দৃষ্টি
বন পলাশ
বাইরে বিয়ের সানাই বাজছে চারি দিকে ধুম ধাম..কাল. যে আমার বিয়ে। আর আমি দরজা বন্ধ করে দেয়ালে টাঙানো বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলেই যাচ্ছি অনবরত আজ কিছুতেই যেন কান্না থামছে না। শরীরের সমস্ত সত্তা যেন বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই ব্যাকুল।
মা সেতো আমার জন্মের পরেই তারার দেশের চলে গেছে তাই বাবা বলো আর মা আমার জন্য ঐ মানুষটাই তো সব ছিল।
যদিও বা ছোটবেলায় বাবাকে কবে শেষ বার চোখের দেখা দেখেছিলাম মনে নেই। বলতেই পারো মাত্র তিন বছর দেখা। বাবার মুখটা কল্পনাতেই ছিল, বাস্তবে জানতাম না। মাত্র তিন বছর বয়সেই নাকি আমার ব্লাড প্রেসার এতো এতো হাই হয়ে গেছিলো যে আমার চোখ দুটোয় স্টোক হয়ে গেলো… ডাক্তার বলেছিলেন এটা নাকি হেরিডিতি। খুব খুব রেয়ার কেসে নাকি এমনটা হয়.। আর দুর্ভাগ্য বসতো আমি সেই রেয়ার কেস।
কিন্তু বাবা, আজ এই তেইশটা বছর সব সময় আমার সাথী হয়েই ছিল। আমি পা ফেলার আগেই বাবা বুঝতে পারতো। একদম ছোটো বেলা থেকেই আমার কি লাগবে না লাগবে বাবা যেন আগেই বুঝতে পারতো।
মা এই শব্দ টা জানি কিন্তু শব্দটার সঙ্গে মোটেও পরিচিতি ছিল না। আমার জীবনে মা বলো আর বাবা ঐ একটাই মানুষ।
অন্ধত্ব কি জিনিস সেটা বাবা বুঝতেই দিতো না। ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি করিয়ে অক্ষরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেও আমার সমস্ত শিক্ষা তো বাবার কাছেই। বাবার কাছেই হারমোনিয়ামের রিড চিনে গান তোলা। কখনো বা নিজেই তবলা নিয়ে বসে যেত সঙ্গদ দেবার জন্য। বাবার কাছেই প্রকৃতি কে চেনা। গাছের পাতা, তার ফুল গন্ধ দিয়েই চিনতে শিখিয়েছিল..এমন কি রান্নার গন্ধ সুখেই নুন হলুদের পরিমাপ ঠিক আছে কিনা সেটাও শিখিয়েছিল।
কত টা সত্যি জানিনা। তবে বাবার চোখে তার রাজকন্যাই ছিল পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী। আর আমার কাছে বাবা.. সে ছিল আমার চলার পথের সঙ্গী, আমার পথ নির্দেশক, আমার ভরসা আমার আদর্শ পুরুষ আমার প্রথম ভালোবাসা। বাবা সব সময় বলতো
“মারে দেখবি একদিন রাজপুত্র এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে আমার সোনা মাকে ..”
আমি হেসে বলতাম ” রাজপুত্র না ছাই। এই অন্ধ মেয়ের দিকে কেউ তাকাবেই না, এই নিয়ে ভেবো না “
” নারে মা, আমি কথা দিচ্ছি দেখিস তোর বিয়ের আগে তু্ই দেখতে পাবি”
সেদিন আমি আর বাবা কুতুবমিনার দেখতে গেছিলাম। দেখা মানে প্রত্যেক বারের মতনই বাবার চোখ দিয়ে দেখা আর আমার হাতের স্পর্শে অনুভব করা। বিশাল মিনারটার গায়ে হাত বুলিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বাবা ইতিহাসের পাতা গুলো আমার মনের সামনে মেলে ধরতে লাগলো এক এক করে। বাবাই ফটো তুলছিলো কিন্তু দুজনার একসঙ্গে ফটো তোলা হচ্ছিলো না। হঠাৎই একটা ছেলের গলায় শুনলাম
আমি কি আপনাদের একসঙ্গে ছবি তুলে দেবো আঙ্কেল।
আমি বললাম না দরকার নেই.
বাবা বলল.. ঠিক আছে বেটা দেও আমার আর মেয়ের ছবি তুলে।
আশ্চর্য ব্যাপার এর পর থেকে সমানে ছেলেটা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগলো। বাঙালি নয়। দিল্লির ছেলে। নাম বললো রমেশ শর্মা। খুব ভালো বাংলা বলতে পারেনা। তবে জোর করেই বাংলা বলতেই চাইছে। আমি মনে মনে হাসছিলাম আর ভাবছিলাম বাংলা বলতে গিয়ে যেন ওর দাঁত গুলোই না ভেঙে যায়। বাবার মতন সেও দেখছি ইতিহাসে পুরো পাকা। আমরা গোম্বুজটা পারকরে একটু ওপরের দিকে উঠছিলাম। হঠাৎ ই ছেলেটা বাবাকে বললো
আংকেলজি আমি কি ম্যাম এর হাত ধরে বাকিটা চিনাতে পারি।
আমি ওর সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু বাবা অবাক করেই বললো। ঠিক আছে বেটা।
রমেশ আমার ডান হাতটা ধরে বললো
আসুন ম্যাম। আমায় বারাতে হয়নি। সে নিজেই আমার ডান হাতটা ধরলো। বাবা ছাড়া জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষ আমার হাতটা ঐ একই ভাবে ধরলো। আমি সম্পূর্ণ যেন বাবার অনুভূতি পেলাম। ওকে দেখতে তো পাচ্ছিলাম না পাশাপাশি চলা ওর সান্নিধ্য যেন মন ভোরে উপভোগ করছিলাম। বাবার মতনই ও পাথরের দেয়ালে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে চেনাতে লাগলো । ইতিহাসের পাতা গুলোর সঙ্গে পরিচয় করাতে লাগলো। ও মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে কথা বলছিলো। ওদের কথাতেই জানতে পারলে. সে নাকি ফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার দিল্লিতেই জব করে। অবাক হলাম। ইতিহাসের ওপরের এতো দক্ষতা দেখে।
আশ্চর্যের ব্যাপার সে ইতিহাস আর ভূগোল ছাড়া আপনার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলো না। ফেরার সময় বাবাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলো যে আমরা সাকেত হোটেলে উঠেছি আর কাল বিকালের শিয়ালদাহ রাজধানী তে ফিরবো।
হোটেলে ফিরে আমি আর বাবা গল্প করলাম, মাঝে মাঝেই বাবা ছেলেটার কথা বলে প্রশংসাও করছিলো। আমার কিন্তু এতো টুকুই ভালো লাগছিলো না। সারাটা দিন আমরা সঙ্গে রইলাম, ভারতের ইতিহাস আর ভূগোল ছাড়া আমার নামটাও পর্যন্ত জানতে চাইলো না। একটা বারও বুঝতে চাইলোনা আমার অনুভূতির কথা। অনেক অনেক বার ভাবছিলাম আমি ওর নাম জিজ্ঞেস করি কিন্তু পারিনি। সারাটা রাত কেবল আমার হাতে ওর স্পর্শই অনুভব করতে লাগলাম। বার বার ভাবতে লাগলাম যদি এমনটা হতো যে….। পরক্ষণেই নিজেকে বুঝাতাম আমি যে অন্ধ। আমার এই সব ভাবার কোনো অধিকার নেই। এই অনুভূতি আমার জন্য নয়। ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেছিলাম নিজেই বুঝতে পারিনি। সকালে বাবার ডাকে ঘুম ভাঙলো।
কিরে তাড়াতাড়ি ঘুছিয়ে নিতে হবে যে। মনে আছে তো ট্রেন বিকাল সাড়ে চারটায়।
আজ চলে যেতে হবে ভেবেই মনটা কেমন যেন বিষাদে ভরে উঠলো। ভাবলাম যদি আবার ওর সঙ্গে দেখা হতো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। গোছানো হচ্ছে তখনি হোটেলের স্টাফ এসে বলল কেউ নিচে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। বাবা নিচে গেলো দেখতে। আশ্চর্যের ব্যাপার তো এখানে তো কেউ চেনা জানা নেই তাহলে। কেনো জানিনা মনের অজান্তেই একবার মনে হলো কালকের ছেলেটা আসেনি তো।
বাবা ঘরে ঢুকে বলল দেখ মা কারা এসেছেন। রমেশ আর ওর বাবা মা এসেছেন দেখা করতে।
একজন মহিলা আমার হাত দুটো ধরে বললো
আজও বেটি মেরে পাস বেইঠো।, ভাই সব আপকে বেটি বহুত সুন্দর হ্যা।
আমি প্রণাম করলাম। উনি নিজেই ওনার হাসবেন্ড যেখানে বসেছিলেন সেখানে নিয়ে গিয়ে বললে।
রমেশ কে পিতাজি হ্যাঁ।
আমি ওনাকেও প্রণাম করলাম। বাবার মতন করে উনিও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ভেঙে ভেঙে বাংলা বলতে চেষ্টা করছিলেন ওনারা। আর সে.. ধুর একটা শব্দ যেন বলতে কেউ বারণ করে দিয়েছে। আন্টি বললেন কাল নাকি সারারাত রমেশ আমাদের কথা বলেছে তাই ওনারা দেখা করতে এসেছে। সত্যি ছেলেটার এতো টুকুও কি লজ্জা নেই। অনেক ক্ষণ গল্প হলো। ওরা এবার যাবার জন্য উঠলো। আমাদের বাড়ির ঠিকানা নিলো। যাবার জন্য উঠলো ওনারা। হঠাৎই আন্টি বাবাকে বললেন।
ভাইসাব আপসে কুছ মঙ্গনা থা। দেয়াঙ্গে হামে প্লিজ।
আমি বাবা দুজনেই অবাক হলাম… বাবা হ্যাঁ দেবো বলতে উনি বললেন।
ভাইসাব হাম আপকে বেটিয়া রানী কো হামারে বেটি বানানা চাহাতে হ্যাঁ। দেঙ্গে হামে।
বাবা বললো ভাবীজি মুঝে সমঝামে নেহি আয়া।
ভাইসাব হাম আপকে বেটিয়া রানী কো আপনে ঘর কে বহু বানানা চাহতে হ্যাঁ।
ইসস কি নির্লজ্জ্ব ছেলেরে বাবা। একে বারে বাবা মাকে বলেই দিলো. হায়রে। বাবা আমায় জিজ্ঞেস করলো।
মা রে কিছু বলবি।
না আমি কিকরে বলি কাল সারা রাত আমার কি অনুভূতি হয়েছিল। বাবা হয়তো আমার না বলা কথা গুলো বুঝতে পেরেই হ্যাঁ বলে দিয়েছিলো। ওনারা বলেন ঠিক পনেরো দিন পরে ওরা কলকাতা আসবেন আশীর্বাদ করতে। বিকালে ট্রেন ছাড়ার আগে ওনারা স্টেশন এসেছিলো ছাড়তে । রাতভর ভাবতে লাগলাম এটাও কি সম্ভব নাকি সবই স্বপ্ন।
কিছুতেই বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না যে রমেশ কেমন দেখতে। নিজেকে এতটা অসহায় হয়তো কোনোদিনও মনে হয়নি নিজেকে। তবে বাবা বার বার বলতো
বলতাম না আমার মেয়ের একদিন ঠিক রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হবে।
বাবা আমার খুব ভয় লাগছে। আমি যে চোখে দেখতে পাইনা। ওরা যদি পরে কিছু বলে।
পনেরো দিন পরেই ওরা এসেছিল আমার আশীর্বাদ করে গেলো। সারাটা দিনের হৈ হুল্লোড় মাঝেও একটাই চিন্তা আমার মনের মধ্যে বার বার সংশয় জাগাছিল। পরে কিছু হবে না তো। বাবা আমার মনের কথাটা ধরে ফেলেছিলো তাই বার বার বলতো দেখিস মা তোর বিয়ের আগেই তোর চোখ ঠিক হয়ে যাবে।
আমাদের কথা মতনই আশীর্বাদের তিন মাস পরে বিয়ের দিন ঠিক করা হয়েছিল। দেখতে দেখতে সময় গুলো কেটে আর মাত্র কুড়ি দিন বাকি রয়েছে। হঠাৎই পাশের বাড়ির আঙ্কেল খবর দিলো বাবার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে হসপিটালে রয়েছে খুব খারাপ অবস্থা। উনি আমায় নিয়ে গেলেন। কি জিজ্ঞেস করবো। Dr পারমিশন দিলেন দেখা করার। বেডের পাশে দাঁড়াতেই বাবার হাতের স্পর্শ পেলাম। আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো। আমি বললাম তুমি ঠিক হয়ে যাবে বাবা। বাবা কিছুই বললো না। কেবন বাবার শক্ত করে ধরে থাকা হাতের বাঁধনটা আসতে আসতে শিথিল হতে হতে একসময় অনুভব অনুভব করলাম বাঁধনটা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে গেছে। নার্স আমায় অন্য রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলেন। পরে জানলাম বাবার পকেটে একটা চিঠি ছিল তাতে বাড়ির ঠিকানা, আমার নাম আর অঙ্গ দানের সার্টিফিকেটের কথা লেখা ছিল।
বাবার ছবিটা দিকে যতবার তাকাচ্ছিলাম তাতো বারই মনে হচ্ছিলো বাবা যেন বলছে
দেখলি তো মা আমি বলতাম না. ঠিক তোর বিয়ের আগেই তোর চোখ ঠিক হয়ে যাবে। দেখলি তো তাই হলো।
চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম বাবা আশীর্বাদ করো আমায়।