স্মৃতি কথাঃ জীবন সংগ্রাম , সাধক মুকুন্দলাল – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

জীবন সংগ্রাম – সাধক মুকুন্দলাল
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

এবার সাধক মুকুন্দলাল সম্পর্কে লিখতে বসে মনে হচ্ছে অনেক কথা বলা হয় নি। দেখা যাক, কতটুকু লেখা যায়। নিরামিশ ভোজী তার উপরে বাড়িতে না থাকলে স্বপাকী, দীর্ঘ দেহ, সব সময় দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটতেন, কটকট করে পায়ের শিরায় আওয়াজ উঠত, ঈষৎ তামার মত গায়ের রঙ, মনে হোত যেন এক দক্ষ লেঠেল। তাঁর শরীরে মেদ বা অতিরিক্ত চর্বি ছিল না। ভুঁড়ি বলে কিছুই ছিল না।

তাঁকে দেখে আমার ‘ মাই ফাদার ইজ হিরো ‘ কথাটা মনে পড়ত। হ্যাঁ, তিনি হিরোই ছিলেন। দরকার হলে তেল চকচকে লাঠি নিয়ে তিনি যেকোন বিপদের সময় সবার আগে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশীদের পাশে থাকতে দেরী করতেন না। ছোটখাটো বিপদ বা ঝামেলা তাঁকে দেখেই মিটে যেত। কপালে তিলক আর গলায় দুছড়া তুলসীর মালা না থাকলে বৈষ্ণব সাধক হিসাবে কেউ ভাবতেই পারতেন না। এত বলিষ্ঠ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সাধক মুকুন্দলাল জীবনের সংগ্রাম চালিয়ে নীরব কর্মকাণ্ডের মাঝপথেই কিন্তু চলে গিয়েছিলেন অনন্তের পথে। সেই পরিপ্রেক্ষিত, অবশ্যই আজকের আলোচনার বর্তমান পর্যায়ের নয়।

একজন পরম সাধক, যাঁকে ‘ রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্ ‘ বলে প্রণাম করেছেন শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ ত়াঁর অমর সৃষ্টি শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে, সেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং লাঠি ধরে দক্ষিণ ভারত ভ্রমণকালে তাঁর একমাত্র সঙ্গী কৃষ্ণদাসকে লোভ দেখিয়ে একরাত্রি ভট্টমারী সাধুদের দ্বারা আটকে রাখা থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তাদেরইমারমুখী একজনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে তিনি এমন ভাবে লাঠি ঘুরিয়েছিলেন যে নিজেদের লাঠির আঘাতে তারা আটককে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আমার বাবা লাঠিখেলা জানতেন কিনা জানিনা তবুও তিনি লাঠি হাতে নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে থাকতেন। কোনও বিপদ বা ঝামেলায় আমরা আজকালকার মানুষরা দরজা জানালা এঁটে খিল দিয়ে ঘরের মধ্যে বসে থাকি। বাবা তা করতেন না। তিনি বৈষ্ণব সাধক হয়েও বলতেন – ভীরুতা আর কাপুরুষতা ভাল নয়। “

আজকের সমাজে নারীদের প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত অত্যাচার নিপীড়নের প্রতি তাঁর যথেষ্ট বিদ্রোহী প্রতিক্রিয়া হতো। চলে যাবার আগের বছর আমাদের সোদপুরের সদ্য প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা উপলক্ষে সহযোগিতা চাইতে পাড়ার উৎসাহী যুবক দুলাল বর্ধন এসেছিলেন। তাঁকে প্রায় নিখরচায় রথের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের ব্যবস্থা কাঠগোলার মালিক পরম বৈষ্ণব ভাদুরী মহাশয়কে বলে করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ঐ রথযাত্রা উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক পুস্তিকা (১৩৭৫ বঙ্গাব্দে বা ১৯৬৮ সালের দ্বিতীয় বার্ষিকী)-য় তিনি নারী পুরুষের সম্পর্ক কোন্ আদর্শের হওয়া উচিত লিখেছিলেন সেখান থেকে উদ্ধৃতি দেয়া অনুচিত হবে না বলে মনে হয়।
“…….জনসাধারণের পক্ষে শ্রী বিগ্রহে কী কী আদর্শ রহিয়াছে তাহা দেখা যাউক।
১) শ্রীকৃষ্ণ রথে জগন্নাথরূপে রথী, লোকের দেহরথেও তিনি আত্মারূপে রথী ; তিনি যেইভাবে চালান সেইভাবেই চলি।
২) দ্বাপরের বসুদেবের সন্তান কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা দারুব্রহ্ম জগন্নাথাদি তিনমূর্তি রূপে এখানে রথে রহিয়াছেন। তাহাতে নারী-পুরুষের জন্য এই আদর্শ রহিয়াছে যে, — চলাফেরায় নারী মাত্রকেই আপন ভগ্নীবৎ এবং পুরুষ মাত্রকেই জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ ভ্রাতাবৎ মনে করিতে হইবে। এই ত্রিমূর্তি যেন সকলকেই আলিঙ্গন দিবার জন্য হস্ত প্রসারিত করিয়া অবস্থান করিতেছেন।
৩) হিন্দু শাস্ত্রের অন্যত্র ‘ মাতৃবৎ পরদারেষু ‘ উপদেশও রহিয়াপ্রত্যেকের পক্ষেই ইহা বিশেষ প্রয়োজন। ইহাতেই জাতি সতেজ ও বলীয়ান হইবে। ……..”
সাধক মুকুন্দলাল গোস্বামীর তখনকার প্রচলিত ভাষায় লেখাটির অংশবিশেষ থেকেই আমরা তাঁর সমাজ সম্পর্কে দুশ্চিন্তা , সচেতনতা ও সমাধানের উপায় নিয়ে চিন্তা ভাবনার পরিচয় পেতে পারি।

একদিন দুপুরের দিকে এক বয়স্কা মহিলা শিষ্যা এসে বললেন – গুরুদেব, আসার পথে দেখলাম কালীপূজার প্যাণ্ডেল থেকে সবাইকে ডেকে ডেকে প্রসাদ দিচ্ছে। আমাকেও ডাকছিল, আমি কিন্তু প্রসাদ নিইনি। ঠিক করেছি না ?”
সাধক মুকুন্দলাল বললেন – না, ঠিক করোনি। মা কালীর প্রসাদের বা যে কোনো দেবদেবীর প্রসাদের অসম্মানের সাহস কারোর থাকা উচিত নয়। তুমি কণিকা মাত্র হাতে নিয়ে দেবীর প্রতি তোমার শ্রদ্ধা জানাতে পারতে।”
বয়স্কা মহিলা বললেন – বাবা, আমরা তো বৈষ্ণব। গোবিন্দের প্রসাদ ছাড়া আমরা কি অন্য ঠাকুরের প্রসাদ নিতে পারি ?”
সঙ্গে সঙ্গে সাধক মুকুন্দলাল বললেন – কাউকে তো আর অসম্মান করতে পারোনা ! তুমি ক্ষুধার্ত হলে নিতে পারো, যদি শ্রীগোবিন্দের প্রসাদ পাবার কোনো সুযোগ না থাকে। তুমি যদি অন্য কোথাও কোনো ঠাকুরের প্রসাদ পেটভরে নিয়ে ফেলো তা হলে তোমার ঈষ্ট দেবতার প্রসাদ নেয়ার জন্য পেটে জায়গা থাকবে না। ঈষ্ট শ্রীগোবিন্দের নাম স্মরণ করে তোমার আর তাঁর প্রসাদ নেবার সুযোগ থাকবে না। তাই, আমার কথা শোন, অন্য কোনো দেবদেবীর প্রসাদকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে কণিকা মাত্র নিয়ে নিজের ঈষ্ট শ্রীগোবিন্দের প্রসাদ নেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত থাকতে হবে। “

সাধক মুকুন্দলাল এরকম বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে শাস্ত্রীয় যুক্তি রেখে ভক্ত শিষ্যদের পরামর্শ দিতেন। সামাজিক দিক থেকেও তিনি অনেক বেশি প্রগতিশীল ছিলেন। অজস্র উদাহরণের একটা অন্তত উল্লেখ করা যেতে পারে :-
সে সময় সামাজিক বিধি নিষেধ ছ্যুঁতমার্গের কবলে পড়ে বাড়ির রাধারমণের নিত্য পূজক হরিদাস মহলানবীশ ঠাকুর মশাইয়ের চাকরি চলে যায়। তাঁর অপরাধ – তাঁর পরিবারের কেউ একজন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়েছেন। সেজন্য ‘ কালাপানি ‘ পাড়ি দেবার তখনকার বিচারে পাপ (?) হয় শুধু সেই ছাত্রের নয়, দেশে বসবাসকারী পুরো পরিবারটিরও নাকি ঐ একই পাপ হয়েছে ধরে নেয়া হোতো, তাই নিত্য পূজক পুরোহিতের চাকরি করার আর অধিকার থাকলো না। তিনিও অচ্ছ্যুৎ বলে পরিগণিত হলেন।
এটা সাধকের ভাল লাগলনা। একা তাঁর জ্ঞাতি আত্মীয় স্বজনদের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়ে এই অবাস্তব নিয়মের বিরোধিতা করেন। তিনি ছিলেন লেখা পড়া উচ্চ শিক্ষা এ সবের প্রতি ভীষণ উৎসাহী। ‌সকলকে অনুপ্রেরণাও দিতেন। বাড়ির কেউ একজন আরো বেশি ভালো করার জন্য বিদেশে (তখন বলা হোত বিলেত) গেছেন বলে তিনি বা পরিবারের অন্যরা অচ্ছুৎ হয়ে যাবেন ? সাধক যতই কট্টর সদাচারী হোন না, এটাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারলেন না। কিন্তু একা নিজে আর কতটা করতে পারতেন ? যতটা পারলেন তা হল, প্রতি বছরের মত বাৎসরিক ‘ পুরোহিত বিদায়ের ‘ ব্যবস্থা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ধূতি, গামছা, উত্তরীয় আর কিছু অর্থ দিয়ে সম্পন্ন করলেন। পুরোহিতদেরও পেট আছে , সম্মান আছে, ভালো করেই বুঝতেন। সমাজের অহিতকর বিধি নিষেধ মান্য করে বৎসরভর পুজোর কাজ করা পুরোহিতকে তাঁর রুটি রুজি ও আশা থেকে বঞ্চিত করা উচিত মনে হয় নি। এরকম উন্নত মানসিকতার প্রকাশ বারবার ঘটেছে। সাধক মুকুন্দলাল এমনই ‘মানুষ’ ছিলেন।
সাধক মুকুন্দলাল গোস্বামীর জীবন সংগ্রামের কথা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছিলো অনেক কথা লেখার বাকি রয়ে গেছে।
সেবার আমার শরীরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর কোন শক্তি ছিল না। জ্বরে ভুগে চলৎচ্ছক্তি হারিয়ে ছিলাম। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও, অনেক ওষুধ খেয়েও কোন ফল হচ্ছিল না। তখন আমার বয়স নয় বা দশ। ক্লাস ফোরে পড়ি। স্কুল যাওয়া বন্ধ, পড়াশোনা শুয়ে শুয়ে যতটুকু সম্ভব করে যাচ্ছি। বাবা কিন্তু হাল ছাড়লেন না। আসানসোলে থাকতাম, জামাইবাবুর রেল কোয়ার্টার্সে। বাড়িতে কল করে আনা হল সেখানকার সি এম ও ডাঃ গুহকে। তিনি অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আগে থেকে নেয়া ওষুধের রদবদল করে বাবাকে বললেন – গোসাঁইজী অনেক তো চিকিৎসা করা হোল, তেমন কাজ দিচ্ছে না। পেসেন্টের মনে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর প্রয়োজন। তবে একটা শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে।”
বাবা বললেন – বলুন না ডাক্তারবাবু, কী চেষ্টা করা যায় ?”
ডাক্তারবাবু হেসে বললেন – ডাক্তার হিসেবে বলার কথা নয়। তবু আপনি যখন ভগবানের বিশ্বাসী এক ভক্ত, আপনাকে জানাই বীরভূম জেলার আহমেদপুর স্টেশনে নেমে গরুর গাড়ি করে বালিয়া নামে এক গ্রামে এক প্রাচীন পুকুর আছে যেখানে একটা ডুব দিলেই নাকি রোগের উপশম হয়ে যায়। অবশ্যই শোনা কথা। “

পরের দিনই খুব ভোরে নিজের লেখাপড়া ছেড়ে বাবা ও মা আমাকে নিয়ে দুপাশে নিয়ে চললেন বর্ধমান, সেখান থেকে ট্রেন পাল্টে আহমেদপুর স্টেশন। গরুর গাড়িতে রেললাইনের ডানদিকে এগিয়ে ডান হাতে গ্রামে ঢোকার রাস্তা। তখন, সম্ভবত ১৯৫৬ সালে গ্রীষ্মের কিছু আগে বসন্তের মৃদু বাতাসে আর গরুর গাড়ির দোলায় যেতে যেতে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। এক সময় আড়ম্বরহীন একটা পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাশে একটা শিবলিঙ্গের ছোট্ট মন্দির। গলায় পৈতা, কাঁধে গামছা জনৈক গ্রামবাসী জানালেন যে ঐ মন্দিরে আছেন ধর্মরাজ ঠাকুর। যথারীতি বাবা ও মা আমায় ধরে পুকুরে নামালেন। পুকুরের জলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সারা শরীরে জল ছিটিয়ে শরীর ভিজিয়ে একসময় ডুব দিয়ে স্নান করতে লাগলাম। খুব ভালো লাগছিলো ঠাণ্ডা পুকুরের জলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। বাবা ও মা বললেন এবার উঠে পড়তে। উঠে জামাকাপড় পালটাতে গিয়ে অনুভব করলাম মা বাবা ধরে না রাখলেও আমি নিজের পোশাক পরতে পারবো। ওঁরা অবাক হলেন, আমিও অবাক হলাম। বাবা ঐ মন্দিরের পূজক মহাশয়ের অল্প কিছু পয়সার বিনিময়ে এক শিশি পায়ে মাখার তেল, পুকুরের মাটি আর এক শিশি পুকুরের জল নিলেন। প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। ততক্ষণে দুপুর অনেকটা হয়ে গেছে, তাই বাবা বললেন – জানি তোমাদের ক্ষিদে পেয়েছে। এখানে ঐ সামনের দোকানে খাবার পাওয়া যেতে পারে কিন্তু খেতে গেলে ট্রেন পেতে দেরী হবে। চল আমরা এগিয়ে যাই আর ফেরার জন্য কোনো কিছু পাই কিনা দেখি।”
আসার সময় যে গরুর গাড়িটা ছিল , সেটা আমাদের নামিয়ে ভাড়া নিয়ে চলে গেছে সম্ভবত স্টেশনে বা অন্য কোথাও যাত্রী ধরার জন্য। আমি বাবাকে জানালাম – চলুন না, এখন আমি নিজের পায়ে হাঁটতে হাঁটতে যতটা পাড়ি এই একটাই পথ এগিয়ে যাই। পথে কোনো গাড়ি পেলে নাহয় ধরে নেবো।”
বাবা অবাক হয়ে বললেন সঙ্গে মাও পরম বিস্ময়ে বলে উঠলেন – এতো ধর্মরাজা ঠাকুরের অশেষ কৃপা, তুই চারপাঁচ মাস ধরে নিজের পায়ে চলতে পারিসনা, আর ধর্মরাজ ঠাকুরের পুকুরে ডুব দিয়েই ঠিক হয়ে গেলি ? জয় ধর্মরাজ ঠাকুর, জয় রাধারমণের।”
সেদিন আপাত গম্ভীর বাবাকে আনন্দে আত্মহারা হতে দেখে আমিও যেন বিস্মিত হয়ে বাবার সারাদিন না খাওয়া মুখটায় উৎসাহ আর উদ্দীপনা দেখলাম। বাবা আমাকে আর মাকে দুপুরে কিছু একটা খাইয়েছেন কিন্তু নিজে সব জায়গায় খাদ্য গ্রহণ করতেন না, তাই বললাম – বাবা, আপনি তো কিছু খেতে পারলেন না।”
সাধক মুকুন্দলাল আমার বাবা বললেন – কোনো তেমন ফলও
দেখলাম না।”
মা এক ফেরীওয়ালাকে প্ল্যাটফর্মে দেখতে পেয়ে ডেকে জিজ্ঞেস করলো – ভাই, তোমার কাছে কলা আছে?”

  • না দিদি, কলা বিক্রি হয়ে গেছে। আছে শুধু শসা।” ফেরীওয়ালা বলতেই বাবা আধা সের শসা (তখনও কিলোগ্রাম এসব কথা আমদানি হয়নি) কিনলেন চার আনায়। দুটো শসা স্টেশনের কলে ধুয়ে মাথায় ছুঁয়ে তাঁর কাঁধের ঝোলা থেকে ছোট একটা ছুরি বের করে খোসা ছাড়িয়ে খেতে লাগলেন। সারাদিনে ঐ তাঁর খাদ্য ! আমি অবাক হলাম, মা বলল – খালি পেটে শসা খাওয়া উচিত নয়।”
    তিনি বললেন – কী আর করা যাবে!”

আসানসোলের গরমে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, বাতাসে ‘লু’ চলে। বাবা এমনিতেই পেঁয়াজ ধরেন না, কিন্তু ‘লু’-এর প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে বাড়ির লোকজন সকলের কোমরে পেঁয়াজ বাঁধতে পরামর্শ দিতেন। এভাবে প্রতি বছর আমরা ‘লু’-এর হাত থেকে রক্ষা পেতাম।

সাধক মুকুন্দলাল গোস্বামী সাধন ভজন আর লেখাপড়া নিয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। সংসারের প্রতি যেন তাঁর মন ছিল না – একথা নিকট জনদের কাছে প্রায়শই শোনা যেত। মা কিন্তু অনেক অনটনের মধ্যেও বাবার পক্ষ নিয়ে উত্তর দিতেন – উনি একজন বয়স্ক মানুষ। শিষ্যবাড়ি যেতে পারেন না, এক শিষ্যবাড়ি বছরে একবারের বেশি যাওয়া উচিত নয়। তাছাড়াও ওদের অনেকেই গরীব। সব হারিয়ে এখানে এসেছে। ওরা আর কত প্রণামী দেবে ?”

ডোলহীন, আর্থিক সহায়তা হীন, নিঃসঙ্গ এক সাধকের আর্থিক অনটনের মধ্যে থেকেও ভগবান শ্রীশ্রীরাধারমণ ও শ্রীশ্রীগৌরগদাধর সাধনায় মগ্ন থাকতে ভালবাসতেন আমার বাবা। তবুও তিনি সংসার নিয়ে কখনও মাথা ঘামাতেন না তা কিন্তু নয়।মনে পড়, একবার আমার পরনের জামা কম পড়েছিল। বাবা শিষ্যবাড়ি থেকে পাওয়া একটা ধূতি কেটে পাড়ার দর্জি রহমান মোল্লার কাছ থেকে জামা তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি আমার আরও ছোটবেলায়, যখন দূরের স্কুলে ভর্তি করা হয়নি তখন শিষ্যবাড়ির আমার প্রায় সমবয়সী ছাত্র ও ছাত্রী দের কাছ থেকে পড়া হয়ে যাওয়া পুরনো বই গুলো নিয়ে আসতেন তাঁর ঝোলায় ভরে। বিভিন্ন প্রকাশনার বইগুলো পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গল্পের বইয়ের মত পড়ে ফেলতাম গোগ্রাসে। আমার ক্লাসের চেয়ে উঁচু ক্লাসের সব বইয়ের সব বিষয় হয়তো বুঝে উঠতে পরতাম না, তবে আমার জন্য কষ্ট করে বয়ে আনা বইগুলি পড়তে বেশ ভালো লাগতো। কাজেই তাঁকে কখনো দায়িত্ব জ্ঞানহীন বলে মনে হতনা।

আমার মনে হচ্ছে এরকম ব্যক্তিগত কথা লেখা হয়তো উচিত নয়, তবু একজন সাধকের জীবন পরিক্রমায় অনেক সুখদুঃখ অতিক্রম করতে হয়। এই জগতের জীবন ধারণে এসব থাকবেই,। থাকবে অনেক পিছু টান যা ডিঙ্গিয়ে চলার মধ্যে তাঁর জীবনের সাফল্য লুকিয়ে থাকা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তাই, তাঁকে পুরোপুরি জানতে হলে কোনো কথা লুকিয়ে রাখা উচিত হবেনা। তাই সব বর্ণনা করাই শ্রেয়ঃ বলে মনে হচ্ছে।
সাধক মুকুন্দলাল গোস্বামীর জীবনে একটি দুরারোগ্য ব্যাধি জীবনের সঙ্গী হয়েছিল। যা নিয়ে ত়াঁকে বাকী জীবন চলতে হয়েছিল। তা হল – শিষ্য ভক্তদের পারমার্থিক মঙ্গলের জন্য আর নিজের আর্থিক প্রয়োজনে তাঁকে বারবার শিষ্যবাড়ি যেতে হতো। একবার তিনি চলেছেন আসামের এক শিষ্যবাড়ি, ট্রেন বাসের পর অনেকটা পথ ধূ ধূ মাঠের উপর দিয়ে যেতে হবে। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রতাপে মাথায় ছাতা নিয়ে, যদিও ছাতা গরমে প্রায় আগুন হয়ে গেছে, এগিয়ে যেতে হয়েছিল। ইতিমধ্যে তাঁর প্রস্রাব পেয়েছে। প্রস্রাব পেলে মাঠের মধ্যে আড়াল আবডালের প্রয়োজন। ফাঁকা মাঠে কোথায় পাবেন সেরকম জায়গা ? প্রস্রাবের পর শৌচ করার জন্য প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট জলের। কোথাও তিনি পুকুর বা কোন জলাশয় দেখতে পেলেন না। ফলে, তলপেট ভারী হয়ে উঠলেও তাঁকে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে হয়েছিল। আর প্রস্রাব ধরে রাখতে পারছেন না। দাঁড়িয়ে পড়ে পেছনে দেখলেন অনেক পথ পেরিয়ে এসেছেন আর সামনেও অনেক পথ বাকি রয়ে গেছে। কাজেই পিছিয়ে যাবার অর্থ হয়না। অথচ তিনি আর চলতে পারছেন না। তবুও এগিয়ে যেতেই হবে। চলা অব্যাহত রেখে তিনি এগিয়ে যেতে লাগলেন। ধীরে ধীরে। এবার হয়তো পরনের কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে, তবুও না থেমে তিনি এগোতে থাকলেন। হঠাৎ দূরে একটা জায়গায় কিছু পাখির ওড়াউড়ি আর আশপাশে কয়েকটা গাছ চক্রাকারে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বুঝলেন, ওখানে জলাশয় থাকা স্বাভাবিক। তিনি সারা শরীরের শক্তি ব্যয় করে প্রায় দৌড়াতে লাগলেন। জলাশয়ে পৌঁছনোর পর দেখলেন, জল আছে তবে অনেক নীচে নেমে গেছে আর সেখানে কয়েকজন তাদের গরুগুলিকে স্নান করাচ্ছে। যাক্, জল পাওয়া গেছে ভাবলেন আর সকলের থেকে দূরে গিয়ে এক গণ্ডুষ জল নিয়ে বাথরুম সারতে লাগলেন। গলগল করে রক্তপাত হতে লাগল। সামান্য চিৎকার তাঁর মুখ থেকে হয়তো বেরিয়েছিল । তিনি জ্ঞান হারিয়ে জলের ধারে পড়ে গেলেন। গরুর স্নানে ব্যস্ত কারোর একজন নজরে পড়তেই প্রায় সবাই ছুটে এসে সাধকের পাশে দাঁড়ালেন। তাঁরা সাধকের চোখে মুখে জলের ধারা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলেন। তাঁরাই পাঁজকোলা করে তুলে নিলেন আর সাধককে জিজ্ঞেস করে পাশের গ্রামের সেই শিষ্যবাড়িতে পৌঁছে দিলেন।
পরে জানা গেল, একটি শিরা অতিরিক্ত প্রস্রাবের চাপে ছিঁড়ে গেছে। কিছু অসুধ দিয়ে তখনকার মতো সুস্থ করে শিষ্যভক্তরা কয়েকদিন পর তাঁকে ঢাকা বিক্রমপুরের পঞ্চসারের বিনোদপুর গ্রামে পৌঁছে দিয়েছিলেন বলে শুনেছি। ঠিক করে চিকিৎসা করে আর প্রয়োজনে অপারেশন করিয়ে হয়তো ভালো করা যেত। কিন্তু অপারেশন করতে গেলে রোগীকে হাসপাতালে কয়েক দিন রাখতে হবে। তিনি কিন্তু রাজী হলেন না। চলল তাঁর হার্ণিয়া রোগ। মাঝে মাঝেই সেই ছিঁড়ে যাওয়া শিরা নেমে এলে তাঁকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপর থেকে ঠিক করে এগিয়ে যেতে পারতেন। এই রোগ তাঁর বাকি জীবনের এক বিরক্তিকর সঙ্গী হয়ে থাকল। চলল তা আজীবন। তবে তিনি কিন্তু সব সময় মুখে হোক বা মনে মনে কৃষ্ণ নাম রাখতে পছন্দ করতেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *