খোকনের ঘর
ভূমিকা গোস্বামী
আশি ছুঁই ছুঁই ভুবনেশ্বর দেখল – সাত সকালেই লীনা আজ ভারি ব্যস্ত। বলল- কী ব্যাপার! সকাল সকাল কী এত কাজ করছো? বসো না একটু! হাতের ঝাড়নটা মাটিতে রেখে, দেয়াল আলমারি থেকে দুটো পিতলের কারুকার্য করা ফুলদানি বের করতে করতে বলল – বাঃ ভুলে গেলে! আজ প্রথম শনিবার। খোকন– বৌমা আর মিঠিকে নিয়ে আসবে। জান তো! খোকন একটা গাড়ি কিনেছে। নিজেই ড্রাইভ করে। কাল তো ফোনে বলছিল – মাগো , এখন আর চিন্তা নেই। তোমার যেখানে যেতে ইচ্ছে করবে , আমি তোমায় নিয়ে যাব।
তুমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই তো ইলিশ মাছ, সবজি সব কিনে ফেলেছি। আমার হাতের রান্না খেতে খোকন খুব পছন্দ করে। আর বৌমা তো প্রতিবারই রান্নার রেসিপি লিখে নিয়ে যায়। বলে,
–” জান তো মা ! সব ঠিক ঠিক করে দিই, কিন্তু তোমার মতো এমন স্বাদ ওঠে না আমার হাতে। তোমার হাতে যাদু আছে…..”
হাসতে হাসতে লীনা বলল — “আজ ভাবছি – ইলিশ ভাপা করবো , বিউলির ডাল , আর সাহী বাটার পনীর। বিউলির ডাল আমার খোকনের খুব পছন্দ। বৌমা আবার সাহী বাটার পনীর ভীষণ ভালবাসে। মিঠির তো উচ্ছে আর পটল ভাজা পেলে আর কিছুই চাই না।”
ভুবনেশ্বর দেখছে — আজ কত খুশিতে আছে লীনা। গুটি পোকা যেন প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলেছে।
ছবির মতো সাজিয়েছে ঘরগুলো। বাগান থেকে পাতাবাহার আর ফুল দিয়ে তুলে রাখা পিতলের কলসী আর ফুলদানি ঘরের কোণে কোণে…. সারা বাড়ি রান্নার সুগন্ধে ম ম ….
বেলা দশটার মধ্যে স্নান সেরে চওড়া লাল পেড়ে শাড়ি আর বড় লাল টিপে কী সুন্দর যে লাগছে…
রাতের খাওয়া সেরে ওরা এইমাত্র গেল।
সারাটা দিন জমজমাট ছিল বাড়িটা। বাবা, মা, ঠাম্মি, দাদু ,ডাকগুলো এতটা মধুর …. নিঃশব্দ প্রাণহীন বাড়িটা যেন হঠাৎ করে জীবন্ত প্রাণবন্ত….
সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে লীনা। ভুবনেশ্বর ওর মুখের থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে ভাবল — আজ স্লিপিং পিল দেওয়ার আগেই কেমন ডিপ স্লিপ।
পনেরো বছর – ওদের একমাত্র সন্তানের সাথে কোন যোগাযোগ নেই।
প্রভিডেন্টে ফান্ড থেকে লোন নিয়ে বাবানকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে ছিল ভুবনেশ্বর। বছর যেতে না যেতেই বাবান জানাল — পড়া ছেড়ে যব নিয়েছে। তারপর একদিন বলল — বিয়ে করেছে । ফোন করতো না। লীনা ফোন করলে বিরক্ত হত।
পনেরো বছর আগে পুজোর সময় আসবে বলল। লীনার সে কি উত্তেজনা ! পুরো বাড়ি রঙ করালো। বাবানের ঘরটা সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়েও যেন মন ভরছিল না । আর ষষ্ঠীর দিন! সকাল থেকে পাঁচ বার বাজারে পাঠিয়েছিল ভুবনেশ্বর কে। বাবান যা যা পছন্দ করতো সব পদ রান্না করেছিল লীনা। না খেয়ে ছেলের জন্য বসে ছিল। কতদিন পর একসাথে খাবে।
অনেক অনেক অপেক্ষার পর বাবান এল দুপুর গড়িয়ে। ঘণ্টা খানেক ছিল। ওরা হোটেলে উঠেছে। এখানে কমফোর্ট ফিল করবে না ওর বৌ তাই….
কিছুই খায় নি। এসব তেল মশলা ওরা নাকি খায় না। নিজেরাই কথা বলছিল। লীনার সাজানো কোণ ফিরেও দেখলো না। এই বাবানকে তো ওরা চেনে না। ঘরের এতটুকু পরিবর্তনও যার চোখ এড়াতো না। বাগানে ওর অজান্তে কোন গাছ লাগালে বলতো এটার নাম কি মা ?
বাবান চলে যাওয়ার পর সেদিনের লীনার কান্না আজও ভুলতে পারে না ভুবনেশ্বর। বুক ফাটা , সব হারানোর কান্না কি একেই বলে…..
ঈশ্বরও হয়তো শুনেছিলেন ওর সেদিনের কান্না ।
মানসিক অবসাদ গ্রস্থ লীনাকে নিয়ে বেনারসে গিয়েছিলেন ভুবনেশ্বর ডাক্তারের পরামর্শে। তাতো বছর বারো তেরো হবে। ট্রেনে আলাপ হয়েছিল অনাথ খোকনের সাথে। পাশাপাশি বসে খোকন নববধুকে নিয়ে হনিমুনে যাচ্ছে। খোকন রামকৃষ্ণ মিশনের অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে । পড়াশোনা শিখেছে। এখন সরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মচারী। অফিস কোয়ার্টারে থাকে ।
লীনা কে মা , আর ভুবনেশ্বর কে বাবা বলে ডাকছিল। এই ডাকের মধ্যে যে কি ছিল — ভুবনেশ্বর দেখছিল — পাষান মূর্তির মতো লীনা যেন ধীরে ধীরে প্রাণীত হচ্ছে। কথায় কথায় খোকন বলছিল লীনাকে — “তোমাকে না একদম মা মা দেখতে। “
প্রতিমাসেই ওরা আসে । রোজ ফোন করে খবর নেয়। ছুটি থাকলে দুদিন থেকেও যায়। পুজোর কটাদিন এখানেই থাকে। একসাথে ঠাকুর দেখে । সব পুজো পার্বণে বৌমা আগের দিন এসে লীনার সাথে সবকিছু সামলায়। লীনা এখন আর বাবানের ঘর বলে না। খোকনের ঘর বলে।
চোখে জল এসে গেল। অসম্ভব সুন্দর।
অনবদ্য। এখনকার সময়ের কাহিনী। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। মেনে নিতে বুকের বাঁ দিকটা যেন স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। ধন্যবাদ।
অসাধারণ একটা গল্প। এটাই ঠিক জীবন বোধ। বড়ো ভাল লাগলো।
মনটা খুব ভালো হয়ে গেলো ।খুব সুন্দর ।😊