পার্থ-পারমিতা–৩
অনিরুদ্ধ সুব্রত
একটা বিচ্ছিন্ন সন্ধ্যে।
কতগুলো ছেঁড়া কাগজের টুকরো উড়ছে ঘরের আকাশে।
জুড়বে বলে ধরতে উদগ্রীব পার্থ।
ফ্যানের হাওয়ায় আরও মাতাল সেই সব টুকরো পুরনো।
কিছুতে সব গুলোকে মুঠোয় আনা অসম্ভব।
বিফল পার্থ চিৎ হয়ে বিছানায় চশমার কাঁচ মুছছে।
রিং হলো…
— হুম, যেখানে থেমে ছিলে সেদিন
সেখান থেকেই ?
অবশ্য শুরুতে গৌরচন্দ্রিকা থাকা ভালো,
চিরকাল ভালো লাগে আবেশ আবহ।
আফটার অল আমিও তো প্রেম-বৈষ্ণব
আমিও ভক্ত।
পারমিতায় অনুরক্ত…
— মনে করেছি আমিই, অথচ ভূমিকা
লিখছ তুমি…
তুমি কবি, গৌরচন্দ্রিকা তো তোমার গানে থাকা স্বাভাবিক —
বিদ্যাপতির শরণে যাবার আগে যেমন
গোবিন্দ দাস ভায়া হয়ে !
— যাগ্গে, রুটিন চেঁচে যেটুকু বাঁচিয়েছ, তাকে
পথে ফেলো না, স্বমহিমায় সূচিত হোক—
দেবী পারমিতা…
— সব কিছুতে তীর্যক, তীব্র, বিদ্রুপ থাকে পার্থ তোমার কথায়
স্বাভাবিকে ফিরবে না যেন আর ?
বোঝা কঠিন তোমার ব্যাপার।
— মিলনান্তক সিনেমা দেখে দেখে
বাঙালির বিয়োগান্তক হলেই কোষ্ঠকাঠিন্য,
আর প্রশ্ন চিহ্ন রেখে ছবি শেষ করলে
হেগে মরে সারারাত।
মূর্খ পরিচালক শালা যাবে কোথায় !
— বেশ, তবু ঐ ভ্রান্ত সিনেমাগিরি বাদ থাক।
হ্যাঁ, সেদিন যে ত্রিকোণের কথা
বলেছিলাম।
বলতে পারো— যা জুড়ে আদতে ত্রিভুজ হয়।
— ত্রিকোণমিতিতে বরাবর আমি ব্যর্থ
মাধ্যমিকে অঙ্কে পঞ্চান্ন ।
কিন্তু সমতল ক্ষেত্রের উপর একটা দারুণ
ত্রিভুজ এঁকে দিতে পারি পেন্সিলে,
ইরেজারে দাগ মোছা খুব সোজা,
যে কোনও বাহু ছেঁটে ফেলা যায়—
যে কোনও দিন…
— এডিটিংয়ে হয়তো সব সোজা,
কিন্তু সিনেমার যে চিত্রে তুমি বিশ্বাস করো,
সেখানে পূর্ব-কল্পিত চিত্রনাট্য গৌণ।
পার্থ কেবল বলতে অভ্যস্ত—
যেমন গতি দ্যাখো, তাকে তৎক্ষণাৎ
তেমনই কেন ধরো !
— সিনেমার ভাইরাসটা পারমিতাকে অ্যাটাক করেছে ভালো।
সে জানত ছোঁয়াচে,
বাঁচতে পারলে না দ্বি-স্তরীয় মুখোশে।
— মুখোশে ?
— ভাইরাসটা ঠেকাতে।
সিনেমার, জীবনের, মোহ বা মোহিত আবেগের আগে
একটা শক্তিশালী নোটিশ বোর্ডের মতো।
— কঠিন করে তুলে
জটিল আবর্তে ঘুরপাক দিয়ে
নষ্ট করে দেবে সপ্তাহান্তের কথা ?
আমি কিন্তু ত্রিকোণ প্রসঙ্গে- এ ছিলাম।
— কেন ছিলে ? প্রজ্ঞা- পারমিতা ?
— আমি শুধুই পারমিতা।
— কিন্তু , ‘পারমিতা’ শব্দের অর্থ
প্রকৃষ্ট রূপে প্রতিফলিত।
— অর্থাৎ ?
— বৌদ্ধ ধর্মানুসারে,
বুদ্ধত্ব অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয়
দ্বাদশ গুণের অধিষ্ঠাত্রী দেবীই হলেন—
পারমিতা।
তাই তিনি প্রজ্ঞা-পারমিতা।
— হতে পারে, আমি তা নই।
আমি রক্ত মাংসের, দ্বিধা দ্বন্দ্বের,
দুঃখ যন্ত্রণার, ভাব অভাবের, হাসি কষ্টের
এক বাস্তব।
আবারও বলছি, পূর্ব কথিত সেই
ত্রিকোণ-এ ছিলাম।
— থাকছ কেন ?
ভেঙে ফেলে দাও, ছুঁড়ে দাও দুর্বল বিন্দুটি।
যা থাকা না থাকা দেয় শুধু বিকার বিকৃতি।
জীবনের উদ্ভট, অস্বীকৃতি,
বৈধ বিন্দু বরাবর টানো সুদৃশ্য সরল রেখা।
ভালো থাকুক রক্ত-মাংসের প্রজ্ঞা।
— এতো রুঢ় পার্থকে দেখিনি… ।
ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও–একি রাজনীতি ?
সামনের দুটি বিন্দু সমান ভাবে টানে।
হ্যাঁ, একটাকে বলেছি অভ্যস্ত জীবন,
আর তৃতীয় দিয়েছে অপার সুখ- সন্ধান।
— কিন্তু আজ তুমি খণ্ডিত,
প্রশ্ন তুলেছ— কাকে ভালবাসি ।
দ্বন্দ্বে ছিন্ন হয়ে বিপর্যস্ত নিঃশ্বাস শুনেছি,
এই অশরীর সাক্ষাতেও দেখেছি
শরীরী খানখান, তার দগ্ধ গান শুনে
বুঝেছি, দ্বিধাগ্রস্ততার বিভ্রান্তি-গ্রাসে
পূর্ববর্তী আবেগ হঠাৎই বাহুল্য ঠেকেছে।
আমি স্পষ্ট শুনতে থেকেছি— কতগুলো
প্রথাগত শব্দে প্রতিদিন পেরিয়ে যাচ্ছো—
এই আপাত অস্বস্তির সমান্তরাল পথ।
— না, না পার্থ না।
কল্পিত অন্ধকারে সব কালো দেখো না।
শুধু অকপট হতে চেয়েছি, বলেছি,
ব্যথার তোলপাড় কীভাবে লেখা যায় !
কী শব্দের বিন্যাসে বর্ণনা পায় যন্ত্রণা—
জানিনা।
— তা বলে দাঁড়িপাল্লায় ?
কসাইয়ের মতো কাটাকুটির মাংস মেদ ?
যতক্ষণ দ্বন্দ্বের এই দীর্ণতা ছিল না,
যতক্ষণ নির্দ্বিধায় দিয়েছ সন্ধ্যের গান
অথবা রাত্রি-স্বপ্ন, দুপুর পাখির কাকলি,
আপ্লুত স্রোতে ভেসেছি স্রতস্বীনীর জলে।
যদিও জানতাম একদিন
সিনেমাটা শেষ হয়ে যাবে।
খুব দূরে নয় সে বিরতি বেলা।
— না, এ সিনেমা শেষ হওয়ার নয়।
পার্থ যে অনন্তের সিনেমা বিশ্বাস করত,
সেখানে দ্বন্দ্ব, যন্ত্রণা, আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থ প্রপাত থাকতে নেই ?
তাহলে সে সিনেমা সত্যি কীসের ?
— সিনেমা আসলেই সত্যি নয় পারমিতা।
আমার সংকল্পের সেলুলয়েড-এ যা দেখাতে
এই ছোট্ট জীবন কেটে গেছে, তাতে
সব, সবই সত্যির ছায়া অবলম্বনে, একটু সরে অথবা বেঁকে, পথ পাল্টে চলেছে।
আমিও পিছনে পিছনে ক্যামেরা তাক করে–
বার বার আমার সিনেমা, গল্প হারিয়ে ফেলেছে।
গল্পেরা আমার নিজস্ব সিনেমা হতে চায় নি,
চরিত্র আর সময়ের ঝগড়া লেগেছে খুব
পরিস্থিতি আমাকে পথের ফকির করেছে,
রাস্তায় শুয়ে তবুও স্বপ্ন থামেনি
মিলনান্তক ছায়াছবির বিপরীতে বহুদূর
নিয়ে গিয়ে ঘুম দিয়েছে ভেঙে…
— উফ্ ! পার্থ !
আশ্চর্য এক ছিন্ন বোধ…
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ভিতরে দুমড়েমুচড়ে
ফেলে, যতবার গুছিয়ে তোমার ছায়ায়
দুদণ্ড দাঁড়াতে চাই।
তুমি আরও শত খণ্ড করে ছড়িয়ে দাও,
আমার স্বীকারোক্তিতে তোমার বিরক্তি ?
— পারমিতা, পরিমিত পথে নিদারুণ পরাকাষ্ঠা
তোমার। মোটামুটি ক্লাইমেক্স-এ পৌঁছে দিতে পেরেছ,
এখানেই হাততালি দিয়ে রাখি।
পুরোটাই হিট সিনেমা তোমার।
আমিই ফ্লপ।
সূচনা আর তারপর বহুদূর বিস্তার, নৃত্য সঙ্গীতের পূর্ণ বিনোদন শেষে
বিভ্রান্তির হলো অবসান।
এবার সরলরেখা বরাবর সমবেত দাঁড়িয়ে
বৈধ ফ্রেমে একটা দূরন্ত ক্লিক দরকার।
উপন্যাস গুলো এমনিই কি আর
মারকাটারি বিক্রি হয় ?
ধ্যাতরা কাহিনী বিক্রি হলো কবে আর ?
পোকায় কাটে তার মলাটের অন্তর।
— শুধুই বিরুদ্ধ বক্তৃতায় গভীরতাকে এড়িয়ে
গিয়ে,উপরি তলের স্থিরতায় ধৈর্য ভাঙো।
কথা বলো—উত্তরহীন পাতার পর পাতার
চির জিজ্ঞাসার মতো।
একবার নতুন করে আবৃত্তি করতে পারো না,
একটা নতুন কবিতা ?
লেখো না কেন আমাকে আর ?
— আসলে তোমাকেই লিখতাম রোজ, কিন্তু
তুমি খুঁজে পাওয়া থেকে দূরে সরে গিয়ে
আজ কবিতাকেও
চিনে নেবার অনিহায়
পষ্টত পেয়েছ নষ্ট-কবির ধষ্ট-দোষ…
— আজকাল তুমি যা লেখো, বড্ড একপেশে
যেন ধারাবাহিক অভিযোগ।
কিন্তু তুমি যা চাও—
তা কি বাস্তব ? সম্ভব ?
–— আশ্চর্য !
কী প্রবল প্রতারণার মতো তোমার এই
প্রশ্নের উচ্চারণ ! পারমিতা ?
‘আমি যা চাই ‘ ?
কিন্তু আমি কী চাই ? আমি তো জানি নি ?
আর সুনির্দিষ্ট কিছু তো দেখিনা ?
কোনও চাওয়ার অজুহাত— ছিল নাকি,
এই হৃদয়ে, শরীরে ?
যা আজ তোমার কাছ থেকে জেনে,
নিজেকে নিজের কাছে যেন
নিচ্ছি এক নতুন চরম করে চিনে…
স্বার্থ আর ঘৃণার বিষ-বাষ্পে ঘিরে ধরে
আমাকে আছড়ে ফেলেছে আমাদেরই
মধ্যবর্তী পাষাণে।
সমস্ত মস্তিষ্কে কেবল হায় হায় উঠছে
প্রচণ্ড পতনের আকস্মিকতায়,
কেবল— হায় হায় !
— না, আমি, মানে, যা বলতে চেয়েছি–
তুমি তাকে অন্য ভাবে…
এই যে নিয়মিত নয়, অথবা
সপ্তাহান্ত বলে যে ক্ষোভ, অভিযোগ
সে সবই, তাকেই বলেছি।
— বেশ করেছ বলেছ।
এই ভাবেই বলে দিও,
ফের যদি সামনে কখনও কেউ আসে।
সম্পর্ক গুলোকে মনোগত প্রযুক্তি প্রয়োগে
ঠিক এভাবেই হ্যান্ডেল করে
তোমার প্রজ্ঞা রেখে যেও পারমিতা।
— তোমার একটা ভুল হচ্ছে পার্থ,
আমি কিন্তু আমিকে ব্যতিরেকে
বলতে চাইনি—
— আমি চুপ থাকতে চাই অনেকক্ষণ।
এক অসুস্থ বোধে আমি শব্দ হারিয়ে ফেলছি..
— পার্থ ! এভাবে কেন ?
আমিও তো,
একই প্রত্যাশার পথিক…
আমারও কি ধমনিতে একই গান
বাজে নি ?
— জানি না,
আপাত স্তব্ধতার একটা আড়াল চাইছি,
নিজের কাছে নিজেই খানিক লুকোনোর মতো একটা ভিজে অন্ধকার,
একটা স্যাতঁসেতে কোণ—
আজকে আমার খুব যেন দরকার…।
— চির অজ্ঞেয়, অদ্ভূত তুমি পার্থ,
অকপট, রুঢ়—
–— হ্যাঁ, অস্পষ্ট, ধষ্ট নষ্ট, কিম্ভুত, কদাকার…
বলো দীর্ঘ নিঃশ্বাসে যতদূর সমার্থক শব্দ,
দেখিয়ে দাও অস্বীকৃত স্বপ্ন-দেখা ভবঘুরেকে
শহরের অন্ধকারে হারিয়ে যাবার পথ।
বলে দাও— ‘ তুমি লোভী, প্রত্যাশার মাত্রা
বিস্তৃত হয়েছ পার্থ।’
— উন্মাদ, তুমি পাগলের মতো বলছ।
তুমি বিভ্রান্ত, বিভ্রান্তির সংলাপ অনবরত
আওড়ে চলেছ…
— পার্থ সত্যিই উন্মাদ।
এই রাতের অন্ধকারের তাকে উপেক্ষা করতে
পারো।
–— এ অপলাপ !
সম্বিতে, স্মৃতিতে, মননে ফিরে এসো—
অযথা কথার আতিশয্য কেন
রচনা করছ ?
–— অপলাপ ? অযথা ? আতিশয্য ?
ভেঙে ফেলো, চালিয়ে দাও বুলডোজার।
পারমিতা, হতাশ আমি ক্লান্ত, ধ্বস্ত…
এই অন্ধকার আঁকড়ে
অনেকক্ষণ আমি স্তব্ধ থাকবো।
— আমিও ব্যর্থ…
তুমি আমার এতোটাই অচেনা পার্থ ?
— দূরবর্তী নক্ষত্র,
তোমার প্রকম্পিত আলো
বারংবার আমাকে দ্বিধান্বিত প্রশ্ন করে গেল…।
–— পার্থ !….
আলো নিভে এলো যোগাযোগে,
যখন ভাদ্র পূর্ণিমার আকাশে
মেঘের পাহাড় ডিঙিয়ে এক অসহায় চাঁদ
মানুষের পৃথিবীর দিকে
তাকাতে পারলো না অনায়াস হাসিতে।
(‘পার্থ-পারমিতা’ তৃতীয় পর্ব– সমাপ্ত)
ভীষণ ভালো লাগল।
খুব ভালো লাগল।
ভীষণ সুন্দর লেখা।