রবীন্দ্রনাথ – প্রসঙ্গ : জগৎ ও সৃষ্টি
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী
জগৎ সৃষ্টি প্রসঙ্গে কিশোর বয়সেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জগতের বিশালতা ও বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন তা তাঁর লেখায় যেন স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের সকলের গুরু এবং বিশ্বকবি। তাঁর কাছে এই বিশ্বের কোন ধর্ম অনাদরের ছিল না। সকলকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েই তাঁর এগিয়ে যাওয়া। সেজন্য তাবৎ পৃথিবীর সকলের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আদরণীয় কবি।
তাঁর রচনা, বিশেষ করে কবিতা আর গানে লেগেছে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। কেননা, ছোটবেলা থেকেই তাঁকে পড়তে হয়েছে উপনিষদ। কিশোর বয়সে তাঁর উপর পড়েছিল ব্রাহ্মধর্মের পত্রিকা ‘ তত্ত্ববোধিনী ‘ সম্পাদনার। সবাই জানেন, এই ব্রাহ্মধর্মের মূল স্রষ্টা রাজা রামমোহন রায় ঈশ্বর ‘ একমেবাদ্বিতীয়ম্রা ‘ সা জগৎ ব্রহ্মাণ্ডে ঈশ্বর এক এবং তাঁর আর দ্বিতীয় কেউ নেই উপনিষদের ধারণা ও বিশ্বাসে ব্রাহ্ম সভা তৈরী করেছিলেন। উপনিষদের প্রধান উপজীব্য ব্রহ্ম আর এই ব্রহ্ম হলেন জগৎ স্রষ্টা।
উপনিষদ মণ্ডিত হয়ে তাঁর অন্তরাত্মা এই জগতের প্রতি, সকল বিশ্বাসের প্রতি, সব সৃষ্টির প্রতি হয়ে উঠেছিলেন সমদর্শী আর প্রেমী। আর এই প্রেম ও সমদর্শিতা স্বাভাবিক ভাবে তাঁর বিভিন্ন লেখায় আপনা আপনি জায়গা করে নিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে কবিতায় যে ‘ তুমি ‘ সম্বোধন করেছেন সেই ‘ তুমি ‘ যে পরমেশ্বর পরমতম ব্রহ্ম বা ঈশ্বর তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ইত্যাদি গ্রন্থের শ্রীকৃষ্ণকেই স্বয়ং পরম ব্রহ্ম পরমতম জগদীশ্বর বলে বারবারই আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে কবির হৃদয়ে এবং হৃদয়ের প্রকাশে অর্থাৎ তাঁর রচনায় বিশেষ করে কবিতায় গানে যেন আমরা শুনতে পাই শ্রীকৃষ্ণের হাতে ধরা মোহন বাঁশির অপরূপ সুরের ধ্বনি। প্রথম কৈশোরে তিনি রচনা করেন ‘সন্ধ্যা সংগীত ‘ যার শুরুই করেছেন ” অনন্ত আকাশতলে বসি একাকিনী ” ছত্র দিয়ে। এই অনন্ত আকাশ শব্দে কবি বিশ্বজগতের অন্তহীন বিস্তৃতি অনুভব করিয়েছেন। তিনি নিজেও এই প্রেক্ষিতে বলেছেন – সন্ধ্যা সঙ্গীতেই আমার কাব্যের প্রথম পরিচয় “।
বিশ্বকবির হৃদয়ের প্রেমধারা পুরোপুরি বোঝার সাধ্য নেই। তবু মনে পড়ে ১১ পৌষ ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্র জয়ন্তীতে পাঠ করার জন্য লিখিত পুস্তিকাকারে “প্রতিভাষণ” নামে মুদ্রিত অংশটি বিশ্বভারতী প্রকাশিত প্রথম রচনাবলীতে ব্যবহৃত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে পঃ বঙ্গ রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর ১ম খণ্ডের অবতরণিকায় তাঁর লেখা :-
“আমাদের বাড়িতে আর একটি সমাবেশ হয়েছিল সেটি উল্লেখযোগ্য। উপনিষদের ভিতর দিয়ে প্রাক পৌরাণিক যুগের ভারতের সঙ্গে এই পরিবারের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। অতি বাল্যকালেই প্রায় প্রতিদিনই বিশুদ্ধ উচ্চারণে অনর্গল আবৃত্তি করেছি উপনিষদের শ্লোক। এর থেকে বুঝতে পারা যাবে সাধারণত, বাংলাদেশে ধর্ম সাধনায় ভাবাবেগের যে উদ্বেলতা আছে আমাদের বাড়িতে তা প্রবেশ করেনি। পিতৃদেবের প্রবর্তিত উপাসনা ছিল শান্ত সমাহিত।”
আমরাও বুঝতে পারছি যে, বিশ্বকবি হওয়ার পেছনে পারিবারিক পরিমণ্ডল ওতপ্রোতভাবে মণ্ডিত। আর সেজন্যই কবিগুরুর সাহিত্যে সমগ্র ভারতবর্ষের মনীষীদের পরম্পরা ধ্বনিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে তা হয়ে উঠেছে আরও আধুনিক। তার সঙ্গে পুরাণ, গৌতম বুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বতন ও পরবর্তী সাধক কবিদের মননে ও চিন্তার যে রসবোধের স্ফূর্তি ঘটেছিল সেসবের প্রভাব ফেলে দেবার নয়।
তিনি নিজেই লিখেছেন :-
” অনেক দিন থেকেই লিখে আসছি, জীবনের নানা পর্বে নানা অবস্থায়। শুরু করেছি কাঁচা বয়সে – তখনো নিজেকে বুঝিনি। তাই আমার লেখার মধ্যে বাহুল্য এবং বর্জনীয় জিনিস ভুরি ভুরি আছে তাতে সন্দেহ নেই। এ সমস্ত আবর্জনা বাদ দিয়ে বাকি যা থাকে আশা করি তার মধ্যে এই স্পষ্ট যে, আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে যে মুক্তি পরমপুরুষের কাছে আত্মনিবেদন, আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য সেই মহামানবের মধ্যে যিনি ‘ সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ’। আমি আবাল্য – অভ্যস্ত ঐকান্তিক সাহিত্য সাধনার গণ্ডিকে অতিক্রম করে একদা সেই মহামানবের উদ্দেশে যথাসাধ্য আমার কর্মের অর্ঘ্য আমার ত্যাগের নৈবেদ্য আহরণ করেছি – তাতে বাইরের থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি অন্তরের থেকে পেয়েছি প্রসাদ। আমি এসেছি এই ধরণীর মহাতীর্থে – এখানে সর্বদেশ সর্বজাতি ও সর্বকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্রে আছেন নরদেবতা – তাঁরই বেদীমূলে নিভৃতে বসে আমার অহংকার আমার ভেদবুদ্ধি স্খালন করবার দুঃসাধ্য চেষ্টায় আজও প্রবৃত্ত আছি।” (ঐ)
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা ও গানে প্রায়ই শোনা যায় বাঁশির কথা। কবির হৃদয় যেন বাঁশি। আমাদের হৃদয় ও তিনি বাঁশি করে তোলেন। এই বাঁশির মালিক আমরা কেউ নই। মালিক তিনি, যিনি এই জগৎ সংসারের মালিক। তিনি পরমেশ্বর পরমাত্মা পরমপুরুষ সর্বশক্তিমান, ‘ আত্মারামশ্চ আত্মারাম ‘ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যাঁর নানান নাম নানান বিশ্বাসে এবং তিনিই একমাত্র পরম পূজ্য। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া এই জগৎ চলে না, ফসল ফলে না, ফুল ফোটে না, কিছুই হয় না। তাই প্রভাত সংগীতের প্রথম রচনা ‘ আহ্বান সংগীতে ‘ তিনি জগৎ ফুলের কীটকেও আহ্বান করেছেন। এই বিশ্বজগতের সমস্ত সৃষ্টিকে আর হা হুতাশ না করে বেরিয়ে আসতে আহ্বান করেছেন। সম্ভাবনাময় অস্ফুটকে উচ্চকিত হয়ে প্রস্ফুটমান হতে নিমন্ত্রণ করেছেন। তা নাহলে যে সৃষ্টিকে শুকিয়ে যেতে হবে, ঝরে পড়তে হবে সকালের শিউলির মত। কবির আহ্বান এই জগৎ সৃষ্টির রহস্যময় কোটর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য।
সৃষ্টির আদিতে কোথাও কিছু ছিল না। সব ছিল রহস্যময় কোটরে। তাই বিশ্বকবি গেয়েছেন :-
“আর কতদিন কাটিবে এমন,
সময় যে চলে যায়।
ওই শোন্ ওই ডাকিছে সবাই,
বাহির হইয়া আয়।”
যেন কবি বলছেন একদিন এই জগৎ সংসার বলে কিছুই ছিল না, ছিল শুধু শূন্যতা আর নিঃসীম অন্ধকার। আজ প্রয়োজন সৃষ্টির নতুন করে আত্মপ্রকাশের, নানান রঙে ভরা, পাখির কলকাকলিতে ভরা, ব্যস্ততার কোলাহলের জেগে ওঠা জগতের, প্রয়োজন জীবনের। প্রয়োজন ঊষার আলো। আলো ছাড়া এই জগতের কিছুই তো দেখা যাবে না। এই জগৎকে বিকশিত হতে হবে। কত সময় আর অপেক্ষা করা যায় !
সত্যিই, কোথাও কিছু ছিল না। শ্রীঅরবিন্দ ঋষি ‘সাবিত্রী’ কাব্য গ্রন্থের শুরুতেই ব্যক্ত করেছেন :-
“IT WAS the hour before the Gods awake.
Across the path of the divine Event
The huge foreboding mind
of Night, alone
In her unlit temple of
eternity,
Lay stretched immobile
upon silence’ marge.”
যেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকুল আহ্বানে সত্যিই চারিদিকের শূন্যতা আর ঘোর অন্ধকার ভেদ করে আলো প্রকাশিত হল, ঘুম ভাঙল সৃষ্টির, জেগে উঠল এই জগৎ :- “আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর।
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত পাখির গান।
না জানি কেনরে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ।”
শ্রীঅরবিন্দ ব্যক্ত করেছেন – All sprang to their unvarging daily acts” (সাবিত্রী)
কবিগুরুও কিশোর বয়স কালেই উপলব্ধি করেছেন তাঁর উপরোক্ত এই ‘ নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ‘ কবিতায় :-
” কী জানি কী হল আজি জাগিয়া উঠিল প্রাণ,
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান —
‘ ‘পাষাণ-বাঁধন টুটি, ভিজায়ে কঠিন ধরা,
বনেরে শ্যামল করি, ফুলেরে ফুটায়ে ত্বরা,
সারা প্রাণ ঢালি দিয়া,
জুরায়ে জগৎ-হিয়া –
আমার প্রাণের মাঝে কে আসিবি আয় তোরা !’
তবুও কবির মনে হয় – এসব হয়তো তাঁর স্বপ্ন মাত্র। তাই তিনি কবিতার অন্তিম অংশে ব্যক্ত করেন তাঁর স্বাধীনতার অভীপ্সা :-
“ওরে, চারিদিকে মোর
একী কারাগার ঘোর !
ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্।
ওরে, আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এসেছে রবির কর !”
ঐ অল্প বয়সে লেখা ‘ প্রভাত সংগীত ‘ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘প্রভাত উৎসব’ কবিতায় দেখি – রাতের অন্ধকার শেষে, গাঢ় ঘুমের শেষে প্রভাতের আলো আর জেগে ওঠার আনন্দই আলাদা আস্বাদনের। অজস্র মানুষ তো ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু আর জেগে ওঠেনা। ঘুমের রাত আর শেষ হয়না। কিন্তু কিশোর রবীন্দ্রনাথ জানেন কোটি কোটি মানুষ আবার জেগে উঠে ভোর ও পায় প্রতি প্রভাতে মুনিঋষিরা পান প্রতি ঊষার লগ্ন আবার মানুষের বিশ্বে মানুষের জন্য কাজ করার সারাদিন ধরে।
নতুন দিনের নতুন উৎসাহে সবাই আবার নতুন নতুন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। নতুন উদ্দীপনা পায় প্রায় সকলেই। কেননা ভোর নিয়ে আসে নতুন আশ্বাস। যেন পুলকিত হয়ে ওঠে সবাই, সব শিশুরা। পুলকিত হৃদয়ে কবি লেখেন :-
তরুণ আলো দেখে পাখির কলরব –
” মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব!
মধুর মধু আলো, মধুর মধু বায়,
মধুর মধু গানে তটিনী বয়ে যায়।…”
এই সুন্দর আমাদের পৃথিবীর সব কিছুই মধু মনে হয়। না দেখতে পেলেও পৃথিবী ছাড়িয়ে এই জগৎসংসার মধুময় মনে হয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদের সাবিত্রী মন্ত্রটির একটি অংশ :-
” মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ। মাধ্বীর্ণঃ সন্তোষধী…অর্থাৎ বায়ুসমূহ ঋতকামীর জন্য মধু ক্ষরণ করে, নদী সমূহ মধু ক্ষরণ করে, ওষধিসমূহ আমাদের কাছে মধুময় হোক।
” মধু নক্তমুতোষসো মধুমৎ পার্থিবৎ রজঃ।
মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা।”
আমাদের রাত্রি দিন মধুময় হোক, পৃথিবীর উপরের বায়ুমণ্ডল এবং আমাদের পিতা ‘দ্যৌ’ মধুমান হোক।
” মধুমন্নো বনস্পতিমধুমান্ অস্তু সূর্যঃ।
মাধ্বীগার্বো ভবান ভবন্তু নঃ।”
বনস্পতি আমাদের কাছে মধুময় হোক, সূর্য ও গাভী সমূহ মধুমান হোক।
প্রভাত উৎসবে তো আমরা আমাদের চারপাশের সবকিছু, আমাদের প্রয়োজনের সবকিছু মধুময় হয়ে উঠুক, – এই আকাঙ্ক্ষাই করবো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উপনিষদ ভাবনায় সে আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে ধরা দেয়। তাই, নৈসর্গিক মাধুর্য আলাদা এক মাত্রা পায়। তিনি ভাবে বিভোর হয়ে বলতে পারেন :- ” নয়ন ডুবে যায় শিশির-আঁখি ধারে,
হৃদয় ডুবে যায় হরষ-পারাবারে ।
কবি জগতের সর্বত্র মহান সৃষ্টিকর্তার ও তাঁর সৃজনের অপরূপ সৌন্দর্য অনুভব করেন। অনুভব করেন প্রভাতরবির অকৃপণ সম্বর্ধনা আর লেখেন :-
” বারেক চেয়ে দেখো আমার মুখপানে –
উঠেছে মাথা মোর মেঘের মাঝখানে,
আপনি আসি ঊষা শিয়রে বসি ধীরে
অরুণকর দিয়ে মুকুট দেন শিরে,
নিজের গলা হতে কিরণমালা খুলি
দিতেছে রবি-দেব আমার গলে তুলি !”
তাতেই প্রভাত উৎসব সার্থক হয়ে ওঠে। প্রভাত উৎসবে জগৎ চরাচরের সবাই একেবারে সবাই থেকে সবকিছু তাঁর ভাই, কেননা এই জগতের সবকিছু সবাই এক ই স্রষ্টার তৈরী। কেউ কারোর পর নই। সবাই ভাই ভাই।
“অনন্ত জীবন” কবিতায় তিনি বারবার আশ্বাস দিয়েছেন :-
” নাই তোর নাইরে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।”
‘ মরে না ‘ কথার অর্থ সম্ভবত, শেষ হয়ে যাওয়া। এই জগতে সৃষ্টির সময় যা যা ছিল, ভবিষ্যতেও তা তা থাকবে। মহাজাগতিক অলিখিত নিয়মে সবকিছুর রূপান্তর বা পরিবর্তন ঘটে মাত্র। কিচ্ছুটি মরেনা বা একেবারে নিঃশেষিত হয় না। অবস্থা বা রূপের পরিবর্তন হয় মাত্র। এই জগতে আছে অনন্ত জীবন, তেমনই আছে অনন্ত মরণ। আর এইটাই জগতের প্রাকৃতিক নিয়ম, নিয়ম জগৎস্রষ্টার, নিয়ম বিশ্বনিয়ন্তার। নিয়ম চলে অবিরাম, নির্বাধ তার গতি। কাজেই ভয় পাবার কোন কারণ নেই, আমি তুমি ছিলাম, আছি আবার থাকবোও। তবে অন্য রূপে অন্য নামে যা হয়তো মনে পড়ছে না বা মনে থাকবে না। তবু কবি ‘ অনন্ত মরণ ‘ কবিতায় বলেন :-
” জীবন্ত মরণ মোরা মরণের ঘরে থাকি
জানি নে মরণ কারে বলে।”
আমরা বুঝতে পারলাম বিশ্বসৃষ্টিতে এক অমোঘ ও অপূর্ব লীলার খেলনা মাত্র, আমরা ক্রীড়নক ছাড়া আর কিছু নই। ক্রীড়নক আমরা ।আমাদের এই জগতে বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া, ভালোলাগা এমনকি আমাদের ভালোবাসাও। কিছুই এর বাইরের নয়।
কবিগুরু জানেন, এই জগতে ঘটে থাকে সৃষ্টি স্থিতি লয়। তিনি জানেন, একদিন এই পৃথিবী ভেঙ্গে যাবে। একদিন এই জগৎ ভেঙ্গে যাবে। ভেঙ্গে যাবে একে একে গ্রহতারারা, ভেঙ্গে ভেঙ্গে মিলে যাবে একেকটি বিম্বের মতন। আর ” চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ চেয়ে জ্যোতির্ময় মহান্ বৃহৎ জীব-আত্মা মিলাইবে একেকটি জল বিম্ববৎ।” তবু তাঁর কাছে প্রশ্ন থেকেই যায় – (মহাস্বপ্ন)।
তবে, উপনিষদ বলছেন :-
” ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।। “
একথার অর্থ হল ব্রহ্ম পূর্ণ জগতের অতীত ও জগৎব্যাপি । জন্ম বা সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মের একত্বের বা পূর্ণত্বের কোন হেরফের হয়না। পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলেও পূর্ণ পূর্ণই থাকে।