লহনার জ্যান্ত পুতুল
পরমা মজুমদার
বেলা এগারোটার সময় একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে মৌলালী মোড়ের ডেন্টিস্ট সাহনী আগারওয়ালের ক্লিনিকে পৌঁছোলো লহনা । তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে ছাতাটাই সঙ্গে আনতে ভুলে গেছে সে ,তাই আসতে আসতে গরমে ঘামে স্নান করে গেল । কিন্তু এসে দেখল , একটা একহাত জায়গা নিয়ে তৈরী গ্লাস চেম্বারে ডাক্তার সাহনী বসে রোগী দেখছেন ,আর বাইরে অগুণতি প্রতীক্ষারত রোগীদের থিকথিকে ভিড় । তখন সবে সাত নম্বর চলছে ; তার মানে আরো কমপক্ষে এক ঘন্টা বসতে হবে তাকে , কারণ তার ডাক আসবে আরো সাতজনের পরে । লহনা ভাবলো , তার মেয়ে দুটো এতক্ষণ কি করে তাকে ছাড়া থাকবে ! তিন বছরের দুটি জমজ মেয়ে তার আর সায়নের- সুইটি আর বিউটি ; কি সুন্দর নীল চোখ , টুকটুকে ফর্সা’ গায়ের রঙ আর বাদামী চুল ওদের ; ঠিক যেন দুটো জ্যান্ত পুতুল ! পরিচিতরা বলে , সায়নের মতই সুন্দর দেখতে হয়েছে তাদের ।
যদিও আসার সময় সে তার মেয়ে দুটো কে ওদের বাবা সায়নের কাছে রেখে এসেছে । তবু ও ভরসা নেই ! কারণ একবার অফিসের কাজ নিয়ে বসলে আর কোনো কিছু খেয়াল থাকে না সায়নের ; বলতে গেলে একপ্রকার কোন্ দুনিয়ায় আছে সেটাই ভুলে যায়! সেই সময় বাাচ্ছা দুটো যদি কিছু করে বসে , তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে । কিন্তু আক্কেল দাঁতটা নিয়ে সপ্তাহ খানেক ধরে যন্ত্রণায় ভুগছে লহনা ; অ্যান্টিবায়োটিক আর পেন কিলার খেয়ে কোনোরকমে যন্ত্রণাটা কমিয়ে নিতান্ত নিরূপায় হয়েই তাই আজ দাঁত তুলতে এসেছে ।
এই ক্লিনিকটার নিয়ম হল , রোগীর নাম ডাকার আগে একটা ফর্ম ফিলআপ করতে হয় । যেহেতু , তার নাম আসতে দেরী আছে ; তাই ধীরে সুস্থে ব্যাগ থেকে পেন বার করে ফর্ম ফিলাপ করতে লাগল সে :–
নাম :: লহনা বোস
অভিভাবকের নাম :: সায়নদীপ বোস (স্বামী )
ঠিকানা ::85 নম্বর ক্রীক রো ,কলকাতা – 14
রোগের প্রকার :: আক্কেল দাঁত জণিত সমস্যা
মোবাইল নম্বর ::: 88767654
ফিলাপ করা ফর্মটা রিসেপশানিস্টের হাতে দিয়ে সোফার পাশে রাখা তাক থেকে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পড়তে লাগল লহনা । হাঁপানীর ওষুধ অসাবধানতার সাথে প্রয়োগে কিভাবে দাঁতের ক্ষতি হয় , সেই সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞরা লিখেছেন; লহনা আলোচনাটা পড়তে শুরু করল ; পড়তে পড়তে তদ্গত হয়ে পড়ল সে।
- লহনা বোস , অ্যাটেনড্যান্ট নামটা ধরে ডাকতেই লহনা হাতের ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে পাশের তাকটাতে রেখে দিয়ে ডাক্তারের চেম্বারের ভেতরে ঢুকে গেল । আক্কেল দাঁতটা তোলবার জন্য জুনিয়র ডাক্তার আবশ্যিক সরঞ্জাম নিয়ে এলেন , সবে দাঁতটা তোলা হয়েছে , হঠাৎ ব্যাগের ভেতর থেকে লহনার মোবাইলটা বেজে উঠল । একটু অবাকই হল সে ,কারণ সে তো সকলকে বলেই এসেছে যে দাঁত তুলতে এসেছে ; তাহলে কে এই অসময়ে ফোন করল তাকে ? ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে তাদের কাজের মাসী মালতী । ফোনটা তুলতেই মালতীর গলা – “ও বৌদি সুইটি কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ,বিউটি বলছে, ও সুইটি কে ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দিয়েছে ; তুমি এক্ষুণি একবার এসো।” শুনে আঁতকে উঠল সে , ” কি ! ” ছিটকে বেরোলো কথাটা লহনার মুখ দিয়ে ! আর কোনো কিছু শোনা বা বলার অবস্থায় রইলো না সে ; হঠাৎ মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল তার ; মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে ছিটকে গেল ,জুনিয়ার ডাক্তারটা কোনোরকমে এসে ধরল তাকে । দাঁত তোলার পর ডাক্তারের নির্দেশ মত চেম্বারের বাইরের একটা চেয়ারে সবাইকে কিছুক্ষণ বসতে হয় , কিন্তু সে ডাক্তারের নিষেধ স্বত্ত্বেও না বসে তৎ ক্ষণাৎ বেরিয়ে এলো ।
চেম্বার থেকে বেরিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়তে লাগল সে ; মৌলালীর ক্রসিং এ পৌঁছে ট্রাফিক সিগন্যাল উপেক্ষা করে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটুর জন্য দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচল লহনা । কিন্তু তাতে ও তার হুঁশ নেই রাস্তা পেরিয়েই গলি দিয়ে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল ,কে জানে এতক্ষণে ওয়াশিং মেশিনটা কেউ না জেনে চালিয়েছে কিনা ! তাহলে তো এতক্ষণে সুইটির ছোট্ট নরম তুলতুলে শরীরটা মেশিনের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে ভাসছে ! আর ভাবতে পারল না সে ।
গলি থেকে বেরিয়ে এক ছুটে বাড়ির ভেতর গিয়ে ঢুকল সে । তাদের বাড়ির ড্রইং স্পেসের এককোণায় যে বাথরুম রয়েছে , তার একপাশে রাখা ওয়াশিং মেশিনটাকে ঘিরে সবাই ভিড় করে রয়েছে ; যেন এক্ষুনি সিনেমা শুরু হবে । কিন্তু ভয়ে কেউই মেশিনের ঢাকনা খুলছে না; এমনকি সায়ন ও না । লহনা এসে ভিড় সরিয়ে দিয়ে ইষ্টদেবতার নাম জপতে জপতে মেশিনের ঢাকনাটা খুলে দিল ;তারপর দেখল টুকরো টুকরো লাল রঙের ছোট্ট পুতুলের জামা , পুতুলের চুল , পেঁজা পেঁজা তুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে জলে ভাসছে । না ! লাল রক্ত বা কোনো মাংসপিন্ড তাতে নেই। ও বুঝল , বোন সুইটি নয় ! বিউটি দুষ্টুমি করে তার প্রিয় সুইটি পুতুল কে মেশিনে কাচতে দিয়েছে । দমবন্ধ করা উৎকন্ঠা টা কিছুটা হলেও কাটলো ; কিন্তু দুশ্চিন্তাটা রয়েই গেল । তার মেয়ে সুইটি তাহলে কোথায় .? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ লক্ষ করল , ওয়াশিং মেশিনের পিছনে দেওয়াল ঘেঁষে যে একটা চারকোণা খোপ জায়গা রয়েছে ; সেখানে কি যেন একটা ! সাহস করে কাছে গিয়ে দেখল , সুইটি সেখানে দুধের বোতল মুখে নিয়ে সেখানে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে !!!! লহনা কাছে গিয়ে ঘুমন্ত লহনাকে কোলে তুলে নিল , থমথমে ভাবটা কেটে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে চারপাশটা আনন্দে ভরে উঠল । ।
দারুণ গল্প।
ভালো লাগলো।