পান্না হলো সবুজ
কাজরী বসু
(১)
একটু আগে আমার পেজের মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ এল।
…আমি একটু বিপদে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হলাম। আমি কি কথাটা বলব?
মেসেজ যিনি করেছেন তাঁর প্রোফাইলে নাম রয়েছে অচেনা সোম। ডি পি হিসেবে একটি টেডি বিয়ার।
আমি সাধারণত নিজের প্রোফাইলে এই সব অদ্ভুত নামের আর ডিপির লোকজনের বন্ধুত্বের অনুরোধ স্বীকার করি না,কিন্তু আমার পেজে এমন অনেকেই লাইক দিয়ে পেজে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন,যাঁরা আমার বন্ধুতালিকায় নেই।
….হ্যাঁ, বলুন প্লিজ।
…… আসলে অনেক কিছুই জানাবার আছে,আমি কি আপনাকে ফোন করতে পারি?
….বেশ তো করুন। দেখুন কনট্যাক্ট নম্বর পেজেই রয়েছে।
আমি আইটি প্রফেশনাল কিংশুক রায়, বছর চারেক হলো একটা আধা বিদেশি কোম্পানিতে কোডিং করি, মাস সাতেক আগে “অনুসন্ধানে কিংশুক” বলে একটি ফেসবুক পেজ খুলেছি আমার শখের গোয়েন্দাগিরিকে একটু ঝালিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে। রীতিমতো ফেলুদাভক্ত আমি ইতোমধ্যেই গোটা দুই কেস সলভ করে বেশ কিছু অর্থও উপার্জন করেছি, মিথ্যে বলব না। আর তাতে আত্মবিশ্বাসটাও চড়চড় করে অনেকটা চড়ে বসেছে।
মোবাইল বাজছে।
…..ইয়েস..
রিনরিনে একটি নারীকন্ঠ।
….নমস্কার কিংশুক। আমিই অচেনা, আমার আসল নাম তিস্তা সোম। আমার আপনার সাহায্য প্রয়োজন ।
….আপনি খুলে বলুন তো সবটা। কোনো কিছু হাইড করবেন না।
মেয়েটি যা বলল,তার সারমর্ম এই..
তিস্তার জন্মের পরেই ওর মা মারা যান। তিস্তাকে মানুষ করার জন্য ওর বাবা অনন্ত সোম তখন তিস্তার ছোটমাসিকে বিয়ে করেন,তিস্তার দাদু দিদা সকলেই তাতে সম্মতি দেন।
কলকাতায় একটি জুয়েলারির দোকানের মালিক ছিলেন অনন্ত। সবই ঠিকঠাকই চলছিল, হঠাৎ তাঁর গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেই সময় তিনি তিস্তাকে বলেন যে দোকান আর ফ্ল্যাটের মালিকানা যেহেতু যৌথ ভাবে ওঁর আর ওঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর,তাই মেয়ের নামে আলাদা ভাবে কিছু রেখে যেতে হয়ত পারবেন না উনি। কিন্তু বেশ কিছু দামী মণিমাণিক্য তিনি বাড়িতে গোপনে কোথাও রেখে যাবেন,যাতে তা অন্য কারো হাতে না যায়। তিস্তার প্রয়োজন হলে সেই পাথর একটা একটা করে নিয়ে সে বিক্রি করতে পারবে,যতক্ষণ না সে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়।
কোথায় রাখা আছে সেগুলো,তা জিজ্ঞেস করায় ওর বাবা বলেছিলেন, সময়মতো জানাবেন।
সেই সময় আর আসেনি। ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিল, মোটামুটি রেসপন্ডও করছিল শরীর,দোকানেও যাতায়াত করছিলেন, ইতোমধ্যে ঘুমের মধ্যে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে তিনি মারা যান। কোথায় সেই মূল্যবান পাথরগুলো তিনি রেখে গেছেন,তা আর জানা হয়নি তিস্তার। অনন্ত সোমের মৃত্যুর পর অনেক খুঁজেছে তিস্তা,কিন্তু কোথাও পায়নি।
মনে মনে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল সে।
আমার ফেসবুক পেজ দেখে তিস্তার মনে আশার সঞ্চার হয়েছে।
যদি কোনোভাবে তার বাবার রেখে যাওয়া পাথরগুলো তাকে খুঁজতে সাহায্য করি!
কথাগুলো শুনে আমার ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল। আমি কিছু বলার আগেই তিস্তা বলল,
একটা কথা আগেই বলে নিই। আপনার পারিশ্রমিক কিন্তু আমি সেভাবে দিতে পারব না। তবে পাথরের সন্ধান পেলে আমি আপনাকে সেখান থেকেই আপনার পরিশ্রমের মূল্যের হিসেবে কোনো একটি পাথর দিয়ে দেব। আপনি তো জানেন মণিমাণিক্যের দাম কম নয়। এছাড়া আলাদাভাবে আপনাকে কোনো অর্থ দেওয়া কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি যদি এই শর্তে রাজি থাকেন তাহলে আমি আপনার মেসেঞ্জারে ঠিকানা দেব,আপনি দু একদিনের মধ্যে বারোটা থেকে চারটের মধ্যে একবার আমাদের বাড়ি এলে বাকি কথা বলা যাবে। তবে খুব বেশি দেরি কিন্তু করবেন না। আমার হাতে খুব একটা সময় নেই। আপনি রাজি না হলে আমি অন্য কারো সাহায্য নেব। আপনি চিন্তাভাবনা করে আমায় পিং করে দেবেন।
…আচ্ছা,একটা কথা,আপনার কি আর কোনো ভাইবোন আছে?
….না, মানি মানে আমার মাসির নিজের কোনো সন্তান হয়নি। আমি একাই।
ফোন রাখার পর ভাবলাম,কেসটা নিয়েই নিই। বাবা যখন একমাত্র মেয়ের জন্য মণিমাণিক্য রেখে গেছেন,তখন তা নিশ্চয়ই খুব একটা খেলো কিছু হবে না। আমার পারিশ্রমিক হিসেবে তার একটি যথেষ্টই হবে আশা রাখি। কিন্তু পাথরগুলো তো আগে খুঁজে বের করতে হবে। কাজটা যে সহজ হবে না, তা তো বলাই বাহুল্য।
সঙ্গে সঙ্গে নয়,দু ঘন্টা বাদে জানালাম,আমি রাজি।
পরদিন দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ উল্টোডাঙা থেকে বাস ধরে তিস্তার দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম। কেয়াতলা রোডে ওদের তিন কামরার ফ্ল্যাট পাঁচ তলায়। লিফটে উঠে দরজায় বেল দিতেই একটি অল্পবয়সী মেয়ে এসে খুলে দিল দরজা। প্রায় পাঁচ ফুট ছ ইঞ্চির ছিপছিপে উজ্জ্বল মুখের অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটি। বলল,আমিই তিস্তা।
(২)
….ভিতরে আসুন,প্লিজ।
সাদা রঙের একটা ফুল হাতা টপ আর হলদে লঙ স্কার্ট পরে রয়েছে তিস্তা। ওর বয়েস ঠিক কত? কুড়ি একুশের আশেপাশেই হবে।
বসার ঘরে নিচু লেদার কাউচ, বেশ আধুনিক ডিজাইনের, তিস্তা বলল,বসুন প্লিজ। আমি একটু আসছি।
বেশ বড়ো বড়ো জানলা রয়েছে ঘরে, গাঢ় বাদামি মোটা পর্দা দুদিকে রিবন দিয়ে আটকানো,ফলে ঘরে বেশ হালকা রোদের আলো খেলা করে বেড়াচ্ছে। সামনের দেয়ালে কাচ বাঁধানো দুটি অয়েল পেন্টিং, কাউচের চারপাশে চারটি বড়ো বড়ো বাঁকুড়ার ঘোড়া। টেবিলের উপর একটি ইনডোর প্ল্যান্ট। ডানদিকের দেয়াল জুড়ে কাচের শো কেস, বাঁ দিকে অন্য ঘরে যাবার দরজার পাশে বেশ বড়ো একটি ওয়াল হ্যাঙ্গিং।
ট্রেতে করে নিজেই সফট ড্রিঙ্কসের গ্লাস এনেছে তিস্তা।
সঙ্গে স্লাইস কেক একটা,প্লেটে।
…নিন,একটু খান,এতটা পথ এলেন…
…আপনি কি এ ফ্ল্যাটে একাই থাকেন?
….মানি এই সময় দোকানে যায়। বাপি মারা যাবার পরে মানিকেই দোকানের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। এই সময়টায় আমি একা থাকি,তাই আপনাকে এই সময়টাই দিয়েছি। আসলে মানি থাকলে তো করা যাবে না কাজটা, মানি তো আসলে জানেইনা..
আমি ভাবছিলাম,মেয়েটা আশ্চর্য রকমের ডেসপারেট তো!
একা একটি তরুণী, আমার মতো একজন যুবককে দিব্যি ডেকে পাঠালো,আমার মনে তো কোনো খারাপ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে…
মোবাইল বাজছে তিস্তার।
হ্যালো, হ্যাঁ তিস্তা বলছি..
তিস্তা উঠে ভিতরে গেল ফোনে কথা বলতে বলতে।
ঘরটা একটু ঘুরে দেখতে উঠে দাঁড়ালাম। আমার পিছনের দেয়ালে তিস্তার একটি আলোকচিত্র, এতক্ষণ পিছনে থাকায় চোখে পড়েনি। তিস্তা একটি সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে, ফুল হাতা সাদা জামা আর সাদা পাজামা ধরনের পোশাক পরনে, কোমরে একটি কালো রিবন টাইট করে বাঁধা। ছবিটি একটাই কথা বলছে,তিস্তা মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণের যে ধাপ পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে ফার্স্ট ডান ব্ল্যাক বেল্ট বলে। আর সেই
পর্যন্ত পৌঁছনোর অর্থ, নিজের নিরাপত্তার জন্য সে একাই একশো, কাউকে ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই তার।
এবারে বুঝলাম তার সাহস আর আত্মবিশ্বাসের আসল কারণ।
তিস্তা আমায় ইমপ্রেস করতে শুরু করেছে ততক্ষণে।
..কী দেখছেন?
চমকে তাকালাম। হাসিমুখে তিস্তা দাঁড়িয়ে।
.. আসুন,আমরা কাজের কথাগুলো বলে নিই। আপনি বলুন আমায় কী কী জিজ্ঞাস্য আছে আপনার।
নরম পানীয়র গ্লাস ঠোঁটে ছুঁইয়ে বললাম,
..আপনার বাবা স্টোনগুলো বাড়িতেই রেখেছেন না অন্য কোথাও সে বিষয়ে আপনার কাছে কী কী তথ্য আছে?
… তথ্য বলতে, দেখুন, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরে আমি কর্ণাটকের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশোনা করছি। এ বছরই আমার ফাইনাল ইয়ার। একটা সেমেস্টার কমপ্লিট হবার মধ্যিখানের ছুটিতে আমার বাড়ি আসা। কলেজে ভর্তির পর পরই বাপির ক্যানসার ডিটেক্ট হয়। সেই সময় ফোনেই কথা হতো বেশি। বাপি আমায় একদিন বলে,তোর জন্য কিছু জেম আমি বাড়িতে কোনো একটা জায়গায় রেখে যাব। তুই পেয়ে যাবি, কোথায় রাখছি সেটা ফোনে বলা ঠিক হবে না। তবে বাড়িতেই রাখব,এটা নিশ্চিত। পরে সময়মতো তোকে বলে দেব।
…”আচ্ছা,একটা কথা বলুন তো,আপনার মাসিকে মানে মানিকে কি আপনার বাপি সন্দেহ করতেন?
…. সন্দেহ ঠিক নয়… মানি কিন্তু আমাকে খুবই ভালোবাসে। মায়ের অসুস্থতার সময় থেকে মানি ই তো আমায় কোলে পিঠে করে বড়ো করে। আর সেই কারণেই আমার কথা ভেবে এই স্যাক্রিফাইস। তাই আমার কোনো ক্ষতি মানির তরফ থেকে হবেই না, বাপিও সে কথা জানত।
…কিন্তু সেক্ষেত্রে এই লুকিয়েচুরিয়ে আপনার জন্য কিছু রেখে যাওয়া,ব্যাপারটা একটু কেমন না? মনে হচ্ছে না কারো কাছ থেকে আপনার বাবা এই পাথরগুলোকে আড়াল করতে চাইছিলেন,যাতে আপনার জিনিস সুরক্ষিত থাকে! আপনি নিজেই ভাবুন না। এটা কি স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে আপনার? এত লুকোছাপা কার জন্য?
না, বলছি আপনাকে, ব্যাপারটা আসলে..
আই মিন..
কথার মধ্যে তিস্তার মোবাইল বেজে উঠল। “এক্সকিউজ মি” বলে ফোন নিয়ে উঠে পাশের ঘরে চলে গেল তিস্তা।
আমি উঠে পায়চারি করতে লাগলাম। এই ফ্ল্যাটের মধ্যে কোথায় কয়েকটা মূল্যবান পাথর সযত্নে লুকিয়ে রেখে গেছেন অনন্ত সোম তা আমায় খুঁজে বের করতে হবে। ক্লু হিসেবে আপাতত কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরের অন্যদিকেও কয়েকটা সোফা কাউচ ছড়ানোছিটোনো। ছোট্ট একটা নিচু ডিভানে পাঁচ ছটা সফট টয়। কোনোটা টেডি বিয়ার,কোনোটা কুকুর,কোনোটা শিম্পাঞ্জি। একটা বিশাল বড়ো পেঁচাও আছে।
….”আপনি খোঁজার কাজটা কাল থেকে শুরু করে দিন,”কখন যেন তিস্তা এসে দাঁড়িয়েছে,” রোজ বারোটা থেকে চারটে অবধি সময় পাবেন। তারপর আপনাকে চলে যেতে হবে। মানি এসে পড়বে। মানির কাছে বাপি যখন ব্যাপারটা বলেইনি,তখন আমিও সেটা জানাতে চাই না। আমি আর দিন পনেরো থাকব,তারপর আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে,আমি ফিরে যাব হোস্টেলে। আপনি এই কয়েকটা দিন খুঁজে দেখুন। পাথরগুলো এই বাড়িতেই আছে। কোথায় আছে তা বের করার দায়িত্ব আপনার।”
লিফট দিয়ে নেমে ফ্ল্যাটের পিছন দিকটাই আগে পড়ে। এদিকটায় অনেক গাছাগাছালি। গেটের দিকে যেতে গিয়েও পিছন দিকটায় এগিয়ে গেলাম। উপরে পাঁচতলায় তিস্তাদের জানালাটা বন্ধ। জানি না এখনো ওটা কার ঘর। নীচে কয়েকটা ফাঁকা টব রাখা আছে। মনে হয় গাছ লাগাবে বলে কেউ কিনেও আর লাগায়নি। একটা টবের মধ্যে কয়েকটা কাগজের টুকরো। বেশ কিছুদিন বৃষ্টি বলে কিছুই নেই, মনে হয় তাই শুকনো রয়েছে। কিছুই না হয়তো, তবু অভ্যেসবশে তুলে নিয়ে পকেটে চালান করে দিলাম।
বাড়ি এসে প্রথমেই পকেট থেকে বের করলাম কাগজগুলো। পরিষ্কার হাতের লেখায় কিছু কিছু কথা লেখা আছে।
একটায় লেখা,
কোথায় গেল নখ?
ভেজাস না আর চোখ!
আর একটায় লেখা,
সব কি থাকে কন্যে
শুধুই দেখার জন্যে!
মন না দিলে আমার কথায়
খুঁজবি হয়ে হন্যে!
তাজ্জব ব্যাপার! এ তো বেশ দু চার লাইনের ছড়া দেখি! ছড়া লিখেছে বুঝলাম। কিন্তু যেই লিখুক, সে লিখে জানলা দিয়ে বাইরে কেন ফেলেছে! কেন!
(৩)
…আপনি বাড়ির সব জায়গাতেই খোঁজাখুঁজি করতে পারেন। শুধু মানির ঘর বাদ দিয়ে। মানি খুব খুঁতখুঁতে মানুষ, নাড়াচাড়া হলে টের পাবেই আর ঠিক কিছু একটা আঁচ করবে। আমি আপনাকে এইটুকু গ্যারান্টি দিচ্ছি, মানির ঘরে বাপি কিছু রাখেনি।
কথামতো ঠিক বারোটায় পৌঁছে গেছি তিস্তাদের কেয়াতলার ফ্ল্যাটে। আজ তিস্তা কমলা টি শার্ট আর নাবিক নীল বারমুডা পরেছে, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা।
…কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন? আপনার মানির ঘর মানে আপনার বাবারই তো ঘর,সেখানেই যদি কোথাও কায়দা করে পাথরগুলো রাখেন আপনার বাবা! বরং ওটাই তো সুবিধেজনক ছিল ওঁর পক্ষে।
চোখ সরু করে তাকাল তিস্তা। একটু চুপ করে থেকে বলল..
… মানির চোখে পড়ে যাবার চান্স আছে জেনেও! শুনুন,আপনি আগে অন্য ঘরগুলো খুঁজতে শুরু করুন না। আমার ঘর দিয়েই নাহয় স্টার্ট হোক।
…বেশ। আচ্ছা,আপনি যখন থাকেন না, আপনার ঘর তখন ব্যবহার করেন কেউ?
…না,কিন্তু ঘর খোলাই থাকে। সকালে বিনু মাসি ঝাড়ু দেয়,মোছে,ডাস্টিং করে। আসুন,আমি ঘরে নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে।
লিভিং এর বাঁ পাশের ঘরটাই তিস্তার। ঘরটা খুব যে একটা গোছানো তা নয়, বাঁ দিকের দেয়ালে হ্যাঙারে ঝোলানো মেয়েদের পোশাক,খাটের উপর বইপত্র খোলা পড়ে আছে, ল্যাপটপ রয়েছে, একটা গোলাপি রঙের টেডি গড়াগড়ি যাচ্ছে।
….এই টেডিটাই আপনার ডিপি না?
…..হ্যাঁ,আমার ছোট্টবেলার পাশবালিশ।
……কিন্তু ডিপিতে এর ছবি কেন?
……কারণ আমার ইচ্ছে।
…..সারা বাড়ি জুড়ে আপনার এই সব পুতুল দেখছি। আপনি এখনো পুতুল খেলেন?
…..এগুলোকে পুতুল বলে? সফট টয়কে আপনি বলছেন পুতুল?
…. ও তাও তো কথা। আচ্ছা এই পুতুলগুলোর মধ্যে মণিমাণিক্য ভরে রাখেননি তো আপনার বাবা?
….একবার আমিও তা ভেবেছিলাম। কিন্তু সেটা হতে পারে না। আমার সফট টয় শ খানেকের কম নয়। আর এগুলো আমার খুব প্রিয়। বাপি এগুলোর মধ্যে পাথর লুকিয়ে রাখবে? না, তা কখনোই করবে না,কারণ সেক্ষেত্রে আমায় সব কটাকে খুলে ছিঁড়ে নষ্ট করে দেখতে হবে। পুরোপুরি মাথা খারাপ না হলে এরকম কথা কেউ ভাবে না। বাপি আর যাই হোক,সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ছিল।
….আপনি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী দেখছি। তা সত্ত্বেও পাথরগুলো খুঁজে পেলেন না?
….বাপির বুদ্ধি যে আমাকেও টেক্কা দিয়ে গেছে। এবার আপনার বুদ্ধির দৌড়টা দেখা যাক।
ঘরের ডানদিকে টেবিলে একটা পুরোনো ঢাউস ডেস্কটপ। দেয়াল জুড়ে ওয়ার্ডরোব। একপাশে দেয়ালে একটা আলমারি জুড়ে বই, অন্য একটা কাচের শোকেস ভর্তি পুতুল আর খেলনা।
…আচ্ছা আপনি ওয়ার্ডরোব খুঁজেছেন ভালো করে?
…অন্তত একশোবার সব নামানো হয়ে গেছে। পাইনি কিছু। আর ছোট ছোট স্টোন ওয়ার্ডরোবে বাপি কোথায় রাখবে বলুন তো!
…ভিতরের পুতুলগুলো?
…..দেখেছি সব। একটা জিনিস বুঝেছি,বাপি সাধারণ কোনো জায়গায় লুকিয়ে রাখেনি ওগুলো। কিছু একটা স্পেশাল ব্যাপার আছেই। আর সেটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।
খাটের মোটা গদি নিখুঁত ভাবে সেলাই করা। এ গদির সেলাই খুলে তুলোর মধ্যে ভরে দেন যদি? সেটা কি সম্ভব? মনে হয়না। তুলোর মধ্যে ভরলে তো হারিয়েই যাবে,এত কঠিন আর দুর্ভেদ্য হবে সব কিছু…নাহ,অন্যভাবে ভাবতে হবে।
…আমি যেখানে যত ড্রয়ার আছে সব পরীক্ষা করেছি। আমার যত জুয়েলারি বক্স আছে,খুঁজেছি। নেই কোত্থাও।
…হুম। ঠিক আছে আমি দেখছি কোথায় খোঁজা যায়।
তিস্তা আর আমি দুজনে মিলে তল্লাশি চালাতে শুরু করলাম।
তিস্তা তো পায়নি,আগেই বলেছে। আমি যে এভাবে পাব,সেই ভরসাও আর পাচ্ছি না তেমন। পণ্ডশ্রম হবে মনে হয় সবটাই।
….আচ্ছা তিস্তা,আপনার বাবার কোনো ডায়েরি বা খাতা টাতা কিছু ছিল?
…না,আমি তো জানি না।
উপর উপর যতটুকু খোঁজাখুঁজি করা যায় খুঁজে ব্যর্থ হয়ে ঘর থেকে বেরোতে যেতেই ওয়াল হ্যাঙ্গিং এর দিকে চোখ গেল।
….আচ্ছা,এইটের মধ্যে দেখেছেন কি?
…হ্যাঁ,ওখানে শুধুই চিঠি আর কাগজের মেলা।
…একবার নামাই?
….হ্যাঁ,প্লিজ..
ওয়াল হ্যাঙ্গিংটা নামিয়ে বসার ঘরে ডিভানের উপর ওটা নিয়ে বসেছি। তিস্তা চা বানিয়ে আনল।
“নিন, একটু গলা ভেজান।”
…আমি নাহয় লাঞ্চ করেই বেরিয়েছি,আপনি খাবেন না?
…আমি তো লাঞ্চ করি না! সকালে প্রোটিন শেক খাই,আবার সেই রাত আটটায় ডিনার।
এতক্ষণে পরিষ্কার হলো তিস্তার নির্মেদ চেহারার রহস্য।
ওয়াল হ্যাঙ্গিং এ মনে হয় সারা সংসার ভরা আছে। কবেকার ইলেক্ট্রিসিটি বিল,কবেকার বাজারের ফর্দ সব কুণ্ডলী পাকিয়ে রাখা।
তিস্তা বলল,”আপনি সার্চ করুন,আমি ঘরে আছি,দরকার মনে করলেই হাঁক দেবেন।
ওয়াল হ্যাঙ্গিং ঘাঁটতে ঘাঁটতে থমকে গেলাম। হাতে লেখা কয়েকটা বাজারের ফর্দর মধ্যে মধ্যে লিখে রাখা কয়েকটা করে লাইন, ফর্দর হস্তাক্ষর আর এই হস্তাক্ষর আলাদা মনে হলো! হাতের লেখাটাও যেন..
হ্যাঁ,কালকের ওই চিরকুটের মতো না!
পকেটের মধ্যেই রয়েছে,বের করে দেখতেই ক্লিয়ার কাট বোঝা যাচ্ছে। একই লেখা।
আর এখানেও ছড়া।
তুমিও যেমন মিষ্টি
তেমনটা এই পিস টি।
কিন্তু তুমি এও কি জানো
ওর যে সজাগ দৃষ্টি!
মনের মধ্যে তখন একটাই কথা…
এগুলো ছড়া নয়,সূত্র।
কিন্তু হাতের লেখাটা কার?
ঘাঁটতে থাকলাম অন্যান্য চিঠিপত্র। না, সেরকম কিছু পাচ্ছি না।
ধরে নিলাম লেখাটা তিস্তার বাবার। তিনিই এখানে ওখানে সূত্র লিখে রেখেছেন। পরে হয়ত মেয়েকে দিয়ে যেতেন,সময়টা আর পেলেন না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো,এই সূত্রগুলো কিসের ইন্ডিকেশন? কী বলার জন্য এই ইঙ্গিতগুলো এসেছে?
কবিতা লেখা পাতাটা টুক করে ছিঁড়ে নিয়ে পকেটে ভরে ফেললাম।
এবার বেরোতে হবে। তিস্তার দেওয়া সময়সীমা প্রায় শেষ। আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।
তিস্তাও ঘর থেকে বেরোল।
“ওই যে বলছিলেন না,একটা পাতলা নোটপ্যাড মতো ছিল,আমার ডেস্কটপের নিচের ড্রয়ারে। বাপির হাতের লেখা বলেই মনে হচ্ছে।”
নোটপ্যাডটা নিয়ে বললাম,
…এটা আমার কাছে রাখছি।আবার কাল আসছি তাহলে। কাল কিন্তু একবার আপনার মানির ঘরটা দেখতে চাই। খুব সাবধানেই খুঁজব। উনি টের পাবেন না।
…সে তো বুঝলাম,কিন্তু মানির ঘরে আপনি কী পাবেন আমার তা মাথায় ঢুকছে না। মানির ঘরে তো বাপি কখনো যেতই না, যে ঘরে ঢুকতই না,সে ঘরে জেম লুকিয়ে রাখবে কীভাবে? জীবনেও ও ঘরে ঢোকেনি বাপি।
….মানে?
একটু চুপ করে থেকে তিস্তা বলল,
….বাপি আর মানির মধ্যে কোনো কনজুগাল রিলেশনশিপ তো ছিলই না।
(বাকি অংশ পরের সংখ্যায় )
ভাল লাগছে। পরের অংশের জন্য প্রতীক্ষায় রইলাম।
ভালো লাগছে। পরের পর্বের প্রতীক্ষায় রইলাম।
বাহ্….দারুণ লাগলো । পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ।
খুব সুন্দর… অপেক্ষায় থাকলাম