রুশ দেশের কথা – রঙ নম্বর
বিজন সাহা

প্রিভিয়েত! তুমি আরও অনেকক্ষণ ধরে দরজা খোলার চেষ্টা করবে?
পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ভারতীয় ছেলেটা দাঁড়িয়ে। নাম মনে হয় সঞ্জয়।
রেডিও ফিজিক্সে পড়ে। একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতেই বলল
এটা চার তলা। তোমার রুম পাঁচ তলায়।
তাই তো। এটা ৪১০ নম্বর ঘর। আমি থাকি ৫১০ নম্বর ঘরে। আমরা পাভলভস্কায়া থেকে দুই নম্বর
ব্লকে এসেছি কিছুদিন আগে – ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তখনকার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়,
চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ষের ছেলেরা থাকতাম যথাক্রমে পাঁচ, চার, তিন, দুই আর এক তলায়।
একটু লজ্জিত হয়ে সরি বলে চলে গেলাম। এটা অবশ্য ঘটতো মূলত ছুটির দিনে যখন আন্ডার গ্রাউন্ডে
স্নান করে দৌড়ে উপরে উঠতাম। এক সময় সঞ্জয় মনে হয় এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। তবে তারচেয়ে
ভয়াবহ হল আমি নিজেই এই ভুলে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম।
দুবনায় পুরানো বাসায় থাকার সময়ে প্রায়ই পাশের এন্ট্রান্সে ঢুকে যেতাম। ভাগ্যিস ঐ এন্ট্রান্স
একটু অন্যরকম ছিল। তাই বেশি দূর যাবার আগেই ভুল ভাঙতো। ল্যাবরেটরিতে আমার আর প্রফেসর
গের্দতের অফিসের মাঝে করনিয়াকের অফিস। করনিয়াক সাধারণত বাসায় বসে কাজ করে আজ থেকে
প্রায় বছর বিশেক হল। আমি আর ভালোদিয়া গের্দত প্রায়ই ভুল করে একে অন্যের অফিসে ঢুকে
যেতাম।ওর মৃত্যুর পরে অবশ্য কখনও এমনটি ঘটেনি। সামারে যখন ভোলগায় সাঁতার কাটতে যাই বাসায়
ফেরার সময় মাঝেমধ্যে অন্য বিল্ডিং এ ঢুকে যাই। চাবি কাজ করে না। তাই নীচে গার্ড দরজা খুলে বলে
আপনি ভুল বিল্ডিং এ এসেছেন। আপনার ফ্ল্যাট পাশের বিল্ডিং এ।
তবে কয়েক দিন আগে যা ঘটল সে তুলনায় এসব নস্যি।
মস্কোয় মেট্রো কানকোভার ওখানে মামার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাসায় রিপেয়ারিং
চলছে। হালকা মেরামত। আগের ঝাড়বাতি নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন ঝাড়বাতি কিনেছি, তবে বুকিং দিয়েছি
স্পোরতিভনায়া। গুলিয়া বলে দিয়েছে ঝাড়বাতিটা কোনকোভায় রেখে আসতে। ওখানে আমি হাতে গোনা
কয়েকবার গেছি। বাড়ি, বাসার নম্বর এসব জানি।
চাবিগুলো একটু কষ্ট করে ঢুকাতে হয়। তবে একবার ঢুকালে অনায়াসে দরজা খোলা যায়।
আমার হাতে চাবির গোছা দিয়ে গুলিয়া বার বার বলে দিল।
এন্ট্রান্সে ঢুকে হেঁটে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। চার বা পাঁচ তলায় বাসা। আসলে অপরিচিত কোন বা
অল্প পরিচিত কোন বাসায় গেলে আমি লিফট ব্যবহার করি না। এটা ক্লাস্ট্রফোবিয়া থেকে। এমনকি
প্রতিদিন যখন অফিসে যাই বা বাসায় ফিরি লিফতের দরজা না খোলা পর্যন্ত টেনশনে থাকি। তাই হেঁটে
যাওয়া।
না বাসা তার আগের জায়গাতেই আছে, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। চার তলায় উঠে দেখি সেখানে
দুটো ফ্ল্যাটের একটা কমন ডোর। সুতরাং এখানেই আমাদের বাসা। নম্বর দেখার কথা একেবারেই
মাথায় এলো না। চেষ্টা করলাম দরজা খুলতে। দুটো তালা। চারটে চাবি। লটারির মত এ চাবি ও চাবি
লাগিয়ে বাইরের দরজা খুললাম। এবার ভেতরের দরজাটি। সেখানে দু’টো তালা। একটা নষ্ট। কয়েকদিন
আগে গুলিয়া সেখানে চাবি ঢুকিয়ে বিপদে পড়েছিল। পরে লোক ডেকে ১০০ ডলার খরচ করে উদ্ধার পায়।
এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আমরা থাকি না, আমাদের কেউ চেনে না। তাই যদি কেউ চোর ভেবে
পুলিশ ডাকে ঝামেলার অন্ত থাকবে না। যাহোক এ চাবি ও চাবি ঘুরিয়ে ঘর খুলছিল না। গুলিয়াকে ফোন
করলাম।
তুমি ভুল চাবি দাওনি তো?
না। একটু সাবধানে ঘর খোল।
দেখছি।
আবার চেষ্টা করতেই একজন ঘর খুললেন। সেখানে ভ্যালেরি নামে এক লোকের কাজ করার কথা ছিল।
কিন্তু পোশাক দেখে তেমন মনে হল না।
উনি আমার দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি আবার গুলিয়াকে ফোন করলাম।
এখানে এক ভদ্রলোক দেখছি।
কারও তো থাকার কথা নয়।
বুঝলাম কোথাও একটা গন্ডগোল হয়েছে। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম
আপনি ভ্যালেরি?
না। আমি আর্কাদি।
মানে রিয়েলটর?
হ্যাঁ। আপনি সাহা?
হুম। এখানে একজনের কাজ করার কথা। আমি ঝাড়বাতি দিতে এসেছি।
আপনাদের ফ্ল্যাট উপরেই। পাঁচ তলায়।
ধন্যবাদ ও দুঃখিত।
আর্কাদি এর আগে আমাদের একটা বাসা বিক্রি করতে সাহায্য করেছিল। তখন কয়েক মিনিটের জন্য
দেখা। তাছাড়া আন্তন কয়েক বার ওর ফ্ল্যাট ভাসিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে কিছু টাকা জরিমানা দিতে
হয়েছে। তাই নাম বলাতেই মনে পড়ে গেছিল। আমার ধারণা ও আমাকে চিনতে পেরেছিল প্রথমেই।
অন্তত ধারণা করেছিল এটা আমি। না হলে ব্যবহারে সেটা প্রকাশ করত।
যাহোক ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাঁচ তলায় উঠলাম। এবার অবশ্য আমি প্রথমে নম্বর দেখে নিলাম।
না ঠিকই আছে। বাসার নম্বর ৪১৪। আমি সব নম্বর বিভিন্ন ভাবে মনে রাখার চেষ্টা করি। এর কোড
ছিল ৩১৪ মানে পাই।
এবার চাবিরা বদমাইশি করেনি। তবে ঘর খোলার পর তালা থেকে চাবি ছাড়াতে পারছি না। অনেক দিন
পরে দেখা। তাই গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আবার গুলিয়াকে ফোন। মজার ব্যাপার হল গুলিয়ার সাথে
এমন হলে আমি বলতাম দুবনায় বসে আমি কি করব। আসলে এরকম ভুলভাল অন্য কোন বাসায় চলে
যাওয়া এ দেশে হয়তো নতুন কিছু নয়। যদিও অন্য প্রেক্ষিতে তবে ভুল বাসায় ঢোকার উপর একটা
বিখ্যাত সিনেমা আছে। প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর এই সিনেমা রুশ টিভিতে দেখায়। লিওনিদ গাইদাইএর
এই মুভির নাম “ভাগ্যের পরিহাস বা স্নান সুখের হোক”। ছবির নায়ক ৩১ মার্চ সাউনায় যায় বন্ধুদের
সাথে ষ্টীম বাথ করতে। এটা ওদের রিচুয়াল – প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর ষ্টীম বাথ করা। ছবির নায়ক
নতুন বছরে বিয়ে করবে। এ উপলক্ষ্যে প্রচুর ভোদকা পান করে সবাই। বিশেষ করে আমাদের নায়ক
আর সেই বন্ধু যে রাতের ফ্লাইটে লেনিনগ্রাদ যাবে বান্ধবীর সাথে নববর্ষ বরণ করতে। কিন্তু
ভোদকার বদৌলতে বন্ধুর পরিবর্তে আমাদের নায়ককে একরকম জোর করে প্লেনে উঠিয়ে দেওয়া হয়।
এয়ারপোর্টে থেকে সে নিজের বলে বাসায় চলে আসে ট্যাক্সি করে। কিন্তু স্বাভাবতই সে বাসা ছিল ছিল
লেনিনগ্রাদে। ঘটনাচক্রে মস্কো আর লেনিনগ্রাদের বাসার ঠিকানা, বাড়ি, ঘরের আসবাবপত্র সবই
হুবহু মিলে যায়। ফলে আমাদের নায়ক তেরই পায় না যে যে অন্যের বাসায় চলে এসেছে। সেখানে থাকতেন
এক মহিলা। আমাদের নায়কের জন্য মস্কোয় অপেক্ষা করছিল তার প্রিয়তমা যার সাথে বিয়ে বিয়ের
কথা হয়েছে। অন্যদিকে সেই ভদ্রমহিলা তার বন্ধুর অপেক্ষা করছিলেন। বাসায় ফিরে দেখেন যে তার
বিছানায় অপরিচিত এক লোক ঘুমুচ্ছে। অনেক চেষ্টার পর তাকে জাগালে সেই লোক বলছে এটা তার
বাড়ি, এই আসবাবপত্র তার, এমনকি সে নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছে। এটা আসলে
সোভিয়েত ইউনিয়নে সবই যে এক রকম করে করার প্রচেষ্টা তাকে নিয়ে কমেডি। সে সময় সোভিয়েত
ব্যবস্থার সমালোচনা করা খুব সহজ ছিল না। তাই অনেকেই সিনেমা, চুটকি এসবের মাধ্যমে সরকারের
সমালোচনা করত। এ ধরণের সৃষ্টি সোভিয়েত ব্যবস্থার কিছু কিছু অনাসৃষ্টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাত
বিধায় ছিল প্রচণ্ড জনপ্রিয়।
যাহোক বাসায় ঢুকে কাজকর্ম কেমন চলছে দেখে রাস্তায় নামলাম। পাশের বিখ্যাত ভিৎসেভস্কি
পার্ক। আমি হাঁটছি মেট্রোর দিকে। পাশের পুকুরের ওপর নতুন সেতু। হলুদ ফুল। ফুলের কিছু ছবি তুলতে
গিয়ে দেখি সময় অনেক হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি না করলে ক্লাসে যেতে দেরি হবে। সামনে একাডেমি অফ
সায়েন্সের হোস্টেল। ১৯৮৩ সালে এখানে মালেক ভাই থাকতেন। বিনায়ক দাও। ছাত্রজীবনে আসতাম
এখানে। তবে তখনও মেট্রো হয়নি। আসতাম বাসে করে। এখানে মেট্রো হয় অবশ্য সেই আশির
দশকেই। সেদিক থেকে বেশ পরিচিত জায়গা। আসলে মস্কোর অধিকাংশ এলাকাই কোন না কোন ভাবে
পরিচিত, বিশেষ করে যেসব এলাকায় আমাদের বন্ধুরা থাকত। ফলে এসব জায়গায় এলেই সেই সব
পুরানো দিনের কথা মনে ভেসে ওঠে। স্মৃতির গভীর থেকে উঠে আসে শত শত মুখ যাদের সাথে না আছে
যোগাযোগ না আছে কোন সম্পর্ক। সম্পর্ক যে নেই সেটাই বা বলি কিভাবে? এরা সবাই আমাদের
সোভিয়েততুতো ভাইবোন।
এখন যখন এসব লিখছি তখন অনুভব করতে পারছি হাসির মনে হলেও ব্যাপারটা কষ্টের হতে পারত
যদি না আর্কাদি আমাকে চিনত পারত। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই সে পুলিশ ডেকে হাঙ্গামা করতে
পারত। আর যদি বদমেজাজি কেউ হলে কষিয়ে দুই ঘা লাগিয়ে দিলে দিতেই পারত। হয়তো এ কারণে
গুলিয়া সাবধান করে
দেখ বাসা ভুল করে ক্ষতি নেই কিন্তু ভুল করে অন্য মহিলার কাছে গেলে কিন্তু খুন করে ফেলব।
ভাগ্যিস আর্কাদি মহিলা নয়।
ভাল লাগল ।মজার লেখা।
ধন্যবাদ।