঠে পা দেওয়া মাত্র কোনো এক কাব্যিক আড়াল থেকে মুমীন সাহেব আমারে দেখলেন।ব্যবসাদার মানুষ কি নেই তাঁর।আজও পর্যন্ত তিনি আমার কোনো অভাব রাখেননি।আমি এই যে লেখালিখি করি, তা তিনি বুঝেন না বটে,তবে তার সম্মতির কোনো অভাব হয়নি আজ অবধি।তবে আমার ছেলে এই কবিতা নিয়ে আমাকে কি খোঁটা দেয়, কি বলবো! সে হস্টেল থেকে এসেই নানা রকম ভাবে আমি আর আমার কবিতা নিয়ে মজা করে।আমি যতক্ষণ না খুব রেগে কিছু একটা বলছি, ততক্ষণ সে বিষয়টাকে জারি রাখে।
ছেলে কয়েকদিন পর আবার হস্টেলে চলে গেলে সকালে মুমীন সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার পর বাসায় আমি আর সাফিনা।সে ভারি ভালো, যা বলি করে।আমার চুলে ডাই করে দেয়।মেহেন্দি লাগিয়ে দেয়।কোথায় অনুষ্ঠানে যাবার আগে আমাকে তৈরি হতে অনেক হেল্প করে।এমনকি লুকিয়ে কোথা থেকে না জানি রেড ওয়াইন ও এনে দেয়।
বাসায় থাকলে বেশির ভাগ সময়টাই আমি আধশোয়া হয়ে মেসেনজারে।কতজন কত ভালো মন্দ বার্তা দেয়।আমি প্রয়োজন মতো উত্তর দিই।কেউ বাড়াবাড়ি করলে ব্লক।তবে অনেকে ছেলেমানুষীও করে।তাদের বার্তার ছেলেমানুষীর কথা ধরলে আমার ছোটোবেলার বন্ধু কাসেমের কথা মনে পড়ে।আমি মনে মনে হেসে ফেলি।কাসেম আমাকে পচ্ছন্দ করত।কিন্তু বলার তার সাহস ছিল না।আমি যদিও কাসেমের দেখানো একটা স্বপ্নের জন্য এখনো টাল খেয়ে যাই।ও বলেছিল, ওর বি এস এ সাইকেলের সামনে আমাকে বসিয়ে জলাবিল ধারে মূল রাস্তা থেকে গড়ান ধরে হুস করে নেমে যাবে।আমাকে জলাবিলের পানকৌড়ি দেখাবে।সেটা আর হয়নি।শুনেছি কাসেম ওর গাঁ য়ে ফিরে গেছে আমার বিয়ের পরেই।সে ওখানে মাছের ব্যবসা করে।সোসাল মিডিয়ায় অনেক খুঁজেও তাকে পাইনি।
কিন্তু হঠাৎ মাসেকখানেক ধরে কাঁটাতারের ওপারের থেকে একজনের বার্তা আসা শুরু হল।গত বছর আলমাহামুদ কবিতা উৎসবে তাকে দেখেছিলাম।কাসেমের দেওয়া সেই পুরোনো দিনের কাঁচা পেয়ারা মতো সবুজ একটা চোখের ঘোর।শুনেছিলাম তার লেখা।মনে হয়ছিল ভারি অদ্ভুত! যেমনটা লেখা যায় না সে সেই সবই লেখে।একবছর পর আমার ওয়ালে দেওয়া একটা লেখা পড়ে আমার সাথে যোগাযোগ। এমনটা আকচারই হয়ে থাকে।তাই গুরুত্ব দিইনি।কিন্তু সে আমাকে তার লেখা পাঠাচ্ছে।বারবার বলছে মনে অনুষঙ্গ নিয়ে আমিও নাকি চমৎকার লিখি।লিখি আমি খারাপ নয়।গুনীজনেরা তাই বলে।কিন্তু এর বলার ভিতর কোথাও একটা আকুতি আছে।কানের ব্যথার মতো সেও আমাকে জ্বালাচ্ছে।মানুষটার বয়স কত! আমারই মতো।কমও হতে পারে আবার সামান্য বেশিও হতে পারে।তার প্রোফাইলে ছোট ছোট আট দশ লাইনের এমন সব লেখা রয়েছে সেগুলো পড়লে আমার খুব মনখারাপ হয়ে যায়।মাথাটা ভার হয়ে ওঠে।কি লিখতে চায় মানুষটা! সম্পর্ক মানেই কি ভাঙন, নাকি ভাঙনের পর যা পড়ে থাকে সেটাই সম্পর্ক! আমাদের তো কোনো পরিচয় নেই।কেনই বা সে আমার বুকের ভিতরের দুঃখবোধ গুলোকে ভিতর থেকে টেনে আনছে! কি দুঃখ ই বা আমার! সে বলে নিসঙ্গতা।হ্যাঁ আছে।পৃথিবীর বহু মানুষেরই তা আছে।এ তো নতুন কিছু নয়।তাহলে! আমি যে বয়সে কাসেমের থেকে কাঁচা পেয়ারা চাইতাম এখনকার সেই বয়সের মেয়েরা সামান্য কারনেই ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে।মাঝে মাঝে মানুষটাকে আর নিতে পারি না।ভাবি ব্লক করে দেই।পারিনি।
সে যে আমাকে বিরক্ত করে তা নয়।সব সময় মেসেজও করে না।কিন্তু হঠাৎ করে সে যখন লেখে কাল রাত তিনটে অবধি জেগে কি লিখলেন কই পাঠালেন না তো! আশ্চর্য! সেদিন দশটায় আমি মোবাইলটাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম।সে জানলো কি করে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, এমনি মনে হল বললাম।মিলে গেছে আর কি।
ইদানীং আমার সারদিনের অনেক ভাবনাই সে মিলিয়ে দেয়।আমি তন্নতন্ন করে জানার চেষ্টা করেছি সে কি আমার খবর আমার পরিচিতর থেকে পায়! না।সাফিনা! না।তাহলে, সে কি করে জানতে পারে আমার শীর ভালো নেই।বুকে একটা ব্যথা হচ্ছে।মুমীন সাহেব তার বাসায় আমাকে নিয়ে আসার এতবছর পর কেন আমাকে জিজ্ঞেস করছে,তোমাকে ইদানীং খুব ক্লান্ত লাগে! ছেলে কেন ফোনে বলে সিরিয়াসলি বলছি,তোমার লেখা নিয়ে আমি আর কুটো কাটবো না,তুমি আমার নটি আম্মু হয়ে যাও! সাফিনাকেই বা কেন বারবার বলতে হচ্ছে স্নানে যাও।টেবিলে খাওয়ার দেওয়া আছে কখন খাবে!।
আমি জানি মানুষটারও প্রবল নিঃসঙ্গতা।সে তার ওয়ালে সব লিখে রেখেছে।তাহলে কি তার সেই নিঃসঙ্গতায় জড়িয়ে যাচ্ছি! তাকে নিঃসঙ্গতার অনুভব জিজ্ঞেস করলে সে লেখে মসৃনতা দিয়ে যদি কোনোদিন অমসৃনের উপর নুইয়ে পড়েন তবে না বুঝবেন।

এসবের কি উত্তর দেবো কে জানে।আমার এখন আবার মাথার যন্ত্রণা শুরু হল।মানুষটা একটা লেখা পাঠিয়েছে।পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে, সে আমাকে একটা বি এস এ সাইকেলের সামনে চাপিয়ে হুস করে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে।যেখান থেকে অলীক কিছু ছাড়া আর কিচ্ছুটি ফিরে আসে না….।

2 thoughts on “গল্পঃ পূর্বজন্ম – দেবাশিস মল্লিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *