গল্পঃ বাপ্পার পরিবার – ভূমিকা গোস্বামী ( সোদপুর)

বাপ্পার পরিবার
ভূমিকা গোস্বামী

শীতের শুরুতে পাড়ার লালিটা চার পাঁচটা বাচ্চা দিয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট নধর নধর বাচ্চাগুলো পাড়ার গলিতে খেলে বেড়ায়। দশ বছরের বাপ্পা বায়না জুড়েছে একটাকে ও ঘরে এনে পুষবে। বাপ্পার বাবা মা রাজী নয়। মা বলল -দ্যাখ , আমাদের একটা মাত্র ঘর। তাও আবার বেশী বৃষ্টি হলে ঘরে জল ঢুকে যায়। আমরাই তখন এই খাটের ওপরে বসে থাকি। ও কোথায় থাকবে ?
এদিকে বাপ্পার তো কিছুই ভাল লাগছে না। ওর ওই এক কথা – আমি যেখানে থাকবো,আমার কোলের কাছে ই ও থাকবে।
বাপ্পার বাবা একটা গেঞ্জির কারখানায় কাজ করে। মা দুটো বাড়িতে রান্না করে। কষ্ট করে সংসার চালায়। তবে ওরা দুজনেই চেষ্টা করে ছেলেকে আনন্দে রাখতে। মনমরা হয়ে বসে থাকা বাপ্পাকে দেখে তাই এবারেও ছেলেকে খুশি করতে রাজি হল বাপ্পার বাবা মা। বাপ্পাও হাসিমুখে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে ইট ইট রংয়ের নধর বাচ্চাটাকে কোলে করে বাড়িতে নিয়ে এল। মাকে বলল- মা মা মোতিকে দুধ দাও। ওর খিদে পেয়েছে।
এখন বাপ্পার অনেক কাজ। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে , জুতোর বড় বাক্স থেকে মোতিকে নিয়ে সোজা রাস্তায়। তারপর লালিকে ডেকে মোতিকে ওর কোলের কাছে নামিয়ে দেয়। বলে – মোতি , দুধ খা। পেট ভরে খাবি কিন্তু। কতকত করে দুধ খায় মোতি। তৃপ্তি করে। বাপ্পা রান্নাঘর থেকে গামলায় রাখা আগের দিন মার তৈরী দুটো বাসি রুটি নিয়ে ছুট্টে এসে লালির মুখের কাছে ধরে।
মোতির দুধ খাওয়া হলে ওকে রারান্দায় রেখে গ্রীলের দরজা আটকে খাটের ওপর পড়তে বসে। মা বিস্কিট আর একগ্লাস দুধ ওর সামনে রেখে কাজে চলে যায়। পড়তে পড়তে দেখে মোতি সারা ঘর ঘুরে বেরাচ্ছে। মাঝে মাঝে খাট থেকে নেমে একটু আদর করে আসে মোতিকে। মোতি তখন জোরে জোরে লেজ নাড়তে নাড়তে ওকেও অনেক আদর করে।
মা কাজ থেকে এসে রান্না করে। দশটা বাজলে ও যখন স্নান করে , মোতিকেও ও স্নান করিয়ে দেয়। মা মাটিতে আসন পেতে ওকে খেতে ডাকলে, স্কুল ড্রেস পরে আসনে এসে বসে। মা আলুসেদ্ধ আর ডিম সেদ্ধ দিয়ে গরম গরম ভাত ঘি দিয়ে মেখে ওকে খাইয়ে দেয়।
মা এদিকে মোতির জন্য প্রেসার কুকারে অনেক সিটি দিয়ে ভাত রান্না করে আলু আর টমেটো সেদ্ধ দিয়ে। বাপ্পা সেই ভাত একবাটি এনে মোতিকে খাইয়ে স্কুলে চলে যায় । মোতি এখনও তো শক্ত জিনিস খেতে পারে না।
স্কুল থেকে ফিরলে মা ওকে ডাল তরকারি মাছ দিয়ে ভাত খাইয়ে দেয়। আর ও মোতিকে। তারপর ওদের গলি তে মোতির অন্য ভাইবোনদের তুলে বারান্দায় এনে মোতির সাথে খেলতে দেয়। তখন ওর বন্ধুরাও আসে । সবাই মিলে মোতির খেলা দেখে । খুব মজা পায় ওরা। সন্ধ্যেবেলা কোচিং য়ে পড়তে যায়। মা ও তখন কাজে যায়। একা মোতি তখন ঘরে থাকে। বাপ্পা পড়ে যখন বাড়ি ফেরে তখন মোতি কি যে করতে থাকে ! হাতের ব্যাগটা ও রাখতে পারে না। একবার পায়ে তো একবার মাথায় লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে। আর সমানে ল্যাজ নাড়াতে নাড়াতে উঁ উঁ করতে থাকে। বাপ্পা পিঠে গায়ে হাত বোলায় , আদর করে। ওর মা রান্না ঘর থেকে বলে – ওরে মোতি, ছাড় ছাড় । বাপ্পাকে ঘরে তো আগে ঢুকতে দে। বাপ্পা বলে , -এতক্ষণ ও একা ছিল তো তাই অমন করছে।

বেশ আনন্দেই দিন কাটছিল ওদের । মোতিও এখন বেশ বড় হয়েছে আর দেখতেও বেশ সুন্দর হয়েছে।
এবার নববর্ষের রাত থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।আর বৃষ্টি মানেই বাপ্পাদের ঘরে নোংরা জল। নিজেরা কোন রকমে খাটের ওপরে বসে শুকনো খাবার খেয়ে থাকবে। মোতিকে কোথায় রাখবে। চিন্তা করছে ওরা। ভোর বেলা চোখ মেলেই বাপ্পা দেখল ঘরের মেঝেতে জল। লাফ দিয়ে উঠে মোতির খোঁজ করতেই দেখল মোতি কুন্ভুলি পাকিয়ে বাসনের ট্রাঙ্কের ওপর শুয়ে আছ। এমন সময় বাপ্পার মাথায় একটা আইডিয়া এল। ওর বাবাকে বলল– বাবা বাবা আমাদের পায়খানার ট্যাঙ্কটা তো বেশ উঁচু। ওখানে তো জল ওঠে না। চল ওখানেই মোতি থাকবে। বলেই, জাজিমের ওপরে পাতা ছিল বড় একটা প্লাস্টিক। ওটাকে টেনে বের করে , দৌড়ে বাড়ির পিছনে চলে গেল । ওখানে অনেকগুলো বাঁশ আমগাছের সাথে বাঁধা ছিল , সেখান থেকে গোটা চারেক বাঁশ নিয়ে এল ।
তারপর বাবা মা আর বাপ্পা মিলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মোতির সুন্দর আস্থানা বানিয়ে ফেলল। মোতিও কিন্তু বাপ্পার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমানে ভিজেছে। ওরা ওকে সরাতে চেষ্টা করলেও এইসব দেখে পাশের বাড়ির টুটুদা ওদের বাড়ি থেকে কাঠের ফলের দুটো বাক্স দিল।
বাক্সদুটো পাশাপাশি রেখে মোতির খাট তৈরী হয়ে গেল।
আজ দুপুরে মা রান্নাঘরে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আলু সেদ্ধভাত রান্না করতে পেরেছে । ওরা খাটের ওপর বসে তাই খেয়েছে। মোতিও চুপচাপ তাই খেয়ে নিয়েছে।
বাবা মাকে বলল — আর কিছুদিন কষ্ট কর। সরকার থেকে বাড়ি করার টাকা দেবে বলছে। এ্যাপলাই করেছি। এবার বেশ উঁচু করে বানাবো।
বাপ্পা বলল – তখন মোতির জন্যেও ছোট্টো একটা ঘর করবে তো বাবা ?
বাবা সস্নেহে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে – করব বাবা।

2 thoughts on “গল্পঃ বাপ্পার পরিবার – ভূমিকা গোস্বামী ( সোদপুর)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *