ভালোবাসার গল্প: ডুবন্ত সূর্য – ভূমিকা গোস্বামী

ডুবন্ত সূর্য
ভূমিকা গোস্বামী

কিছুদিন আগে হঠাৎ শেষরাতে ভয়ংকর কাপুনি দিয়ে জ্বর এলো অদিতির। তিনটে দিন জ্বরের সাথে বাস করার পর জ্বর ফিরে গেল , কিন্তু ও আর নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে না ।
চিরদিন বড় বড় কঠিন গিঁট – ছুড়ি কাঁচি ছাড়া খুলে এসেছে এতোদিন। সমস্যা থাকলে সমাধান আছে বিশ্বাস করে এসেছে , সেটা নিজের হোক বা অন্যের। বয়স তো কম হল না। দিদি , বৌদি থেকে দিদা —-
ইতিমধ্যে সকলেই চিনে ফেলেছে – মুসকিল আসান হয় নাকি ওর সাথে কথা বলে।
বছরদুয়েক আগে ওর সামনের বাড়িতে ভাড়া এল বুল্টি আর ওর স্বামী। দুজনের সংসার। ও দেখে- সকালে বাড়ির সামনে আসা সবজির গাড়ি থেকে বাজার করে বুল্টি। অদিতিও কেনে। ওই থেকেই সামান্য আলাপ। ও বারান্দায় ভিজে জামাকাপড় মেলে। চোখাচোখি হলে একটু হাসির বিনিময় । ব্যাস এটুকুই।
সেদিন রবিবার। সকাল থেকেই পাড়ার ছেলেরা ক্লাবের মাঠে আড্ডা দিচ্ছে। চায়ের জল চাপিয়ে আগের দিনের জমিয়ে রাখা চা-পাতা ফুল গাছের গোড়ায় দিতে বাগানে এসেছে , হঠাৎ চেঁচামেচি কানে এল । বুল্টি বেশ চেঁচাচ্ছে।ওর বর কি বলছে শোনা আচ্ছে না। বাসন ছোঁড়ার ঝনঝন শব্দ।

  • মা বলেছে ? মা কি ডাক্তার ? সব দোষ আমার ? তোমার দোষ থাকতে পারে না ? নিজের ছেলের দোষ দেখবে কেন ?
    ধীরে ধীরে বেলা বাড়ছে পাশাপাশি ওদের ঝগড়া ও।
    ছেলেটা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে একসময় বেড়িয়ে গেল দেখল ও। বুল্টির কান্নার আওয়াজ ।
    নাঃ , আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। পায়ে স্যান্ডেলটা গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওকে দেখেই কাঁদতে কাঁদতে এসে জড়িয়ে ধরল বুল্টি।
    ওদের নাকি বারো বছর বিয়ে হয়েছে , সন্তান হয় নি। শাশুড়ি বিরক্ত । নানা তেতো কথার ভীড়।
    শেষ পর্যন্ত বুল্টির বর-কে ফোন করে বোঝানোয় – রাত আটটায় ফিরে এল। সারাদিন ওদের খাওয়া হয় নি। রাতের খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার দিয়ে আনলো ওর বর।
    ওর পরিচিত একজন ধন্বন্তরি গাইনি – ডাক্তার সাহার ফোন নাম্বার দিয়ে বাড়ি ফিরলো ও।
    একুশের মাঝামাঝি ওদের জমজ বাচ্চা হয়েছে। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ভারি মিস্টি হয়েছে ওরা। শাশুড়ি বৌ দুজনে মিলে বাচ্চার দেখভাল করছে। বারান্দার রোদে তেল মেখে হাত পা ছোড়ে বাচ্চারা। মাঝে মাঝে গিয়ে আদর করে আসে ও।ওকে দেখলেই কেমন খুশিতে হাত পা ছুড়ে কোলে উঠতে চায়।
    নিজের নাতির কথা মনে পড়ে। ছেলে দেশের বাইরে। ছেলে , বৌ দুজনেই খুব ব্যস্ত। দেশের জন্য , মায়ের জন্য মন পুড়লেও আসতে পারে না।পাঁচ বছরের শুভদীপকে কতদিন বুকে নেয়নি ও।
    তখন ওর মধ্য গগন। ছেলে ছোট। প্রতিদিন অজানা সমস্যার আনাগোনা। কুশলী খেলোয়াড়ের মতো চার ছক্কা পিটিয়ে মাঠের বাইরে বের করছে তখন ও। আর একটু একটু করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। সেই সময় প্রায় সমবয়সী বেশ সুন্দরী একটি মহিলা কলি একদিন ওর কাছে এল। খুব কান্নাকাটি করছিল। কলির স্বামী নাকি অন্য একটি মেয়েতে আসক্ত। মেয়েটি ডিভোর্সি। একটি ছেলে নিয়ে বাপের বাড়িতে এসে রয়েছে। ওই বাড়িতেই বেশিরভাগ সময়ে কাটায় এই কলির স্বামী। নিজের বউ বাচ্চার খোঁজ নেয় না। সুন্দর একটা সংসার নৌকো প্রায় ডুবতে বসেছে। রোজ ঝগড়া মারামারি !
    এদিকে বাপের বাড়ির জোড় নেই। কলি ইতিমধ্যেই কোন জ্যোতিষীর কাছে তাবিজ কবজের ফাঁদে ঠাকুমার দেওয়া তিন ভরির হাতের বালা খুইয়ে বসেছে। তাকে তখন কি বলেছিল ওর মনে নেই , তবে ওর আত্মবিশ্বাসের কিছুটা আলো সঞ্চারিত করে ছিল মনে আছে। এখন ওরা বৃদ্ধ বৃদ্ধা। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে ব্যাঙ্গালোরে প্রতিষ্ঠিত। খুব আনন্দ হয় এখন ওদের দেখে।
    কিছুদিন যাবৎ সেই ওর কিনা হঠাৎ সমস্যা , অশান্তি কানে শুনলেই বুকের মধ্যে হাজার সমুদ্রের তরঙ্গ ! টিভির সিরিয়ালের দজ্জাল শাশুড়ির অভদ্র আচরণ, বা কুচক্রী বৌয়ের চক্রান্ত তে গা গুলিয়ে উঠছে। টিভি বন্ধ করে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা ! কি হল ওর ! কোন ডাক্তারের কাছে যাবে ? কোথায় গেলে ওর নিজেকে ফিরে পাবে বুঝতে পারছে না।
    গতকাল দুপুরে খাওয়ার পর ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে, ফোনে গান চালিয়ে শুনতে শুনতে তন্দ্রা মত এসেছে। হঠাৎ ঝনঝন করে কাঁচের বাসন ভাঙার শব্দে লাফিয়ে উঠল। পিছনের বাড়ির মীনা, ওর বাবা ,মা একসাথে চেচাচ্ছে। মীনা ছোট থেকেই পাগল। ওর বাবা মা কে চেন্নাইয়ে গিয়ে চিকিৎসা করতে বলেছিল। ওষুধ পত্র খেয়ে এতদিন তো ভাল ই ছিল। আজ আবার ক্ষেপেছে।
    এদিকে বুকের ভেতর সহস্র সমুদ্রের ঢেউ। ও পালাচ্ছে। দুকান চেপে ঘর ছেড়ে বাইরে। তখনও বাসন ভাঙার আওয়াজ ওকে তাড়া করছে। প্রায় দৌড়ে অমরাবতীর খোলা বড় মাঠে এসে পড়েছে। সূর্য তখন পশ্চিমের আকাশ রাঙিয়ে ডুবছে। একা দাড়িয়ে আছে। চারদিক লোকালয় শুন্য। সূর্য কে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তাঁর সুন্দর আলো এখনও আছে। মনেহল, এতো মর্তলোক। প্রতিদিন মরার পর আবার বেঁচে ওঠার খেলা চলে এখানে। পালানো নয়, সমস্যার মুখোমুখি হয়ে সমাধানের পথ খোঁজাই জীবন।সকলের সমস্যা যেন অদিতির সমস্যা। সকলের আনন্দ যেন ওর আনন্দ। অদিতির অন্তরে যেন এক সমুদ্র প্রেম। ইনোসেন্ট সূর্য আবার কাল সকালে হামাগুড়ি দিয়ে উঠবে।
    পাখিরা দলবেঁধে বাসায় ফিরছে। সকালে নতুন উদ্যমে বাঁচার লড়াইয়ে বেরোবে। ঠান্ডা লাগছে, শালটা ফেলেই চলে এসেছে। মীনার বাবাকে বলতে হবে চেন্নাইয়ে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে। বাড়ির দিকে পা বাড়ায় ও। ডুবন্ত সূর্যের আলো এখনও ফুরিয়ে যায় নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *