ছোট গল্পঃ রাখি – দেবাংশু সরকার

রাখি
দেবাংশু সরকার

সোম আমাদের পাড়ার গর্ব। ছোট থেকেই সে ভীষণ দুরন্ত, ডানপিটে। পড়াশোনাতে খুব ভালো না হলেও, খুব খারাপ নয়। কিন্তু ফুটবল খেলার মাঠে সে চাম্পিয়ন। পাড়ার ক্লাবের হয়ে এদিকে ওদিকে খেলতে গিয়ে সে মাঠ মাতায়। জন্মগত প্রতিভা তার। বল তার পায়ে পড়লে যেন তার পোষা বিড়াল হয়ে যায়। সোমের পায়ের শৈল্পিক ছোঁয়া বিপক্ষ দলকে নাকানি চোবানি খাইয়ে ছাড়ে। সোমের এই শৈল্পিক ফুটবল, চুম্বকের আকর্ষণের মত শয়ে শয়ে দর্শককে মাঠে টেনে আনে। নিয়মিত সে কখনো কাপ, কখনো শিল্ড, কখনো ক্যাশ প্রাইজ জিতে বাড়িতে নিয়ে আসে।
এমন এক টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে সোম নজরে পড়ে যায় প্রখ্যাত কোচ অশোক সেনের। কথায় আছে জহুরী জহর চেনে। জহুরী অশোক সেন খালি পায়ে কাদা মাঠে খেলতে থাকা আসল জহরকে চিনতে ভুল করেননি। অশোক সেন সোমকে একজোড়া খেলার বুট উপহার দেন এবং ময়দানে তার ক্লাবে অনুশীলনের ব্যবস্থা করে দেন। খালি পায়ে খেলতে অভ্যস্থ সোমের প্রথমে কিছুটা অসুবিধে হলেও, কিছু দিনের মধ্যেই সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তার পরেই বড় মাঠে তার চমক দেখাতে শুরু করে। তার পায়ের কাজ, অনায়াসে দুতিন জনকে কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া, গোল লক্ষ করে জোরালো সট নেওয়া ক্রমশ সোমকে পাদ প্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে । কয়েক বছরের মধ্যেই আসে বড় দলে খেলার হাতছানি। বড় দলে খেলার স্বপ্নপুরণ হয় তার। এরপর সে ডাক পায় বাংলা দলের হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলার।
বড় মাপের কোচেদের হাতে পড়ে আরো নিখুঁত আরো শানিত হয় সোমের খেলা। বাংলা দলে সুযোগ পেয়েই দর্শকদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। পরপর পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, কেরলকে সোমের গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে বাংলা। সেখানেও সোমের ম্যাজিক। গোয়ার বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে বাংলাকে চাম্পিয়ন করে সে।
চাম্পিয়ন হওয়ার পর সেলিব্রেশন, আনন্দ উচ্ছ্বাস, খাওয়া দাওয়া সারতে সারতেই বিশেষ খবরটা পায়। আসন্ন এশিয়াডের জন্য ভারতীয় দলে সে সুযোগ পেয়েছে।
সন্তোষ ট্রফি জেতার পর সোম নিজের এলাকায় রীতিমত সেলিব্রিটি। প্রত্যেক দিন কেউ না কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য অভিনন্দন জানায়। বিভিন্ন সংবর্ধনা সভায় তাকে যেতে হচ্ছে। আপাতত চার মাসের বিশ্রাম। তারপর শুরু হবে এশিয়াডের প্রস্তুতি শিবির।
এমন এক সরকারি সংবর্ধনা সভায় এসেছে সোম। হল ভর্তি লোক। স্থানীয় পুরসভার চেয়ারম্যান এসেছেন সেই সভায়। আছেন অনান্য কাউন্সিলার এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও। স্টেজে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করছে নমিতা বোস নামের এক স্থানীয় গায়িকা। এরপর হবে কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তারপর মুল অনুষ্ঠান। দর্শক আসনের প্রথম সারিতে বসে আছে সোম। তাকে ঘিরে বেশ কিছু শিশু শিল্পী সেলফি তুলতে ব্যস্ত। সোম হাসি মুখে তাদের আব্দার মেটাচ্ছে।
স্টেজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে গাইতে নমিতার নজর চলে যায় সোমের দিকে। সোমের মুখের উপর নজর আটকে যায় নমিতার। মাগুরে রঙা, সুদর্শন সোমের মধ্যে যেন নিজের কেষ্ট ঠাকুরটিকে খুঁজে পেয়ে, রাধাভাব জেগে ওঠে নমিতার মধ্যে। গান শেষ করে স্টেজ থেকে নেমে এক শিশু শিল্পীকে সরিয়ে, সোজা গিয়ে বসে পড়ে সোমের পাশের চেয়ারে। ব্যাগ থেকে ছোট একটা নোট বই বের করে সোমের দিকে এগিয়ে দেয় অটোগ্রাফের জন্য। নমিতা জীবনে কোনো দিন ফুটবল খেলা না দেখলেও, ফুটবল নিয়ে জমিয়ে গল্প জুড়ে দেয় সোমের সঙ্গে। জানতে চায় ফুটবলার সোমের উত্থানের কাহিনী। শুনতে শুনতে ‘দারুন’, ‘সুপার্ব’ প্রভৃতি শব্দ বের হতে থাকে নমিতার মুখ থেকে। সোমের খারাপ লাগে না একজন সুন্দরী মহিলার সঙ্গে গল্প করতে। সেও প্রশংসায় ভরিয়ে দেয় নমিতার গানকে। ‘জন গন মন’ ছাড়া জীবনে আর কোনো রবীন্দ্র সঙ্গীত না শুনলেও, সে বোঝানোর চেষ্টা করে যে সে একজন রবীন্দ্র সঙ্গীতের বড় বোদ্ধা। শুনে খুশি হয় নমিতা। সোমকে আমন্ত্রণ জানায় তার অনান্য অনুষ্ঠানে গান শুনতে আসায় জন্য। কিছুক্ষণ পরে স্টেজে ডাক আসে সোমের। সে উঠে যায়। অবশ্য তার আগেই দুজনের মধ্যে মোবাইল ফোন নম্বর বিনিময় হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা নাগাদ বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফেরে সোম। কোনো এক অনাবিল প্রশান্তি যেন তাকে ঘিরে রয়েছে। চা খেতে খেতে গুনগুন করে গান গাইছে সে। এমন সময়ে বেজে ওঠে মোবাইলটা।
পরি না হলেও নমিতাকে বেশ সুন্দরী বলা যায়। অবশ্য রূপ আর গানের গলা ছাড়া আর বলার মত কিছু তার আছে কিনা সন্দেহ! নমিতা একজন টিপিক্যাল মুখরা, ঝগড়ুটে, রগচটা, বদরাগী। এককথায় তুমুল ঝামেলাবাজ মহিলা। মাঝে মাঝে নিজের বদমেজাজের জন্য তার নিজেরই খারাপ লাগে। কেন যে যখন তখন সে মেজাজ হারায় সে নিজেও জানে না! তবে আজ সন্ধ্যা থেকে তার মনটা যেন কেমন অন্যরকম হয়ে রয়েছে। কিরকম, সে নিজেও বুঝতে পারছে না! কখনো মনে হচ্ছে সে মেঘের উপর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে! আবার কখনো মনে হচ্ছে সে মাঝ সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে! কেন যে তার মনের মধ্যে এরকম হচ্ছে সেটা তার মাথায় ঢুকছে না! তবে কেউ যে তার সব কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে সেটা পরিস্কার। একেই কি বলে প্রেম? তবে কি সে প্রেমে পড়েছে? নিজেকে প্রশ্ন করে নমিতা। তার মত এক লেডি হিটলারের পক্ষে কি প্রেমে পড়া সম্ভব? অবশ্য নরম স্বভাবের রাধারানীতো এই ধরা ধামের একমাত্র প্রেমিকার উদাহরণ নয়। শূর্পনখা বা হিড়িম্বার মত গোলমেলে টাইপের মহিলারাওতো কখনো কখনো প্রেমে পড়েছিল। ফলস্বরূপ কারো প্রাপ্তি নাসিকা ছেদন আবার কারো প্রাপ্তি ঘটোৎকচের ন্যায় পুত্র। যদিও নমিতার নাক কাটবে এমন পুরুষ এখনো জন্ম নেয় নি। তবে কি তার প্রাপ্তি হতে চলেছে ঘটোৎকচের ন্যায় পুত্র। পুত্র লাভের কথা ভাবতে গিয়ে লজ্জায় নমিতার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে ওঠে। আবার নিজেকে শূর্পনখার সঙ্গে তুলনা করেছে ভেবে বেশ জোরে হেসে ওঠে সে। কাছেই ছিল তার বোন সুমিতা। সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কিরে দিদি, তোর কি পেট গরম হয়েছে? অকারণে হাসছিস! চোখ মুখ কেমন যেন লাল হয়ে গেছে! ডাক্তার ডাকতে হবে?”

  • না কিছু হয়নি, এমনি।
  • এমনি! বুঝেছি, মনে হচ্ছে তুই কারো প্রেমে পড়েছিস।
  • চুপ কর।
    নিজের পুরানো স্বভাবে ফিরে এসে হাত চালিয়ে দেয় নমিতা। সুমিতা খুব ভালো মত চেনে তার দিদিকে। বিদ্যুতের গতিতে সরে গিয়েও সে বারে বারে খোঁচাতে থাকে তার দিদিকে। অবশেষে নমিতা সবকিছু খুলে বলে তার বোনকে।
    “তাই!” উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সুমিতা। বারে বারে নমিতাকে বলে সোমকে ফোন করতে।
    ছোট বোনের কথা রাখতে নাকি নিজের মনের সুপ্ত ইচ্ছাটাকে বাস্তবায়িত করার জন্য সুমিতাকে ঢাল বানানোর চেষ্টা করে নমিতা বলে ওঠে, “তুই বারে বারে বলছিস, তোর কথা রাখার জন্য ফোন করছি। পরে একদম লেগ পুলিং করবি না। এসব আমার একদম ভালো লাগে না।”
    কথা শেষ করে ফোন করলো নমিতা। অপর দিক থেকে ‘হ্যালো’ শব্দটা শুনে একটু যেন কেঁপে উঠলো। মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “আপনি কি বাড়ি পৌছে গেছেন?”
    “হ্যাঁ। আপনি?” উত্তর এবং প্রশ্ন এলো অপর প্রান্ত থেকে।
    “আমিও বাড়িতে। যে কারনে ফোন করলাম, আমি জানতাম না আমার বোন আপনার খুব বড় ফ্যান। আপনার সঙ্গে ও কথা বলতে চাইছে।” ফোনটা সুমিতার হাতে দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সুমিতা সামনে না থাকলে হয়তো সে কথা চালিয়ে যেত।
    ফোনটা নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সুমিতা বলতে থাকে, “হ্যালো জাম্…মানে সোমদা, আপনার খেলা আমি নিয়মিত টিভিতে দেখি। আমি জানি আপনি এক সটে গোল দিতে পারেন। চোখের পলকে অপর পক্ষকে বেসামাল করে দিতে পারেন। আরো কত কিছু পারেন! আমিতো খুব ছোট, সব বুঝতে পারি না। আমার দিদিও অনেক কিছু পারে। রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারে। প্রেমের গান গাইতে পারে। ভালোবাসার গান গাইতে পারে। আপনার কেমন লাগলো আমার দিদির গান?”
    সুমিতার কথায় বেশ মজা পায় সোম। ইশারা গুলো বুঝতেও অসুবিধা হয় না। সে বলে, “খুব সুন্দর তোমার দিদির গান। এমনিতে আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে খুব ভালোবাসি। তোমার দিদির গানের গলা অপূর্ব।”
    চলতে থাকে কথপোকথন। ফোনেই আর একবার সোম জেনে নেয় নমিতার পরবর্তী গানের প্রোগ্রাম কবে এবং কোথায়। কথা দেয় সে গান শুনতে অবশ্যই যাবে।
    নিয়মিতই সোমকে দেখা যায় নমিতার গানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে। এছাড়া বিভিন্ন কাফে, রেস্টুরেন্টে নিয়মিত দেখা যায় তাদের। মাঝে মাঝে সোমের বাইকে চেপে তারা লং ড্রাইভে যায়। কখনো দীঘা, কখনো টাকি, আবার কখনো বকখালিতে। সকালে বেরিয়ে সারা দিন গল্পে আড্ডায় মেতে থাকে তারা। সন্ধ্যার সময়ে ফিরে আসে।
    এভাবে মাস দেড়েক কাটার পর, একদিন দুই বাড়িতে বেজে ওঠে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি। দেখতে দেখতে আরো দুমাস কেটে যায়। সোমের এশিয়াডের প্রস্তুতি শিবিরে যাওয়ার সময় এসে যায়।
    এবার ভারতীয় ফুটবল দলের জন্য আনা হয়েছে এক বিদেশী কোচ। ফুটবলারদের ক্ষমতা, এবং সামর্থ দেখে তিনি স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন অনান্য দলের থেকে তার দল বেশ দুর্বল। তাই সোমের লম্বা চওড়া চেহারা দেখে তিনি সোমকে অ্যাটাকিং ফুটবলার হিসেবে না খেলিয়ে, ডিফেন্সিভ ব্লকার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। নিজের স্বাভাবিক খেলার সুযোগ হারিয়ে সোমের সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। ক্রমশ ব্যর্থ হতে থাকে সে। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কয়েক দিনের মধ্যেই সোমরা এশিয়াড থেকে বিদায় নেয়।
    খালি হাতে বাড়ি ফেরে সোম। এবার আর তারজন্য নেই কোনো মালা, ফুলের তোড়া বা সংবর্ধনা। সব ভুলে আবার সে যোগ দেয় ক্লাবের অনুশীলনে। সঙ্গে চলে অফিস ফুটবল। কসরত করতে থাকে নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্য।
    এমনি একদিন অফিস টুর্নামেন্ট খেলে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে শেষ ট্রেনটা সে ধরতে পেরেছে। বর্ষার রাত, স্টেশনে নেমে সে দেখে স্টেশন একেবারে জনশূন্য। কোথাও কেউ নেই। এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে কিছু দুরে একটা টোটো দেখতে পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
    টোটো চালাতে চালাতে টোটো চালক গুরুদাস গান গাইছে। খুব সুন্দর তার গানের গলা। সোম তার গানের প্রশংসা না করে পারে না। এমনকি গুরুদাসের মোবাইল নম্বর নিয়ে নেয়। বাড়ি ফিরে নমিতাকে গুরুদাসের কথা খুলে বলে। পরের দিন গুরুদাসকে ডাকে সোম। তার টোটোতে চেপে নমিতাকে নিয়ে বেড়াতে যায়। পথের মধ্যে গুরুদাস গান ধরে। গুরুদাসের সুরেলা কন্ঠস্বরের নমিতা চমকিত হয়। গুরুদাসকে সে বলে, “তোমার এত সুন্দর গলা। তুমি সিরিয়াসলি গানের চর্চা কর না কেন? এখন কত সুযোগ। কত রিয়েলিটি শো হয় চারিদিকে। এগুলো কাজে লাগাও।”
    গুরুদাস বলে, “বৌদি আমরা গরিব মানুষ। আমাদের ওসব বিলাসিতা মানায় না।”
    মিনতি বোঝানোর চেষ্টা করে, “এটা কোনো কাজের কথা নয়। একটা ছেলে ত্রিপুরা থেকে কলকাতায় এসে দারোয়ানের চাকরি করেও একটা রিয়েলিটি শোতে গান গেয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। তোমার গলা ওদের থেকে অনেক ভালো, তুমিও চেষ্টা কর। যদি সফল না হও ক্ষতি নেই, কিন্তু সফল হলে কোথা থেকে কোথায় পৌছে যাবে একবার চিন্তা কর। কোনো ওস্তাদ রাখার দরকার নেই। আমি তোমাকে রেওয়াজ করাবো।”
    এরপর নমিতা সোমকে বোঝায় গুরুদাসকে রাজি করাতে। এর পেছনে নমিতার একটা উদ্দেশ্যে আছে। সোমের জনপ্রিয়তা দেখে সে ঈর্ষান্বিত হয়। ভাবে সেও যদি গান গেয়ে সোমের মত খ্যাতি অর্জন করতে পারতো! অবশ্য সে গায়িকা হিসেবে তার সীমাবদ্ধতা জানে। সে জানে পাড়ার ফাংশান অবধি সে সাবলীল। তার চেয়ে বেশি এগনো তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু গুরুদাসের সহজাত প্রতিভা। কেবল একটু গাইড দরকার, তাহলে সে অনেক দুর অবধি যাবে। আর গুরুদাসের সঙ্গে তার মেন্টরের সুনাম অনেকদূর ছড়িয়ে পড়বে। এবং গুরুদাসের সঙ্গে সে যদি ডুয়েট গায় তাহলে গুরুদাস তার প্রতিভা বলে নমিতার সীমাবদ্ধতাকে ঢেকে দিয়ে অনেক উন্নততর সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারবে।
    শুরু হয় গুরুদাসের তালিম। নমিতা মোহিত হয়ে গাইতে গাইতে কখনো গুরুদাসের কাঁধে, কখনো পিঠে হাত রাখে। অস্বস্তি হয় সোমের। সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পরে নমিতাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, “গান শেখাচ্ছো ঠিক আছে, কিন্তু কাঁধে, পিঠে, বগলে হাত দেওয়ার কি আছে! মনে হচ্ছিল যেন কোনো লাভ সিনের শ্যুটিং চলছে!”
    কথাটা শুনে ভীষণ রেগে যায় নমিতা। প্রচন্ড চিৎকার, চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। শুরু হয়ে যায় তর্কাতর্কি, ঝগড়া ঝাটি। প্রায় প্রত্যেক দিন সন্ধ্যার পর এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভিড় বাড়তে থাকে প্রতিবেশীদের জানালায়। শুরু হয়ে যায় রসালো ফিসফিসানি। রাস্তা ঘাটে সোমকে দেখে অনেকেই মুখ টিপে হাসে। জানতে চায় ব্যাপারটা কি? কেউ আবার সহানুভূতিও জানায়। অসহ্য লাগে সোমের। সে বাড়ির কথা ভুলে খেলায় মন দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এশিয়াডের সময় ভুল কোচিংয়ের ফলে তার খেলার মান পড়তির দিকে। রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতে খেলতে তার পায়ের জাদুও হারিয়ে গেছে। ঘরে বাইরে ক্রমশ যেন একা হতে থাকে, হারিয়ে যেতে থাকে সে কোনো এক অজানা অন্ধকারে।
    তালিম চলতে চলতে বিভিন্ন রিয়েলিটি শোতে গুরুদাসকে নিয়ে যায় নমিতা। গুরুদাসের গান শুনে মুগ্ধ হন বিচারকরা। অনেক সময়ে এই সাফল্যের পেছনে থাকা মানুষটাকেও তারা টেনে আনেন স্টেজে। সম্মানে, প্রশংসায় ভরিয়ে দেন নমিতাকে। এই সম্মান, এই প্রশংসাটাইতো আশা করেছিল নমিতা প্রথম দিন থেকে।
    ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকে গুরুদাস। ছড়াতে থাকে তার নাম। গান গাওয়ার জন্য ডাক আসতে থাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে। সেইসঙ্গে নমিতারও ডাক আসে। দুজনে মিলে দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করে আসর মাতিয়ে দেয়। গানের অনুষ্ঠান চলতে চলতে মাঝে মাঝে রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যায়। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, টিভির চ্যানেলে, সোশাল মিডিয়াতে এমনকি দেওয়ালের পোস্টারে বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে দুজনের অন্তরঙ্গ ছবিও দেখা যায়। চোখে পড়ে সোমের। এক অব্যক্ত মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে সে। সহ্য করতে পারে না! কোনো কিছুই সহ্য করতে পারে না সোম। ভাবে সব কিছু ভেঙে চুরে শেষ করে দেবে!
    এমনি এক মধ্যরাতে নমিতা বাড়ি ফেরে। নমিতার সঙ্গে গুরুদাসকে দেখে হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে পড়ে সোম। হাত চালিয়ে দেয় গুরুদাসের উপর। রেহাই পায় না নমিতাও। সেও শারীরিক এবং মানসিক ভাবে আহত হয়।
    সেই রাতেই বাড়ি ছাড়ে নমিতা। বাপের বাড়ি ওঠার আগে থানায় ডায়েরি করে যায়। অবশ্য একথাও বলে যায়, “অপরাধ প্রমাণের পর অপরাধী সাজা পাক। কিন্তু তার আগে যেন গ্রেফতার করে নামি ফুটবলারের মানহানি করা না হয়।” থানার ডিউটি অফিসার বুঝতে পারেন প্রবল রাগের মধ্যে প্রচ্ছন্ন অনুরাগ লুকিয়ে রয়েছে।
    শুরু হয়ে যায় কোর্ট কাছারি, মামলা মকদ্দমা। জমে ওঠে উকিলদের বাকযুদ্ধ। এত ঝামেলার মধ্যেও গানকে বা গুরুদাসকে ছেড়ে দেয়নি নমিতা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়াটা চালিয়ে যায় তারা।
    একদিন এক গানের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয় নমিতাদের গাড়ি। মারাত্মক ভাবে আহত হয় তারা। স্থানীয় লোক জন তাদের উদ্ধার করে হসপিটালে নিয়ে যায়। খবর যায় স্থানীয় থানাতেও। থানা থেকে খবর যায় নমিতার বাপের বাড়ি। ডাক পড়ে সোমেরও। প্রথমে সে যেতে অস্বীকার করলেও, যেহেতু বিয়েটা ভাঙেনি, তাই যেতে বাধ্য হয় সে।
    বেশ তাড়াতাড়ি হসপিটালে পৌছে যায় সোম। তখনো নমিতার বাপের বাড়ি থেকে কেউ পৌছায়নি। হাসপাতালে গিয়ে শোনে, গুরুদাসের চোট তেমন গুরুতর না হলেও, নমিতার অবস্থা মোটেই ভালো নয়। তাকে আই সি ইউতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ডাক্তার বাবুরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু চিকিৎসায় সাড়া মিলছে না। শুনে খুশি হয় সোম। মনে মনে সে ভগবানকে জানায়, এই দুর্ঘটনা যেন তাকে তার জীবনের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়ে দেয়। অর্থাৎ সে এখন নমিতার মৃত্যু কামনা করছে। কারন আইন আদালতের লড়াই তাকে একেবারে কোনঠাসা করে ফেলেছে। এর থেকে তার মুক্তির পথ, যদি নমিতা মামলা মকদ্দমা থেকে সরে যায়। কিন্তু নমিতাতো লড়াই ছাড়বে না। তাই নমিতার মৃত্যু সোমের কাছে একমাত্র কাম্য।
    উদ্ধারকারী স্থানীয় মানুষরা তখনো হাসপাতালে উপস্থিত। তাদের মধ্যে একজন সোমকে চিনতে পেরে নমিতার ভ্যানিটি ব্যাগটা সোমের হাতে দেয়। প্রথমে সে ব্যাগটা অযত্নে একধারে রেখে দিলেও, কিছুক্ষণ পরে সে ব্যাগটা খুলে দেখতে থাকে, যদি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়, যেটা কোর্টে কাজে লাগতে পারে। ব্যাগের মধ্যে সে কয়েক হাজার টাকা পায়। আর পায় একটা রাখি।
    আগামীকাল রাখি পূর্ণিমা। কিন্তু নমিতারতো কোনো ভাই নেই! এমনকি মামাতো, পিসতুতো ভাইও নেই! তাহলে কার জন্য সে রাখি কিনেছে?
    আবার নতুন করে সব কিছু ভাবতে থাকে সোম।

One thought on “ছোট গল্পঃ রাখি – দেবাংশু সরকার

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *