গহন মন
অদিতি ঘোষ দস্তিদার
আজ আমাদের ছোটো ছেলেটা কলেজে চলে গেল। বড়টা গেছে বছর ছয়েক আগে। এখন চাকরিতে। বাড়ির বাইরেই।
মনখারাপ যে তখনও হয়নি এমনটা নয় -কিন্তু তখন তো বাড়িতে ছোটোটা ছিল। তার ওপর বড়টা বরাবরই শান্ত, চুপচাপ ধরণের। বাড়িতে আছে কী নেই টের পাওয়াও যেত না – কিন্তু এই ছোটোপুত্তুরটি জন্ম থেকেই নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে সোচ্চার! মা ছাড়া যে দুনিয়ায় কিছু আছে সেটা বুঝতে সময় নিয়েছিল অনেকটা – জ্বালাতন লাগত তখন! মনে হত কবে বড় হবে! বুকটা মুচড়ে উঠল – বড্ড তাড়াতাড়ি যেন বড় হয়ে গেল!
চারদিকে ওর জিনিস ছড়ানো – কত চেঁচিয়েছি, বকেছি সেই নিয়ে – বইয়ের পাতা খোলা, খাতা ফড়ফড়িয়ে উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায় -গেঞ্জি জাঙ্গিয়া কম্পিউটার টেবিলে- চায়ের কাপ যেখানে সেখানে উল্টে চটচটে – গাদা গাদা অভিযোগ রোজ রোজ আমার! আজ তো আরও ছড়ানো- সব কাজের জিনিস নিয়ে গেছে সে যেমন করে পারে! ছাড়া পাজামাটা পর্যন্ত দুপায়ে দাঁড়িয়ে আছে!
সারা ফ্ল্যাট ভর্তি শুধু ওর ফেলে যাওয়া জিনিসের ভিড়ে! থাক গে যাক! আজ আমার আর কিচ্ছু গুছোতে ইচ্ছে করছে না!
তীব্র অবসাদে মন ছেয়ে আছে! পড়ে থাক সব কাজ আজ!
রান্নাবান্না তেমন কিছু করার নেই। কদিন ধরে ছেলেটা যা ভালোবাসে সব করে দিয়েছি। তাই আছে কিছু কিছু। বড়টাও এসেছিল, সেই দিতে গেছে ভাইকে বেঙ্গালুরুতে। আমরা দুজনে ট্রেনে তুলতে গেছিলাম – বেশ সকালের দিকে ছিল ট্রেন!
স্টেশনেই ছেলের বাবা জোর করে চা বিস্কুট খাইয়ে ছিল -নিজেও সামান্য কিছু খেয়ে নিয়েছিল। বাড়ি ফিরে কারুরই খাবার ইচ্ছে নেই। ছেলের বাবা একটু বসার ঘরে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে, আর আমি শুধু এদিক ওদিক করে যাচ্ছি – বেলা গড়িয়ে গেল।
খালি খালিই মনটা অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। মাঝে একটু হোয়াটস অ্যাপ করে খোঁজ নিলাম। দুভাইয়ে দিব্যি আছে।
কাগজটা পড়া হয়নি সকাল থেকে – বসার ঘরের দিকে যাচ্ছি কাগজটা আনতে, বাড়ি ভরে গেল সাদা আলোয়! জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি ভীষণ কালো করে এসেছে চারদিক!
মনে পড়ল ছাদে জামাকাপড়ের কাঁড়ি! কাপড় কেচে দিয়ে গেছে কাজের মেয়েটি আমরা ফেরার পরপরই। রোদে কাঠ ফাটছিল তখন! সব শুকিয়েই এসেছে মনে হয়।
ছুটলাম ছাদে। আমাদের ফ্ল্যাটের ওপরেই ছাদ। ছাদে সচরাচর কেউ যায় না। আমাদের পাশের একটা ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না, আর একটায় ভাড়াটে ছিল উঠে গেছে মাস দুয়েক হল, নতুন কেউ আসেনি এখনও।
ছাদে পা রাখতেই একরাশ ছুটে আসা ঠান্ডা হাওয়া সারা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে গেল!
আঃ! কী শান্তি!
চোখ মেললাম আকাশে!
সারাটা আকাশ মন কেমন করা কালো মেঘে ভরা। সূর্য কোথাও একটা আছে, সোজাসুজি দেখা যাচ্ছে না তাকে। মেঘের ধূপছায়া শাড়ির পাড়ে তার সোনা জরির আলপনা! দূরে কটা নারকেল গাছ, ওদের পাতাগুলো ঠিক আমার বৌভাতের বেনারসিটার মত – রুপো মেশানো সবুজ! আমার মত আজন্মের ঘোর সংসারী কাঠখোট্টা মেয়েটারও মনটা হু হু করে উঠল! কাপড় জামাগুলো তুলতে তুলতে গুনগুনিয়ে অনেক দিনের পুরোনো গান উঠে এল বুকের কোন গোপন কুলুন্দি থেকে আর… আর বড্ড মনকেমন করে উঠল আমার ঘরের লোকটার জন্যে! আজীবন তার যে একটাই সাধ!
সারাজীবন আমার ঘরের লোকটার একটাই আক্ষেপ!
একটা গোপন ইচ্ছে।
যতবারই সেই নিয়ে হাহুতাশ করেছে আমি হেসে গড়িয়ে পড়েছি।
পরে যখন একলা আবার সেকথা নিয়ে ভেবেছি মায়াও হয়েছে। সব সাধ কি আর মধ্যবিত্তের পূরণ হয়?
লোকটা আসলে বড্ড রোমান্টিক। এই ইঁটকাঠের শহরটার রোজ দিনগত পাপক্ষয়ের মধ্যেও ওর এই কচি কলাপাতার মত নরম আর সবুজ মনটা যে বেঁচে আছে সেটা আমার ভারি অবাক লাগে।
বিয়ে হয়েছে আমার কম বয়েসেই। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোই বিয়ে পাস করে ফেলেছিলাম। তবে বিয়ে হয়েছিল একেবারে খোদ কলকাতা শহরে। শিয়ালদা স্টেশন ছিল হেঁটে পাঁচ মিনিট।
শরিকি বাড়ি। শ্বশুরেরা তিন ভাই। আমার অবস্থাপন্ন দুই জ্ঞাতি ভাসুর ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছিলেন। বাকি সবাই তিনতলা বাড়িতে গাদাগাদি। একটা ঘর জুটেছিল আমাদের রাতে শোবার জন্যে। দিনের বেলা সেটা মোটামুটি বারোয়ারি।
আমার স্বামীর ছোটখাট চাকরি একটা ছোট প্রাইভেট ফার্মে। মাইনে পত্তর এমন কিছু নয়, তাই কাজের শেষে দু একটা টিউশন না করলে চলে না। সে সব সেরে রাতে বাড়ি ফেরা ক্লান্ত শরীরে। আমারও তখন সারাদিন সংসারের ঊনকোটি ঝামেলা সামলে বিধ্বস্ত অবস্থা।
কিন্তু সেই রাতগুলো শুধু জৈবিক তাগিদে ভরা থাকত না। সারাদিনের ধকল সত্ত্বেও আমার ভদ্রলোকটি রাতের বেলায় গল্প করত – কখনও অফিসের বা ছাত্রদের আবার কখনও বা বাস ট্রামের মজার ঘটনা। শুনতে চাইত আমার একঘেয়ে দিনলিপিও। ছোট ছোট কথায় হাসির ফুলঝুরি জ্বলত। তবে হাসি কথা সবই ফিসফিসিয়ে। পাশের ঘরেই তো শ্বশুরমশাই।
একদিনের কথা বেশ মনে পড়ে।
শহরের বুকে থাকলেও আমার শ্বশুরবাড়ি খুব সেকেলে। বাড়ির বৌদের শাড়ি ছাড়া অন্য কোন পোশাক ব্যবহারের নিয়ম ছিল না। মাথায় ঘোমটা।
বিয়ে হয়েছে তখন বোধহয় মাস দুই তিন। রাতে শোবার আগে গা ধুয়ে একটা পরিষ্কার শাড়ি না পরলে আমার খুব অস্বস্তি হয়। রাতে শুতে এসেছি। ঘরের দরজা বন্ধ সবে ভেজিয়েছি পেছন থেকে এসে সে আমায় জড়িয়ে ধরেছে – কানে ফিসফিসানি, “পরে দেখাবে?”
হাতে ঝুপ করে পড়েছে একটা সাটিনের নাইটি!
গোপনে, খুব গোপনে রেখেছি সেই নাইটি। ভয়ে কাচতেও পারিনি, যদি কেউ দেখে ফেলে!
এই রকমই ছোট ছোট শখ তার বউকে ঘিরে! পয়সা তো বেশি নেই, সংসারের দুকুড়ি সাতের খেলার দান মিটিয়ে চুপিচুপি আনে বাহারি ক্লিপ বা রঙ্গিন কাচের চুড়ি বা শান্তিনিকেতনী পয়সার ব্যাগ, আমার জন্মদিনে, বিয়ের তারিখে বা নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে!
এই লোকটিই বিয়ের কিছুদিন পর একদিন ঘোর বর্ষার রাতে আবেগ গদগদ সুরে বউকে বলেছিল, “বড় সাধ যায় তোমাকে নিয়ে একসঙ্গে ভিজি!”
শুনেই আমার প্রথমে মনে পড়েছিল হিন্দি সিনেমার নায়ক নায়িকার একসঙ্গে ভেজার সিনগুলো। সেই জায়গায় নিজেদের ভেবে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিলাম! কিন্তু তারপরই নাইট ল্যাম্পের আবছা আলোয় ওর ব্যথাভরা মুখটা দেখে সামলে নিয়েছিলাম – আসলে রোমান্স কী, তা তখনও অবধি বোধহয় জানা ছিল না!
“হাসছো! ভাবছো আমি পাগল তাই না! এই সেকেলে বাড়ির ফুটো পয়সার মালিক হয়েও শখ যায় না, তাই ভাবছো তো!”
আমার চোখে তখন জল এসে গেছিল! আরো কাছে ঘেঁসে এসেছিলাম! ওর নিশ্বাস ঘন হয়ে এসেছিল,
“সত্যি আকাশভাঙা বৃষ্টিতে তোমাকে নিয়ে ভেজার বড্ড ইচ্ছে আমার!”
“এ আবার এমন বড় কথা কী! নিশ্চয়ই হবে কোনও একদিন!” আমি আশ্বাস দিয়েছিলাম আদরে আশ্লেষে মিশে গিয়ে।
বলা সহজ হলেও মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে কাজটা যে খুব সহজ নয় বোঝা গেল দিনে দিনেই।
শরিকি বাড়ি- সব সময়েই গিজ গিজ করছে লোক! ছাদটা ছিল মস্ত। কিন্তু একটা ঘর ছিল সেখানে। আমার এক আর্টিস্ট খুড়শ্বশুর একা থাকতেন সেখানে। ওটাই ওনার স্টুডিও ছিল। তাই বাড়ির বৌরা কোন রকমে ছাদে ভেজা জামাকাপড় মেলেই পালিয়ে আসত। তাই আমরা দুজনে মিলে ছাদে উঠব, এটা মোটামুটি অবাস্তব কল্পনা।
বিয়ের পর বেড়াতে যাওয়াও হাতে গুনে। আর সে যাওয়া মানে তো বলতে গেলে সবার সঙ্গেই। বাসে করে কামারপুকুর, জয়রামবাটী বা দীঘা। পুরী একবার গেছিলাম তিনদিনের জন্যে, তখন তো দুই ছেলে সঙ্গে।
প্রতিবছর বর্ষা আসে আর ফিরে যায়! তার সাধ আর পূর্ণ হয় না!
একদিনের কথা মনে পড়ে এখন হাসিও পায়, দুঃখও হয়!
শ্রাবণ মাসের একদিন। খুড়শ্বশুর বাড়ি ছিলেন না, দিল্লি গেছিলেন কোনও একটা এগজিবিশনে। কী যেন একটা কারণে ওর অফিস ছুটি ছিল সেদিন, আজ আর মনে নেই। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর দেখি আকাশ কালো করে মেঘ করেছে, বৃষ্টি এল বলে!
দুপুরে খাবার পর ঘরে আসতে ও চুপিচুপি বলেছিল, “সবাই ঘুমোলে ছাদে চলে যাবে, আমি ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি!”
তখন বড় ছেলে বছর তিনেক বোধহয়, ছোটোটা হয়নি।
ঠিক এমনই মেঘে ভরা আকাশটা ছিল বোধহয় সেদিনও –আকাশ ফালা ফালা করা বিদ্যুতের চমক, আর সোঁদা মাটির গন্ধ মাখা ঠান্ডা হাওয়া জানান দিচ্ছিল দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে! আমি ওর বুকে মাথা দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম বৃষ্টির! কতক্ষণ কেটে গেল কিন্তু দু এক ফোঁটা করে শুধু বৃষ্টি হল। ভেজার মত নয়!
তারপর এক্ সময় নিচ থেকে ছেলের কান্না, শাশুড়ির চিৎকার! আমি দুদ্দুড়িয়ে নেমে এলাম। ছেলের ঘুম ভেঙে যেতে মা বাবাকে না দেখে কান্না জুড়েছে, আর তার ঠাকুমাও বাড়ি মাথায় করেছেন!
এরপর তো ছোট ছেলে হল। সেই পুরনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট উঠল। আমরা পেলাম এই চারতলার দু কামরার ফ্ল্যাট! সব সাধ আহ্লাদ তখন বাচ্চাদের ঘিরেই!
তাও ছেলেদের বাবা মাঝে মাঝেই বলত, “এরা যখন দূরে যাবে, তখন তুমি আর আমি যা যা সাধ মেটাতে পারিনি জীবনে সেগুলো করব!”
আমি মুচকি হেসে চোখ টিপে বলতাম, “বৃষ্টিতে ভেজা?”
জোর গলায় উত্তর আসত, “হবে, হবে, সব হবে! এগুলো যাক আগে, দেখবে তখন! আমার রোমান্স কিন্তু একটুও কমেনি!”
আজ কেন জানি না সব কথা বুকের মধ্যে কেমন যেন দলা পাকাচ্ছে! সব দোষ এই ভিজে হাওয়ার! হঠাৎ নিজের কেমন এক লজ্জা হল! বলব নাকি লোকটাকে ছাদে আসতে!
দশবার হ্যাঁ না এর দোলায় যখন নাজেহাল, কাপড় জামা তুলে নিয়ে নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে। দেখি সে কী বলে!
নিচে এসে কাপড় জামার ডাঁই সোফাতেই জড় করলাম। কিন্তু বসার ঘরে দেখতে পেলাম না লোকটাকে। গেল কোথায় এখানেই তো ঘুমোচ্ছিল! বেডরুমের দিকে যেতে গিয়ে ছোটটার ঘরের দরজা বন্ধ। খোলাই তো ছিল, বন্ধ করল কে? ঘরে ঢুকে দেখি, সব পরিপাটি করে গোছানো। তবে কী?
ঘরটার দিকে তাকিয়ে আবার মনটা ভিজল। কিন্তু ওর বাবা কোথায়? গলা চড়ালাম।
“কই গো! গেলে কোথায়! আকাশ জুড়ে মেঘ! বাড়ি ফাঁকা! তোমার আজীবনের সাধ আজ মিটতে পারে কিন্তু…”
বলতে বলতে আমাদের ঘরে ঢুকেই থমকে যাই আমি!
বিছানায় বসে লোকটা! আর চারদিকে ছড়ানো ফটো! ছেলেদের ছোটবেলার!
আমাকে দেখে ও বিছানা থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরল! দুজনেই ভিজলাম মনখারাপের শ্রাবণধারায়!
বাইরে ঝেঁপে বৃষ্টি এল অনেকদিনের পর!
অসম্ভব ভাল লাগলো।
কী অসাধারণ ভালবাসার গল্প। অনেক ভালবাসা লেখককে।
দারুণ!ভীষণ ভাল লাগল। অভিনন্দন!
ভীষণ ভাল গল্প। অভিনন্দন
আমরাও ভিজলাম। ভালো লাগার অঝোর ধারায়।