রিক্ত মানুষের কবিতাগুচ্ছ
অমিত চক্রবর্তী
১
যেটাকে জিত বলে মনে হচ্ছে
রঙের উৎপীড়ন চর্তুদিকে। শব্দেরও।
নিরীহ মানুষটাকে ক্ষ্যাপাবার জন্যে
যেন দুন্দুভি, মাদল, খরতাল বের করেছে কৈলাশ পর্বত
যেন বাজি ধরে খেলা দেখছে অলস, কাজবিহীন
কিছু ভাগ্যনিয়ন্ত্রক। সমীরণ অপ্রস্তুত নয় তাতে, সে জানে
একবার বেদনাকে আঁকড়ে ধরতে পারলে,
একবার সেলফ-পিটি মেখে নিতে পারলে,
আসতে থাকবে বিবিধ জয়, মুখগোঁজা উটপাখির মতন
স্থায়ী, টেকসই জয়। রঙ মুছে যাবে ক’দিনেই,
কাদা, মাটি, বরফ ফিরবে সংসারে,
মনমাতাল শব্দকাকলি, রতি-দামাল পাখির দল
সব চলে যাবে দূরে, অন্য কোনো প্রতীতির
খোঁজে। কিন্তু বেদনা নিরন্তর, আত্মকরুণা নিরন্তর,
মরণপণ শোধ করেছে সমীরণ, দেখিয়ে দেবে তার মনমরা,
বিষণ্ণ ধ্যান, জিতে যাবে এই নিজস্ব খেলায়,
অন্তত যেটাকে জিত বলে মনে হচ্ছে তার।
২
নির্বাক সম্ভার
পাতাবাহারের গাছ যেমন শিশির আঁকড়ে
অবতল, সবুজ পাঁচিল ঘিরে উদ্বেগহীন, শান্ত
তেমনই ছন্দে ছিল অরিন্দম।
অথচ সে গাছ রোদ উঠলেই নিঃস্ব, আসলেই ফক্কা মুঠো
শিশির শুকিয়ে গেছে কখন, জলের দাগও নেই শিরাতে আবছা।
সেই বেতালে জীবন দেখে অরিন্দম –
দেখে জুয়ায় জিতে যাওয়া মানুষ, তাদের আস্ফালন
বুকফোলানো ছাতারে পাশে স্টেরয়েড খাওয়া দাঁড়কাক –
সব দামড়া, মাচো ভাব সে
ধরে রাখে বুকে, পাথরে পাকস্থলীতে
কেলাসের মত আগলায় যত লুকোচুরি, যত শান দেওয়া বিদ্রূপ।
এখন সে নির্বাক সম্ভার – খেয়ালখুসি,
কৌতুক আর বিড়ম্বনার রাজকোষ
পুরু লেন্স, মোটা খোলসে সে এখন কবিতার পথে …
৩
কক্ষচ্যূত
তুমি অন্যমনস্ক অথবা বিষয়ীমন
খুঁটিয়ে মেপে নিলে গ্রহপথ, যত উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব
আর আমি কক্ষচ্যূত, ভাবি কোথায় পাব জ্যোতিষ্ক আবার,
ভাবি মহাকর্ষ সরল করে দেবে এই সমস্ত সন্ধিপদ।
প্রস্তুতির বাঁশি কিন্তু শুনছিনা এখনো, হৃদয়ের দোষগুণও বাতিল নয়
শুধু দৃশ্যহীন স্থির আছি। জোড়ডাঙার মাটিতে সেঁটে স্থির
পিচ্ছিল ঢালুকে আঁকড়ে স্থির।
সাময়িক ভিড় জমেছে সেখানে, কেটে যাবে নিশ্চয়
লোকে কৌতূহল হারায় –
অন্যলোকের কাছে সব থেকে যায় আড়ালে।
শুধু গ্রীনরুমে একবার
তুমি প্রশ্ন করেছিলে, কক্ষচ্যূত হয়ে আমি দিন কাটাচ্ছি কেন –
ন যযৌ, ন তস্থৌ
বন্ধন নেই অথচ মুক্তির লোভও নেই
কোন গতিবেগ বা আকাঙ্ক্ষার লেশমাত্র নেই
কিন্তু বলব কি, এ সব প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই জানি না।
৪
দীর্ঘপতনের শব্দে
দীর্ঘপতনের শব্দে সে কিন্তু চমকায়নি একটুও
হয়তো প্রত্যাশিত…
সেই থেকে আমি ওঠার চেষ্টায় – তালুতে ভর দিয়ে,
হাটুঁতে ভর দিয়ে, উল্টেপাল্টে হামাগুড়ি দিয়ে।
একটা কাপুরুষ ভাব, অলস স্বভাব জড়িয়ে ধরছে ক্রমে
দীর্ঘ বেষ্টনীজাল – চাকচিক্য বাইরে যদিও, বহু পোঁচ, সাটিন রঙ
ভেতরে প্রাচীন ঋতু, সীমায়িত জ্ঞান, ভুল আশার কৃস্ট্যাল।
সবই ভর্তুকি এখন, সময়ের কাছে ঋণ
কেউ একটা দাম দিচ্ছে কোথাও আমার অবসাদের।
তাই বুঝি এত রাত্রির ভিড়, এত ভুষাকণা। তাই এখনো
জিজ্ঞাসায় ছেয়ে আছে সেই মেয়ে, হয়তো বা সান্ত্বনায়
পিছুডাক দিয়ে, আমি যে রিক্ত …
৫
রঙপর্ব
জৈষ্ঠ্যের দুপুরে সাবানজল নিয়ে খেলে প্রতিবেশী বালক
খড়কাঠি ফুঁ দিয়ে বানানো সে বুদ্বুদ, তাতে
রঙ বুঝি রোপণ করেছে আলো,
জল পাল্টে, জল পাল্টে কোনো এক পলাতক হৃদয়।
এই নাটকে আবহ সংগীত
কর্কশ থেকে করুণ হতে থাকে
যৌবন দামামা থেকে পরিণত বাঁশি, সরোদ
ফিজিক্স বলবে, ঠিকই তো, রঙপর্ব পাল্টাবেই তো
ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে যে বুদ্বুদ
কালো কালো ছোপ এখন সারা গায়ে, প্লেগের উপাখ্যান
দু দিনের আশা, আসা মাত্র …
“দুদিনের আশা, আসা মাত্র…” অসাধারণ! প্রতিটি কবিতা, তার নিজস্ব স্বাক্ষরে উচ্চারণে প্রোজ্জ্বল। তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে সেরা লাগল ‘কক্ষচ্যূত’…অনবদ্য! শুধুমাত্র এ কবিতা নিয়েই আস্ত একটি প্রবন্ধ হয়ে যায়। ‘বিষয়ীমন’, ‘সন্ধিপদ’ শব্দরা আশ্চর্য অ্যামবিয়েন্স সৃষ্টি করেছে। পাঁচটির মধ্যে একটিকে সেরা বলে কি বাকী চারটিকে কি হেয় প্রতিপন্ন করতে চাওয়া হল? আশা করি তেমনটা বুঝবার মত মানুষ আপনি নন। আসলে কিছু কবিতা আছে, যাদের সাথে প্রথম পাঠ থেকেই রিলেট করা যায় গভীরভাবে। আপনার বিষয়ান্তরে পরিক্রমা আর গহীন দর্শনের মোড়কে আটপৌরেকেও মুড়ে রাখার এই স্বতন্ত্র ধারা বাংলা কবিতাকে সম্পন্ন করে তোলে। পত্রিকা সম্পাদককে ধন্যবাদ, এই কাব্য লহরীর অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। শুভকামনা অনিঃশেষ।
দারুণ লাগল, বিশেষ করে শেষ পর্বটা….❤️🙂
৩, ৪,৫…অত্যন্ত ভালো লাগলো… যদিও সবগুলোই ভালো।
শুভকামনা বন্ধু💐💐
নির্বাক সম্ভার পড়ে আপ্লুত
অমিতবাবুকে অনেক শুভেচ্ছা। কবিতাগুচ্ছের নামই বলে দিচ্ছে আপাতভাবে যাদের ‘ হেরে যাওয়া’ মনে হচ্ছে তারা কি সত্যিই তাই? আমি কিন্তু তলায় তলায় নতুন সম্ভাবনাকেই পেয়েছি।