দীর্ঘ কবিতা: পার্থ-পারমিতা—২
অনিরুদ্ধ সুব্রত
“সকলেই তার তার মতো করে
ব্যস্ত থাকে শেষ পর্যন্ত,
আলাপ বিলাপ প্রলাপ সংলাপে ছয়লাপ করে
শেষে কেউ ঘুম কিনতে যায় নগরে
কেউ নদীতে চোখ ধুয়ে বসে পারে।”
—- তোমার শেষ লেখাটা থেকে তুলেছি,
বুঝলাম না, যদি বলো …
— লেখা তো লেখাই— ব্যাখ্যা নেই ;
ব্যাখ্যার প্রয়োজনও নেই।
— তবু , এইটুকু সত্যিই যে,
সকলেই তার তার মতো করে ব্যস্ত…
–— হুম, রকমফেরের বিজিনেস।
কারও ঘুম নগরে মেলে, ব্যাগভর্তি জোছনা
অথবা সমস্ত শহরের এক হাঁটু জলের রাস্তা
পেরিয়ে উঁচু প্লাজায় উঠে দাঁড়ালে
নাগালে প্রয়োজনীয় চাঁদ ছোঁয়া যায়,
ভিজে অন্ধকার তাড়িয়ে দেখেশুনে কিনে
ছেনে সাজিয়ে রাখা যায়— সুখের রেপ্লিকা।
— অযথা বিতর্ক না বাড়িয়েও সহমত হতেই পারি, যদি মনে করো— সে রেপ্লিকা।
কিন্তু ‘আলাপ বিলাপ প্রলাপ….’ এসব ?
— সপ্তাহান্তে বা পক্ষান্তে সেই এক আধ বার,
যখন শেষ উচ্চারণ গুলোতে ছ্যাদলা জমছে
যখন ছেদ যতি চিহ্নতে ভাবের প্রক্ষেপ গুলো
আর কিছুতেই মহিমান্বিত নেই—
তখন সে সব অনর্গল, গলগল প্রলাপ বিলাপ
আলাপের শব্দ বমনের মতো অভিধায়
শুধুই পড়ে থাকে বোধে।
— এ কী জাতীয় আত্ম-প্রতারণা পার্থ ?
কতবার সব কিছুকে কেবল অনুগ্রহের মতো করে দেখো, অথচ সব জানো।
সপ্তাহান্তে বা পক্ষান্তে— বলে পিন ফোঁটাও,
সুযোগ আর সময়কে যত আমি সন্ধান করেছি, তুমি কেবল খুঁজেছ তার মধ্যবর্তী অন্তর…
—- পারমিতাকে প্রবঞ্চক বলিনি। আমারও বিশ্বাস— পরম মিত্র সে আমার।
কিন্তু পর্বান্তর খুঁজি না, সে আমার
একমাত্র কাজও নয়—
— একমাত্র কাজ— ? বলেছি কি…
কেবলই ক্রিটিক্যাল সিনেমা করে তোলো।
যেন কথার সবটুকু সময় তর্কের, প্রতিস্পর্ধী যুক্তি আর জবাবদিহির।
তা না হলে এতো ধূসর, স্যাঁতসেঁতে, ছ্যাদলা
জড়ায় পূর্ববর্তী কথায় !
—- ওহ্ ! ভেবেছি, আজ সিনেমার কথা আনব না।
দেখেছি তো সিনেমার চিত্রকল্প গুলো
কেবলই মার খায়।
কিন্তু তোমার মুখে হঠাৎ সিনেমার তুলনা !
—- সিনেমার চিত্রকল্প কেবল তুমিই দেবে ?
এতো শুনেছি,
আমিও তো একদিন দিতে পারি,
না কি—
— আচ্ছা বেশ, কিন্তু কী কথায়
কখন চেয়েছি, কীসের জবাবদিহি — ?
যদি মনে করো আমরা অভিমান থেকে বেরিয়ে এসেছি !
হ্যাঁ, বয়স হয়েছে সত্যি, এই সমান্তরালের।
পারমিতা-ই একমাত্র— সেই সত্যির প্রকৃষ্টতর রূপ বুঝেছে — তাহলে,
সময়ে হারানো পারম্পর্য, তাই বেমানান আজ, বেহিসেবি কথার দিন গেছে চলে ।
— পার্থ, তোমার মনে পড়ে— সে সব ?
পলাশপুরের সাইকেল-বেলা,
ছুঁড়ে ফেলা বৃষ্টি-ছাতার দিন অথবা
জ্বরের রাতের ফোন
আর সেই পাতলা পাতলা মন—
এখনও কি নতুন গল্প বানায় ?
না স্মৃতির বিস্মৃতিতে দাঁড়িয়ে
শুধু নষ্ট দিনের কষ্ট ঘেঁটে ঘেঁটে
যা খুশি তাই লেখো ?
মন টানে না তো আর তেমন, তোমার সাম্প্রতিক লেখায়…
—- একটা জোর হাততালি, হুম আবারও খুব জোর, হাত দুটো ব্যথা না হওয়া অবধি।
মুগ্ধ পারমিতা তোমার এই একমাত্র শ্রোতা,
এই মুহূর্তে আপ্লুত তোমার চমক বক্তৃতায়—
উফ্ ! আবারও একবার কর-এ কর-এ করতালি।
— হাততালি চাই নি, তোমাকে ফুরিয়ে যেতে
দেখছি, তাই কষ্টে বলেছি।
— যাক ফুরোনো টের পেয়েছ তাহলে ?
কিন্তু তোমার কষ্ট কীসের !
মানুষ ফুরিয়ে যাবেই একদিন।
পৃথিবীর সব কিছু ফুরোবে ।
এই মন আর মন-দানী এই শরীর ভাঙবে,
নষ্ট হবে, শেষে ফুরিয়ে যাবে।
বলো, আমি কি ফুরিয়ে যাইনি তোমার
সংগ্রহ থেকে ?
— সারা জীবন ছুঁয়ে থাকব, এই ছিল অঙ্গীকার
ভুলে গেছ।
আর সংগ্রহ কেন, আমি তো বলেছি
তুমি আমার অর্জন।
— মাত্র দুই শত কিলোমিটার দূর থেকে
পরস্পর আমৃত্যু ছুঁয়ে আছে— আহা ব্যঞ্জনা !
অপার, আনন্দময়ী এ উচ্চারণ তোমার।
একদিন প্রত্ন-দিন হবে আজকের দিন,
একদিন কোনও অজুহাতে যদি খুঁড়ে বের হয়,
হয়তো তখনও ঐ অঙ্গীকারের জীবাশ্মরা
দূরে, বহুদূরে— আপ্রাণ ছুঁয়ে থাকার
মতো অপূর্ণ অভিব্যক্তি নিয়ে
শুয়ে আছে অপেক্ষার শরীরে ?
— একথা তীর্যক নয় নিশ্চই ?
কিন্তু কি জানো, এমন করে চরম ব্যর্থ কথা
আমি ও ভেবেছি অনেক। তবু আজকাল বড় দ্বন্দ্বের ধন্ধে থাকি—
সত্যিই এই একটি জীবনে— কাকে ভালবেসেছি !
— বাঃ !
বেশ নতুন ! বেশ পরিণত, বেশ প্রশ্নের।
কী এমন রহস্য রেখেছ, এমন তাৎপর্যের ?
নাকি সাবজেক্ট হিসেবে ক্রমশ কঠিন হচ্ছো,
বদলে যাচ্ছে মহা জগতের প্রেক্ষিতে
নিত্য তোমার কৌণিক অবস্থান ?
— সব কিছু কেবল জটিল করে ভাবতে চাও।
অভ্যেস বদলাও— এই চোখের দিকে তাকিয়ে
তাৎপর্য স্পষ্ট হয় না কি ?
— ভুলে যেওনা পারমিতা,
আমরা কতদিন শুধু টেলিফোনে
মুখোমুখি আছি,
এমনকি এই মুহূর্তে…
— কিন্তু এ কি দেখতে পাওয়া নয় ?
ধরো যদি এমন হতো— আমরা দুজনেই
জন্ম হতে দৃষ্টি হীন।
ধরো দুজনেই শুধু কন্ঠস্বরে পরস্পর মিলেছি এই বিশ্ব সংসারে…
তাহলেও যে সব জীবন্ত- দেখাকে উত্তীর্ণ করে
আমারা আমাদের খুঁজে পেতাম গভীর,
জীবনের বিস্তীর্ণ অন্ধকারে।
— উফ্ ! এমন করে আছড়ে ফেলো—
এমন কঠিন করে টেনে তুলে আনো সমস্ত,
এমন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিংড়ে দাও যে কেন…
যাগ্গে, তোমার প্রসঙ্গটা শুরু করো—
” কাকে ভালবেসেছি”
সত্যিই এতোটা পথ হেঁটে এসে, আজ আশ্চর্য তোমার এই দ্বন্দ্বের অর্থ
হোক অবাক করা, তবু জানতে চাইছি…
— না পার্থ,
এ কোনও দ্বন্দ্ব নয়…
— তবে দ্বিধা ?
— উঁহু , তাও নয়—
এক সুস্পষ্ট ত্রিকোণ
—- ত্রিকোণ ?
—- হুম,
তুমি, আমি আর এই অভ্যস্ত-জীবন।
(কয়েকটা বিপ বিপ শব্দ)
কেটে যায় পারমিতার ফোন। পার্থ অপেক্ষা করতে থাকে আবারও সপ্তাহান্ত অথবা পক্ষান্তের অবকাশের জন্য।
অসাধারণ লাগল…💐🙂
এককথায় অসাধারণ…..দারুণ ।