মুক্তগদ্যঃ ঝুলন ও রাখী বন্ধন – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

ঝুলন ও রাখী বন্ধন
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

ঝুলন সাজানো

আমাদের ছোট বেলায় ঝুলন পূর্ণিমার আগের দিন থেকেই আমরা ছোট্ট করে একটা দোলনায় ছোট্ট রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি রেখে মাঝে মাঝে দোল দিতাম আর বাড়ির সকলকে, পাড়ার এবং আশপাশের পাড়ার বিভিন্ন বয়েসী ছেলে মেয়েদের আমাদের ঝুলন সাজানো দেখাতাম।
গাছপালা, কাঁচা কোথাও পাকা রাস্তা, সরোবর, সরোবরে রাজহাঁস ঘুরছে, নদী, নদীতে বড় বড় মাছ, নৌকা, জাহাজ, পাহাড়, বরফের ঢাকনা সহ পর্বত মালা, ছোট বড় বাড়ি ঘর, খেলার মাঠ তাতে ফুটবল খেলছে ছোট্ট ছোট্ট রঙিন জামাপরা খেলোয়াড় পুতুলরা। কোথাও পার্ক ফুলে ফুলে ফুলময়। কোথাও বিরাট কারখানা, কারখানার উঁচু চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে। রাস্তায় হাঁটছে মানুষ, চলছে হরেক রকমের গাড়ি, মায় কাঁচা রাস্তায় গরুর গাড়ি, আরও কত সজ্জা। একেবারে শহর গ্রামের চেহারা কোথাও এয়ারপোর্ট যেখানে সারি সারি বিমান অপেক্ষা করছে। এইসব নিয়ে গড়ে উঠতো আমাদের এই সব সাজানো।
বিমান যাত্রার শুরুর দিকে তাকালে নীচের বাড়িঘর ফসলের ক্ষেত যেমন দেখায় তেমনই ছিল আমাদের ও আর আশপাশের পাড়ার বন্ধুদের নিজ নিজ বাড়ির বারান্দায় বা পরিত্যক্ত কোনো ঘরে ঝুলন সাজানো। কেউ কেউ আবার রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র বানাতো। তবে এখনকার সময়ে কম বয়েসী ছেলেমেয়েরা এসব ঝুলন ঝুলন খেলতে গিয়ে নিজেদের কল্পনার রূপ দেবার সুযোগ খুব একটা পায় না বা অনেক ক্ষেত্রে তারা পছন্দ ই করে না। তাদের হাতে মোবাইল বা স্মার্ট ফোন এসে গেছে। কারোর কাছে ট্যাব, ল্যাপটপ এসব নিয়ে বেশ সময় কোথা দিয়ে বেরিয়ে যায় তা টেরও করতে পারে না।
এছাড়াও বাড়ির মায়েরা নিজেদের ঘরে হরেক রকমের পুতুল খেলনা দিয়ে সোকেজ বা আলমারি সাজাতে ভালবাসেন। নিত্যনতুন পুতুল না কিনলেও দেখা যাবে সেসব জায়গা পুরনো খেলনায় ভরে উপচে উঠেছে। হয়তো পঁচিশ ত্রিশ বছরের পুরনো পুতুল রয়ে গেছে। কোন কোনটায় জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতিও। কাজেই ঝুলন সাজানো আজকাল তেমন আর নজরে পড়ে না।

শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন

ঝুলনাকে বলা হয় হিন্দোল বা হিন্দোলিকা বা হিন্দোলা। আগের দিনে হিন্দোলায় শ্রীরাধাকৃষ্ণকে দোলন করিয়ে দোল উৎসব হতো। এখনও বিভিন্ন মন্দিরে দোল এভাবেই দোল উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে দোল বা হোলি হয়ে থাকে ফাল্গুন মাসে।
মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের একটি কবিতার অংশ:-
” ঝুলে আজি ঝুলনে,
সুখ কুঞ্জ কাননে,
শ্যাম রাধিকা একি আসনে….”
মীরা বাঈ গেয়েছেন :-
” ঝুলত রাধা সঙ্গ গিরধর।
আবীর গুলাল উঠাবত রাধা, ভরি পিচকারী রংগ।
লাল ভ ই বৃন্দাবন যমুনা, কেশর চুবত রংগ।।
নাচত তাল অধর সুর ভরে, ধিমধিম বাজে মৃদঙ্গ।
মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর, চরণ কমল কুরঙ্গ।।…”
এসবই তো ফাল্গুন মাসের হোলি উৎসবের গান। কিন্তু আমরা শ্রাবণ মাসের ঝুলনের কথা বলতে শুরু করেছিলাম।
আসলে গাছের ডালে দড়ি বেঁধে গ্রামের ছেলে মেয়েরা আজও দোলনায় চেপে দোল খায় আবার দোল দেওয়ায়। আদিম এই মজার খেলা অল্প বিস্তর আজও দেখা যায়। কেউবা নিজের বাড়ির বারান্দায় বা ব্যালকনিতে দোলনায় দোলেন আরাম পেতে। দোলনায় দোল খেতে কোন কাল বা মাসের বিচার হয় না।

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর রাখাল বন্ধুদের নিয়ে বৃন্দাবনের বনের গাছের ডালে বাঁধা দোলনায় প্রায়ই দোল খেতে ভালবাসতেন। তিনি তাঁর রাখাল সখাদের পর্যন্ত দোলাতেন। পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সখীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা শ্রীমতী রাধারাণীর সঙ্গে অবশ্যই দুলতেন। সখীরা দোল দিতেন। সম্ভবত, শ্রাবণ মাসেই শুক্লপক্ষে এই ঝুলন সংগঠিত হয়েছিল। বৈষ্ণবরা এই শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে শ্রীরাধাকৃষ্ণকে সুসজ্জিত হিন্দোলিকায় আরোহণ করিয়ে পূর্ণিমা পর্যন্ত দুলিয়ে থাকেন। নৃত্য গীতে মুখরিত হয়ে উঠতো বৃন্দাবনের গাছপালা, পাখিরা সব, ময়ূর ময়ূরীরা, সুন্দর সুন্দর হরিণ হরিণীরা। তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তরাও ঝুলনে গান নৃত্য সঙ্কীর্তনে সমস্ত পরিমণ্ডল মুখরিত করে অকাতরে আনন্দ বিতরণ করে থাকেন।

রাখীবন্ধন

রাখীবন্ধন একটি প্রাচীন রীতি। মা যশোধা তাঁর ছোট্ট গোপালকে রাখী পরিয়ে দিতেন, যাতে গোপালকে কোন অমঙ্গল স্পর্শ না করে।

ইতিহাসে দেখা যায়, সিকন্দরের স্ত্রী রৈক্সোনা পুরুর কাছে রাখী পাঠিয়েছিলেন। যুদ্ধে প্রথমে সিকন্দর পরাজিত হলেও পুরু তাঁকে হত্যা করার সুযোগ পেয়েও হত্যা করতে পারেননি, কারণ তাঁর অঙ্গীকার করা বোন রৈক্সোনার দেয়া রাখী তাঁর হাতে বাঁধা ছিল।

রাজপুত কন্যা করুণাবতী দিল্লীর তখনকার বাদশাহ হুমায়ুনকে কয়েক বছর রাখী পাঠিয়েছিলেন। রাখীর মাধ্যমে বোনের বিপদের সময় খবর পেয়ে বাদশাহ হুমায়ুন অন্য যুদ্ধ ক্ষেত্র ছেড়ে পাতানো বোনকে রক্ষা করতে কিছু সৈন্য সহ ছুটে যান। বেশ দূরের পথ। কিন্তু তিনি পৌঁছনোর আগে সম্মান রক্ষার্তে কোন উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে ততক্ষণে রাজপুত সংস্কার মেনে বোন করুণাবতী জহর ব্রতের আগুনে আত্মবিসর্জন দিয়ে ফেলেন।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলকে রাখী পরিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার উৎসব শুরু হয়।

ঝুলন যাত্রার মাঝখানে শ্রাবণের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে বা রাখীপূর্ণিমা তিথিতে পবিত্রারোপণ উৎসব পালনের রীতি বৈষ্ণবদের মধ্যে বর্তমান। সোনা, রুপা, তামা, পাটের, পদ্মের, কার্পাস, কাশ ও কুশ নির্মিত সূতোই পবিত্র সূতো বা ডোর বলে গণ্য করা হয়। দেশকাল অনুসরণে এক মাস বা এক পক্ষ বা একদিন এই পবিত্র ডোর ধারণ কর্তব্য। সম্ভবত, এই পবিত্রারোপণ উৎসব থেকে রাখীবন্ধন উৎসব দেশকাল ভেদে নানান রূপ পেয়েছে।

2 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ ঝুলন ও রাখী বন্ধন – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *