ত্যাগ ও বৈরাগ্যের প্রতিমূর্তি সনাতন ও রূপ গোস্বামী
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)
বৈরাগ্য ও ত্যাগের মহিমা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুভব করা কঠিন | আমাদের দেশে যুগে যুগে বেশ কিছু মহৎ মানুষ সমাজ ও সাধারণ মানুষের নানারকম কল্যাণের জন্য আন্তরিক ভাবে সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন, এমনকি নিজেদের অমূল্য প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছেন | তাঁদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বৈরাগ্যের প্রতীক দুই ভাই শ্রীসনাতন ও শ্রীরূপ গোস্বামীদের এই রচনায় স্মরণ করা যাক | ত্যাগ ও বৈরাগ্যের পরাকাষ্ঠার নিদর্শন |
যাঁদের স্মরণে হয় বন্ধন বিমোচন || , (শ্রীশ্রীগৌরভক্তামৃত লহরী , তৃতীয় খণ্ড, প্রথম লহরী , শ্রীকিশোরী দাস বাবাজী , চৈতন্যডোবা , হালিশহর, উঃ চব্বিশ পরগণা)
শ্রদ্ধেয় কিশোরী দাস বাবাজী আরও জানিয়েছেন :-
“…. রূপ সনাতন বল্লভ ভাই তিনজন |
যাঁর বংশে গৌর বিনা নহে অন্যমন ||
তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীজীব গোঁসাই নাম |
সবংশে মিলিয়া করে গৌর গুণনাম ||”… ( ঐ )
নবদ্বীপ লীলায় যেমন বিভিন্ন ভক্ত ও শতাধিক শ্রীগৌরাঙ্গ পার্ষদের মধ্যে মাত্র শ্রীগৌরাঙ্গ সহ বাকী চার জনকে নিয়ে পঞ্চতত্ত্ব বলে সাধনা করা হয় তেমনই শ্রীবৃন্দাবনে শতাধিক শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর অনুগামীদের মধ্যে ছয়জনকে বলা হয় ষড়গোস্বামী |
নবদ্বীপের পঞ্চতত্ত্বরা হলেন :- শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু মাঝখানে , বাঁয়ে শ্রীগদাধর পণ্ডিত ও শ্রীশ্রীবাস আর ডানদিকে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু ও শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্য |
আর শ্রীবৃন্দাবনের ষড় বা ছয় গোস্বামী হলেন :- শ্রীসনাতন, শ্রীরূপ , শ্রীরঘুনাথ ভট্ট , শ্রীগোপাল ভট্ট, শ্রীজীব এবং শ্রীরঘুনাথ দাসগোস্বামী| |
শ্রীবৃন্দাবনের এই ছয় গোস্বামী ছাড়া শ্রীভূগর্ভ গোস্বামী ও শ্রীলোকনাথ গোস্বামীরা আগেই প্রেরিত হয়েছিলেন, প্রেরিত হয়েছিলেন বৈরাগী হওয়া শ্রীসুবুদ্ধি রায় , পরে যুক্ত হলেন শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ এবং আরো অনেকে | এঁরা শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নির্দেশে দক্ষ সৈনিকদের মত নিষ্ঠা একাগ্রতা শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে একের পর এক একটা ভগ্ন বিধ্বস্ত জঙ্গলাকীর্ণ মন্দির , বিভিন্ন মূর্তি বা বিগ্রহ জঙ্গল বা পরিত্যক্ত কূয়ো অন্যকোন জলাশয় থেকে উদ্ধার করা ও পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে লাগলেন | শ্রীগৌরাঙ্গ কর্তৃক প্রশিক্ষিত হয়ে এবং নিজস্ব উচ্চ শিক্ষার সহায়তায় শ্রীসনাতন , শ্রীরূপ, কবি কর্ণপুর প্রমুখ সুলেখকবৃন্দ একের পর এক একটি অমূল্য বৈষ্ণব গ্রন্থের রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন |
এবার আমরা শ্রীবৃন্দাবনের ছয় গোস্বামীর অন্যতম প্রধান মান্য শ্রীসনাতন ও শ্রীরূপ গোস্বামীদের পূর্ব ইতিহাস নিয়ে কিছুটা আলোচনার সুযোগ নিতে চেষ্টা করি:-
আগে আমরা সুদূর কর্ণাটক রাজ্যের রাজ সিংহাসনের দিকে তাকাই – রাজা কর্ণাটক অধিপতি শ্রী নানান গুণে ও নানান শাস্ত্রে অত্যন্ত সুপণ্ডিত ছিলেন, তাই তাঁকে বিভিন্ন পণ্ডিতগণ “বেদসিদ্ধান্ত” উপাধি প্রদান করেন | এই মহারাজের একমাত্র পুত্র অনিরুদ্ধ দেব সাবালক ও যোগ্য হতে বর্ষীয়ান বেদসিদ্ধান্ত পুত্রের উপরে রাজ্যভার সমর্পণ করে নিজে শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মথুরায় বাস করতে চলে যান |
অনিরুদ্ধ দেব অনেক দিন দোর্দণ্ডপ্রতাপে সুশাসন চালিয়ে রাজত্ব পরিচালনা করেছিলেন | তাঁর দুই পুত্র রূপেশ্বর ও হরিহর দেব | এই রাজবংশ বেদান্তসিদ্ধান্তর অনুসরণে দেব উপাধিতে ভূষিত হতেন | তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রূপেশ্বর দেবকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন আর কনিষ্ঠ পুত্র হরিহরকে অনুরাজ হয়ে দুই ভাইকে একসঙ্গে রাজ্য শাসন করতে নিয়োজিত করলেন | আর নিজে দান ধ্যান করে কলিন্দ নন্দিনী তথা যমুনার পুণ্যতটে বাস করার জন্য ঘর ছাড়লেন |
যুবরাজ রূপেশ্বর সর্বশাস্ত্রে অধিকারী ও সদনুষ্ঠানে ব্রতী ছিলেন | অন্যদিকে কনিষ্ঠ ভাই অনেক বেশী বলশালী, অনর্থপ্রিয়, হিংস্রক ও নির্দয় ছিলেন | রাজ্যের মধ্যে ও বাইরে বড় ভাইয়ের যশগাথা শুনে শুনে জিগীষার বশবর্তী হয়ে রাজা রূপেশ্বরের বিনাশ সাধনের কু-মন্ত্রণায় লিপ্ত হয়ে ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন | বিচক্ষণ রূপেশ্বর কাউকে জানতে না দিয়ে মন্ত্রীকে ডেকে ছোটভাইকে রাজসিংহাসনে বসাবার নির্দেশ দিয়ে নিজে এক পরিচারক, এক পরিচারিকা এবং সহধর্মিনীসহ উৎকলের দিকে এগোতে লাগলেন ।
(ইতিহাসের অংশটি ডঃ ফণী পাল কৃত ধনকৃষ্ণ অধিকারী রচিত শ্রীল শ্রীযুক্ত সনাতন গোস্বামী ও শ্রীরূপ গোস্বামীর জীবন চরিত্র গ্রন্থ , লোক সংস্কৃতি পরিষদ , 13/30 অশোক এভেন্যু , দুর্গাপুর – 713 204, বর্ধমান , কর্তৃক প্রকাশিত , দ্বিতীয় প্রকাশ থেকে সংকলিত |)
এরপর একদিন নীলগিরিতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ দেবের মন্দিরের ভেতরের জগমোহনে সপরিবারে জগতের ঈশ্বর দর্শন করার আগে রূপেশ্বর ও বর্ধমানের রাজা সপরিবার মহেন্দ্রসিংহের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আলাপ হয় | পরবর্তীকালে উভয়ে উভয়ের সঙ্গে পরিচিত হন | একসময় উভয় পরিবার বিভিন্ন তীর্থস্থানে ঘুরতে ঘুরতে মার্কণ্ডেয় তীর্থে এসে ক্ষেত্রপুরোধার মন্ত্র পর্যায়ানুক্রমে উভয়েই স্নান তর্পণ ইত্যাদি করে পরম পবিত্র জল একজন একজনের হাতে দিয়ে পরস্পর পরস্পরকে বন্ধু সম্বোধন করলেন | পরে রূপেশ্বর যে রাজনন্দন তা জানতে পেরে মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ বন্ধুর মধুর ব্যবহারে এতই বিমোহিত হয়েছিলেন যে তিনি রূপেশ্বর দেবকে তাঁরই রাজপ্রাসাদে সমান রাজকীয় মর্যাদায় থাকতে অনুরোধ করলেন | বন্ধুর ঔদার্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর আতিথ্য গ্রহণ না করে পারলেন না | তিনি বন্ধুর রাজকার্য পরিচালনায় মন্ত্রীর মত সহযোগিতা করতে লাগলেন |
এরপর একসময় রূপেশ্বর দেবের পত্নীর গর্ভে এক সুন্দর পুত্রের জন্ম হলো | রূপেশ্বর জগন্নাথ দেবের নামানুসরণে পুত্রের নাম রাখলেন পদ্মনাভ | (ঐ পূর্বোক্ত)
এই পদ্মনাভ থেকেই সনাতন রূপের আবির্ভাব | পদ্মনাভ রাজপণ্ডিত যদুজীবন তর্কপঞ্চাননের একমাত্র কন্যা রমা দেবীক বিবাহ করেন | নিজ পিতা ও শ্বশুর লোকান্তরিত হলে পদ্মনাভ নবহট্ট (বর্তমানের নৈহাটি) গ্রামে বাস করেছিলেন | সেখানেই তাঁর আঠারোটি ও পাঁচটি পুত্র জন্মগ্রহন করে | তাঁদের কনিষ্ঠের নাম মুকুন্দ |
রত্নাকরে নরহরি দাসের বর্ণন:-
“… শ্রীসর্বজ্ঞ জগদ্ গুরু বিপ্ররাজ নাম |
কর্ণাট দেশ অধিপতি সর্বগুণ ধাম ||
যজুর্বেদী ভরদ্বাজ গোত্র হয় তাঁর |
সর্ব নরপতি পূজ্য বিক্রম যাহার ||
তাঁর পুত্র অনিরুদ্ধ সর্ব গুণবান |
রূপেশ্বর হরিহর দুই পুত্র তান ||
হরিহর রূপেশ্বরের রাজ্য কারি নিল |
রূপেশ্বর পৌলস্ত্য রাজ্যে আবাস গড়িল ||
মিত্র শিখরেশ্বর স্থানে তথায় রহিল |
পদ্মনাভ নামে পুত্র তথায় জন্মিল ||….”
(শ্রীশ্রীগৌর ভক্তামৃত লহরী , তয় খণ্ড, কিশোরীদাস বাবাজী) ইতিমধ্যে পদ্মনাভ বৃদ্ধা শ্বাশুরীর উত্তরাধিকারী’ হয়ে বাকলাচন্দ্র দ্বীপে বাস করতে লাগলেন | মুকুন্দ দেবের পুত্রের নাম কুমার দেব | এই পুত্র কুমারদেব ও পিতা মুকুন্দদেবকে পূর্বদেশ বাকলা থেকে মোরগ্রাম মাধাইপুরে উপযুক্ত পাত্রীর জন্য ঘটকের সঙ্গে এসে পাত্রীর পিতার পণ্ডিত খ্যাতনামা বিশারদগৃহে উপস্থিত হলেন | পাত্র ও পাত্রী নির্বাচিত হলে এই মোরগ্রাম (মটুকগ্রাম) মাধাইপুরেই কুমারদেবের বিবাহ সম্পন্ন হয় |
এই গৃহে একমাত্র কন্যার জন্য কুমারদেব শ্বশুরালয়েই রয়ে গেলেন এবং নিকটস্থ রাজধানী গৌড় নগর স্থায়ী বাসস্থানের জন্য উপযুক্ত মনে করলেন |
কুমার দেবের এক এক করে তিন পুত্র হল | এঁরা হলেন সনাতন , রূপ ও অনুপম (বল্লভ)| রাজধানীর জন্য বহু দেশী বিদেশী উচ্চ শিক্ষিত ও বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তির আনাগোনা | ফলে তিনজনই বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী হয়েছিলেন এবং প্রয়োজনে দেশের বাইরে গিয়েও শিক্ষা গ্রহণ করলেন | সনাতন,রূপ ও অনুপম বা বল্লভ এই তিন ভাইই ব্যাকরণাদিতে যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন | জানা যায় , তাঁদের অন্যতম শিক্ষক গুরু ছিলেন বিদ্যাবাচস্পতি মহাশয় | এবং সনাতন অল্প বয়সেই বৈষ্ণবধর্মানুরাগী ছিলেন |
অন্যদিকে তখন গৌরের সিংহাসনে বাদশাহ ছিলেন হুসেন শাহ | মেজাজী বাদশাহ জৈনেক রাজমিস্ত্রীর ইটের কাজের প্রশংসা করে তাকে জল গড়ের পাশেই অনুপম সুদৃশ্য মন্দিরা তৈরী করার বরাত দেন | অল্প সময়ে এই মন্দিরা প্রায় তৈরী হওয়ায় বাদশাহ পরিদর্শন করতে এলেন | এই সৌধের উপরে ওঠা ও নামার জন্য শঙ্খের ভেতরের মত চক্রাকারে সিঁড়ি দেখে হুসেন শাহ বিমুগ্ধ হয়েছিলেন | তখনো ছাদ তৈরীর কাজ বাকি ছিল | তিনি বললেন – আমার কাছে যেমন ভেবেছিলাম, তার চাইতে অনেক বেশী সুন্দর লাগছে |”
তা শুনে ভাবে গদগদ হয়ে রাজমিস্ত্রি পিরু বড় মুখ করে বলতে লাগলেন – বাদশাহ, আপনি আমার করা যে সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন , তাতো খুবই সামান্য , আমি এর চাইতে আরও বেশী সুন্দর করে বানাতে পারি |”
সঙ্গে সঙ্গেই বাদশাহ হুসেন শাহ রাগতঃ স্বরে বললেন – তুই যদি এর চেয়েও ভাল করতে পারিস , তাহলে করিসনি কেন ? আমার এখানে কি মাল মসলার অভাব হয়েছিল ?” এই কথা বলে হুসেন শাহ কাছে দাঁড়ানো পাঠান ভৃত্যকে আদেশ দিলেন – সরফরাজ খাঁ , তুমি এই পিরুকে ঐ মন্দিরার উঁচু থেকে নীচে ফেলে দাও |” যেমন আদেশ তেমনই কাজ | হতভাগ্য রাজমিস্ত্রীর সমস্ত হাড়গোড় ভেঙে শরীর দলা পাকিয়ে গেল | পরবর্তীকালে সৌধের কাজ শেষ হলে নামকরণ করা হোল ‘ পিরুসা মন্দিরা ‘ |
এই ঘটনার পর ঐ সৌধের ছাদ তৈরীর জন্য অন্য এক রাজমিস্ত্রী আনানোর জন্য হিঙ্গা নামের এক ঘোড়সওয়ার পেয়াদাকে তাড়াতাড়ি মোরগ্রাম মাধাইপুরে গিয়ে খোঁজ করে আনতে বলার আগেই তাঁকে পেছন থেকে তাঁরও বেশী সম্মানীয় মুরসিদ ডাকলে তিনি নির্দেশ মাঝ পথেই থামিয়ে মুরসিদকে অভিবাদন ও আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন | ফলে পেয়াদা অসমাপ্ত নির্দেশ নিয়েই মাধাইপুরে চলে যায় এবং ইতস্তত ঘুরতে লাগলো | বাদশাহ তাকে মোরগ্রাম মাধাইপুর যাবার নির্দেশমাত্র দিয়েছিলেন , আর কিছু জানতে পারেনি | এই এলোমেলো ঘোরা পেয়াদাকে নিজ গৃহ থেকেই দেখে সনাতন রূপকে ব্যাপার কী জানতে বললে শ্রীরূপ পেয়াদাকে ডেকে আদ্যোপান্ত প্রশ্ন করে ঘটনার অবস্থান জেনে আন্দাজ করলেন যে মাধাইপুর থেকে কয়েকজন রাজমিস্ত্রী নিয়ে গেলেই কাজ হতে পারে | ঐ পেয়াদা রূপের কথামত তা-ই করল , ভুল হলে বাদশাহ হুসেন শাহকে এঁদের কথা জানাবে, ঠ্যালা এঁরাই সামলাবেন আর এঁদের বাড়িও চেনা রইল | কয়েকজন রাজমিস্ত্রী নিয়ে ঐ পেয়াদা গৌড়নগরে বাদশাহ হুসেন শাহের কাছে পৌঁছলে তিনি সব দেখে বিস্মিত হলেন | পেয়াদা ভুল হয়েছে মনে করে রূপ ও সনাতনের ঘাড়ে দোষ চাপাতে তাঁদের কথা জানায় | বাদশাহ পেয়াদাকে জিজ্ঞেস করে সবটা জানলেন | এত বুদ্ধিমান ব্যক্তি কে হতে পারেন ভেবে তখনই নগর কোতোয়াল কেশব ছত্রীকে পাল্কিসহ ঐ একই পেয়াদা হিঙ্গাকে বাড়ি চিনে তাঁদের আনতে পাঠালেন |
যথাযথ সম্মান করে পেয়াদা হিঙ্গার চিহ্নিত দুই ভাই সনাতন ও রূপকে আনা হলে হুসেন শাহ তাঁদের নিরুপম সৌন্দর্য্য ও অঙ্গসৌষ্ঠব দেখেই বিমোহিত হয়ে গেলেন | নাম জিজ্ঞেস করলেন | জানতে পারলেন এঁরা দুই ভাই শুধু বিদগ্ধ পণ্ডিতই নন , যথেষ্ট পরিমাণ ব্যবহারিক বুদ্ধিও ধরেন , না হলে অব্যক্ত কথাও কিকরে পেয়াদাকে বলে দিতে পারলেন ! বাদশাহ হুসেন শাহ সনাতনকে মন্ত্রী ও রূপকে অণু মন্ত্রীর পদে বরণ করে নিলেন | সঙ্গে সঙ্গে সনাতনকে ‘দবিরখাস’ আর রূপকে ‘সাকর মল্লিক’ উপাধি প্রদান করলেন |
সনাতন ও রূপ মন্ত্রী হয়ে কাজের সুবিধার জন্য দরবারের কাছাকাছি স্থানে নিজেদের বাসাগৃহ ঠিক করলেন | মাঝে মাঝেই মাধাইপুর যেতে হত | সঙ্গে থাকত হাতি , ঘোড়া , শিবিকা, পদাতিক বাহিনী ইত্যাদি | সেজন্য রূপ বা সাকর মল্লিক মাধাইপুরের কাছাকাছি বাড়ি তৈরী করে অনেক প্রজা বসতি বসিয়ে নবগ্রামের নাম সাকরমল্লিকপুর রেখেছিলেন | সনাতন ও রূপের আলাদা বাড়ি ছিল | রূপের বাড়ির নাম রাখা হয়েছিল গির্দাবাড়ি | তার পাশে একটি বড় জলাশয় কাটানো হয়েছিল , নাম দেয়া হয়েছিল রূপসাগর |
সনাতনের বাড়ির নাম ছিল বড় বাড়ি, তার পাশে একটি জলাশয় তৈরী করিয়েছিলেন , তাকে সনাতন সাগর বলা হোত | বলা যায় বাদশাহ হুসেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় রাজ্যশাসনের গুরু দায়িত্ব থাকায় সনাতনের পক্ষে কখনই তাঁর মনের সাধ মিটিয়ে তীর্থ ভ্রমণ করা সম্ভব হয়নি| এমনকি তাঁকে প্রজা সাধারণ হুসেন শাহর পরবর্তী জন বলেই মনে করত | তাই বোঝা যায় তিনি ভীষণ কর্মব্যস্ত থাকতেন | তিনি ব্রজের বিগ্রহ শ্রীমতী রাধারাণী সহ মদনমোহন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত করেন এবং রাধাকুন্ড , শ্যামকুন্ড আর অষ্টসখীদের জন্য বিভিন্ন কুণ্ডের প্রকাশ করেন | এসব করে একাগ্রচিত্তে নিজ মনে ব্রজভাব রেখে বাহ্যাড়ম্বরে রাজকার্য সম্পাদন করতেন | এই দুই ভাইই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচন্দ্রের ভাবে সবসময় বিভোর হয়ে থাকতে ভালবাসতেন | একদিন শ্রীসনাতন স্বপ্নের মধ্যে দেখলেন শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু তাঁকে বলছেন – সনাতন , আর দেরী করোনা, জীবের উদ্ধার জন্য ব্রজের মঞ্জরী দেহ পরিত্যাগ করে এসেছ | এবার তোমরা দুই ভাই বৃন্দাবনে গিয়ে লুপ্ত তীর্থ গুলি উদ্ধার কর আর শ্রীভগবদ্ভক্তি শাস্ত্র প্রণয়ন করে জীবের সদ্গতির সোপান নির্মাণ কর |” এই স্বপ্নে দুই ভাই অনেক ধৈর্যধরে দুজনে মিলে মহাপ্রভু দৈন্য প্রকাশ করে তাঁর কাছে পত্রী লিখলেন |
শ্রীশ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ পরবর্তীকালের রামকেলীতে মহাপ্রভুর আগমন ও দুই ভাইয়ের তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন –
“দৈন্য পত্রি লিখি মোরে পাঠাইলে বার বার |
সেই পত্রি দ্বারায় জানি তোমার ব্যবহার ||”
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব মাত্র চব্বিশ বছর নবদ্বীপে বাল্য কৈশোর কাটিয়ে বিদ্যাভ্যাস সমাপন করে ঈশ্বরপুরীর কাছে শ্রীকৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আপামরর জনসাধারণের মধ্যে জাতি ধর্ম বর্ণ পণ্ডিত মূর্খ নির্বিশেষে সকলের মধ্যে হরিনাম বিতরণ করে কাটোয়ায় শ্রীকেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস মন্ত্র গ্রহণ করেন | তারপর নীলাচলে থেকে সুদূর দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিম ভারতের কিছু অংশে প্রায় দুবছর ধরে পরিভ্রমণ করে সকলের মধ্যে হরিনাম বিলিয়ে আবার পুরী হয়ে বৃন্দাবন যাবার মানসে ভাগীরথী হয়ে বিভিন্ন পার্ষদ ও ভক্তগণ সহ গৌড়নগর রামকেলী এলেন | আসার পথে অসংখ্য মানুষ তাঁকে অনুগমন করে রামকেলীতে এলেন |
এবার ধনকৃষ্ণ অধিকারী রচিত পূর্বোক্ত গ্রন্থের হুবহু উদ্ধৃতি করা যাক –
“…..বহুজন কৃত অত্যুচ্চ হরি হরি কলধ্বনি শ্রবণ মাত্র গৌড়পতি হুসেনসাহ চমত্ কৃত ও ত্র্যস্ত হইয়া দবিরখাস প্রতি জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, মন্ত্রি ! ঐ যিনি সঙ্খাতীত জন সমভিব্যাহারে সমাগত হইয়াছেন, ইঁহার আগমনে আমার চিত্তে ভয়ের সঞ্চার হইয়াছে | যেহেতু আমি আদেশের অনুগমনার্থে বহু লোক নিযুক্ত করিয়াছি বটে কিন্তু সকলেই শ্রম বিনিময়ে বেতন পরিগ্রহ করিয়া থাকে | দেখ মন্ত্রি ! সঙ্খ্যাতীত মনুষ্য অর্থ বাধ্য না হইয়াও যাহার অনুগত হইয়াছে , তাঁহা হইতে রাজবিদ্রোহ হইবে আশ্চর্য্য কি ?
সনাতন কহিলেন, – নরেন্দ্র ! আপনি যে রাজবিদ্রোহের প্রয়োগ করিলেন ইহা অর্থান্তরে সত্য অর্থই প্রতিপাদন করিয়াছে , সন্দেহ নাই , কারণ বর্তমান যুগাধিপতি কলিরাজ অধর্ম্ম, দস্যুতা, হিংসা, অসত্য ও কপটাদি অমাত্যবর্গের আনুকূল্যে অধিকার বিস্তার করিয়াছেন, তদ্বিদ্রোহ জন্যই সমাগত চৈতন্যদেব ত্রিতাপ বিজয়ী হরিনামাস্ত্র ধারণ করতঃ সমরার্থ দণ্ডায়মান হইয়াছেন | নরেশ ! আপনার প্রতি বিদ্রোহ উদ্দেশ্য তাঁহার কিঞ্চিন্মাত্র দেখিতেছি না ; ইনি হিন্দুশাস্ত্র কুলের ভক্ত ভাবাত্মকারী গূঢ়াবতার, ইঁহার মহিমা শ্রবণ করুন | যাঁহার ইচ্ছায় অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড উদ্ভূত হইয়া কালে বিলয় প্রাপ্ত হয় , যাঁহার ইচ্ছায় সুধাংশু ও অংশুমালী উদয় অস্ত দ্বারায় ভূ-লোকের হিত সাধন করিতেছেন, যাঁহার ইচ্ছায় ত্রিগুণাবতার আপন আপন গুণ ক্রিয়া সম্পাদনে সমর্থ হইয়াছেন , সেই অজিত অনবচ্ছিন্নানন্দ পুরুষ যুগ ধর্ম্ম পালনার্থ চৈতন্য নামে অভিহিত হইয়া আপনার অধিকারে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন | নরনাথ ! আপনার সদৃশ সুকৃতি শ্রেষ্ঠ নরেন্দ্র কে আছে ?…. ” একদা মুরসীদ গৌড়পতি হুসেনশাহকে এরকম ভবিষ্যৎ বাণীই দিয়েছিলেন মনে করে কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে গৌড়পতি সনাতনের প্রতি বললেন – দবিরখাস ! যদি নৃপবেশধারী ঈশ্বর আমার গৌড়নগরে আগমন করিয়াছেন, তবে তাঁহাকে গণ সহ উপযুক্ত বাসা প্রদান করত অশনাদির ব্যয় রাজ্যধনাগার হইতে সম্পন্ন করিতে হইবে | দেখ মন্ত্রি ! তাঁহার ইচ্ছানুরূপ কার্য্যে কদাচ ত্রুটি করিবে না |…”
(ডঃ ফণী পাল সম্পাদিত ধনকৃষ্ণ অধিকারী রচিত পূর্বোক্ত গ্রন্থ)
এরপর গৌড়েশ্বরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দবিরখাস ও সাকর মল্লিক দুই ভাই নিজ নিজ বাসায় রাজকীয় পোষাক ছেড়ে সামান্য দিন হীনের পোষাক পরে রামকেলী গ্রামে কেলি কদম্বমূলে যেখানে শ্রীচৈতন্য তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে হরিনাম সঙ্কীর্তনে মেতে ছিলেন , সেখানে গেলেন | এই দুই ভাইকে আসতে দেখেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত বাড়িয়ে নিজ বক্ষে ধারণ করতে গেলেন | এই দুই ভাইয়ের দৈন্যতাবশে আপত্তি থাকলেও শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু জোর করে আলিঙ্গন করলেন | তাঁদের এই প্রথম মিলন সম্ভবত জৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তিতে ( 1513 খ্রীষ্টাব্দে) হয়েছিল | মহাপ্রভু আষাঢ়ের দ্বিতীয় দিনই কানাই নাটশালা পথে শান্তিপুরে ফিরে আসেন |
“ভক্তাধীন গৌরচন্দ্র ভক্তের কারণ |
বৃন্দাবন যাত্রা ছলে কৈল আগমন ||
রামকেলি গ্রামে প্রভু হৈল উপনীত |
গুপ্তে রূপসহ আসি হইল প্রণত ||
দন্তে তৃণ ধরি বহু করয়ে স্তবন |
নিজ অভিপ্রায় তবে করে নিবেদন ||
বিষয় বিষ্ঠা গর্ভ হোতে উদ্ধার আমারে |
অনুক্ষণ ভাসি যেন প্রেমের সাগরে ||
প্রভু কহে দুই ভাই মোর নিত্য দাস |
অচিরে কাটাবে কৃষ্ণ যত মায়া ফাঁস ||”
(শ্রীশ্রীগৌরভক্তামৃত লহরী , তৃতীয় খণ্ড, কিশোরীদাস বাবাজী)
রামকেলিতে শ্রীচৈতন্যদেবকে দেখার পর থেকেই সনাতন ও রূপের পাগলপ্রায় অবস্থা | আর দেরী করা যাবে না | এবার বেরিয়ে পড়তে হবে | ততদিনে বাংলার প্রাণস্বরূপ শ্রীচৈতন্যদেব পুরী থেকে ঝাড়িখণ্ড পথে বলভদ্র ও তাঁর পাচক ব্রাহ্মণ সহ বৃন্দাবনের পথে চলে গেছেন | লোক মারফত্ তা জানতে পেরে সনাতন ও রূপের শরীরে অদ্ভুত পুলকের হল এবং শ্রীগৌরপ্রেমে তাঁদের বক্ষ চোখের জলে ভেসে লাগলো |
এদিকে রূপ ছোট ভাই অনুপমের সঙ্গে এক নির্জন ঘরে বসে মন্ত্রণা করলেন পরদিন রাত পোহানোর আগেই সব কিছু ছেড়ে শ্রীচৈতন্য দর্শনের জন্য বেরিয়ে পড়বেন | অনুপমও দুই দাদা সনাতন ও রূপের মতাই বিদ্বান ছিলেন আর বাদশাহ হুসেন শাহের দরবারে খাজাঞ্চি পদের দায়িত্বে বহাল ছিলেন | রূপ অনুপমকে জানালেন – তুমি এই খবর আগেই দাদাকে জানিও না | জানলে হয়তো বলবেন এখনই ! চলো আমরা যাই অথবা তিনিই আগে যেতে চাইবেন, আমাকে যাবার অনুমতি দেবেন না |”
অনুপম বললেন – কিন্তু আমিও যে আপনার সঙ্গে যাবার জন্য আগ্রহী |” রূপ ‘অনুপমের এ কথার কোন উত্তর দিলেন না |
অনুপমের মনে পড়ল, এর মধ্যে একদিন বড় সনাতন বলেছিলেন – ভাই অননুপম , তুমি কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হলে মনে খুব আনন্দ হতো |”
অনুপম মাথা নীচু করে নীরব থাকলেন | বড় ভাই পিতা সমান সম্মানীয়, তাঁর প্রতি কথায় জবাব দেয়া অনুচিত | তবুও তিনি বলেছিলেন – আমিতো শ্রীরামের স্মরণাপন্ন |”
সনাতন তাঁকে জানিয়েছিলেন – ভাই , রাম আর কৃষ্ণে কোন ভেদ নেই | জগন্মনোরমণ শক্তি নিয়ে যিনি রাম তিনিই জগম্মনোহরণ শক্তি নিয়ে হরি নামে অভিহিত | তাঁর থেকেই তারকব্রহ্মনাম –
” হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে |
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে || “
রূপ তাঁর ভাই অনুপম তথা বল্লভকে মাথায় হাত দিয়ে বললেন – ভাই মায়ামুগ্ধ হয়ে আর কেঁদোনা | গৌড়পতির দরবারে তোমার খাযাঞ্চির পদ চির স্থির থাকুক | তুমি স্থির সুখে জীবন বাহিত কর, তোমাকে আশীর্বাদ করি | “
তবুও অনুপম শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের কথা স্মরণ করে যে একদিন না একদিন দুস্কৃতির ফল পেতেই হবে , অনন্তকাল পর্যন্ত মনে রেখে অনুপম রূপের সঙ্গে শ্রীগৌর দর্শনের জন্য যেতে লাগলেন | অবশ্য শ্রীরূপ জ্যেষ্ঠ শ্রীসনাতনের জন্য চিঠি লিখে পাঠানোর ব্যবস্থা করে এসেছেন :-
“আমি দুই ভাই চলিলাম তাঁহারে মিলিতে |
তুমি যৈছে তৈছে ছুটি আইস তাহা হৈতে ||
দশ সহস্র মুদ্রা তথা আছে মুদিস্থানে |
তাহা দিয়া কর শীঘ্র আত্মবিমোচনে ||”
(শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজকৃত , মধ্যলীলা, ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ)
দুজনে অতি সঙ্গোপনে হাবাস খানার ঘাটে এসে নৌকায় গঙ্গা পার হয়ে এগোতে লাগলেন | বন জঙ্গলের পথে দুই ভাই এগারো দিন পর কাশীধামে পৌঁছে পরদিন ব্রহ্ম মুহূর্তে প্রয়াগ ধাম পর্যন্ত এগিয়ে শুনলেন ততদিনে মহাপ্রভু বৃন্দাবন ঘুরে ফিরে এসে এই প্রয়াগ ধামেই বিন্দু মাধবের গৃহে আছেন | এই খবরটা শুনে দুই ভাইয়ের আর আনন্দের সীমা রইলো না | শ্রীচৈতন্যদেবের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রেমে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে তাঁর শ্রীচরণে লুটিয়ে পড়লেন | রূপ ও অনুপমের সব বিষয়সম্পত্তি ত্যাগ করে চলে আশায় শ্রীমন্মহাপ্রভু প্রীত হলেন |
“শ্রীরূপ দেখি প্রভু প্রসন্ন হইল মন |
উঠ উঠ রূপ আইস বলিলা বচন ||
কৃষ্ণের করুণা কিছু না যায় বর্ণন |
বিষয় কূপ হৈতে কাঢ়িল দুই জন ||”
(ঐ)
শ্রীমন্মহাপ্রভু দুই ভাইকে দেখে একটি শ্লোক আবৃত্তি করলেন –
“ন মে ভক্তশ্চতুর্ব্বেদী মদ্ভক্তঃ স্বপচঃ প্রিয়ঃ| তস্মৈ দেয়ং ততো গ্রাহ্যং স চ পূজ্যো যথা হ্যহম্ ||” (ঐ এবং
হরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে ধৃত)
সেখানে শ্রীচৈতন্যদেব উভয় ভাইকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন | এরপর দুই ভাইকে নিয়ে শ্রীমন্মহাপ্রভু প্রসাদ পাইয়ে ত্রিবেণীর উপরে বাসায় তাঁর কাছেই রেখে দিলেন | শ্রীরূপের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে তাঁকে প্রশিক্ষিত করলেন | –
“লোকভিড়ভয়ে প্রভু দশাশ্বমেধ যাইয়া | রূপগোসাঞিকে শিক্ষা করেন শক্তি সঞ্চারিয়া ||
কৃষ্ণভক্ত ভক্তিতত্ত্ব রসতত্ত্ব প্রান্ত |
সব শিক্ষাহল প্রভু ভাগবতসিদ্ধান্ত ||
রামানন্দ-পাশে যত সিদ্ধান্ত সুনীল |
রূপে কৃপা করি তাহা সব সঞ্চারিলা |
শ্রীরূপ-হৃদয়ে প্রভু শক্তি সঞ্চারিলা |
সর্ব্বতত্ত্ব নিরূপিয়া প্রবীণ করিলা ||”
( ঐ )
এদিকে গৌড়পতি হুসেনখাঁ বা সৈয়দ বংশের হুসেন খাঁ এক সময়ে সুবুদ্ধিরায় জমিদারের অধীনে চাকরি করতেন | একবার জমিদার সুবুদ্ধিরায় একটি জলাশয় খনন কাজে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন | তাঁর কাজে গাফিলতি হওয়ায় জমিদার তাঁকে চাবুক দিয়ে মারতে থাকেন আর রাগের মধ্যে ঊরুদেশে চাবুক পড়ায় বেশ কিছুটা রক্তপাত হয় এবং চিরস্থায়ী দাগ থেকে যায় | এসময়ে গৌড়ের সিংহাসনে আছেন হুসেনশাহ আর সামান্য জমিদারই রয়ে যান সুবুদ্ধিরায় | একদিন রাত্রে গৌড়পতির বেগমের নজরে পড়ে যায় ঐ চিহ্ন | চিহ্নের কারণ সবিস্তারে জানত চাইলেন | সব শুনে তিনি স্বামী গৌড়পতিকে জমিদার সুবুদ্ধি রায়কে মৃত্যুদণ্ড দেবার আর্জি জানালেন | না হলে তিনি নিজেই আত্মঘাতী হবেন জানালেন | অথচ হুসেন শাহ তাঁর একসময়কার প্রতিপালক জমিদারের প্রাণ হরণের কথা ভাবতেও পারতেন না | অথচ নিজ বেগমকে খুশিই রাখা চাই | সঙ্গে সঙ্গে ঐ গভীর রাত্রেই ডাক পড়ল প্রধান মন্ত্রী দবির খাসের |
সে সময় দবিরখাস তথা শ্রীসনাতন (সনাতন ও রূপ দুই ভাইয়েরই নামকরণ মহাপ্রভুই করেন)
একমনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, রূপ ও অনুপমের কথা ভাবছিলেন | হঠাত্ এই গভীর রাত্রে, প্রতিপদের দ্বিতীয় প্রহরের অন্ধকারে, বজ্রবিদ্যুত্ সহ ঝড়জলের মধ্যে বাদশাহের তলব ! এসময় তো দরবারের সময় নয় , নিশ্চয়ই কোনও ব্যক্তিগত কারণ হবে – এই ভেবে অগত্যা তিনি ছুটলেন হুসেন শাহের প্রাসাদের দিকে | সবটা শুনে তিনি বেগম সাহেবাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন | বেগম সাহেবা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন | তাঁকে আরো বোঝাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বোঝালেন মৃত্যু ঘটানো আর জাতি হানি করা তো একইরকম তাইনা ? ততক্ষণে বেগম সাহেবা রাজী হলে, দবিরখাস নামধারী সনাতন বাদশাহকে তা-ই করতে বললেন | বেগম সাহেবার আত্মহনন রোধ হল এবং একজন ব্রাহ্মণ জমিদার সুবুদ্ধি রায়ের জীবন রক্ষা পেল ভেবে বাদশাহ হুসেন শাহ মানসিক স্বস্তি পেলেন | আর সনাতন ভাবলেন , জাতি নষ্ট হলে শাস্ত্রমতে প্রায়শ্চিত্ত করলেই জাতি ফিরে পাওয়া যেতে পারে | (পরবর্তীতে অনেকের সামনে বাদশার বদনার কয়েক ফোঁটা জলে সিক্ত করে জাতি নষ্ট হল বলে ঘোষণা করা হয়|)
পাল্কিতে চড়ে ফেরার পথে এক তালপাতার ছাউনিতে , শুনতে পেলেন ঝড়বৃষ্টির মধ্যে এই গভীর রাত্রে সশব্দে কে যায় প্রশ্নের উত্তরে এক ভিখিরিণীকে ভিখারী বলছিল, নিশ্চয়ই কোন পরাধীন ব্যক্তি | দেশের রাজা বা কারোর মালিক না ডাকলে কেউ রাস্তায় বের হয় নাকি ? কথাটা শুনে সনাতন ভাবলেন, আর দেরী করা নয় , এবার সময় হয়েছে বেরিয়ে পড়ার |